গন্তব্য ঢাকা-পরিবারের হাসিই তাঁর সবকিছু
ছোট ভাই পাপনকে নিয়ে হাঁটছিলাম গুলশান-১-এর ৪০ নম্বর রোড ধরে। সূক্ষ্ম কারুকার্যময় কাঁথাস্ট্রিচের চাদর দেখে দুজনেই থমকে দাঁড়ালাম। পাশে গিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছি। মনের মধ্যে হাজারো জিজ্ঞাসা। কার তৈরি এগুলো? এগুলো কি বিক্রেতার মা বা স্ত্রীর হাতের যতনে বোনা কারুকাজ? যেটায় লুকিয়ে আছে অনেক ভালোবাসা আর কিছু স্বপ্ন।
সারা দিন সংসারের হাড়ভাঙা খাটুনির পর বিকেলের অবসরে এ কাঁথাটা বুনতে বুনতে লোকটির প্রিয় মানুষগুলো কি স্বপ্ন বোনেন যে এটা বিক্রি করে লোকটি তাঁদের জন্য কিছু জিনিস নিয়ে যাবেন? জানার আগ্রহ নিয়ে যখন পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন লোকটি আরেকজন ক্রেতাকে তাঁর দ্রব্যাদির সৌন্দর্য বিশ্লেষণে ব্যস্ত। আমরা ব্যস্ত হয়ে উঠি তাঁর গল্প শোনার জন্য। ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি আমাদের একটু একটু করে শোনান তাঁর ছোটবেলার গল্প, পরিবারের গল্প, বন্ধুদের গল্প। অভিজাত এলাকায় অভিজাত জিনিস না নিয়ে এলে কারও নজরে পড়বে না। দেখতেও আকর্ষণীয় হতে হবে। এ বিক্রেতা রাস্তার ধারে বসেন নজরকাড়া কিছু জিনিস নিয়ে। লোকটির নাম জাহাঙ্গীর সরদার। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বা গাড়িতে চড়ে যাওয়ার সময় অনেকেরই পছন্দ হয়ে যায় কাঁথাস্ট্রিচের চাদর অথবা কাঁথা। তখন কিছু টাকার বিনিময়ে নিজেদের ঘরের সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্য নিয়ে যান পছন্দমতো একটি।
মাদারীপুরের ছোট্ট এক গ্রামের সঙ্গে তাঁর নাড়ির সম্পর্ক। শিবচর থানার বামনীতলা গ্রামের আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে আছে তাঁর ঘামের গন্ধ। সেসব ভালোবাসার জায়গা ছেড়ে তিন বছর আগে ঢাকার বুকে পাড়ি জমিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর সরদার। শুধু একটু অর্থনৈতিক সচ্ছলতার আশায়। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে থাকতে মন টানে না তাঁর। তাই এক-দেড় মাস পরেই বাড়ির পথে ছোটেন। আর বাড়ি পৌঁছেই ছুটে যান পরিচিত সেই নদীর ধারে, বিস্তীর্ণ মাঠে অথবা খোলা আকাশের নিচে। মুখে হাসি সব সময় লেগেই থাকে লোকটির। সেই হাসিমাখা মুখেই বলতে থাকেন নিজের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। ‘আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই বয়ে গেছে আড়িয়াল খাঁ। সেখানে যে ব্রিজটা আছে, বিকেল হলে ওখানে আমাদের যাওয়া লাগবেই। ওখানে আমরা বন্ধুরা মিলে রাত পর্যন্ত আড্ডা দিই। বাড়িতে এ সময়টা সবচেয়ে ভালো লাগে। আবার যদি বাড়িতে কোনো কাজ থাকে, তাহলে সব আড্ডা বাদ দিয়ে চলে আসি বাড়িতে।’
‘ছোটবেলা থেকেই আমি শয়তানি করি বেশি। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখন আমার বাবা মারা গেল। তাই পড়াশোনা আর হয়নি। তখন আমি নদীতে ট্রলার চালিয়ে টাকা আয় করতাম। সংসার তো চালাতে হবে। কিন্তু তার পরও অনেক মজা করছি গ্রামে। এই যেমন আমরা বন্ধুরা মিলে হঠা ৎ বের হয়ে যেতাম নৌকা নিয়ে। আমাদের ওদিকে ছোট নৌকাগুলোকে বলে ডিঙি নৌকা বা কোষা। একবার এমন ঘুরতে বের হয়েছি। তিন-চারজনের নৌকায় আমরা উঠেছি ছয়-সাতজন। নৌকা গেছে উল্টে। আমরা গ্রামের ছেলে। সাঁতার আমাদের কাছে ডাল-ভাত। টানা দুই ঘণ্টা সাঁতরাতে পারি আমি। সাঁতার জানি বলেই সে দিন বেঁচে গেছি।’
ছোটবেলার গ্রামের স্মৃতি বেশ উচ্ছ্বসিত করে তোলে তাঁকে। ‘ছোটবেলায় কোনো দিন দুপুরে ঘুমাতাম না। মা জোর করে এনে বিছানায় শোয়াত আর আমি চুপ করে উঠে চলে যেতাম খেলতে। কিন্তু পড়তাম মন দিয়ে। বাবা মারা যাওয়ার পরে তো পড়াশোনা বন্ধ হলো। কাঁধে দায়িত্ব এল। এখন মনে হয় পড়াশোনাটা করতে পারলে আমিও হয়তো প্যান্ট-শার্ট পরে সকালে ছুটতাম অফিসে।’ তিনি নিজে পড়তে পারেননি তাই স্বপ্ন দেখেন একমাত্র ছেলে সোহাগ পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হবে।
