শেকড়ের ডাক-বড় বাজেট কি পারবে শিক্ষার ঐতিহ্য ফেরাতে? by ফরহাদ মাহমুদ
অনেক কারণে আমি নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, আমি এমন কিছু শিক্ষকের কাছে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি, যাঁদের কাছে আমি ছিলাম সত্যিকার অর্থেই সন্তানতুল্য এবং তাঁরাও আমার কাছে, অথবা আমাদের কাছে ছিলেন পিতৃতুল্য। এমনই একজন শিক্ষক ছিলেন মরহুম এম এ হক।
ত্রিশের দশকে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে ইংরেজিতে এমএ পাস করেছিলেন। সে সময় সরকারের সর্বোচ্চ চাকরির জন্য যে আইসিএস অফিসার নিয়োগ করা হতো, তার জন্য সাধারণ বিএ পাস করাটাই যথেষ্ট ছিল। তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে কিংবা তার পরও এ নিয়মই বহাল ছিল। আর ইংরেজিতে এমএ পাস করা কোনো ব্যক্তির পক্ষে লোভনীয় ক্যারিয়ার গড়ে তোলা তখন কোনো কঠিন বিষয় ছিল না। কিন্তু না, তিনি সরকারি চাকরিতে যাননি। ক্যারিয়ার গড়ে তোলার চিন্তাও করেননি। নিজের বাড়ি বৃহত্তর নোয়াখালী হলেও তিনি শিক্ষকতার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বর্তমান নরসিংদী জেলার হাতিরদিয়ায়। কোনো প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে নয়, নতুনভাবে শুরু করা একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলটির নাম হাতিরদিয়া সাদত আলী মডেল হাই স্কুল। প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন শহীদ আসাদের বাবা মাওলানা আবু তাহের। কিন্তু তিনি খুব বেশি দিন সেখানে থাকেননি। তাঁর পরই স্কুলটিতে যোগ দিয়েছিলেন মরহুম এম এ হক। সেখানে কত টাকা বেতন পেতেন অথবা কী সুযোগ-সুবিধা পেতেন_সেসব প্রশ্নে নাই-বা গেলাম। সে সময় একজন স্কুলশিক্ষকের বেতন যে খুবই কম ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রম করে তিলে তিলে তিনি স্কুলটি গড়ে তুলেছিলেন। শুধু গড়ে তোলা নয়, এক বিশেষ সম্মানজনক স্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন স্কুলটিকে। সে সময় হাতিরদিয়ার অবস্থান ছিল ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ মহকুমার অধীনে। নারায়ণগঞ্জ মহকুমায় বরাবরই স্কুলটি সবচেয়ে ভালো ফল করেছে। ঢাকা জেলায়ও বহুবার স্কুলটি সবচেয়ে ভালো ফল করেছে। ১৯৭০ সালে তাঁর শিক্ষকজীবনের শেষ ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম আমি। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই ব্যক্তিজীবনে যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁরই ছাত্র অধ্যাপক আবদুল মান্নান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন। আমরা যখন সেই স্কুলের ছাত্র, তার অনেক আগেই নির্মিত হয়েছিল স্কুলের মূল ভবনটি_বিশাল দ্বিতল অট্টালিকা। পশ্চিম পাশে ছিল প্রধান শিক্ষকের বাসভবন। তার ঠিক দক্ষিণে ছিল বেশ বড় ছাত্রাবাস। স্কুলমাঠটি ছিল অনেক বড়। মাঠের দক্ষিণ পাশে ছিল ছাত্রদের ব্যায়ামাগার ও মসজিদ। এক কথায় ছাত্রদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব কিছুই ছিল স্কুলটিতে। তখন খুব কমসংখ্যক মাধ্যমিক বিদ্যালয়েই এ রকম অবকাঠামোগত সুবিধা দেখা যেত।
