মন্ত্রীর পরিবার মেয়রের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল, পুলিশের তিন শীর্ষ কর্তা প্রত্যাহার by সেলিম জাহিদ, সুমন মোল্লা ও মনিরুজ্জামান
নরসিংদী পৌরসভার মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার পর গতকাল শুক্রবার পুলিশ সুপার আক্কাস উদ্দীন ভূঁইয়া এবং দুই অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাক ও এনামুল কবিরকে গতকাল প্রত্যাহার করা হয়েছে। জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রত্যাহারের বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার। গতরাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত লোকমান হত্যা মামলার কোনো আসামিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তবে পুলিশ দাবি করেছে, তারা আসামি ধরতে অভিযান চালিয়েছে।
গতকালই মামলাটি তদন্তের জন্য জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) স্থানান্তর করা হয়েছে। ডিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল্লাহ আল মামুন তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন। লোকমান হোসেনের ভাই মো. কামরুজ্জামান গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদের ছোট ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদসহ ১৪ জনকে আসামি করে এ মামলা করেন। আসামিদের ১৩ জনই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। মামলায় আরও সাত-আটজনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি দেখানো হয়।
প্রত্যাহার হওয়ার আগে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাক প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘সালাহউদ্দিন আহমেদ ছাড়া এজাহারে উল্লিখিত আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, ছিনতাই, মাদকদ্রব্য আইনে মামলা আছে।’
হত্যা মামলার আসামিদের নিয়ে নরসিংদীর রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানামুখী আলোচনা। পুলিশ প্রশাসন সূত্র জানায়, লোকমান হত্যার এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ ছাড়া বাকিদের নামে পৃথক হত্যা, ছিনতাই, অস্ত্র, মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে থানায় মামলা আছে। পুলিশের দাবি, আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়েছে তারা। তবে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। আসামিদের মধ্যে তিনজন দেশের বাইরে আছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের দলের নেতা ও জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হত্যার আসামি করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঞা দলের সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার এজাহারে কাদের নাম আছে, তা আমি জানি না। এটা তাঁদের (লোকমানের) পরিবার থেকে করা হয়েছে। এ বিষয়ে তাঁরা আমার বা দলের কারও সঙ্গে কথা বলেননি। তাই এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’
মামলার এজাহারে এক নম্বর আসামি সালাহউদ্দিন আহমেদ ও দুই নম্বর আসামি আবদুল মতিন সরকারকে হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। শেষ চার আসামি যথাক্রমে আশরাফ হোসেন সরকার, মিঞা মো. মঞ্জুর, আমির হোসেন ওরফে আমু ও মামুনকে হত্যার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করা হয়। বাকি সাতজন আসামিকে নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
রাজনৈতিক বৈরিতা: স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, মামলার প্রধান দুই আসামির সঙ্গে লোকমান হোসেনের দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বৈরিতা চলে আসছিল। বিশেষ করে, এক নম্বর আসামি সালাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সম্প্রতি সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। সূত্রগুলোর মতে, এর দুটি প্রধান কারণ হলো: জেলা ছাত্রলীগকে দিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীকে এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করানো এবং আসন্ন জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে লোকমানের সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা।
দলের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রী ও তাঁর পরিবারকে তাচ্ছিল্য করে লোকমান হোসেন সম্প্রতি মন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিনকে কিছু কথা বলেন। লোকমান এমন কথাও নাকি বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে মন্ত্রীর পরিবার থেকে কেউ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হতে পারবে না।’ এতে মন্ত্রীর পরিবারের লোকজন লোকমানের ওপর রুষ্ট হন।