জাহাঙ্গীর সরদারের বাড়িতে যতটুকু জমি আছে, তাতে চাষ করলেও ঠিকমতো বছর চলে না। তাই বাধ্য হয়ে ঢাকায় কাজ করতে হয়। দামি চাদরটা কখনো নিজের বাড়িতে ব্যবহার করা হয় না বটে, কিন্তু এ চাদরই তো ভাত জোটায় পুরো পরিবারের। অবশেষে জানতে পারলাম যে এ কাঁথাগুলো তাঁর মা বা স্ত্রীর হাতের নয়, এগুলো তিনি আনেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুর ও যশোর থেকে। তবুও এগুলোর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অনেক স্বপ্ন। সকাল ১০টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এ কাঁথাগুলো বিক্রি করেন তিনি। এগুলো বিক্রি করে যা টাকা আয় হয়, তা দিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় মা, স্ত্রী বা একমাত্র ছেলের জন্য কিছু নিয়ে যান। ওদের মুখের হাসিই তো জাহাঙ্গীর সরদারের সবকিছু।
শর্মিলা সিনড্রেলা
মাদারীপুরের ছোট্ট এক গ্রামের সঙ্গে তাঁর নাড়ির সম্পর্ক। শিবচর থানার বামনীতলা গ্রামের আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে আছে তাঁর ঘামের গন্ধ। সেসব ভালোবাসার জায়গা ছেড়ে তিন বছর আগে ঢাকার বুকে পাড়ি জমিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর সরদার। শুধু একটু অর্থনৈতিক সচ্ছলতার আশায়। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে থাকতে মন টানে না তাঁর। তাই এক-দেড় মাস পরেই বাড়ির পথে ছোটেন। আর বাড়ি পৌঁছেই ছুটে যান পরিচিত সেই নদীর ধারে, বিস্তীর্ণ মাঠে অথবা খোলা আকাশের নিচে। মুখে হাসি সব সময় লেগেই থাকে লোকটির। সেই হাসিমাখা মুখেই বলতে থাকেন নিজের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। ‘আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই বয়ে গেছে আড়িয়াল খাঁ। সেখানে যে ব্রিজটা আছে, বিকেল হলে ওখানে আমাদের যাওয়া লাগবেই। ওখানে আমরা বন্ধুরা মিলে রাত পর্যন্ত আড্ডা দিই। বাড়িতে এ সময়টা সবচেয়ে ভালো লাগে। আবার যদি বাড়িতে কোনো কাজ থাকে, তাহলে সব আড্ডা বাদ দিয়ে চলে আসি বাড়িতে।’
‘ছোটবেলা থেকেই আমি শয়তানি করি বেশি। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখন আমার বাবা মারা গেল। তাই পড়াশোনা আর হয়নি। তখন আমি নদীতে ট্রলার চালিয়ে টাকা আয় করতাম। সংসার তো চালাতে হবে। কিন্তু তার পরও অনেক মজা করছি গ্রামে। এই যেমন আমরা বন্ধুরা মিলে হঠা ৎ বের হয়ে যেতাম নৌকা নিয়ে। আমাদের ওদিকে ছোট নৌকাগুলোকে বলে ডিঙি নৌকা বা কোষা। একবার এমন ঘুরতে বের হয়েছি। তিন-চারজনের নৌকায় আমরা উঠেছি ছয়-সাতজন। নৌকা গেছে উল্টে। আমরা গ্রামের ছেলে। সাঁতার আমাদের কাছে ডাল-ভাত। টানা দুই ঘণ্টা সাঁতরাতে পারি আমি। সাঁতার জানি বলেই সে দিন বেঁচে গেছি।’
ছোটবেলার গ্রামের স্মৃতি বেশ উচ্ছ্বসিত করে তোলে তাঁকে। ‘ছোটবেলায় কোনো দিন দুপুরে ঘুমাতাম না। মা জোর করে এনে বিছানায় শোয়াত আর আমি চুপ করে উঠে চলে যেতাম খেলতে। কিন্তু পড়তাম মন দিয়ে। বাবা মারা যাওয়ার পরে তো পড়াশোনা বন্ধ হলো। কাঁধে দায়িত্ব এল। এখন মনে হয় পড়াশোনাটা করতে পারলে আমিও হয়তো প্যান্ট-শার্ট পরে সকালে ছুটতাম অফিসে।’ তিনি নিজে পড়তে পারেননি তাই স্বপ্ন দেখেন একমাত্র ছেলে সোহাগ পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হবে।
জাহাঙ্গীর সরদারের বাড়িতে যতটুকু জমি আছে, তাতে চাষ করলেও ঠিকমতো বছর চলে না। তাই বাধ্য হয়ে ঢাকায় কাজ করতে হয়। দামি চাদরটা কখনো নিজের বাড়িতে ব্যবহার করা হয় না বটে, কিন্তু এ চাদরই তো ভাত জোটায় পুরো পরিবারের। অবশেষে জানতে পারলাম যে এ কাঁথাগুলো তাঁর মা বা স্ত্রীর হাতের নয়, এগুলো তিনি আনেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুর ও যশোর থেকে। তবুও এগুলোর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অনেক স্বপ্ন। সকাল ১০টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এ কাঁথাগুলো বিক্রি করেন তিনি। এগুলো বিক্রি করে যা টাকা আয় হয়, তা দিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় মা, স্ত্রী বা একমাত্র ছেলের জন্য কিছু নিয়ে যান। ওদের মুখের হাসিই তো জাহাঙ্গীর সরদারের সবকিছু।
শর্মিলা সিনড্রেলা
No comments