মন্ত্রীর কাছে চার সাংসদের প্রশ্ন-কোনো আসামি গ্রেফতার হয়নি মামলা ডিবিতে হস্তান্তর নরসিংদীর এসপি অতিরিক্ত এসপি প্রত্যাহার by শাহেদ চৌধুরী ও প্রীতিরঞ্জন সাহা,
জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সমাবেশে দলের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর কাছে নরসিংদী পৌরসভার মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের ব্যাখ্যা চেয়েছেন সরকারি দলের সাংসদরা। তারা স্পস্ট বলেছেন, 'আমরা মন্ত্রীকে বলি, সঠিক ঘটনা তুলে ধরুন। আমরা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চাই না। দ্রুত সত্য বের করুন।' এদিকে নরসিংদী পৌরসভার মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে করা মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের কেউ গ্রেফতার হয়নি।
এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে তিন থেকে চারজন বৃহস্পতিবার রাতে নিজ বাড়িতে অবস্থান করলেও শুক্রবার সকাল থেকে
তারা আত্মগোপনে রয়েছেন। এ এজাহার নিয়ে নরসিংদীতে নতুন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তবে কেউই মুখ খুলছেন না।
লোকমান হোসেন হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় নরসিংদী রেলস্টেশন ভাংচুর ও এগার সিন্ধুর আন্তঃনগর ট্রেনে অগি্নসংযোগের ঘটনায় অজ্ঞাত ৫০০ জনকে আসামি করে দুটি মামলা করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শহরের পরিস্থিতি থমথমে ছিল। দিনের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থাকলেও সন্ধ্যার পর শহরে এক ধরনের অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। গতকালও শহরের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে শোকের প্রতীক কালো পতাকা উড়তে দেখা গেছে।
'মন্ত্রীর ব্যাখ্যা চাই' : গতকাল বিকেলে শহরের প্রধান সড়ক সদর রোডে জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সমাবেশে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর দিকে ইঙ্গিত করে নরসিংদী-৩ আসনের সাংসদ জহিরুল হক মোহন বলেন, মন্ত্রী দেশে নেই। শুক্রবার রাতে তার দেশে ফেরার কথা। লোকমান হত্যাকাবিরুদ্ধে নানা কথা উঠেছে। তাই নরসিংদীবাসী মন্ত্রীর কাছে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চায়। কে লোকমান হোসেনকে খুন করেছে, তা বলতে হবে। খুনিদের মুখোশ উন্মোচনে মন্ত্রীর ভূমিকা জানাতে হবে। জাতির সামনে মন্ত্রীর অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। তিনি আরও বলেন, খুনি যতই ক্ষমতাধর এবং তার হাত যতই লম্বা হোক না কেন তার বিচার হতেই হবে। হত্যাকারী সরকারি দলের কেউ হয়ে থাকলে তাকেও ছাড় দেওয়া চলবে না। রাজনৈতিক দলের নেতা হলেও ছাড় পাবে না খুনি।
নরসিংদী-৪ আসনের সাংসদ অ্যাডভোকেট নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনও মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকা ের বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর কাছে প্রকৃত ঘটনা জানতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, 'আমরা মন্ত্রীকে বলি, সঠিক ঘটনা তুলে ধরুন। আমরা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চাই না। দ্রুত সত্য বের করুন। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চলছে। আসল খুনিদের আড়াল করার অপচেষ্টা হচ্ছে। তাই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ও সস্তা রাজনীতি করলে চলবে না।' নরসিংদী-২ আসনের সাংসদ ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ বলেন, 'হত্যাকারী যে-ই হোক না কেন তার প্রতি নরসিংদীবাসীর কোনো অনুকম্পা ও সহানুভূতি নেই।'
নরসিংদী-১ আসনের সাংসদ লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু বীরপ্রতীক জানতে চান, 'লোকমান হত্যাকা কি রাজনৈতিক হত্যাকা ? নাকি তৃতীয় পক্ষ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা চালাচ্ছে?' তিনি লোকমান হত্যাকা ের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই তত্ত্বাবধান করছেন উলেল্গখ করে আরও বলেন, 'লোকমান হত্যার বিচারের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী দেখছেন। এ ব্যাপারে কাউকেই ছাড় দেবেন না প্রধানমন্ত্রী। যত শক্তিশালীই হোক, খুনিকে তিনি শাস্তির আওতায় আনবেন।' সাংসদ হিরু বলেন, 'খুনিদের ফাঁসির দড়িতে না ঝোলানো পর্যন্ত নরসিংদীবাসী শান্তি পাবে না। লোকমান হত্যার বিচার আদায় করতেই হবে।'
প্রতিবাদ সমাবেশে মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেনের ছোট ভাই নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ও জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজের বক্তৃতার সময় সমবেত সবাই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। শামীম নেওয়াজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সবাই স্বজন হারানোর ব্যথায় চোখের পানি ফেলেন; স্লোগান তুলে লোকমান হত্যার প্রতিবাদ জানান; হত্যাকারীদের শাস্তি চান। সমাবেশের চারপাশে বিপুলসংখ্যক পুলিশকে সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