হক স্যারের ব্যক্তিত্ব ছিল আকাশচুম্বী। তাঁকে কখনো কোনো ছাত্রকে মারতে দেখিনি। কিন্তু তার পরও ছাত্ররা তাঁকে যেমন ভয় পেত, তেমনি সমীহ করত। তিনি সচরাচর স্কুল ক্যাম্পাসের বাইরে যেতেন না। বিশেষ প্রয়োজনে স্কুলের সামনের রাস্তায় গেলে মুহূর্তেই রাস্তা খালি হয়ে যেত। কারণ এলাকার শিক্ষিতজন প্রায় সবাই ছিলেন তাঁর ছাত্র। যাঁরা তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলেন না, তাঁরাও তাঁকে একই রকম সমীহ করতেন। শুধু হক স্যার নন, আরো অনেক শিক্ষকই ছিলেন একই ধরনের ব্যক্তিত্বের অধিকারী ও নিষ্ঠাবান। বাবু কেদারনাথ রায়ের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। আমাদের ব্যাকরণ পড়াতেন। তিনি বাড়ি থেকে আসতেন সাইকেলে চড়ে। আমাদের অভিভাবকদেরও দেখতাম স্যারকে আসতে দেখলে নিজেরা সাইকেল থেকে নেমে যেতেন। স্যারকে আদাব বা নমস্কার জানাতেন। বলা যায়, আমার শিক্ষক-ভাগ্য বরাবরই খুব ভালো ছিল। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়-জীবনের শিক্ষক সালাম স্যারের কথা প্রায়ই আমার মনে পড়ে। তিনি অঙ্ক করাতেন। না পারলে হালকা শাস্তিও দিতেন। ছাত্ররা তাঁকে যমের মতো ভয় পেত। কিন্তু তাঁর যে ব্যক্তিত্ব ও ভালোবাসা ছিল ছাত্রদের প্রতি তা কখনো ভুলবার মতো নয়। ঢাকা কলেজের আদর্শবান শিক্ষকদের মধ্যে দুজনের কথা বড় বেশি মনে পড়ে_অধ্যাপক লতিফুর রহমান ও কাজী নূরুল ইসলাম ফারুকী। আমি তাঁদের কোনো ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে তাঁরা হোস্টেলে পিয়ন পাঠিয়ে দিতেন আমার খোঁজ নিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া শিক্ষকরাও আমার জীবনকে অনেক পরিশীলিত করেছেন। আবার অনেক শিক্ষক আছেন, আমি যাঁদের সরাসরি ছাত্র নই, কিন্তু তাঁদের দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়, তাঁদের সংস্পর্শে এলে ভালোবাসায় সিক্ত হই। বিশেষভাবে কারো নাম নাই-বা বললাম।
আমার ব্যক্তিজীবনের এ দীর্ঘ ফিরিস্তি পড়ে যদি কেউ বিরক্ত হয়ে থাকেন, তাঁর কাছে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। এই দীর্ঘ ফিরিস্তি দিলাম এ কারণে যে আজ (১৫ জুন ২০১১) কালের কণ্ঠের প্রথম পাতায় কার্টুনসহ তিনটি খবরের একটি বঙ্ দেখে এবং খবরগুলো পড়ে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। খবরের শিরোনামগুলো হলো : ঘুষ শেখায় শিক্ষা ভবন, তাৎক্ষণিক 'ঝাড়িকেন্দ্র' এবং তদন্তের ধরন। শুধু এ তিনটি খবরই নয়, আজকেই অন্য একটি পত্রিকায় দেখলাম আরেকটি শিরোনাম_'দুর্নীতির মধুর হাড়ি, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর'। শিক্ষকের নিয়োগ, পদোন্নতি, এমপিওভুক্তি_ সর্বত্রই দুর্নীতি। শিক্ষককে সামান্য কাজের জন্য পিয়ন, দারোয়ানদের কাকুতি-মিনতি করে কিংবা দক্ষিণা দিয়ে কোনো কর্মকর্তার কাছে পেঁৗছাতে হয়। শিক্ষক সেবাকেন্দ্রে গিয়ে কর্মকর্তার 'ঝাড়ি' খেতে হয়। ঘুষ না দিলে ফাইল খুঁজে পাওয়া যায় না, কোনো কাজই হয় না_পত্রিকার এই খবরগুলো প্রতিনিয়ত হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। এই দুঃখবোধগুলো যদি কিছু পরিমাণে 'শেয়ার' করা যায়, সেই উদ্দেশ্যেই এই লেখা। এসব খবর থেকে যেটি প্রতীয়মান হয়, 'শিক্ষা ভবন' নামের সরকারি দপ্তরটি শুধু শিক্ষকদের পদে পদে অপমান করে না, শিক্ষার যে উদ্দেশ্য, আদর্শ সেগুলো থেকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্রমেই দূরে সরিয়ে দিয়েছে ও দিচ্ছে। গতকাল সংসদে বাজেট নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর দীর্ঘ বক্তৃতা শুনলাম। শুধু বড় বাজেট কি পারবে শিক্ষাব্যবস্থাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পেঁৗছাতে? বাজেট বর্তমানের দশ গুণ করলেই কি শিক্ষা থেকে নির্বাসিত নৈতিকতা ফিরে আসবে? আর নৈতিকতাহীন শিক্ষা সমাজ বা দেশের কোন উপকারে আসবে?
