আমাদের সব মাতৃভাষা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে হবে by সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী
অমর একুশে আমাদের গর্ব- আমাদের স্বাধীনতার প্রথম সোপান। একুশের চেতনার পথ ধরে আমরা অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। আমাদের ভাষা-শহীদদের চরম আত্মত্যাগ ইতিহাসে একটা বিরল ঘটনা। তাঁরা রক্ত দিয়ে আমাদের মাতৃভাষা রক্ষা করে গেছেন। আজকের এই দিনে তাঁদের জানাই শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।
আজকের এই দিনটি সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হচ্ছে। আমাদের ভাষা-শহীদদের মতো আজ পৃথিবীর ১৮৫টি দেশের নাগরিকরা তাঁদের স্ব স্ব মাতৃভাষা রক্ষার্থে নতুন করে অঙ্গীকার করছেন। সারা জাতির জন্য এটা একটা গৌরবময় অর্জন।
আজ গৌরবের দিন। আজ আত্মবিশ্লেষণের দিন। প্রথম প্রশ্ন আমরা কি আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও চেতনা সারা বিশ্বে তুলে ধরতে পেরেছি? আমাদের মাতৃভাষার কতটুকু সমৃদ্ধকরণ ও পরিবর্ধন করতে পেরেছি আমরা?
আজ থেকে এক যুগেরও আগে অর্থাৎ ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলন বহু দেন-দরবার ও কূটনৈতিক কলাকৌশল খাটিয়ে আমাদের প্রস্তাবটি অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিলাম। ফলে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০০ উদ্যাপিত হয়েছিল। তদানীন্তন মহাপরিচালক কাইচুরা মাৎসুরা দিনটির শুভ উদ্বোধন বা লঞ্চিং করেছিলেন।
প্রস্তাবের প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের মাতৃভাষা রক্ষার্থে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার অঙ্গীকারও করেছিল। কতটুকু পারলাম সেই অঙ্গীকার রক্ষা করতে? অনেক টানাপড়েনের পর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আজ থেকে দুবছর আগে স্থাপিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা রক্ষা করার জন্য তাদের যে পরিমাণ সামর্থ্য ও পারদর্শিতা দরকার, তা অর্জন করতে তাদের আরো সময় লাগবে। তবে এই প্রাথমিক পর্যায়ে তারা আমাদের দেশের মাতৃভাষাগুলো সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে পারে।
বাংলা আমাদের প্রধান মাতৃভাষা। কিন্তু তা ছাড়া প্রায় ৩০টিরও বেশি আঞ্চলিক ও উপজাতীয় ভাষা আছে। এগুলোর সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এর মধ্যে চাকমা একটি প্রধান ভাষা। প্রায় দুই লাখ উপজাতি এই ভাষায় কথা বলে। ইঙ্গো-ইউরোপীয় সমৃদ্ধ ভাষা চাকমা। তথ্য অনুযায়ী ১৮৬০ সালে এই ভাষার বর্ণে বাইবেল প্রকাশিত হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনকালে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের যে এলাকায় চাকমারা ও মারমারা বাস করত, সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই ভাষাগুলো শেখানো হতো। পরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটা চালু করা দরকার। তঞ্চঙ্গা আরেকটি ইঙ্গো-ইউরোপীয় পরিবারভুক্ত উপজাতীয় ভাষা। এ ভাষারও নিজস্ব বর্ণমালা আছে। আছে তাদের নিজেদের সাহিত্যও।
খিয়াং আরেকটি উপজাতীয় ভাষা। আমাদের দেশের রাঙামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলে এই ভাষা প্রচলিত। তবে তাদের নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই। মূলত সিনে-টিবেটান ভাষাটি মিয়ানমারেও প্রচলিত আছে। এ ছাড়াও খিয়াং, মারমা, বম, খুমি, চাক, কোচ, খাড়িয়া, হাজং, গারো, সাঁওতাল ও অন্যান্য উপজাতীয় ভাষা আছে।
গবেষকরা মনে করেন বর্তমানে বাংলাদেশে বাংলাসহ প্রায় ৪২টি ভাষা আছে। এর অধিকাংশই দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলোর রক্ষার্থে এসব অঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাতৃভাষার শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে ভাষাগুলো নির্ঘাৎ মৃত্যুর পথে এগোবে। ২০০৭ সালে এ ব্যাপারে কিছুটা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বেশি দূর এগোয়নি। আবার এ ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। উপজাতীয় ভাষায় প্রকাশিত বইগুলো যত্নসহকারে সংরক্ষণ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবর্তন করা যেতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, একটি ভাষার মৃত্য একটি মানবগোষ্ঠীর সঞ্চিত জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিলুপ্তি।