আবদুল মতিন: সূত্র জানায়, মামলার দুই নম্বর আসামি আবদুল মতিন সরকারের সঙ্গে মেয়র লোকমান হোসেনের বৈরিতা দীর্ঘদিনের। শহরের বেপারীপাড়ার অধিবাসী আবদুল মতিন দুবারের নির্বাচিত মেয়র ছিলেন। তাঁকে পরাজিত করেই লোকমান হোসেন মেয়র নির্বাচিত হন। গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনেও দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে লোকমানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আবদুল মতিন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। নির্বাচনে টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর সমর্থন পান আবদুল মতিন। পরে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করায় মতিনকে পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
স্থানীয় একাধিক রাজনৈতিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, লোকমান হোসেনের সঙ্গে আবদুল মতিন সরকারের বিরোধ শুরু হয় ১৯৯৭ সালের পৌরসভা নির্বাচন থেকে। ওই নির্বাচনে আবদুল মতিনের পক্ষ নিয়েছিলেন রাজিউদ্দিন আহমেদ। লোকমান হোসেন পক্ষ নিয়েছিলেন নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান ওরফে জামানের।
মোন্তাজ উদ্দিন ভূঞা: দলীয় সূত্র বলছে, এজাহারে উল্লিখিত আসামিদের মধ্যে মোন্তাজ উদ্দিন ভূঞা হত্যাকাণ্ডের সময় লোকমান হোসেনের পাশেই বসা ছিলেন। মোন্তাজ উদ্দিন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি, আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন লোকমান হোসেন। কিন্তু দুজনের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না। শহরের বেপারীপাড়ার অধিবাসী মোন্তাজ উদ্দিন আগামী সম্মেলনে লোকমান হোসেনের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।
মোবারক হোসেন: অন্যতম আসামি মোবারক হোসেন ওরফে মোবা ছিলেন লোকমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বাল্যবন্ধু। তিনি শহর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। কিন্তু গত পৌর নির্বাচনের আগে থেকে তাঁর সঙ্গে লোকমানের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে বলে জানান লোকমানের ঘনিষ্ঠজনেরা। বর্তমানে তিনি মালয়েশিয়ায় আছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
আশরাফ হোসেন: খুনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বলে এজাহারে উল্লেখ করা আসামি আশরাফ হোসেন সরকারের সঙ্গে লোকমানের বিরোধও পুরোনো। সম্প্রতি এই বিরোধ আরও জোরদার হয় পৌরসভার প্রায় আট কোটি টাকার একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে। আশরাফ হোসেন মামলার দুই নম্বর আসামি আবদুল মতিন সরকারের ছোট ভাই।
সূত্র জানায়, মেয়র লোকমান হোসেন শহরের মেঘনা নদীর তীরবর্তী ব্রাহ্মণপাড়ার পাথরঘাট এলাকার যে জায়গায় প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছিলেন, এর পাশেই সরকারি জায়গা ইজারা নিয়ে ব্যবসা করছিলেন আশরাফ। কিন্তু লোকমান ওয়াটার প্ল্যান্টের জন্য আশরাফের ইজারার জমি থেকে কিছু অংশ নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে নতুন করে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
মিঞা মো. মঞ্জুর: নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মিঞা মো. মঞ্জুরের সঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমেদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে বলে অভিযোগ আছে। তিনি অন্য আসামি আশরাফেরও ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
মঞ্জুর একসময় ছাত্রদলের নরসিংদী সরকারি কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু তাঁর কনিষ্ঠ স্থানীয় বিএনপিদলীয় সাংসদ শামসুদ্দীন এছাকের ছেলে সাব্বিরকে কলেজ কমিটির সভাপতি করা হলে ক্ষুব্ধ হয়ে মঞ্জুর ছাত্রলীগে যোগ দেন। পরে তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) হন।
এক পরিবারের তিনজন আসামি এবং...: আমির হোসেন ওরফে আমু নিহত মানিক মিয়া কমিশনারের ছোট ভাই। ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি নরসিংদীতে মানিক মিয়া কমিশনার খুন হন। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটে শহরের ভেলানগরে একটি যাত্রা প্যান্ডেলে। এই হত্যাকাণ্ডের পর লোকমান হোসেন ও তাঁর ভাই কামরুজ্জামানকে প্রধান আসামি করে মামলা হয়। মামলায় বাদী ছিলেন আমির হোসেন আমু। আমির নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। একবার অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারও হন তিনি। তাঁর বাবা আজিজ মিয়া ভেলানগরের গণপিটুনিতে নিহত হন।
লোকমান হত্যা মামলার আসামি মামুন নিহত মানিক মিয়ার ছেলে। তিনি আবদুল মতিনের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত। তিনি একাধিক মামলার আসামি এবং এলাকায় মাদকাসক্ত হিসেবে পরিচিত।
