নিত্যজাতম্-ঘর ভাগ করলে সে ঘর থাকে না by মহসীন হাবিব
১৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমের মধ্যকার চেকপোস্টের কাছে একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ ফিলিস্তিনি শিশু ঘটনাস্থলেই মারা গেল। শিশু এবং স্কুল শিক্ষকসহ আরো কমপক্ষে ৩০ জন এখন গুরুতর আহত হয়ে ইসরায়েলের বিভিন্ন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
বৃষ্টিভেজা রাস্তায় একটি ইসরায়েলি ভারী লরির সঙ্গে সংঘর্ষে এ হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে। যে শিশুরা মারা গেছে, তাদের বয়স ছিল চার থেকে আট বছরের মধ্যে। এ ঘটনায় গোটা ফিলিস্তিন শোকাহত হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শোক জানিয়েছেন। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছেন।
এ কাহিনী লেখার বিশেষ একটি উদ্দেশ্য আছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বৈরিতার চেয়ে বড় কোনো বৈরিতা এ দুনিয়ায় নেই। দুপক্ষের কাছেই এ সংঘাত হলো অস্তিত্বের সংঘাত, বাঁচা-মরার সংঘাত। লক্ষ করা গেল, তার পরও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস সত্যকে মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে ঘৃণা ছড়াতে চেষ্টা করেননি। এত বড় একটি হৃদয়বিদারক মর্মস্পর্শী দুর্ঘটনা থেকে কোনো রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চেষ্টা করেননি তিনি। একটি বারও ইঙ্গিত দিতে চেষ্টা করেননি যে এই দুর্ঘটনার পেছনে ইসরায়েলের হাত আছে। এ চেষ্টা না করার পেছনে হয়তো দুটো বিষয় কাজ করেছে। একটি হলো জাতি হিসেবে ফিলিস্তিনিরা মনে করেছে, এই শিশুদের নিয়ে রাজনীতি করা, শিশুদের লাশকে রাজনীতিতে প্রবেশ করানো হবে চরম অনৈতিক কাজ। আবার অন্যদিকে হয়তো পাকা রাজনীতিবিদ হিসেবেও মাহমুদ আব্বাস এবং ফিলিস্তিনি নেতারা জানেন, কোন ঘটনায় কী বলতে হয়। একটি নিরেট দুর্ঘটনাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে চালাতে গেলে কতটা তা বিশ্ববাসী গ্রহণ করবে, সেটা সম্পর্কে নিশ্চয়ই তাঁরা অজ্ঞ নন।
তারা তো ভিন্ন দুটি বৈরী ভাবাপন্ন দেশ। কিন্তু আমাদের গৃহ অভ্যন্তরে এই নৈতিকতা ও কমনসেন্সের অভাব আমরা বহুকাল ধরে উপলব্ধি করছি না কেন? যখনই যেখানে কোনো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটছে, তা হোক প্রাকৃতিক কিংবা দর্ঘটনাজনিত_তখনই দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল একে অপরকে জনগণের সম্মুখে দোষী বলে প্রমাণ করতে চেষ্টা করছে। ফলে জাতীয় অভিন্ন স্বার্থ বা কমন কোনো জাতীয় বিষয় বলে কিছু থাকছে না। এদিক দিয়ে বাংলাদেশ সত্যিই এক দুর্ভাগ্যজনক অভিশপ্ত সংস্কৃতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছে। এ থেকে যেন অচিরে কোনো মুক্তি নেই। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে কেউ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেও দুদল ইশারায়-ইঙ্গিতে বলতে চেষ্টা করে যে এ মৃত্যুর পেছনে ষড়যন্ত্র আছে। মাত্র তিন দিন আগে এক সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পুঁজিবাজার নিয়ে বলেছেন, 'দেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলাদেশ যাতে ঘুরে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্যই পুঁজিবাজারে লুটপাট করা হয়েছে। তিনি স্পষ্টতই দেশের বিরুদ্ধে এ ষড়যন্ত্র ক্ষমতাসীন দল করছে বলে ইঙ্গিত করেছেন। এই পুঁজিবাজারে দেড় বছর আগে যখন দরপতন শুরু হয় এবং মানুষ মাথায় হাত রেখে রাস্তায় নেমে আসে, তখন দুপক্ষ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি শুরু করে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ। মনে আছে, আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা বলতে চেষ্টা করেছেন, বিএনপির হাতে ছিল লুটপাট করা টাকা, সেই টাকা দিয়ে পুঁজিবাজারে কারসাজি করে তারা পুঁজি বের করে নিয়ে গেছেন। আর বিএনপিকে বলতে শোনা গেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই জনগণকে পুঁজি বাজারে ডেকে নিয়ে তারপর টাকা লুট করে নিয়ে যায়। ১৯৯৬ সালেও ক্ষমতায় এসে তারা তাই করেছিল। দুই পক্ষের কারো কাছ থেকে একটিবারের মতো উচ্চারিত হয়নি, আসুন