শামীম নেওয়াজ জানতে চান, কী অপরাধ ছিল তার ভাইয়ের? তার ভাই সারাজীবন নরসিংদীতে শান্তির জন্য কাজ করেছেন, উন্নয়ন করেছেন। এর বিনিময়ে এমন অপ্রত্যাশিত মৃত্যুই কি তার প্রাপ্য ছিল। তিনি বলেন, একজন লোকমান হোসেনের জনপ্রিয়তার কারণে কারও কারও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তারাই ষড়যন্ত্র করে লোকমান হোসেনকে চিরতরে সরিয়ে দিয়েছে। শামীম নরসিংদীবাসীর কাছে লোকমান হত্যার বিচারের ভার ছেড়ে দিয়ে আরও বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই আমাদের পরিবার আশাবাদী। নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী তার কথা রাখবেন, লোকমান হোসেন হত্যার বিচার করবেন।'
শামীম নেওয়াজ বলেন, যারা লোকমান হোসেনকে খুন করে নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল এবং রাজনীতির মাঠ দখলের পাঁয়তারা করেছিলেন তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না। এক লোকমান নিহত হয়েছেন; কিন্তু নরসিংদীর প্রতিটি ঘরে লোকমানরা বেঁচে আছেন হত্যার বদলা নিতে। তার কথায়, 'আমরা লোকমান পরিবারের সদস্যরা ভীত নই। লোকমান হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছেড়ে যাব না। এ জন্য প্রয়োজনে আমরা নরসিংদীবাসীর মতো রক্ত দিতে প্রস্তুত রয়েছি।'
মঙ্গলবার রাতে স্থানীয় বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন জেলা আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হওয়ার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেয়র লোকমান হোসেন অযত্ন ও অবহেলার শিকার হয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন শামীম নেওয়াজ। তার অভিযোগ, মেয়রকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন ছিল না। সংকটাপন্ন অবস্থায় ঢাকায় নেওয়ার পথে মেয়রকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের সামনে পুলিশের গাড়ি না থাকায় অ্যাম্বুলেন্সটি যানজটে দীর্ঘ সময় আটকে ছিল।
শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান ফটিক মাস্টার এ নৃশংস হত্যাকা ের বিচার না হলে জনতা আবার ক্ষুব্ধ হবে বলে মন্তব্য করেছেন। কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আমিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, প্রকৃত খুনিদের আড়াল করা চলবে না। তাদের বিচার করতে হবে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া প্রকৃত খুনিদের বিচারে প্র্রশাসনের গাফিলতি মেনে নেওয়া হবে না বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, খুনি যতই শক্তিশালী হোক না, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।
জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদোজ্জামানের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তৃতা করেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট এসএ হাদী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া, জেলা কৃষক লীগ সভাপতি লাবিবউদ্দিন, জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহ আলম, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সাধারণ সম্পাদক রঞ্জন কুমার সাহা, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সফর আলী, সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ার, শিবপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ আলম ভূঁইয়া, অধ্যাপক অহিভূষণ চক্রবর্তী, ইঞ্জিনিয়ার শওকত আলী, অ্যাডভোকেট নাছিরুল হক ভূঁইয়া, শামসুল আলম রাখিল ও জুবায়ের আহমেদ জুয়েল।
মামলা ডিবিতে হস্তান্তর
নরসিংদী মডেল থানার ওসি আনোয়ার হোসেন জানান, মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলাটি গোয়েন্দা বিভাগে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিবির পরিদর্শক মামুনুর রশিদ ম ল বলেন, এরই মধ্যে তিনি তদন্ত শুরু করেছেন। আসামিরা যত শক্তিশালীই হোক না কেন তাদের গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানো হবে।
মামলা তদন্তের জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি এসএম কাইয়ুম মামলাটি স্পর্শকাতর মামলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন।
পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি আসাদুজ্জামান সমকালকে বলেন, মামলা ডিবিতে এসেছে। তবে ঘটনার পর থেকেই ডিবি এর ছায়াতদন্ত করে আসছিল। তদন্তে এরই মধ্যে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। শিগগির জড়িতদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, মামলা দায়েরের পর থেকেই আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। তবে এখনও এজাহারভুক্ত কোনো আসামিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এদিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা ডিবির ওসি মামুনুর রশিদ সমকালকে বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। বিভিন্ন স্থানে অভিযান চলছে। পাশাপাশি থানা পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থাও ডিবিকে সহায়তা করছে।
কবরস্থানে মানুষের ঢল : নরসিংদীবাসীর প্রিয় মানুষ দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেনকে শহরের শালিধা এলাকায় পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। দাফন করার পর থেকেই হাজার হাজার মানুষ তার কবর জিয়ারত করছেন। গতকাল জুমা নামাজ আদায়ের পর তার কবরস্থানে উপচেপড়া ভিড় ছিল। মানুষজন ফুল দিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। নামাজ আদায়ের পর শহরের প্রতিটি মসজিদে লোকমান হোসেনের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
