ই-ভোটিং : বিভ্রান্তি দূর করতে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগ প্রয়োজন

এক. ১৯৯০ সালের সামরিক সরকার পতনের বিষয় ছাড়া পরবর্তীকালে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগকে আর কখনো সহমতে আসতে দেখা যায়নি। এই দ্বিমত এতটাই তীব্র যে তা যেকোনো গণতান্ত্রিক বিষয়েও দুই দলকে সহমতে কখনো দেখা যায় না।


বিরোধী দল মানেই যেকোনো বিষয়ে বিরোধিতা নয়, আর সরকারি দল মানেই বিরোধী দলকে দমিয়ে রাখা নয়_এই মূূল্যবোধ আমাদের রাজনীতিতে নেই। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমরা আশা করেছিলাম, দুই দলের প্রধানই উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু বিরোধিতা এতটাই অসৌজন্যতার পর্যায়ে পেঁৗছে ছিল যে এমন অনুষ্ঠানেও তার ছাপ রাখল পরস্পরবিদ্বেষী রাজনীতি। সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মন্তব্য করেছেন, সরকার ই-ভোটিংয়ের নামে ডিজিটাল কারচুপির দিকে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দল বিরোধিতা করবে সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মন্তব্য যদি দেশের জনগণের উপকার না করে অপকার করে, তবে তা দেশকে পিছিয়ে দেয়। একইভাবে সরকার যেকোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিরোধী দলকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াও আমাদের উন্নতিতে বাধার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে ই-ভোটিং ব্যবস্থা এখনো অঁঁাঁতুড়ঘরে। এখনো এই প্রযুক্তি নিয়ে এ দেশের ভোটাররা সম্যক ধারণা রাখেন না। গণমাধ্যমে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো তথ্য চোখে পড়েনি। এ রকম একটি সময়ে বিপুল সম্ভাবনার একটি প্রযুক্তিকে প্রথমেই যদি জনগণের সামনে বিপদ আকারে তুলে ধরা হয়, তবে সেটি দেশের উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের আলোচনায় আমরা স্পষ্ট করতে চাই, সরকার আদতে কতখানি এগিয়েছে ই-ভোটিং বাস্তবায়নের ব্যাপারে। আর বিরোধী দল যা বলছে তা কতটুকু যৌক্তিক।
দুই. সম্প্রতি দৈনিক জনকণ্ঠে ই-ভোটিং নিয়ে আমরা বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখি। 'ই-ভোটিং ব্যবস্থার সফল বাস্তবায়ন কিভাবে সম্ভব', 'ই-ভোটিংয়ের পক্ষে সবার ঐকমত্য জরুরি' এবং 'ই-ভোটিং ব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০৯' শিরোনামে এই লেখাগুলোতে আমরা ই-ভোটিংয়ের নানা দিক তুলে ধরি।
এই প্রবন্ধগুলোতে আমাদের দেশে ই-ভোটিং ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা তুলে ধরাসহ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট কেমন সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি কেমন হতে হবে, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিভাবে বাস্তব রূপ দিতে হবে সেটিও স্পষ্ট করা হয়েছে এই প্রবন্ধগুলোতে। বর্তমান সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের মনে এমন আশঙ্কাপূর্ণ মন্তব্যের পর পূর্বোলি্লখিত কিছু কিছু তথ্য পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন বোধ করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ ডিসেম্বর ২০১০ সালে টোকিওস্থ হোটেল নিউ ওটানিতে অনুষ্ঠিত জাপান-বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি লীগের এক ভোজসভায় বলেন, তাঁর সরকার নির্বাচনে কারচুপি রোধ করার লক্ষ্যে ভবিষ্যতে দেশের সামগ্রিক ভোটব্যবস্থাকে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করতে