প্রিয় পাঠক, আপনার কি জানতে ইচ্ছা করে না যে আমাদের সেই প্রিয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি এখন কেমন আছে? ভালো নেই। কিছুদিন আগে বাড়ি গিয়েছিলাম। তখন একাধিক জনের কাছ থেকে শুনে এসেছি, সেই বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে একজন ব্যক্তিকে দিতে হয়েছে ছয় লাখ টাকা। ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়া সেই শিক্ষক কি পারবেন, না চাইবেন সেই বিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে? ঘুষের টাকাটা তো অন্তত তাকে আদায় করতে হবে। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে মরহুম আবদুল হক যে স্কুলের জন্য নিজের ব্যক্তিজীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সেই উৎসর্গের কী মূল্য থাকল? পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, শুধু সেই স্কুলটিই নয় কিংবা শুধু সেই এলাকার স্কুলগুলোই নয়, এই রেওয়াজ কমবেশি সারা দেশের স্কুলেই ছড়িয়ে পড়েছে। এখন শিক্ষক হতে মেধার প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় অর্থের। অথচ হক স্যারদের যুগে প্রথম শ্রেণী পাওয়া তুখোড় ছাত্ররা চাকরির জন্য নয়, জীবনের ব্রত হিসেবে শিক্ষকতা পেশা বেছে নিতেন। এ রকম প্রচুর প্রমাণ সামান্য ইতিহাস ঘাঁটলেই আপনি পেয়ে যাবেন।
শিক্ষকের মর্যাদা প্রসঙ্গে ছোটবেলায় বাদশাহ আওরঙ্গজেবের ধারণা পড়েছিলাম। আপনারাও অনেকে সেটি পড়ে থাকবেন। বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সন্তানকে পড়াতেন যে শিক্ষক, একদিন আসার পথে তাঁর পায়ে ময়লা লেগে যায়। তিনি আওরঙ্গজেবের সন্তানকে পায়ে পানি ঢালতে দিয়ে নিজেই পা দুটো পরিষ্কার করছিলেন। বাদশাহ আওরঙ্গজেব দূর থেকে তা দেখলেন। ছাত্রকে পড়ানো শেষ হলে তিনি শিক্ষককে ডাকালেন? শিক্ষক দুরু দুরু বুকে বাদশাহর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আওরঙ্গজেব বললেন, 'পণ্ডিতজি, কাজটা আপনি ভালো করেন নাই। আপনি কেন নিজের হাতে পা পরিষ্কার করলেন, কেন আমার ছেলেকে দিয়ে পা পরিষ্কার করালেন না?' আমাদের সন্তানদের কাছেই এখন এসব কথা রূপকথা বা অবাস্তব মনে হতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই শিক্ষকের মর্যাদা এখনো প্রায় সেই পর্যায়ে রয়ে গেছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এতটাই অধঃপতন হয়েছে যে শিক্ষা ভবনের একজন পিয়নও একজন শিক্ষককে প্রায় গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারে। কর্মকর্তাদের তো কথাই নেই। অথচ বয়োজেষ্ঠদের কাছে শুনেছি, আমাদের হক স্যার নাকি একবার এসডিইও সাহেবকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অনুমতি না নিয়ে স্কুলে ঢোকার জন্য। আজ 'সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই' ধরনের যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কি পারবেন বড় বাজেট দিয়ে তাকে যথাস্থানে ফিরিয়ে আনতে? নাকি বড় বাজেট বড় দুর্নীতিরই জন্ম দেবে?