জনপ্রিয়তাই কাল হলো লোকমানের : নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও নরসিংদী সরকারি কলেজের ভিপি শামীম নেওয়াজ জানান, সর্বশেষ পৌর মেয়র নির্বাচনে দলীয় সমর্থন পাওয়া-না পাওয়া নিয়েও লোকমানের একাধিক শত্রু তৈরি হয়েছিল। পৌর নির্বাচনে দলের সমর্থন লাভের চেষ্টা করেন মতিন সরকার। দল তাকে সমর্থন না দিয়ে লোকমান হোসেনকে সমর্থন দেওয়ায় মতিন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে লড়াই করেন এবং বহিষ্কৃত হন।
শামীম জানান, দল থেকে বহিষ্কৃত মতিন সরকার ও দলের কয়েক নেতার নিয়ন্ত্রণে নরসিংদীর কাউড়িয়াপাড়া বস্তিতে মাদক বেচাকেনা হতো। লোকমান মেয়র হওয়ার পর বস্তি তুলে দিয়ে সেখানে ঈদগাহ ময়দান তৈরি করেন। এতে তিনি জেলার অনেক নেতার রোষানলে পড়েন।
সদর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলামকে আসামি করা সম্পর্কে শামীম বলেন, তিনি এ শহরে অস্ত্রের রাজনীতি করেন। তরুণদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন। সে হিসেবে নুরুল ইসলাম এ হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন।
মামলার আসামি আওয়ামী লীগের মমতাজ উদ্দিন আহমেদকে একজন ঠা া মাথার ক্রিমিনাল হিসেবে উল্লেখ করেন শামীম। তিনি বলেন, মমতাজ এ হত্যা পরিকল্পনার সব ধরনের তথ্য প্রতিপক্ষকে সরবরাহ করেছেন। এ হত্যাকা ের আসামিদের নামের তালিকা নিয়ে দলের হাইকমান্ড কোনো চাপ দেয়নি বলে জানান শামীম।
ন্যায়বিচার নিয়ে সংশয়ে পরিবার : সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন নিহতের স্ত্রী বুগলি বেগম এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা। গতকাল শুক্রবার নিহতের স্ত্রী বুগলি বেগম ও ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম সমকালের কাছে নিজেদের আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হিসেবে কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার নাম পাওয়া গেছে। তারা সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে প্রভাবিত করে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যেতে পারেন।
নিহতের স্ত্রী বলেন, নরসিংদীতে লোকমান হোসেন ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি ছিলেন গণমানুষের নেতা। তার উত্থান ঠেকাতে একটি পক্ষ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তাই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার নিয়ে আমাদের আশঙ্কা রয়েছে। বুগলি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশা দিয়েছে বলেছেন, এ হত্যাকা ের বিচার হবে। তারপরও মনে হচ্ছে, যতই দিন গড়াবে এ বিষয়টি ততই আড়ালে চলে যাবে। এক সময় দেখা যাবে, লোকমান হত্যার সুষ্ঠু বিচারের পরিবর্তে আমরা পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে গেছি। আশঙ্কার কারণ হিসেবে বলেন, হত্যাকাণ্ডের পেছনে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে দলের কয়েকজন নেতার নাম এসেছে। তারা দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে প্রভাবিত করতে পারেন। তিনি এ বিপদের সময় গণমাধ্যমসহ সবাইকে তাদের পাশে থাকার অনুরোধ জানান।
ট্রেনে আগুন ও স্টেশন ভাংচুরে দুই মামলা : বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন ভাংচুর ও এগারো সিন্ধুর ট্রেনে অগি্নসংযোগের ঘটনায় অজ্ঞাত পাঁচশ' জনকে আসামি করে দুটি মামলা হয়েছে। নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মরণ চন্দ্র দাস বাদী হয়ে ৩ নভেম্বর ভৈরব রেলওয়ে থানায় একটি মামলা করেন। তিনি মামলায় উল্লেখ করেন, '১ নভেম্বর রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার সময় পি/ম্যান আবদুল লতিফ, রিলে রুমের এম/এস আনোয়ার ও খালাসি খাইরুলসহ লোকজনের মাধ্যমে তিনি ও সহকারী স্টেশন মাস্টার আসাদুল হক জানতে পারেন, নরসিংদী পৌর মেয়র লোকমান হোসেন সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। শহরে গ১টার দিকে ৪০০-৫০০ জন উচ্ছৃঙ্খল জনতা কলেজ গেট হতে রাস্তার দু'পাশে থাকা দোকানপাট ভাংচুর শুরু করে। বেআইনি জনতা লাঠি, শাবল, হকিস্টিকসহ অন্যান্য দেশি অস্ত্রশস্ত্রসহ পল্গাটফর্মে অনধিকারভাবে প্রবেশ করে অফিস কক্ষে রিলে রুমসহ প্রতিটি রুমে ৫০-৬০ জন উচ্ছৃঙ্খল জনতা প্রবেশ করে। অফিসে থাকা ফার্নিচার, আসবাবপত্র, কাগজপত্র অফিস হতে বের করে পল্গাটফর্মে এনে আগুন ধরিয়ে দেয়। কিছু উচ্ছৃঙ্খল জনতা রিলে রুম ও কিছু গুদাম রুমে পেট্রল জাতীয় দাহ্য পদার্থ দ্বারা আগুন ধরিয়ে দিয়ে রিলে রুম ও অন্যান্য রুমে ইলেকট্রিক মেশিনপত্র ও সিগন্যালের মেশিনপত্রসহ যাবতীয় আসবাবপত্র পুড়িয়ে দেয়। স্টেশনের প্রশাসনিক ভবনসহ সমস্ত রুমের দরজা ও জানালা ভাংচুর করে অনুমান ৪ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। ঘটনার সময় পল্গাটফর্মে কর্তব্যরত রেলওয়ে পুলিশ ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রতিরোধে আপ্রাণ চেষ্টা করলেও প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। উচ্ছৃঙ্খল জনতা আধাঘণ্টা নাশকতা চালিয়ে ক্ষতিসাধন করার পর পল্গাটফর্ম হতে বের হয়ে স্টেশন রোডে আশপাশের এলাকায় দোকানপাট ভাংচুর করতে করতে বাজির মোড়ের দিকে চলে যায়। এতে ট্রেনলাইন বিকল হয়ে পড়ে এবং সিগন্যাল বাতি সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ট্রেন চলাচল বিঘ্নসহ যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। উচ্ছৃঙ্খল জনতা পল্গাটফর্মে ও অফিস কক্ষে প্রবেশ করে বৈদ্যুতিক সকল বাল্ব ভেঙে ফেলেছে।' এদিকে এগারো সিন্ধুর আন্তঃনগর ট্রেনের পরিচালক আবদুল বারি ট্রেনটিতে ভাংচুর এবং অগি্নসংযোগের ঘটনায় আরেকটি মামলা করেছেন।
