গ্যাস কেলেঙ্কারি-কানাডায় দণ্ডিত নাইকো, পেছনের কথা by বদরূল ইমাম

গত ২৩ জুন ২০১১ একটি খবর কানাডা ও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ও আলোচিত হয়। খবরটি হলো, কানাডার তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ আলবার্টা প্রদেশের রাজধানী ক্যালগেরির আদালতে সে দেশের তেল কোম্পানি নাইকো রিসোর্স কর্তৃক ২০০৫ সালে বাংলাদেশের ত ৎ কালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনকে ১ লাখ ৯০ হাজার ডলার মূল্যের বিলাসবহুল গাড়ি ঘুষ দিয়েছে বলে স্বীকারোক্তি এবং আদালত কর্তৃক নাইকোকে দণ্ড প্রদান।


নাইকো আরও স্বীকার করে যে প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনকে কানাডা ও আমেরিকায় ভ্রমণ করার জন্য যাবতীয় খরচও দেওয়া হয়। নাইকো ২০০৫ সালে ছাতক (টেংরাটিলা) গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিপ্রেক্ষিতে যে ক্ষতিপূরণের দাবি ওঠে, তা লাঘব করার লক্ষ্যে এ ঘুষ দেওয়া হয়। আদালত ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রভাব খাটাতে উ ৎ কোচ দেওয়ার অপরাধের শাস্তি হিসেবে নাইকোকে ৯.৫ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করেন।
উন্নত বিশ্বের সেরা ধনবান দেশ কানাডার সাধারণ মানুষ বা সংবাদমাধ্যমগুলোতে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশের কোনো সংবাদ সাধারণভাবে প্রাধান্য না পেলেও এ সংবাদ ছিল ব্যতিক্রম। কানাডার এক সাংবাদিকের ভাষ্যমতে, এর কারণ যে নাইকোর মতো একটি অখ্যাত তেল কোম্পানি বাংলাদেশি মন্ত্রীকে উ ৎ কোচ দিয়ে প্রভাবিত করেছে তা-ই নয়, বরং সে কোম্পানিকে নিয়োগ করার পক্ষে কাজ করে দেশের স্বার্থহানি ঘটানোর অভিযোগে এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও মামলা করে। কানাডা পুলিশ (রয়্যাল ক্যানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ, সংক্ষেপে আরসিএমপি) কর্তৃক দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছরের অনুসন্ধানকাজের ভিত্তিতে ক্যালগেরির আদালতে নাইকো মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এ অনুসন্ধানকাজ করতে কানাডার পুলিশ ক্যালগেরি শহরে নাইকো কোম্পানির সদর দপ্তরেই কেবল কড়া নাড়েনি বরং পুলিশের একটি দল বাংলাদেশে ঢাকায় গিয়ে বহু জনের জবানবন্দি গ্রহণ করে। এসব অনুসন্ধানী কাজের সূত্রে নাইকো কোম্পানির ভেতরের অনেক খবর বের করা ছাড়াও বাংলাদেশের ত ৎ কালীন ক্ষমতাসীন সরকারের ভেতরের অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বের করে আনে।
গত ২৫ আগস্ট ২০১১ ক্যালগেরি থেকে প্রকাশিত দৈনিক দি গ্লোব অ্যান্ড মেইল-এ কানাডার সাংবাদিক গ্রেগ ম্যাক আর্থার বাংলাদেশে নাইকো গ্যাস কেলেঙ্কারির ওপর এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রে দুর্নীতির যে স্বরূপ তুলে ধরেছেন, তা বিশ্বের সেরা দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে দেশটির খেতাব সুদৃঢ় করে। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত নাইকো রিসোর্স কোম্পানির কর্মকাণ্ড কানাডা বা আমেরিকার কোনো স্থানে নেই। ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশে গ্যাসপ্রাপ্তির সংবাদ ও সম্ভাবনা প্রচার হওয়ার পর বহু আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির সঙ্গে নাইকোও বাংলাদেশে গ্যাস ব্লক নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামে। নাইকোর প্রধান রবার্ট ওসলোর (মৃত্যু ২০০৪) ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে সে সময় উপরিউক্ত কারণে বহুবার ভ্রমণকালে প্রতিবারই লক্ষাধিক টাকা করে বিভিন্ন জনের হাতে দেওয়া হয়। কিন্তু বৃহ ৎ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কারিগরিভাবে যোগ্য বিবেচিত হতে না পারায় নাইকো কোনো গ্যাস ব্লক পেতে ব্যর্থ হয়। প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হলেও নাইকো ‘ভিন্নভাবে’ জাতীয় কোম্পানির সঙ্গে একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার করার সমঝোতা চুক্তি সই করতে সক্ষম হয়। কিন্তু সমঝোতা চুক্তি নিয়ে তো মাঠে নামা যায় না।
নাইকো ২০০২ সালে নতুন করে বাংলাদেশে মাঠে নামার উদ্যোগ নেয়। ইতিমধ্যে দেশে ভোটজয়ী বিএনপি নতুন সরকার গঠন করে। নাইকো সুপরিকল্পিতভাবে সরকারের কেন্দ্রমহলে সখ্য গড়ে তোলে। আর এ সখ্য গড়ে তুলতে সরকারের কেন্দ্রে অবস্থান করে বা কেন্দ্রে কার্যকর প্রভাব খাটাতে পারে—এ ধরনের ব্যক্তিদের হাতে মোটা অঙ্কের অর্থ উ ৎ কোচ হিসেবে তুলে দেওয়া হয়। কানাডার যে পুলিশ দলটি বাংলাদেশে নাইকোর ঘুষ মামলাটি তদন্ত করতে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে আসে, তাদের একজন করপোরাল লয়েড সোয়েপ প্রথম জীবনে ব্যাংকার হলেও পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়া তাঁর স্বপ্ন ছিল। অপর একজন করপোরাল কেভিন ডুগান অবৈধ ড্রাগ ব্যবসার বিরুদ্ধে বিপুলভাবে অভিজ্ঞ ব্যক্তি। কানাডার পুলিশ দলটি ঢাকা শহরের লোডশেডিং নিয়ে খুব বিচলিত থাকে এবং নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জবানবন্দি নিতে রাতের সময়টি বেছে নিতে পছন্দ করে যখন লোডশেডিং তুলনামূলকভাবে কম হতো। তাঁরা ভূতপূর্ব জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন, ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ও অন্য ব্যক্তিদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
কানাডার পুলিশের সূত্র ধরে দি গ্লোব অ্যান্ড মেইল পত্রিকার সাংবাদিক ম্যাক আর্থার লিখেছেন, তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোগী গিয়াসউদ্দিন আল মামুন স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যে কানাডার পুলিশকে জানান যে ২০০২ সালে নাইকোর জনৈক অফিসার তাঁকে ১০ লাখ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন, যদি তিনি সরকারি মহলে প্রভাব খাটিয়ে যৌথ উদ্যোগে গ্যাস উত্তোলন কাজটি নাইকোকে এনে দিতে পারেন। একই সঙ্গে তাঁকে ১০ হাজার ডলার দেওয়া হয় এ কাজ করতে উ ৎ সাহ দেওয়ার জন্য। একই সূত্র ধরে সাংবাদিক ম্যাক আর্থার আরও লিখেছেন, কেবল গিয়াসউদ্দিন মামুনকেই নয়, বরং খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে সখ্য আছে অপর একজন ব্যক্তি যিনি সে সময় ঢাকা ক্লাবের সভাপতি ছিলেন, তাঁকেও (পুলিশকে দেওয়া তাঁর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী) নাইকো একই শর্তে ১০ লাখ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ম্যাক আর্থার তাঁর প্রতিবেদনে এরপর আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পরিবেশন করেন। পুলিশকে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যের সূত্র ধরে তিনি লেখেন যে নাইকো বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনে জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তি সই করতে সক্ষম হওয়ার পর এই দ্বিতীয় ব্যক্তিকে পাঁচ লাখ ডলার দেয়, যা তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। এ টাকার একটি অংশ ত ৎ কালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের কাছে যায়, যার মধ্যে তাঁর পুত্র তারেক রহমান অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আর জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মোশাররফকে দেওয়া হয় ১০ লাখ ডলার।