লোকমান হত্যা মামলায় এই আমির হোসেন আমু, তাঁর ভাই হিরণ মিয়া ও মানিক মিয়ার ছেলে মামুনকে আসামি করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মানিক মিয়া হত্যা মামলা থেকে মুক্তি পেতে লোকমান হোসেন প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। মামলাটি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বলে প্রত্যাহার করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করেন তিনি। কিন্তু স্থানীয় প্রতিপক্ষের তৎপরতায় সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
এপিএস মুরাদ: লোকমান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মাসুদুর রহমান মুরাদ মন্ত্রীর ব্যক্তিগত একান্ত সহকারী (এপিএস)। খুনি চক্রের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে বলে অভিযোগ করেছে বাদীপক্ষ। স্থানীয় কাউরিয়াপাড়ার একটি ডাইং কারখানায় অপরাধীদের সঙ্গে তিনি আড্ডা দেন বলে অভিযোগ আছে।
কবির সরকার: আসামি কবির সরকার হচ্ছেন বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ রহমান সরকারের ছেলে। শহরের পশ্চিম কান্দাপাড়ায় জেলা আওয়ামী লীগের যে অস্থায়ী কার্যালয় আছে, তার জমিদাতা হচ্ছেন রহমান সরকার। কবির সরকার শহর যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি।
বিএনপির নূরুল ইসলাম ও তারেক আহমেদ: মামলায় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত দুজনকে আসামি করা হয়। একজন নূরুল ইসলাম, অন্যজন তারেক আহমেদ। নূরুল ইসলাম শহর বিএনপির সভাপতি। তারেক ছাত্রদলের হয়ে নরসিংদী কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। নরসিংদীর ধনাঢ্য ব্যক্তি ও শিল্পপতি তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে তারেক গত পৌর নির্বাচনে লোকমান হোসেনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, নূরুল ইসলাম সাবেক বিএনপিদলীয় সাংসদ মরহুম শামসুদ্দীন আহমেদ এছাকের ছেলে মাসুদুর রহমান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। সূত্র জানায়, নূরুল ইসলাম বর্তমানে মালয়েশিয়ায় আছেন। আরেক আসামি তারেক আহমেদ সৌদি আরবে পবিত্র হজ পালন করতে গেছেন।
প্রতিক্রিয়া: লোকমান হত্যা মামলায় মন্ত্রীর ভাইসহ আওয়ামী লীগের লোকদের আসামি করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নরসিংদী সদর আসনের সরকারদলীয় সাংসদ নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এজাহারে এভাবে নাম না দিলে ভালো হতো। আসামিদের নাম সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ায় পুলিশ একটি গণ্ডির মধ্যে আটকে গেল। এতে এটা কি সন্ত্রাসী ঘটনা, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, ব্যক্তিগত আক্রোশ নাকি দেশে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, এটা তদন্তের ক্ষেত্রে একটা জটিলতার সৃষ্টি হবে। তবে আমি এও মনে করি না যে বৃহত্তর পরিসরে তদন্তের ক্ষেত্রে এটা বাধা হবে।’
তদবির: নিহত লোকমানের পারিবারিক সূত্র জানায়, মামলার এজাহারে যাতে কারও নাম উল্লেখ না করা হয়, সে জন্য বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একজন নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা তাঁদের অনুরোধ করেছিলেন। এ নিয়ে নানামুখী তৎপরতার কারণে মামলার এজাহার তৈরি করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। শেষ পর্যন্ত আসামিদের নাম উল্লেখ করেই বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মামলা দেওয়া হয়।
প্রত্যাহার হওয়ার আগে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাক প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘সালাহউদ্দিন আহমেদ ছাড়া এজাহারে উল্লিখিত আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, ছিনতাই, মাদকদ্রব্য আইনে মামলা আছে।’
হত্যা মামলার আসামিদের নিয়ে নরসিংদীর রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানামুখী আলোচনা। পুলিশ প্রশাসন সূত্র জানায়, লোকমান হত্যার এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ ছাড়া বাকিদের নামে পৃথক হত্যা, ছিনতাই, অস্ত্র, মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে থানায় মামলা আছে। পুলিশের দাবি, আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়েছে তারা। তবে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। আসামিদের মধ্যে তিনজন দেশের বাইরে আছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের দলের নেতা ও জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হত্যার আসামি করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঞা দলের সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার এজাহারে কাদের নাম আছে, তা আমি জানি না। এটা তাঁদের (লোকমানের) পরিবার থেকে করা হয়েছে। এ বিষয়ে তাঁরা আমার বা দলের কারও সঙ্গে কথা বলেননি। তাই এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’
মামলার এজাহারে এক নম্বর আসামি সালাহউদ্দিন আহমেদ ও দুই নম্বর আসামি আবদুল মতিন সরকারকে হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। শেষ চার আসামি যথাক্রমে আশরাফ হোসেন সরকার, মিঞা মো. মঞ্জুর, আমির হোসেন ওরফে আমু ও মামুনকে হত্যার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করা হয়। বাকি সাতজন আসামিকে নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