এজাহারভুক্ত আসামিরা আত্মগোপনে : নরসিংদী পৌরসভার মেয়র জনপ্রিয় জননেতা আলহাজ লোকমান হোসেন হত্যাকা ে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৪ জনকে আসামি করে বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় এজাহার দায়ের করেছেন মেয়রের ছোট ভাই ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি কামরুজ্জামান কামরুল। এজাহারে হত্যাকা ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ছোট ভাই এবং নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
মামলার বাদী কামরুজ্জামান কামরুল এজাহারে বলেছেন, আসন্ন নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে সামনে রেখে মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালিয়ে আসছিলেন। অন্যদিকে সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু নিজেও ওই পদে প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালাচ্ছিলেন। জনসমর্থন না পেয়ে এবং আলহাজ লোকমান হোসেনের জনসমর্থনে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিতেন।
মন্ত্রীর এপিএস মাসুদুর রহমান মুরাদসহ মোট ১৪ জন এ মামলার আসামি। এজাহারে জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক তারেক আহমদ এবং শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলামকেও আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়াও আসামির তালিকায় আছেন নরসিংদী পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুল মতিন সরকার ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া। আসামিদের মধ্যে ১১ জন আওয়ামী লীগের এবং দু'জন বিএনপির। অন্যজন প্রেসকর্মী। গতকাল রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। তারা সবাই আত্মগোপনে রয়েছেন।
আসামিরা যা বললেন : লোকমান হত্যা মামলার আসামিরা আত্মগোপনে থাকলেও কমবেশি সবাই টেলিফোনে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, মেয়র লোকমান হোসেনের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। এমন জনপ্রিয় নেতাকে খুন করার মতো ঘৃণ্য চিন্তা কেউ কল্পনায়ও আনতে পারে না। মন্ত্রীর এপিএস মাসুদুর রহমান মুরাদ কিছুদিন ধরে মন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশে অবস্থান করছেন।
মামলার দ্বিতীয় আসামি নরসিংদী পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুল মতিন সরকার। গত পৌরসভা নির্বাচনে তিনি লোকমান হোসেনের প্রতিপক্ষ ছিলেন। তিনি বলেছেন, মেয়র লোকমান হোসেনের সঙ্গে তার কোনো বিরোধ নেই। আবদুল মতিন সরকারের ছোট ভাই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ হোসেন সরকার ওরফে আশরাফুল সরকারও মামলার আসামি। তার ভাই শরীফ হোসেন সরকার বলেছেন, প্রকৃত খুনিদের আড়াল করতেই তার দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।
মামলার ৮ নম্বর আসামি নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও স্থানীয় বিএনপি নেতা তারেক আহমদের স্ত্রী বেগম তারেক বলেছেন, তার স্বামী হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন। তিনি এখন হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। তারেক আহমেদ গত পৌরসভা নির্বাচনে লোকমান হোসেনের প্রতিপক্ষ ছিলেন। আরেক আসামি শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলামের প্রতিবেশী বাবুল মিয়া জানিয়েছেন, তিনি মালয়েশিয়ায় আছেন। মামলার আসামি জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক মোবারক হোসেন মোবা মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন।
শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়াও মামলার আসামি। লোকমান হত্যাকা েহোসেনের সঙ্গে তিনি রাজনীতি করেছেন। গেল নির্বাচনে তার পাশে থেকেছেন। অথচ তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেন হত্যা মামলার আসামি হিরণ মিয়া, আমির হোসেন আমুর ভাই ও মামুনের পিতা ওয়ার্ড কাউন্সিলর মানিক মিয়া ২০০১ সালের ৪ জানুয়ারি ভেলানগর এলাকায় নিহত হন। এ মামলার আসামি লোকমান হোসেন।
এসপি ও অতিরিক্ত এসপি প্রত্যাহার
পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থতার অভিযোগে নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঁইয়া এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) এনামুল কবিরকে (অপরাধ শাখা) প্রত্যাহার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাককে গতকাল শুক্রবার বদলি করা হয়েছে। নরসিংদী জেলার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদারকে।
পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার সমকালকে বলেন, পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঁইয়া এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এনামুল কবির_ এ দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে তাদের চাকরি পুলিশ সদর দফতরে ন্যস্ত করা হয়। একই সঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় কুমার বসাককে ফরিদপুরে বদলি করা হয়েছে এবং ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদারকে নরসিংদীর (চলতি) পুলিশ সুপারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে নিহত পৌর মেয়র লোকমান হোসেন ও পুলিশ সুপার আক্কাছ উদ্দিন ভূঁইয়ার মধ্যে বনিবনা ছিল না। নানা কারণে তাদের মধ্যে মতবিরোধ চলে আসছিল। মঙ্গলবার রাতে মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের গুলিতে লোকমান নিহত হওয়ার পর নরসিংদীতে ব্যাপক ভাংচুর, অগি্নসংযোগ ও গণবিক্ষোভের ঘটনা সৃষ্টি হলেও উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় পুলিশ প্রশাসন। পাশাপাশি আগাম গোয়েন্দা তথ্য দিতেও ব্যর্থ হয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) এনামুল কবির।