এদিকে কানাডার পুলিশ ভূতপূর্ব জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনো স্বীকারোক্তি পায়নি। সাংবাদিক ম্যাক আর্থার পুলিশের সূত্র ধরে লিখেছেন যে তাঁর বাসভবনে সাক্ষা ৎ কারের সময় মোশাররফ হোসেন একের পর এক সিগারেট ধরিয়ে বলে চলেন যে তিনি কোনো টাকাপয়সা নেননি, নাইকো কিছু দিলে সরাসরি না দিয়ে বরং অপরের মাধ্যমেই দিত। তবে তিনি বলেন, তাঁর কানাডা-আমেরিকা সফরের সময় নাইকো তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে।
ওপরের আলোচনা থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে কানাডার আদালত নাইকো কোম্পানিকে ব্যবসার ক্ষেত্রে ঘুষ দেওয়ার কারণে দোষী সাব্যস্ত করে যে অর্থ জরিমানা করেছেন, তা নাইকো কোম্পানির স্বীকারোক্তি অনুযায়ী করেছেন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ভূতপূর্ব প্রতিমন্ত্রী তাঁকে ঘুষ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু নাইকো যদি তাঁকে ঘুষ দেওয়ার কথা স্বীকার না-ও করত, বাংলাদেশের সবাই ২০০৫ সালের এক সকালে পত্রিকার প্রথম পাতায় নাইকোর দেওয়া অত্যাধুনিক বিলাসবহুল কোটি টাকার গাড়িটি মন্ত্রী মহোদয়ের বাড়িতে থাকা অবস্থায় ছবিটি দেখেছিলেন, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আর সাংবাদিক ম্যাক আর্থার নাইকোর অফিসার কর্তৃক মন্ত্রী মহোদয়ের বাসায় গাড়ির চাবি হস্তান্তরের ঘটনাটির সুন্দর নাটকীয় বর্ণনা দিয়েই তাঁর প্রতিবেদনটি শুরু করেন।
আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের দুর্নীতির ঘটনায় নাইকো গ্যাস কেলেঙ্কারিই সর্বাপেক্ষা চাঞ্চল্যকর। এ ঘটনায় জড়িত আছে দেশের কোটি কোটি টাকার গ্যাসসম্পদহানি, শত শত মানুষের গ্যাস দুর্ঘটনাজনিত দুর্ভোগ, বিস্তীর্ণ এলাকার পরিবেশ দূষণ, একদল দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা ও সহযোগী কর্তৃক দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে উ ৎ কোচ লুট আর বিদেশি লুটেরাদের অস ৎ চাল। কানাডার আদালত নাইকোকে অর্থদণ্ড দেন বাংলাদেশি মন্ত্রীকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে। মন্ত্রীকে এ ঘুষ দেওয়া হয় নাইকো কর্তৃক সংঘটিত গ্যাস দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ দাবিকে কমিয়ে নাইকোর পক্ষে কাজ করার জন্য। কিন্তু তারও আগে যে অস ৎ পথে নাইকো বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলন জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তি করে ঢুকে পড়ে, সে বিষয়ে কানাডার আদালত কোনো দণ্ড দিতে পারেননি। কানাডার আইনজীবীদের মতে, হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত ভেঙে পড়া ব্যবস্থাপনার একটি দেশে সংঘটিত এহেন দুর্নীতি প্রমাণ করার প্রয়োজনীয় সাক্ষী ও আলামত কানাডায় এনে হাজির করা কঠিন কাজ। কাজটি বাংলাদেশকেই করতে হবে।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.