আগ্রহী। তিনি বলেন, 'সম্প্রতি আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আলাপ করেছি। আমি তাঁকে দেশের পুরো নির্বাচনীব্যবস্থাকে ইলেকট্রনিক করার কথা বলেছি।' তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে পরিপূর্ণ ই-ভোটিং ব্যবস্থা প্রবর্তনে তাঁর সরকার যত অর্থ প্রয়োজন তা দিতে প্রস্তুত। এর আগে প্রধানমন্ত্রী তাঁর অফিসে ১৩ এপ্রিল ২০১০ সালে ইউএন-এর আবাসিক সমন্বয়কারী ও ইউএনডিপির বাংলাদেশস্থ আবাসিক প্রতিনিধি মিস রেনাটা লক ডেসালিয়ানের সঙ্গে এক বিদায়ী সাক্ষাৎকারে নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য ইলেকট্র্রনিক ভোটিং পদ্ধতি প্রবর্তনের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। সরকারের আগ্রহ প্রশংসাযোগ্য; কিন্তু কাজ এবং ই-ভোটিং বাস্তবায়ন নীতিমালায় প্রয়োজনের তুলনায় ঘাটতি রয়েছে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, রূপকল্প ২০২১ সামনে রেখে প্রণীত তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালায় ই-ভোটিং বিষয়টি অনালোচিত।
তিন. বিরোধী দল দাবি করল, সরকার ই-ভোটিংয়ের নামে ডিজিটাল কারচুপির দিকে যাচ্ছে। দেশে ইতিমধ্যে ই-ভোটিং ব্যবস্থার সূত্রপাত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ১৭ জুন ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সীমিত পরিসরে ই-ভোটিং কার্যকর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেখানকার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের ১৪টি পোলিং স্টেশনে ই-ভোটিং পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এতে এলাকার ২৫ হাজার ২৩০ জন ভোটার, যাঁদের মধ্যে ১২ হাজার ৮৭৯ জন পুরুষ ও ১২ হাজার ৩৫১ জন মহিলা ৭৯টি বুথে ইভিএময়ের সাহায্যে মেয়র ও দুটি ওয়ার্ড কমিশনার পদে ভোটদানের সুযোগ পেয়েছিলেন। সেখানে একজন ভোটারও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেননি ই-ভোটিং নিয়ে। বরং সবাই প্রশংসার চোখে দেখেছেন এই আধুনিক প্রযুক্তিকে। চট্টগ্রামের দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ ১৮ জুুন ২০১০ শিরোনাম করে 'দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ই-ভোট দিয়ে খুশি ভোটাররা।' দৈনিক জনকণ্ঠ ১৮ জুন ২০১০ সালে প্রকাশিত সংখ্যার শিরোনাম ছিল 'ই-ভোটিং যুগে বাংলাদেশ'। প্রতিবেদনে বলা হয়, লোকপ্রশাসন কেন্দ্রে স্থাপিত পুরুষ ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার প্রফেসর ড. নুরুল আলম জানান, ই-ভোটিংয়ের জন্য কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। কারণ একজন নিরক্ষর ভোটারও প্রতীক চেনেন। প্রতীক দেখে বাটন চাপলেই হলো। দৈনিক কালের কণ্ঠ ১৮ জুন ২০১০ সালে প্রকাশিত সংখ্যার শিরোনাম ছিল 'ই-ভোটিং পদ্ধতিতে দুই ঘণ্টায় ফলাফল'। সেখানে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অন্য ওয়ার্ডের মতোই ২১ নম্বর জামাল খান ওয়ার্ডের ভোট গ্রহণ শেষ হয় বিকেল ৪টায়। এর মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে সন্ধ্যা ৬টায় ফলাফল পেয়ে যান ভোটাররা। অথচ অন্য ওয়ার্ডে তখনো ভোট গণনা চলছে। আর অন্যান্য ওয়ার্ডে কিছু না কিছু ভোট বাতিলের খবর পাওয়া গেলেও জামাল খান ওয়ার্ডে কোনো ভোট বাতিল হয়নি।