তারা আত্মগোপনে রয়েছেন। এ এজাহার নিয়ে নরসিংদীতে নতুন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তবে কেউই মুখ খুলছেন না।
লোকমান হোসেন হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় নরসিংদী রেলস্টেশন ভাংচুর ও এগার সিন্ধুর আন্তঃনগর ট্রেনে অগি্নসংযোগের ঘটনায় অজ্ঞাত ৫০০ জনকে আসামি করে দুটি মামলা করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শহরের পরিস্থিতি থমথমে ছিল। দিনের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থাকলেও সন্ধ্যার পর শহরে এক ধরনের অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। গতকালও শহরের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে শোকের প্রতীক কালো পতাকা উড়তে দেখা গেছে।
'মন্ত্রীর ব্যাখ্যা চাই' : গতকাল বিকেলে শহরের প্রধান সড়ক সদর রোডে জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সমাবেশে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর দিকে ইঙ্গিত করে নরসিংদী-৩ আসনের সাংসদ জহিরুল হক মোহন বলেন, মন্ত্রী দেশে নেই। শুক্রবার রাতে তার দেশে ফেরার কথা। লোকমান হত্যাকাবিরুদ্ধে নানা কথা উঠেছে। তাই নরসিংদীবাসী মন্ত্রীর কাছে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চায়। কে লোকমান হোসেনকে খুন করেছে, তা বলতে হবে। খুনিদের মুখোশ উন্মোচনে মন্ত্রীর ভূমিকা জানাতে হবে। জাতির সামনে মন্ত্রীর অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। তিনি আরও বলেন, খুনি যতই ক্ষমতাধর এবং তার হাত যতই লম্বা হোক না কেন তার বিচার হতেই হবে। হত্যাকারী সরকারি দলের কেউ হয়ে থাকলে তাকেও ছাড় দেওয়া চলবে না। রাজনৈতিক দলের নেতা হলেও ছাড় পাবে না খুনি।
নরসিংদী-৪ আসনের সাংসদ অ্যাডভোকেট নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনও মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকা ের বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর কাছে প্রকৃত ঘটনা জানতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, 'আমরা মন্ত্রীকে বলি, সঠিক ঘটনা তুলে ধরুন। আমরা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চাই না। দ্রুত সত্য বের করুন। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চলছে। আসল খুনিদের আড়াল করার অপচেষ্টা হচ্ছে। তাই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ও সস্তা রাজনীতি করলে চলবে না।' নরসিংদী-২ আসনের সাংসদ ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ বলেন, 'হত্যাকারী যে-ই হোক না কেন তার প্রতি নরসিংদীবাসীর কোনো অনুকম্পা ও সহানুভূতি নেই।'
নরসিংদী-১ আসনের সাংসদ লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু বীরপ্রতীক জানতে চান, 'লোকমান হত্যাকা কি রাজনৈতিক হত্যাকা ? নাকি তৃতীয় পক্ষ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা চালাচ্ছে?' তিনি লোকমান হত্যাকা ের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই তত্ত্বাবধান করছেন উলেল্গখ করে আরও বলেন, 'লোকমান হত্যার বিচারের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী দেখছেন। এ ব্যাপারে কাউকেই ছাড় দেবেন না প্রধানমন্ত্রী। যত শক্তিশালীই হোক, খুনিকে তিনি শাস্তির আওতায় আনবেন।' সাংসদ হিরু বলেন, 'খুনিদের ফাঁসির দড়িতে না ঝোলানো পর্যন্ত নরসিংদীবাসী শান্তি পাবে না। লোকমান হত্যার বিচার আদায় করতেই হবে।'
প্রতিবাদ সমাবেশে মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেনের ছোট ভাই নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ও জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজের বক্তৃতার সময় সমবেত সবাই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। শামীম নেওয়াজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সবাই স্বজন হারানোর ব্যথায় চোখের পানি ফেলেন; স্লোগান তুলে লোকমান হত্যার প্রতিবাদ জানান; হত্যাকারীদের শাস্তি চান। সমাবেশের চারপাশে বিপুলসংখ্যক পুলিশকে সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
শামীম নেওয়াজ জানতে চান, কী অপরাধ ছিল তার ভাইয়ের? তার ভাই সারাজীবন নরসিংদীতে শান্তির জন্য কাজ করেছেন, উন্নয়ন করেছেন। এর বিনিময়ে এমন অপ্রত্যাশিত মৃত্যুই কি তার প্রাপ্য ছিল। তিনি বলেন, একজন লোকমান হোসেনের জনপ্রিয়তার কারণে কারও কারও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তারাই ষড়যন্ত্র করে লোকমান হোসেনকে চিরতরে সরিয়ে দিয়েছে। শামীম নরসিংদীবাসীর কাছে লোকমান হত্যার বিচারের ভার ছেড়ে দিয়ে আরও বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই আমাদের পরিবার আশাবাদী। নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী তার কথা রাখবেন, লোকমান হোসেন হত্যার বিচার করবেন।'