আমরা একসঙ্গে বসে পুঁজিবাজারের এ সর্বনাশ কেন হলো, তা খতিয়ে দেখি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা ছিল বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) বিদ্রোহের ঘটনা। সেটি ছিল আমাদের জাতির এক চরম সংকটকাল। সেই বিদ্রোহে মহামূল্যবান সেনা কর্মকর্তাদের মৃত্যুর দায় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি পরস্পরের ঘাড়ে চাপাতে চেষ্টা করেছিল। এভাবেই দেশের সরল-সহজ করে বোঝা জনগণ দুই পক্ষের বক্তব্যে বিভ্রান্ত হয়ে আসছে। এ দুটি দল টাকার ওপর ছাপ, নাম পরিবর্তন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র নির্ধারণেও দুভাগ হয়ে আছে। দুভাগে বিভক্ত হয়ে আছেন সংগীত শিল্পীরা, সাংস্কৃতিক কর্মীরা। এমনকি ভাগ হয়ে গেছে দেশাত্মবোধক গান! দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে শুরু করে আয়করদাতা পর্যন্ত সব কিছুকে এই দুটি বড় দল জাতীয় এজেন্ডা হিসেবে না নিয়ে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে আসছে। আবারও বলছি, বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয়ে নয়, দেশের প্রতিটি স্বার্থ নিয়ে এরা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বিভক্ত। এর কোনো ব্যত্যয় নেই।
এই বিদ্বেষ দুটি দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু সমস্যা হলো, এ বিদ্বেষ একদিকে যেমন জাতির অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে, তেমনি প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড হয়ে পড়ছে দুর্বলতর। আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি, 'ব্লেম গেম' বা পরস্পর পরস্পরের ওপর দোষারোপ করতে চেষ্টা করার ফলে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা পড়ে গেছে। তার চেয়েও বড় সমস্যা হলো এই প্রবণতার কারণে দেশের মানুষের মধ্যে ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতার চর্চা গড়ে উঠছে না, সত্যিকার গণতান্ত্রিক চেতনা সৃষ্টি হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। এ বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের জাতীয় জীবনে। এই দুটি বড় দল রীতিমতো দুটি পরস্পরবিরোধী সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। একবার বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, এ দুটো দলের মধ্যে কোনো বিষয়ে মিল নেই, শুধু একটি বিষয় ছাড়া। সেটি হলো রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কতটা খর্ব করা যায়। আর আমরা মনে করি, এ দুটো দলের মধ্যে কোনো বিষয়েই মিল নেই, শুধু একটি বিষয় ছাড়া। তা হলো জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা কতটা উপেক্ষা করা যায়।
রাজনীতিতে ব্লেম-গেম থাকবে, প্রপাগান্ডা থাকবে। প্রায় সব দেশেই আছে। যতদিন মানুষের ভোট নিয়ে শাসন ক্ষমতায় যাওয়ার প্রক্রিয়া থাকবে, তত দিন হয়তো এ ধরনের জনগণকে সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশিয়ে ভুল বোঝানোর চেষ্টা চলবে। কিন্তু সমস্যা মাত্রাজ্ঞান নিয়ে। জাতীয় স্বার্থ নিয়ে ভাগ হতে নেই। পৃথিবীর কোনো জাতিতে তা হয় না। অসংখ্য উদাহরণ আছে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ভারত, জার্মানিসহ অসংখ্য দেশে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন, তেল-গ্যাস রক্ষা, সীমান্তে গুলি না খাওয়াএসব আমাদের জাতীয় ইস্যু। আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন A house divided against itself cannot stand.
সব ব্যাপারে এভাবে ভাগ হয়ে থাকা মানেই ঘর ভাগ করে ফেলা। যে ঘর গড়ে তুলেছে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের লুঙ্গিপরা মুক্তিযোদ্ধা, যে ঘর গড়ে তুলেছে রোদে পোড়া কৃষক, যে ঘর এখন গড়ে তুলছে আমাদের পর্যাপ্ত পুষ্টি না পাওয়া লাখ লাখ গার্মেন্টের বোনেরা, যে ঘর গড়ে তুলছে বন্ধু-আত্মীয়হীন একা বিদেশে পড়ে থেকে দশ ঘণ্টা পরিশ্রম করা কারিগর_সে ঘরকে অব্যাহতভাবে বিভক্ত করার অপপ্রয়াস বড় দুটি দলের শীর্ষ নেতাদের পরিত্যাগ করতে হবে। নচেৎ এ দেশের দেশপ্রেমী জনগণ আপনাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে!