চার. বাংলাদেশের বেশির ভাগ ভোটারই আধুনিক প্রযুক্তি তো দূরের কথা, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সুবিধার মধ্যে বসবাস করেন না। যে কারণে 'প্রযুক্তির অপর নাম নির্ভরতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা'_এই ধারণা তেমন জোরালোভাবে গড়ে ওঠেনি। ইভিএম যন্ত্র সম্পর্কে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়ে কোনো রাজনৈতিক দল যদি সুবিধা নিতে চায়, তবে সেটি বৃহৎ অর্থে পুরো দেশকে পিছিয়ে রেখে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর সুবিধা লাভের অপচেষ্টা বলে গণ্য হবে। একইভাবে সরকারের উচিত, এ রকম উন্নয়নমূলক কাজে বিরোধী দলকে সম্পৃক্ত করা, যাতে তাদের আস্থার জায়গাটি তৈরি হয়। ইভিএম প্রযুক্তি পুরো ভোটিং ব্যবস্থার আদল পাল্টে দিতে পারে, এমন একটি সুযোগ যেন দলীয় কোন্দলে নষ্ট না হয়, সে বিষয়ে সরকার দলমত-নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারে। ৬ ফেরুয়ারি ২০১১ দৈনিক জনকণ্ঠে 'ই-ভোটিংয়ের পক্ষে সবার ঐকমত্য জরুরি' শিরোনামে প্রকাশিত আমাদের প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশের ৮৫ শতাংশ ই-ভোটিং প্রকল্প কোনো না কোনোভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। যার পেছনের কারণ রাজনৈতিক দলীয় কোন্দল এবং যন্ত্রে মানুষের আস্থার অভাব। কিন্তু এরই মধ্য দিয়ে ভারতের মতো বহু মতের রাষ্ট্র ই-ভোটিং ব্যবস্থায় সফলতা লাভ করে সারা বিশ্বের জন্য মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানকার বহু ভোটার বাংলাদেশের মতো নিরক্ষর এবং আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন না। ভারতের এই সফলতার পেছনের শক্তি তুলনামূলক সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আমাদের রাজনীতিতে সহমতের অভাব যেকোনো উন্নতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সেটি নতুন করে বলার কিছু নেই।
পাঁচ. এখানে নির্বাচন কমিশনের একটি বড় ভূমিকা আছে। ই-ভোটিংয়ের বিষয়ে একটি আধুনিক নীতিমালা তৈরি করে কাজ বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং ভোটারদের মনে আস্থার জায়গা তৈরি করাই এখন নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ। মাঝেমধ্যে সরকার ই-ভোটিং নিয়ে আশার কথা শোনাবে আর বিরোধী দল বিরোধিতা করে যাবে, আদৌ কাজের কাজ কতটুকু হচ্ছে তা না জানালে বিষয়টি ধোঁয়াশায় থেকে যাবে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন-পরবর্তী বেশ কয়েকটি নির্বাচনে ই-ভোটিং সিস্টেমে ভোট গ্রহণের কথা থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত হয়নি এবং সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এই প্রযুক্তিনির্ভর ভোটিং ব্যবস্থাটির এখন পর্যন্ত তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। সুতরাং এমন মহতী একটি সম্ভাবনা যেন রাজনৈতিক রেষারেষি আর শুধু প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে, সেটি নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। সর্বোপরি ভোটে জিতলে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে, আর না জিতলে কারচুপি_এমন মানসিকতা থেকে দেশের প্রধান দুই দলকেই বেরিয়ে আসতে হবে। ই-ভোটিং ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার আগেই সে সুযোগ যাতে কেউ তৈরি করে রাখতে না পারে, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
লেখকবৃন্দ : যথাক্রমে ডিরেক্টর-ইনচার্জ, জাপান স্টাডি সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সহযোগী অধ্যাপক, বিসিএস শিক্ষা এবং এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.