শামীম নেওয়াজ বলেন, যারা লোকমান হোসেনকে খুন করে নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল এবং রাজনীতির মাঠ দখলের পাঁয়তারা করেছিলেন তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না। এক লোকমান নিহত হয়েছেন; কিন্তু নরসিংদীর প্রতিটি ঘরে লোকমানরা বেঁচে আছেন হত্যার বদলা নিতে। তার কথায়, 'আমরা লোকমান পরিবারের সদস্যরা ভীত নই। লোকমান হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছেড়ে যাব না। এ জন্য প্রয়োজনে আমরা নরসিংদীবাসীর মতো রক্ত দিতে প্রস্তুত রয়েছি।'
মঙ্গলবার রাতে স্থানীয় বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন জেলা আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হওয়ার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেয়র লোকমান হোসেন অযত্ন ও অবহেলার শিকার হয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন শামীম নেওয়াজ। তার অভিযোগ, মেয়রকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন ছিল না। সংকটাপন্ন অবস্থায় ঢাকায় নেওয়ার পথে মেয়রকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের সামনে পুলিশের গাড়ি না থাকায় অ্যাম্বুলেন্সটি যানজটে দীর্ঘ সময় আটকে ছিল।
শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান ফটিক মাস্টার এ নৃশংস হত্যাকা ের বিচার না হলে জনতা আবার ক্ষুব্ধ হবে বলে মন্তব্য করেছেন। কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আমিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, প্রকৃত খুনিদের আড়াল করা চলবে না। তাদের বিচার করতে হবে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া প্রকৃত খুনিদের বিচারে প্র্রশাসনের গাফিলতি মেনে নেওয়া হবে না বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, খুনি যতই শক্তিশালী হোক না, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।
জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদোজ্জামানের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তৃতা করেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট এসএ হাদী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া, জেলা কৃষক লীগ সভাপতি লাবিবউদ্দিন, জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহ আলম, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সাধারণ সম্পাদক রঞ্জন কুমার সাহা, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সফর আলী, সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ার, শিবপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ আলম ভূঁইয়া, অধ্যাপক অহিভূষণ চক্রবর্তী, ইঞ্জিনিয়ার শওকত আলী, অ্যাডভোকেট নাছিরুল হক ভূঁইয়া, শামসুল আলম রাখিল ও জুবায়ের আহমেদ জুয়েল।
মামলা ডিবিতে হস্তান্তর
নরসিংদী মডেল থানার ওসি আনোয়ার হোসেন জানান, মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলাটি গোয়েন্দা বিভাগে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিবির পরিদর্শক মামুনুর রশিদ ম ল বলেন, এরই মধ্যে তিনি তদন্ত শুরু করেছেন। আসামিরা যত শক্তিশালীই হোক না কেন তাদের গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানো হবে।
মামলা তদন্তের জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি এসএম কাইয়ুম মামলাটি স্পর্শকাতর মামলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন।
পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি আসাদুজ্জামান সমকালকে বলেন, মামলা ডিবিতে এসেছে। তবে ঘটনার পর থেকেই ডিবি এর ছায়াতদন্ত করে আসছিল। তদন্তে এরই মধ্যে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। শিগগির জড়িতদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, মামলা দায়েরের পর থেকেই আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। তবে এখনও এজাহারভুক্ত কোনো আসামিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এদিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা ডিবির ওসি মামুনুর রশিদ সমকালকে বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। বিভিন্ন স্থানে অভিযান চলছে। পাশাপাশি থানা পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থাও ডিবিকে সহায়তা করছে।
কবরস্থানে মানুষের ঢল : নরসিংদীবাসীর প্রিয় মানুষ দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেনকে শহরের শালিধা এলাকায় পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। দাফন করার পর থেকেই হাজার হাজার মানুষ তার কবর জিয়ারত করছেন। গতকাল জুমা নামাজ আদায়ের পর তার কবরস্থানে উপচেপড়া ভিড় ছিল। মানুষজন ফুল দিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। নামাজ আদায়ের পর শহরের প্রতিটি মসজিদে লোকমান হোসেনের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
জনপ্রিয়তাই কাল হলো লোকমানের : নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও নরসিংদী সরকারি কলেজের ভিপি শামীম নেওয়াজ জানান, সর্বশেষ পৌর মেয়র নির্বাচনে দলীয় সমর্থন পাওয়া-না পাওয়া নিয়েও লোকমানের একাধিক শত্রু তৈরি হয়েছিল। পৌর নির্বাচনে দলের সমর্থন লাভের চেষ্টা করেন মতিন সরকার। দল তাকে সমর্থন না দিয়ে লোকমান হোসেনকে সমর্থন দেওয়ায় মতিন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে লড়াই করেন এবং বহিষ্কৃত হন।