রাজনৈতিক বৈরিতা: স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, মামলার প্রধান দুই আসামির সঙ্গে লোকমান হোসেনের দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বৈরিতা চলে আসছিল। বিশেষ করে, এক নম্বর আসামি সালাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সম্প্রতি সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। সূত্রগুলোর মতে, এর দুটি প্রধান কারণ হলো: জেলা ছাত্রলীগকে দিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীকে এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করানো এবং আসন্ন জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে লোকমানের সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা।
দলের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রী ও তাঁর পরিবারকে তাচ্ছিল্য করে লোকমান হোসেন সম্প্রতি মন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিনকে কিছু কথা বলেন। লোকমান এমন কথাও নাকি বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে মন্ত্রীর পরিবার থেকে কেউ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হতে পারবে না।’ এতে মন্ত্রীর পরিবারের লোকজন লোকমানের ওপর রুষ্ট হন।
আবদুল মতিন: সূত্র জানায়, মামলার দুই নম্বর আসামি আবদুল মতিন সরকারের সঙ্গে মেয়র লোকমান হোসেনের বৈরিতা দীর্ঘদিনের। শহরের বেপারীপাড়ার অধিবাসী আবদুল মতিন দুবারের নির্বাচিত মেয়র ছিলেন। তাঁকে পরাজিত করেই লোকমান হোসেন মেয়র নির্বাচিত হন। গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনেও দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে লোকমানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আবদুল মতিন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। নির্বাচনে টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর সমর্থন পান আবদুল মতিন। পরে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করায় মতিনকে পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
স্থানীয় একাধিক রাজনৈতিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, লোকমান হোসেনের সঙ্গে আবদুল মতিন সরকারের বিরোধ শুরু হয় ১৯৯৭ সালের পৌরসভা নির্বাচন থেকে। ওই নির্বাচনে আবদুল মতিনের পক্ষ নিয়েছিলেন রাজিউদ্দিন আহমেদ। লোকমান হোসেন পক্ষ নিয়েছিলেন নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান ওরফে জামানের।
মোন্তাজ উদ্দিন ভূঞা: দলীয় সূত্র বলছে, এজাহারে উল্লিখিত আসামিদের মধ্যে মোন্তাজ উদ্দিন ভূঞা হত্যাকাণ্ডের সময় লোকমান হোসেনের পাশেই বসা ছিলেন। মোন্তাজ উদ্দিন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি, আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন লোকমান হোসেন। কিন্তু দুজনের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না। শহরের বেপারীপাড়ার অধিবাসী মোন্তাজ উদ্দিন আগামী সম্মেলনে লোকমান হোসেনের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।
মোবারক হোসেন: অন্যতম আসামি মোবারক হোসেন ওরফে মোবা ছিলেন লোকমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বাল্যবন্ধু। তিনি শহর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। কিন্তু গত পৌর নির্বাচনের আগে থেকে তাঁর সঙ্গে লোকমানের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে বলে জানান লোকমানের ঘনিষ্ঠজনেরা। বর্তমানে তিনি মালয়েশিয়ায় আছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
আশরাফ হোসেন: খুনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বলে এজাহারে উল্লেখ করা আসামি আশরাফ হোসেন সরকারের সঙ্গে লোকমানের বিরোধও পুরোনো। সম্প্রতি এই বিরোধ আরও জোরদার হয় পৌরসভার প্রায় আট কোটি টাকার একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে। আশরাফ হোসেন মামলার দুই নম্বর আসামি আবদুল মতিন সরকারের ছোট ভাই।
সূত্র জানায়, মেয়র লোকমান হোসেন শহরের মেঘনা নদীর তীরবর্তী ব্রাহ্মণপাড়ার পাথরঘাট এলাকার যে জায়গায় প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছিলেন, এর পাশেই সরকারি জায়গা ইজারা নিয়ে ব্যবসা করছিলেন আশরাফ। কিন্তু লোকমান ওয়াটার প্ল্যান্টের জন্য আশরাফের ইজারার জমি থেকে কিছু অংশ নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে নতুন করে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
মিঞা মো. মঞ্জুর: নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মিঞা মো. মঞ্জুরের সঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমেদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে বলে অভিযোগ আছে। তিনি অন্য আসামি আশরাফেরও ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