লেখক : সাংবাদিক
হক স্যারের ব্যক্তিত্ব ছিল আকাশচুম্বী। তাঁকে কখনো কোনো ছাত্রকে মারতে দেখিনি। কিন্তু তার পরও ছাত্ররা তাঁকে যেমন ভয় পেত, তেমনি সমীহ করত। তিনি সচরাচর স্কুল ক্যাম্পাসের বাইরে যেতেন না। বিশেষ প্রয়োজনে স্কুলের সামনের রাস্তায় গেলে মুহূর্তেই রাস্তা খালি হয়ে যেত। কারণ এলাকার শিক্ষিতজন প্রায় সবাই ছিলেন তাঁর ছাত্র। যাঁরা তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলেন না, তাঁরাও তাঁকে একই রকম সমীহ করতেন। শুধু হক স্যার নন, আরো অনেক শিক্ষকই ছিলেন একই ধরনের ব্যক্তিত্বের অধিকারী ও নিষ্ঠাবান। বাবু কেদারনাথ রায়ের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। আমাদের ব্যাকরণ পড়াতেন। তিনি বাড়ি থেকে আসতেন সাইকেলে চড়ে। আমাদের অভিভাবকদেরও দেখতাম স্যারকে আসতে দেখলে নিজেরা সাইকেল থেকে নেমে যেতেন। স্যারকে আদাব বা নমস্কার জানাতেন। বলা যায়, আমার শিক্ষক-ভাগ্য বরাবরই খুব ভালো ছিল। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়-জীবনের শিক্ষক সালাম স্যারের কথা প্রায়ই আমার মনে পড়ে। তিনি অঙ্ক করাতেন। না পারলে হালকা শাস্তিও দিতেন। ছাত্ররা তাঁকে যমের মতো ভয় পেত। কিন্তু তাঁর যে ব্যক্তিত্ব ও ভালোবাসা ছিল ছাত্রদের প্রতি তা কখনো ভুলবার মতো নয়। ঢাকা কলেজের আদর্শবান শিক্ষকদের মধ্যে দুজনের কথা বড় বেশি মনে পড়ে_অধ্যাপক লতিফুর রহমান ও কাজী নূরুল ইসলাম ফারুকী। আমি তাঁদের কোনো ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে তাঁরা হোস্টেলে পিয়ন পাঠিয়ে দিতেন আমার খোঁজ নিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া শিক্ষকরাও আমার জীবনকে অনেক পরিশীলিত করেছেন। আবার অনেক শিক্ষক আছেন, আমি যাঁদের সরাসরি ছাত্র নই, কিন্তু তাঁদের দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়, তাঁদের সংস্পর্শে এলে ভালোবাসায় সিক্ত হই। বিশেষভাবে কারো নাম নাই-বা বললাম।
আমার ব্যক্তিজীবনের এ দীর্ঘ ফিরিস্তি পড়ে যদি কেউ বিরক্ত হয়ে থাকেন, তাঁর কাছে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। এই দীর্ঘ ফিরিস্তি দিলাম এ কারণে যে আজ (১৫ জুন ২০১১) কালের কণ্ঠের প্রথম পাতায় কার্টুনসহ তিনটি খবরের একটি বঙ্ দেখে এবং খবরগুলো পড়ে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। খবরের শিরোনামগুলো হলো : ঘুষ শেখায় শিক্ষা ভবন, তাৎক্ষণিক 'ঝাড়িকেন্দ্র' এবং তদন্তের ধরন। শুধু এ তিনটি খবরই নয়, আজকেই অন্য একটি পত্রিকায় দেখলাম আরেকটি শিরোনাম_'দুর্নীতির মধুর হাড়ি, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর'। শিক্ষকের নিয়োগ, পদোন্নতি, এমপিওভুক্তি_ সর্বত্রই দুর্নীতি। শিক্ষককে সামান্য কাজের জন্য পিয়ন, দারোয়ানদের কাকুতি-মিনতি করে কিংবা দক্ষিণা দিয়ে কোনো কর্মকর্তার কাছে পেঁৗছাতে হয়। শিক্ষক সেবাকেন্দ্রে গিয়ে কর্মকর্তার 'ঝাড়ি' খেতে হয়। ঘুষ না দিলে ফাইল খুঁজে পাওয়া যায় না, কোনো কাজই হয় না_পত্রিকার এই খবরগুলো প্রতিনিয়ত হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। এই দুঃখবোধগুলো যদি কিছু পরিমাণে 'শেয়ার' করা যায়, সেই উদ্দেশ্যেই এই লেখা। এসব খবর থেকে যেটি প্রতীয়মান হয়, 'শিক্ষা ভবন' নামের সরকারি দপ্তরটি শুধু শিক্ষকদের পদে পদে অপমান করে না, শিক্ষার যে উদ্দেশ্য, আদর্শ সেগুলো থেকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্রমেই দূরে সরিয়ে দিয়েছে ও দিচ্ছে। গতকাল সংসদে বাজেট নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর দীর্ঘ বক্তৃতা শুনলাম। শুধু বড় বাজেট কি পারবে শিক্ষাব্যবস্থাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পেঁৗছাতে? বাজেট বর্তমানের দশ গুণ করলেই কি শিক্ষা থেকে নির্বাসিত নৈতিকতা ফিরে আসবে? আর নৈতিকতাহীন শিক্ষা সমাজ বা দেশের কোন উপকারে আসবে?