লেখক : সাংবাদিক
mohshin.habib@yahoo.com
এ কাহিনী লেখার বিশেষ একটি উদ্দেশ্য আছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বৈরিতার চেয়ে বড় কোনো বৈরিতা এ দুনিয়ায় নেই। দুপক্ষের কাছেই এ সংঘাত হলো অস্তিত্বের সংঘাত, বাঁচা-মরার সংঘাত। লক্ষ করা গেল, তার পরও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস সত্যকে মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে ঘৃণা ছড়াতে চেষ্টা করেননি। এত বড় একটি হৃদয়বিদারক মর্মস্পর্শী দুর্ঘটনা থেকে কোনো রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চেষ্টা করেননি তিনি। একটি বারও ইঙ্গিত দিতে চেষ্টা করেননি যে এই দুর্ঘটনার পেছনে ইসরায়েলের হাত আছে। এ চেষ্টা না করার পেছনে হয়তো দুটো বিষয় কাজ করেছে। একটি হলো জাতি হিসেবে ফিলিস্তিনিরা মনে করেছে, এই শিশুদের নিয়ে রাজনীতি করা, শিশুদের লাশকে রাজনীতিতে প্রবেশ করানো হবে চরম অনৈতিক কাজ। আবার অন্যদিকে হয়তো পাকা রাজনীতিবিদ হিসেবেও মাহমুদ আব্বাস এবং ফিলিস্তিনি নেতারা জানেন, কোন ঘটনায় কী বলতে হয়। একটি নিরেট দুর্ঘটনাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে চালাতে গেলে কতটা তা বিশ্ববাসী গ্রহণ করবে, সেটা সম্পর্কে নিশ্চয়ই তাঁরা অজ্ঞ নন।
তারা তো ভিন্ন দুটি বৈরী ভাবাপন্ন দেশ। কিন্তু আমাদের গৃহ অভ্যন্তরে এই নৈতিকতা ও কমনসেন্সের অভাব আমরা বহুকাল ধরে উপলব্ধি করছি না কেন? যখনই যেখানে কোনো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটছে, তা হোক প্রাকৃতিক কিংবা দর্ঘটনাজনিত_তখনই দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল একে অপরকে জনগণের সম্মুখে দোষী বলে প্রমাণ করতে চেষ্টা করছে। ফলে জাতীয় অভিন্ন স্বার্থ বা কমন কোনো জাতীয় বিষয় বলে কিছু থাকছে না। এদিক দিয়ে বাংলাদেশ সত্যিই এক দুর্ভাগ্যজনক অভিশপ্ত সংস্কৃতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছে। এ থেকে যেন অচিরে কোনো মুক্তি নেই। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে কেউ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেও দুদল ইশারায়-ইঙ্গিতে বলতে চেষ্টা করে যে এ মৃত্যুর পেছনে ষড়যন্ত্র আছে। মাত্র তিন দিন আগে এক সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পুঁজিবাজার নিয়ে বলেছেন, 'দেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলাদেশ যাতে ঘুরে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্যই পুঁজিবাজারে লুটপাট করা হয়েছে। তিনি স্পষ্টতই দেশের বিরুদ্ধে এ ষড়যন্ত্র ক্ষমতাসীন দল করছে বলে ইঙ্গিত করেছেন। এই পুঁজিবাজারে দেড় বছর আগে যখন দরপতন শুরু হয় এবং মানুষ মাথায় হাত রেখে রাস্তায় নেমে আসে, তখন দুপক্ষ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি শুরু করে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ। মনে আছে, আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা বলতে চেষ্টা করেছেন, বিএনপির হাতে ছিল লুটপাট করা টাকা, সেই টাকা দিয়ে পুঁজিবাজারে কারসাজি করে তারা পুঁজি বের করে নিয়ে গেছেন। আর বিএনপিকে বলতে শোনা গেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই জনগণকে পুঁজি বাজারে ডেকে নিয়ে তারপর টাকা লুট করে নিয়ে যায়। ১৯৯৬ সালেও ক্ষমতায় এসে তারা তাই করেছিল। দুই পক্ষের কারো কাছ থেকে একটিবারের মতো উচ্চারিত হয়নি, আসুন আমরা একসঙ্গে বসে পুঁজিবাজারের এ সর্বনাশ কেন হলো, তা খতিয়ে দেখি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা ছিল বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) বিদ্রোহের ঘটনা। সেটি ছিল আমাদের জাতির এক চরম সংকটকাল। সেই বিদ্রোহে মহামূল্যবান সেনা কর্মকর্তাদের মৃত্যুর দায় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি পরস্পরের