শামীম জানান, দল থেকে বহিষ্কৃত মতিন সরকার ও দলের কয়েক নেতার নিয়ন্ত্রণে নরসিংদীর কাউড়িয়াপাড়া বস্তিতে মাদক বেচাকেনা হতো। লোকমান মেয়র হওয়ার পর বস্তি তুলে দিয়ে সেখানে ঈদগাহ ময়দান তৈরি করেন। এতে তিনি জেলার অনেক নেতার রোষানলে পড়েন।
সদর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলামকে আসামি করা সম্পর্কে শামীম বলেন, তিনি এ শহরে অস্ত্রের রাজনীতি করেন। তরুণদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন। সে হিসেবে নুরুল ইসলাম এ হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন।
মামলার আসামি আওয়ামী লীগের মমতাজ উদ্দিন আহমেদকে একজন ঠা া মাথার ক্রিমিনাল হিসেবে উল্লেখ করেন শামীম। তিনি বলেন, মমতাজ এ হত্যা পরিকল্পনার সব ধরনের তথ্য প্রতিপক্ষকে সরবরাহ করেছেন। এ হত্যাকা ের আসামিদের নামের তালিকা নিয়ে দলের হাইকমান্ড কোনো চাপ দেয়নি বলে জানান শামীম।
ন্যায়বিচার নিয়ে সংশয়ে পরিবার : সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন নিহতের স্ত্রী বুগলি বেগম এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা। গতকাল শুক্রবার নিহতের স্ত্রী বুগলি বেগম ও ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম সমকালের কাছে নিজেদের আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হিসেবে কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার নাম পাওয়া গেছে। তারা সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে প্রভাবিত করে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যেতে পারেন।
নিহতের স্ত্রী বলেন, নরসিংদীতে লোকমান হোসেন ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি ছিলেন গণমানুষের নেতা। তার উত্থান ঠেকাতে একটি পক্ষ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তাই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার নিয়ে আমাদের আশঙ্কা রয়েছে। বুগলি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশা দিয়েছে বলেছেন, এ হত্যাকা ের বিচার হবে। তারপরও মনে হচ্ছে, যতই দিন গড়াবে এ বিষয়টি ততই আড়ালে চলে যাবে। এক সময় দেখা যাবে, লোকমান হত্যার সুষ্ঠু বিচারের পরিবর্তে আমরা পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে গেছি। আশঙ্কার কারণ হিসেবে বলেন, হত্যাকাণ্ডের পেছনে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে দলের কয়েকজন নেতার নাম এসেছে। তারা দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে প্রভাবিত করতে পারেন। তিনি এ বিপদের সময় গণমাধ্যমসহ সবাইকে তাদের পাশে থাকার অনুরোধ জানান।
ট্রেনে আগুন ও স্টেশন ভাংচুরে দুই মামলা : বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন ভাংচুর ও এগারো সিন্ধুর ট্রেনে অগি্নসংযোগের ঘটনায় অজ্ঞাত পাঁচশ' জনকে আসামি করে দুটি মামলা হয়েছে। নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মরণ চন্দ্র দাস বাদী হয়ে ৩ নভেম্বর ভৈরব রেলওয়ে থানায় একটি মামলা করেন। তিনি মামলায় উল্লেখ করেন, '১ নভেম্বর রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার সময় পি/ম্যান আবদুল লতিফ, রিলে রুমের এম/এস আনোয়ার ও খালাসি খাইরুলসহ লোকজনের মাধ্যমে তিনি ও সহকারী স্টেশন মাস্টার আসাদুল হক জানতে পারেন, নরসিংদী পৌর মেয়র লোকমান হোসেন সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। শহরে গ১টার দিকে ৪০০-৫০০ জন উচ্ছৃঙ্খল জনতা কলেজ গেট হতে রাস্তার দু'পাশে থাকা দোকানপাট ভাংচুর শুরু করে। বেআইনি জনতা লাঠি, শাবল, হকিস্টিকসহ অন্যান্য দেশি অস্ত্রশস্ত্রসহ পল্গাটফর্মে অনধিকারভাবে প্রবেশ করে অফিস কক্ষে রিলে রুমসহ প্রতিটি রুমে ৫০-৬০ জন উচ্ছৃঙ্খল জনতা প্রবেশ করে। অফিসে থাকা ফার্নিচার, আসবাবপত্র, কাগজপত্র অফিস হতে বের করে পল্গাটফর্মে এনে আগুন ধরিয়ে দেয়। কিছু উচ্ছৃঙ্খল জনতা রিলে রুম ও কিছু গুদাম রুমে পেট্রল জাতীয় দাহ্য পদার্থ দ্বারা আগুন ধরিয়ে দিয়ে রিলে রুম ও অন্যান্য রুমে ইলেকট্রিক মেশিনপত্র ও সিগন্যালের মেশিনপত্রসহ যাবতীয় আসবাবপত্র পুড়িয়ে দেয়। স্টেশনের প্রশাসনিক ভবনসহ সমস্ত রুমের দরজা ও জানালা ভাংচুর করে অনুমান ৪ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। ঘটনার সময় পল্গাটফর্মে কর্তব্যরত রেলওয়ে পুলিশ ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রতিরোধে আপ্রাণ চেষ্টা করলেও প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। উচ্ছৃঙ্খল জনতা আধাঘণ্টা নাশকতা চালিয়ে ক্ষতিসাধন করার পর পল্গাটফর্ম হতে বের হয়ে স্টেশন রোডে আশপাশের এলাকায় দোকানপাট ভাংচুর করতে করতে বাজির মোড়ের দিকে চলে যায়। এতে ট্রেনলাইন বিকল হয়ে পড়ে এবং সিগন্যাল বাতি সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ট্রেন চলাচল বিঘ্নসহ যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। উচ্ছৃঙ্খল জনতা পল্গাটফর্মে ও অফিস কক্ষে প্রবেশ করে বৈদ্যুতিক সকল বাল্ব ভেঙে ফেলেছে।' এদিকে এগারো সিন্ধুর আন্তঃনগর ট্রেনের পরিচালক আবদুল বারি ট্রেনটিতে ভাংচুর এবং অগি্নসংযোগের ঘটনায় আরেকটি মামলা করেছেন।
এজাহারভুক্ত আসামিরা আত্মগোপনে : নরসিংদী পৌরসভার মেয়র জনপ্রিয় জননেতা আলহাজ লোকমান হোসেন হত্যাকা ে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৪ জনকে আসামি করে বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় এজাহার দায়ের করেছেন মেয়রের ছোট ভাই ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি কামরুজ্জামান কামরুল। এজাহারে হত্যাকা ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ছোট ভাই এবং নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
