মিরসরাইয়ের পাহাড়ে 'বাংকার'-র‌্যাব বলছে, জঙ্গি তৎপরতার অংশ হতে পারে by মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন,

ট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার দুটি পাহাড়ে রহস্যজনক চারটি সুড়ঙ্গ পাওয়া গেছে। স্থানীয় লোকজন বলছে এগুলো বাংকার। জঙ্গিরা তাদের গোপন তৎপরতার অংশ হিসেবে এগুলো খনন করেছে বলে মনে করছে তারা। ইতিমধ্যে পুলিশ ও র‌্যাব খোঁজখবর নিয়েছে। পুলিশ বলছে, মাদকাসক্তরা এই সুড়ঙ্গ করে থাকতে পারে। র‌্যাব বলেছে, এগুলো সুড়ঙ্গ। কোনো জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতার অংশ হতে পারে এগুলো।জানা যায়, উপজেলার উত্তর তালবাড়িয়া এলাকার মন্দিরা পাহাড়ে প্রথম একটি সুড়ঙ্গের খোঁজ পায় স্থানীয় লোকজন। এরপর সেখানে আরো দুটি সুড়ঙ্গ পাওয়া যায়। পাহাড় কেটে এসব সুড়ঙ্গ করা হয়েছে। এর মধ্যে আরেকটি সুড়ঙ্গ পাওয়া গেছে কাছের বদরখোঁ পাহাড়ে।