ঘাড়ে চাপাতে চেষ্টা করেছিল। এভাবেই দেশের সরল-সহজ করে বোঝা জনগণ দুই পক্ষের বক্তব্যে বিভ্রান্ত হয়ে আসছে। এ দুটি দল টাকার ওপর ছাপ, নাম পরিবর্তন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র নির্ধারণেও দুভাগ হয়ে আছে। দুভাগে বিভক্ত হয়ে আছেন সংগীত শিল্পীরা, সাংস্কৃতিক কর্মীরা। এমনকি ভাগ হয়ে গেছে দেশাত্মবোধক গান! দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে শুরু করে আয়করদাতা পর্যন্ত সব কিছুকে এই দুটি বড় দল জাতীয় এজেন্ডা হিসেবে না নিয়ে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে আসছে। আবারও বলছি, বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয়ে নয়, দেশের প্রতিটি স্বার্থ নিয়ে এরা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বিভক্ত। এর কোনো ব্যত্যয় নেই।
এই বিদ্বেষ দুটি দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু সমস্যা হলো, এ বিদ্বেষ একদিকে যেমন জাতির অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে, তেমনি প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড হয়ে পড়ছে দুর্বলতর। আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি, 'ব্লেম গেম' বা পরস্পর পরস্পরের ওপর দোষারোপ করতে চেষ্টা করার ফলে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা পড়ে গেছে। তার চেয়েও বড় সমস্যা হলো এই প্রবণতার কারণে দেশের মানুষের মধ্যে ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতার চর্চা গড়ে উঠছে না, সত্যিকার গণতান্ত্রিক চেতনা সৃষ্টি হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। এ বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের জাতীয় জীবনে। এই দুটি বড় দল রীতিমতো দুটি পরস্পরবিরোধী সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। একবার বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, এ দুটো দলের মধ্যে কোনো বিষয়ে মিল নেই, শুধু একটি বিষয় ছাড়া। সেটি হলো রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কতটা খর্ব করা যায়। আর আমরা মনে করি, এ দুটো দলের মধ্যে কোনো বিষয়েই মিল নেই, শুধু একটি বিষয় ছাড়া। তা হলো জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা কতটা উপেক্ষা করা যায়।
রাজনীতিতে ব্লেম-গেম থাকবে, প্রপাগান্ডা থাকবে। প্রায় সব দেশেই আছে। যতদিন মানুষের ভোট নিয়ে শাসন ক্ষমতায় যাওয়ার প্রক্রিয়া থাকবে, তত দিন হয়তো এ ধরনের জনগণকে সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশিয়ে ভুল বোঝানোর চেষ্টা চলবে। কিন্তু সমস্যা মাত্রাজ্ঞান নিয়ে। জাতীয় স্বার্থ নিয়ে ভাগ হতে নেই। পৃথিবীর কোনো জাতিতে তা হয় না। অসংখ্য উদাহরণ আছে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ভারত, জার্মানিসহ অসংখ্য দেশে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন, তেল-গ্যাস রক্ষা, সীমান্তে গুলি না খাওয়াএসব আমাদের জাতীয় ইস্যু। আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন A house divided against itself cannot stand.
সব ব্যাপারে এভাবে ভাগ হয়ে থাকা মানেই ঘর ভাগ করে ফেলা। যে ঘর গড়ে তুলেছে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের লুঙ্গিপরা মুক্তিযোদ্ধা, যে ঘর গড়ে তুলেছে রোদে পোড়া কৃষক, যে ঘর এখন গড়ে তুলছে আমাদের পর্যাপ্ত পুষ্টি না পাওয়া লাখ লাখ গার্মেন্টের বোনেরা, যে ঘর গড়ে তুলছে বন্ধু-আত্মীয়হীন একা বিদেশে পড়ে থেকে দশ ঘণ্টা পরিশ্রম করা কারিগর_সে ঘরকে অব্যাহতভাবে বিভক্ত করার অপপ্রয়াস বড় দুটি দলের শীর্ষ নেতাদের পরিত্যাগ করতে হবে। নচেৎ এ দেশের দেশপ্রেমী জনগণ আপনাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে!
লেখক : সাংবাদিক
mohshin.habib@yahoo.com
No comments