মঞ্জুর একসময় ছাত্রদলের নরসিংদী সরকারি কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু তাঁর কনিষ্ঠ স্থানীয় বিএনপিদলীয় সাংসদ শামসুদ্দীন এছাকের ছেলে সাব্বিরকে কলেজ কমিটির সভাপতি করা হলে ক্ষুব্ধ হয়ে মঞ্জুর ছাত্রলীগে যোগ দেন। পরে তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) হন।
এক পরিবারের তিনজন আসামি এবং...: আমির হোসেন ওরফে আমু নিহত মানিক মিয়া কমিশনারের ছোট ভাই। ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি নরসিংদীতে মানিক মিয়া কমিশনার খুন হন। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটে শহরের ভেলানগরে একটি যাত্রা প্যান্ডেলে। এই হত্যাকাণ্ডের পর লোকমান হোসেন ও তাঁর ভাই কামরুজ্জামানকে প্রধান আসামি করে মামলা হয়। মামলায় বাদী ছিলেন আমির হোসেন আমু। আমির নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। একবার অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারও হন তিনি। তাঁর বাবা আজিজ মিয়া ভেলানগরের গণপিটুনিতে নিহত হন।
লোকমান হত্যা মামলার আসামি মামুন নিহত মানিক মিয়ার ছেলে। তিনি আবদুল মতিনের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত। তিনি একাধিক মামলার আসামি এবং এলাকায় মাদকাসক্ত হিসেবে পরিচিত।
লোকমান হত্যা মামলায় এই আমির হোসেন আমু, তাঁর ভাই হিরণ মিয়া ও মানিক মিয়ার ছেলে মামুনকে আসামি করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মানিক মিয়া হত্যা মামলা থেকে মুক্তি পেতে লোকমান হোসেন প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। মামলাটি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বলে প্রত্যাহার করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করেন তিনি। কিন্তু স্থানীয় প্রতিপক্ষের তৎপরতায় সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
এপিএস মুরাদ: লোকমান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মাসুদুর রহমান মুরাদ মন্ত্রীর ব্যক্তিগত একান্ত সহকারী (এপিএস)। খুনি চক্রের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে বলে অভিযোগ করেছে বাদীপক্ষ। স্থানীয় কাউরিয়াপাড়ার একটি ডাইং কারখানায় অপরাধীদের সঙ্গে তিনি আড্ডা দেন বলে অভিযোগ আছে।
কবির সরকার: আসামি কবির সরকার হচ্ছেন বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ রহমান সরকারের ছেলে। শহরের পশ্চিম কান্দাপাড়ায় জেলা আওয়ামী লীগের যে অস্থায়ী কার্যালয় আছে, তার জমিদাতা হচ্ছেন রহমান সরকার। কবির সরকার শহর যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি।
বিএনপির নূরুল ইসলাম ও তারেক আহমেদ: মামলায় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত দুজনকে আসামি করা হয়। একজন নূরুল ইসলাম, অন্যজন তারেক আহমেদ। নূরুল ইসলাম শহর বিএনপির সভাপতি। তারেক ছাত্রদলের হয়ে নরসিংদী কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। নরসিংদীর ধনাঢ্য ব্যক্তি ও শিল্পপতি তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে তারেক গত পৌর নির্বাচনে লোকমান হোসেনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, নূরুল ইসলাম সাবেক বিএনপিদলীয় সাংসদ মরহুম শামসুদ্দীন আহমেদ এছাকের ছেলে মাসুদুর রহমান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। সূত্র জানায়, নূরুল ইসলাম বর্তমানে মালয়েশিয়ায় আছেন। আরেক আসামি তারেক আহমেদ সৌদি আরবে পবিত্র হজ পালন করতে গেছেন।
প্রতিক্রিয়া: লোকমান হত্যা মামলায় মন্ত্রীর ভাইসহ আওয়ামী লীগের লোকদের আসামি করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নরসিংদী সদর আসনের সরকারদলীয় সাংসদ নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এজাহারে এভাবে নাম না দিলে ভালো হতো। আসামিদের নাম সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ায় পুলিশ একটি গণ্ডির মধ্যে আটকে গেল। এতে এটা কি সন্ত্রাসী ঘটনা, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, ব্যক্তিগত আক্রোশ নাকি দেশে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, এটা তদন্তের ক্ষেত্রে একটা জটিলতার সৃষ্টি হবে। তবে আমি এও মনে করি না যে বৃহত্তর পরিসরে তদন্তের ক্ষেত্রে এটা বাধা হবে।’
তদবির: নিহত লোকমানের পারিবারিক সূত্র জানায়, মামলার এজাহারে যাতে কারও নাম উল্লেখ না করা হয়, সে জন্য বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একজন নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা তাঁদের অনুরোধ করেছিলেন। এ নিয়ে নানামুখী তৎপরতার কারণে মামলার এজাহার তৈরি করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। শেষ পর্যন্ত আসামিদের নাম উল্লেখ করেই বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মামলা দেওয়া হয়।
No comments