অন্য পাহাড়গুলোতেও সুড়ঙ্গ থাকতে পারে_এমন ধারণা করছে স্থানীয় বাসিন্দারা। রহস্যজনক এসব সুড়ঙ্গ দেখে উপজেলার সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। বাজার, দোকান, রাস্তাঘাটসহ সর্বত্রই এ নিয়ে আলোচনা চলছে। তাদের ভাষায়, 'বাংকারের পাহাড়' কাহিনী।
গত বুধবার বিকেলে মন্দিরা পাহাড়ের একটি সুড়ঙ্গ পরিদর্শন শেষে র‌্যাব-৭-এর উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) ফরহাদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, নিশ্চয়ই এটি কোনো জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতার অংশ। নেহায়েত সাধারণ মানুষ এমন ঘটনা ঘটাতে পারে না। তাদের পরিমাপে মন্দিরা পাহাড়ে প্রথম পাওয়া ওই সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট ও প্রস্থ তিন ফুট।
মন্দিরা পাহাড়ের কিছু দক্ষিণে অন্য একটি পাহাড়ে আরো বড় সুড়ঙ্গ পাওয়া গেছে। গতকাল শুক্রবার এ প্রতিবেদক সরেজমিন গিয়ে দেখতে পান, দক্ষিণ তালবাড়িয়ার বদরখোঁ পাহাড়ের ওই সুড়ঙ্গ ঘিরেও মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে উত্তেজনা। স্থানীয় লোকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, পরিদর্শনের পর এখন পর্যন্ত পুলিশ রহস্যের কোনো সুরাহা করতে পারেনি। তাদের অভিযোগ, পুলিশ বিষয়টি আন্তরিকভাবে আমলে নেয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা সনজিৎ বিশ্বাস, শেখ নবী, জয়নাল আবেদীন, মো. মিয়ন বলেন, তাঁরা শুনেছেন এসব 'বাংকারে' অস্ত্র মজুদ করে রাখা হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে জঙ্গিদের হামলা শুরু হতে পারে। এমন খবরে এলাকায় কিছুটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিনভর পাহাড়ের আশপাশে স্থানীয় কৃষকরা কাজ করেন। পাশের জমিতে রাতের বেলায় অনেকেই ধান পাহারা দেন। কিন্তু 'বাংকার' খননের বিষয়টি কেউই আঁচ করতে পারেননি।
স্থানীয় বাসিন্দা সাইফুল্লাহ দিদার, নাজিম উদ্দিন, ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিনসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসা উৎসুক ব্যক্তিরা কালের কণ্ঠকে বলেন, এই 'বাংকারের' রহস্য উন্মোচন হওয়া দরকার।
অতীতের বিভিন্ন তৎপরতা : কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯০ সাল থেকে মিরসরাইয়ের দুর্গম পাহাড়ে সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর তৎপরতা শুরু হয়। সর্বশেষ ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় র‌্যাব-৭-এর কর্মকর্তারা মিরসরাইয়ের সীমান্তবর্তী কয়লা এলাকার পাহাড়ে অবস্থান নেওয়া ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি সংগঠনের ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেয়।
আরো জানা যায়, ১৯৯০ সালে 'যুবকমান্ড' নামে সন্ত্রাসী দল মধ্যম তালবাড়িয়ার একটি পাহাড়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিত। খবর পেয়ে মিরসরাই থানার তখনকার ওসি মাহফুজুল হকের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল অভিযান চালিয়ে 'যুবকমান্ডের' সেই আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়।
২০০১ সালে নিজামপুরের পাহাড়ি অঞ্চলে আস্তানা গাড়ে 'আল-খিদমত' নামের ওই সংগঠনের অস্ত্রধারীরা। সংগঠনটির প্রধান ছিলেন ওই সময়ের শিবির ক্যাডার কায়সার। তারা রাতের বেলায় পাহাড়ের ঢালে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিত। পুলিশের তৎপরতায় ওই আস্তানাটিও গুটিয়ে যায়।
নতুন করে আবারও কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠী তৎপর হয়েছে এবং তারাই এসব সুড়ঙ্গ করেছে_এমন আশঙ্কা স্থানীয় লোকজনের। মিরসরাই সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিষয়টি সত্যিই আতঙ্কের। এটি উদ্বেগজনকও। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এর রহস্য উদ্ঘাটনে তৎপর হওয়া জরুরি।'
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের উদ্বেগ : র‌্যাবের ধারণা অনুযায়ী সুড়ঙ্গ তৈরি করা যদি জঙ্গি তৎপরতারই অংশ হয়, তবে বিষয়টি খুবই উদ্বেগের বলে মন্তব্য করেছেন মিরসরাই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কবির আহাম্মদ। তিনি বলেন, 'প্রথম বাংকারের খবরটি শুনেই রহস্যজনক মনে হয়েছে। এরপর আরো তিনটি বাংকার পাওয়ার খবর পেয়েছি। গত ৩১ অক্টোবর উপজেলা সম্মেলনকক্ষে মাসিক সমন্বয় সভায় বাংকার তৈরির বিষয়টি উত্থাপন করি। কিন্তু ওসি বিষয়টি আমলে নেয়া হয়নি।'
পাশেই 'খুনের পাহাড়' : মন্দিরা পাহাড় থেকে একটু উত্তরে গেলেই পড়ে 'খুনের পাহাড়'। এ পাহাড়ে খুন হয়, অন্যত্র খুন করে লাশ এখানে ফেলে যায় এবং দূর থেকে অপহরণ করে এখানে জিম্মি করে রাখা হয়। এ নিয়ে গত বছরের ২৩ জুন কালে কণ্ঠে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়।
মন্দিরা পাহাড়ে সুড়ঙ্গ পাওয়ার ঘটনায় এলাকাবাসী মনে করছে ওই পাহাড়ে খুনের বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ায় চক্রটি বিকল্প হিসেবে মন্দিরা পাহাড়কে বেছে নিতে পারে।
পুলিশের ভূমিকা : গত ২৯ অক্টোবর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মিরসরাই থানার ওসি ইফতেখার হাসান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, 'এটি স্রেফ মাদকসেবীদের কাণ্ড।'
এরপর স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছ থেকে খবর পেয়ে গত রবিবার বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন মিরসরাই-সীতাকুণ্ড জোনের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) রুহুল আমিন সিদ্দিকী।
সুড়ঙ্গের কাছাকাছি যাননি জানিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'থানা পুলিশের কয়েকজন বাংকারটি দেখে এসেছেন। অনুমাননির্ভর কিছু বলা যাচ্ছে না।'
উপজেলার মাসিক সমন্বয় সভায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কবির আহাম্মদ উদ্বেগ প্রকাশ করে সুড়ঙ্গের বিষয়টি তুলে ধরেন। এ সময় ওসি ইফতেখার হাসান এটি আমলে না নিয়ে বলেন, '১২ থেকে ১৪ ফুট দৈঘ্র্যের গর্তটি মাদকসেবীরা তৈরি করতে পারে।'
সর্বশেষ পরিস্থিতি বিষয়ে মিরসরাই থানার ওসি ইফতেখার হাসান সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা নতুন কিছু পাইনি।' সর্বশেষ সন্ধান পাওয়া সুড়ঙ্গের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন।

No comments

Powered by Blogger.