শুধু উপজাতিদের ভাষা নয়, আমাদের বিভিন্ন জেলায় ব্যবহৃত উরধষবপঃ বা কথিত ভাষা আজ অনেকটা বিপদাপন্ন। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের পালাগান, জারিগান, বারোমাসি গান, পই-প্রবাদ, ডাক ও ডিবান। বর্তমান ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার দাপটে তারা সম্পূর্ণ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। খেয়াল করলে দেখা যায়, আজ ঢাকার প্রায় ২০টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে আমাদের অন্যান্য ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রায় অনুপস্থিত। আমাদের অনেক চ্যানেল হয়েছে কিন্তু কোনো নীতিমালা ছাড়া শুধু বাণিজ্যিক ভিত্তিতেই তা চলছে।
সিলেট জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে রয়েছে নিজস্ব স্বকীয়তা। তার একটি বড় প্রমাণ নাগরী লিপি ও সাহিত্য। ভাষাটি 'সিলেট নাগরী' বলে পরিচিত। দেবনাগরী থেকে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও শুধু মুসলমানদের মধ্যে এই লিপি প্রচলিত ছিল।
হজরত শাহজালালের সঙ্গে ৩৬০ আউলিয়া সিলেটে আসেন। তাঁরা মূলত বিভিন্ন দেশ ও এই উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে আসেন। তাঁদের ভাষা বাংলা ছিল না। তাঁরা সম্ভবত তখন আরবি অক্ষরে তাঁদের স্ব স্ব ভাষার চর্চা করতেন দেবনাগর অক্ষরে। সে ভিত্তিতেই সিলেট নাগরী গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে সময়ে ফার্সি ভাষায় সংবলিত হয়ে হিন্দি ভাষা, উর্দু ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো সিলেটেও আসে। কিন্তু গরিব মুসলমান হিন্দি, ফার্সি, আরবির দাপট থেকে দূরে থেকে তাদের নাগরী ভাষা চালাতে লাগল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এই নাগরী শুধু গরিব মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। বর্তমানে এই নাগরী অক্ষরে লেখা পুঁথি-সাহিত্য সংরক্ষণে বেসরকারিভাবে প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে। আমাদের মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারে।
আমাদের মূল মাতৃভাষা বাংলার সমৃদ্ধিকরণ ও আন্তর্জাতিককরণ প্রক্রিয়া আরো জোরদার করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আমরা ইংরেজি ভাষার সমৃদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ার দিকে নজর দিতে পারি। ফরাসির তুলনায় ইংরেজি অনেক উদার মনোভাব দেখায় ও বিভিন্ন সাহিত্য থেকে সব ধরনের বইপত্র অনুবাদ করে ও নতুন নতুন শব্দ আহরণ করে। তবে তারা কাজটা করত খুব সুচারুভাবে। তাদের মোদ্দাকথা যে শব্দ ইংরেজি ভাষাতে নেই, তা ভেবেচিন্তে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বর্তমান কম্পিউটারের জগতে বাংলাকে আনতে হবে। তা না হলে বাংলাকে কিভাবে বিশ্বাঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করব।
তবে বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজির বিকল্প নেই। কাজেই আমাদের বাংলা ও ইংরেজিতে সমান পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে। মানব সম্পদ আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ, তাকে যথাযোগ্য ভাষার জ্ঞান দিতে হবে, যেন তারা বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে। আমি মধ্যপ্রাচ্যে শুধু ইংরেজি না জানার কারণে আমাদের শ্রমিকদের পিছিয়ে পড়তে দেখেছি। ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইনের নাগরিকরা ইংরেজি জানায় পূর্ণ সুবিধা পাচ্ছেন।
একই কারণে আমাদের ৮০ শতাংশ আন্তর্জাতিক কল সেন্টার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমরা হারাচ্ছি পাঁচ বিলিয়ন ডলার। এখানেও প্রতিবেশী ভারতের বিরাট দাপট। তারা পৃথিবীর শীর্ষে আছে। অতীতে আমরা দুটি ভাষাই শিখতাম- বাংলা ও ইংরেজি। নিশ্চয়ই চেষ্টা করলে আবার পারব।
আজকে এই ৬০তম একুশের উদ্যাপনে আমাদের ব্রত হওয়া উচিত : মাতৃভাষা বাংলাকে সুদৃঢ়, সমৃদ্ধ ও আন্তর্জাতিক করব। বাকি সব মাতৃভাষা সংরক্ষণ করব ও একই সঙ্গে ইংরেজি ও বিদেশি ভাষা শিখব। দেশকে উন্নত করতে হবে, তাহলে পৃথিবী আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির দিকে আরো আগ্রহ দেখাবে। মহান একুশে অমর হোক।
লেখক : সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা প্রস্তাবটি তিনি ইউনেসকোতে বাংলাদেশের পক্ষে উত্থাপন করেন এবং অনুমোদনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন
No comments