মামলার বাদী কামরুজ্জামান কামরুল এজাহারে বলেছেন, আসন্ন নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে সামনে রেখে মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালিয়ে আসছিলেন। অন্যদিকে সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু নিজেও ওই পদে প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালাচ্ছিলেন। জনসমর্থন না পেয়ে এবং আলহাজ লোকমান হোসেনের জনসমর্থনে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিতেন।
মন্ত্রীর এপিএস মাসুদুর রহমান মুরাদসহ মোট ১৪ জন এ মামলার আসামি। এজাহারে জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক তারেক আহমদ এবং শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলামকেও আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়াও আসামির তালিকায় আছেন নরসিংদী পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুল মতিন সরকার ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া। আসামিদের মধ্যে ১১ জন আওয়ামী লীগের এবং দু'জন বিএনপির। অন্যজন প্রেসকর্মী। গতকাল রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। তারা সবাই আত্মগোপনে রয়েছেন।
আসামিরা যা বললেন : লোকমান হত্যা মামলার আসামিরা আত্মগোপনে থাকলেও কমবেশি সবাই টেলিফোনে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, মেয়র লোকমান হোসেনের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। এমন জনপ্রিয় নেতাকে খুন করার মতো ঘৃণ্য চিন্তা কেউ কল্পনায়ও আনতে পারে না। মন্ত্রীর এপিএস মাসুদুর রহমান মুরাদ কিছুদিন ধরে মন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশে অবস্থান করছেন।
মামলার দ্বিতীয় আসামি নরসিংদী পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুল মতিন সরকার। গত পৌরসভা নির্বাচনে তিনি লোকমান হোসেনের প্রতিপক্ষ ছিলেন। তিনি বলেছেন, মেয়র লোকমান হোসেনের সঙ্গে তার কোনো বিরোধ নেই। আবদুল মতিন সরকারের ছোট ভাই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ হোসেন সরকার ওরফে আশরাফুল সরকারও মামলার আসামি। তার ভাই শরীফ হোসেন সরকার বলেছেন, প্রকৃত খুনিদের আড়াল করতেই তার দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।
মামলার ৮ নম্বর আসামি নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও স্থানীয় বিএনপি নেতা তারেক আহমদের স্ত্রী বেগম তারেক বলেছেন, তার স্বামী হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন। তিনি এখন হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। তারেক আহমেদ গত পৌরসভা নির্বাচনে লোকমান হোসেনের প্রতিপক্ষ ছিলেন। আরেক আসামি শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলামের প্রতিবেশী বাবুল মিয়া জানিয়েছেন, তিনি মালয়েশিয়ায় আছেন। মামলার আসামি জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক মোবারক হোসেন মোবা মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন।
শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়াও মামলার আসামি। লোকমান হত্যাকা েহোসেনের সঙ্গে তিনি রাজনীতি করেছেন। গেল নির্বাচনে তার পাশে থেকেছেন। অথচ তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেন হত্যা মামলার আসামি হিরণ মিয়া, আমির হোসেন আমুর ভাই ও মামুনের পিতা ওয়ার্ড কাউন্সিলর মানিক মিয়া ২০০১ সালের ৪ জানুয়ারি ভেলানগর এলাকায় নিহত হন। এ মামলার আসামি লোকমান হোসেন।
এসপি ও অতিরিক্ত এসপি প্রত্যাহার
পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থতার অভিযোগে নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঁইয়া এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) এনামুল কবিরকে (অপরাধ শাখা) প্রত্যাহার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাককে গতকাল শুক্রবার বদলি করা হয়েছে। নরসিংদী জেলার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদারকে।
পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার সমকালকে বলেন, পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঁইয়া এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এনামুল কবির_ এ দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে তাদের চাকরি পুলিশ সদর দফতরে ন্যস্ত করা হয়। একই সঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় কুমার বসাককে ফরিদপুরে বদলি করা হয়েছে এবং ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদারকে নরসিংদীর (চলতি) পুলিশ সুপারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে নিহত পৌর মেয়র লোকমান হোসেন ও পুলিশ সুপার আক্কাছ উদ্দিন ভূঁইয়ার মধ্যে বনিবনা ছিল না। নানা কারণে তাদের মধ্যে মতবিরোধ চলে আসছিল। মঙ্গলবার রাতে মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের গুলিতে লোকমান নিহত হওয়ার পর নরসিংদীতে ব্যাপক ভাংচুর, অগি্নসংযোগ ও গণবিক্ষোভের ঘটনা সৃষ্টি হলেও উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় পুলিশ প্রশাসন। পাশাপাশি আগাম গোয়েন্দা তথ্য দিতেও ব্যর্থ হয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) এনামুল কবির।
No comments