প্রিয় পাঠক, আপনার কি জানতে ইচ্ছা করে না যে আমাদের সেই প্রিয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি এখন কেমন আছে? ভালো নেই। কিছুদিন আগে বাড়ি গিয়েছিলাম। তখন একাধিক জনের কাছ থেকে শুনে এসেছি, সেই বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে একজন ব্যক্তিকে দিতে হয়েছে ছয় লাখ টাকা। ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়া সেই শিক্ষক কি পারবেন, না চাইবেন সেই বিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে? ঘুষের টাকাটা তো অন্তত তাকে আদায় করতে হবে। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে মরহুম আবদুল হক যে স্কুলের জন্য নিজের ব্যক্তিজীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সেই উৎসর্গের কী মূল্য থাকল? পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, শুধু সেই স্কুলটিই নয় কিংবা শুধু সেই এলাকার স্কুলগুলোই নয়, এই রেওয়াজ কমবেশি সারা দেশের স্কুলেই ছড়িয়ে পড়েছে। এখন শিক্ষক হতে মেধার প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় অর্থের। অথচ হক স্যারদের যুগে প্রথম শ্রেণী পাওয়া তুখোড় ছাত্ররা চাকরির জন্য নয়, জীবনের ব্রত হিসেবে শিক্ষকতা পেশা বেছে নিতেন। এ রকম প্রচুর প্রমাণ সামান্য ইতিহাস ঘাঁটলেই আপনি পেয়ে যাবেন।
শিক্ষকের মর্যাদা প্রসঙ্গে ছোটবেলায় বাদশাহ আওরঙ্গজেবের ধারণা পড়েছিলাম। আপনারাও অনেকে সেটি পড়ে থাকবেন। বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সন্তানকে পড়াতেন যে শিক্ষক, একদিন আসার পথে তাঁর পায়ে ময়লা লেগে যায়। তিনি আওরঙ্গজেবের সন্তানকে পায়ে পানি ঢালতে দিয়ে নিজেই পা দুটো পরিষ্কার করছিলেন। বাদশাহ আওরঙ্গজেব দূর থেকে তা দেখলেন। ছাত্রকে পড়ানো শেষ হলে তিনি শিক্ষককে ডাকালেন? শিক্ষক দুরু দুরু বুকে বাদশাহর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আওরঙ্গজেব বললেন, 'পণ্ডিতজি, কাজটা আপনি ভালো করেন নাই। আপনি কেন নিজের হাতে পা পরিষ্কার করলেন, কেন আমার ছেলেকে দিয়ে পা পরিষ্কার করালেন না?' আমাদের সন্তানদের কাছেই এখন এসব কথা রূপকথা বা অবাস্তব মনে হতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই শিক্ষকের মর্যাদা এখনো প্রায় সেই পর্যায়ে রয়ে গেছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এতটাই অধঃপতন হয়েছে যে শিক্ষা ভবনের একজন পিয়নও একজন শিক্ষককে প্রায় গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারে। কর্মকর্তাদের তো কথাই নেই। অথচ বয়োজেষ্ঠদের কাছে শুনেছি, আমাদের হক স্যার নাকি একবার এসডিইও সাহেবকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অনুমতি না নিয়ে স্কুলে ঢোকার জন্য। আজ 'সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই' ধরনের যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কি পারবেন বড় বাজেট দিয়ে তাকে যথাস্থানে ফিরিয়ে আনতে? নাকি বড় বাজেট বড় দুর্নীতিরই জন্ম দেবে?
লেখক : সাংবাদিক
No comments