পৃথিবীর শান্তি কামনায় শেষ হলো কঠিন চীবরদান উৎসব by ফজলে এলাহী,

গণিত পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থীর সমাগমে, লাখো মানুষের মিলনমেলার মধ্য দিয়ে শুক্রবার রাঙামাটির রাজবন বিহারে শেষ হলো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দুদিনব্যাপী কঠিন চীবরদান উৎসব। আড়াই হাজার বছর আগে মহামতি গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায় মহাপুণ্যবতী বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা, সুতা থেকে কাপড় আর কাপড় থেকে চীবর বা বস্ত্র বয়ন শেষে ধর্মীয় গুরু বনভান্তের হাতে তা তুলের দেওয়ার মাধ্যমে শেষ হয় এই মহাযজ্ঞ। গত বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় কর্মীদের পঞ্চশীল গ্রহণ ও দুপুর পৌনে ৩টায় বেইন ঘরের অনুষ্ঠান উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দুদিনের কর্মসূচি শুরু হয়েছিল।


শুক্রবার সকাল থেকেই রাজবন বিহারের বিশাল এলাকাজুড়ে শুরু হওয়া বর্ণাঢ্য বস্ত্র ও কল্পতরু শোভাযাত্রা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় মুহুর্মুহু আনন্দ ধ্বনি উৎসবের জোয়ারকেই যেন প্রকম্পিত করে। দুপুর ১২টা বাজার আগেই বিশাল এলাকাজুড়ে তৈরি প্যান্ডেলে জড়ো হতে থাকে অনুষ্ঠানে সমবেত কয়েক লাখ পুণ্যার্থী। বরাবরের মতো এবারও অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন সর্বজন পূজ্য বৌদ্ধ আর্যপুরুষ মহাসাধক শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভান্তে।
দানানুষ্ঠান শুরু হয় বিকেল পৌনে ৩টায়। এ সময় লাখো মানুষের পদভারে বিশাল এলাকাজুড়ে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। এর আগে বনভান্তের শিষ্যবর্গ ও অনুত্তর ভিক্ষুসংঘ অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত হলে লাখো ভক্তের 'সাধু...সাধু...সাধু...' ধ্বনিতে সমগ্র এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
দানযজ্ঞের প্রথম পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ভক্তদের পঞ্চশীল গ্রহণ। পরে পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হয় সংঘদান, অষ্ট পরিষ্কার দান, বুদ্ধমূর্তি দান, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুণ্যার্থীদের তৈরি কঠিন চিবর দান উৎসর্গ এবং পরিত্রাণ পাঠ। এ সময় শিল্পমন্ত্রী দীলিপ বড়ুয়া, চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, রাঙামাটি পৌরসভার মেয়র সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ভুট্টো, পুলিশ সুপার মাসুদ উল হাসান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক দুই মন্ত্রী কল্পরঞ্জন চাকমা ও মনিস্বপন দেওয়ান, জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ান, রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের কর্মকর্তাসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
বনভান্তে পুণ্যার্থীদের উদ্দেশে সদ্ধর্ম দেশনা দেন। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে বনভান্তের হাতে চীবর তুলে দেন জেলা বিএনপির সভাপতি দীপেন দেওয়ান আর জাতিসংঘ উন্নয়ন সহায়তা কর্মসূচি-পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রধান রবার্ট স্টলম্যান বনবিহারে একটি বিশাল বুদ্ধমূর্তি প্রদান করেন। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত উৎসবের সর্বশেষ কর্মসূচি সার্বজনীন প্রদীপ পূজা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রী দীলিপ বড়ুয়া বলেন, বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে দুই হাজার বছরের পুরনো রীতি অনুসারে প্রতি বছরের মতো এবারও সর্বসাধারণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে দানোত্তম কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছি। তিনি বলেন, এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যেমন গৌতম বুদ্ধের আমলের প্রথার পুনরুজ্জীবন ঘটেছে, তেমনি পার্বত্যাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জুম সংস্কৃতি ও বয়নশিল্পকে লালন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এসব প্রয়াস একমাত্র বনভান্তের সুনেতৃত্ব, আশীর্বাদ ও শুভ দৃষ্টির ফলে সম্ভব হচ্ছে।
কঠিন চীবরদান উৎসবের সমাপনীতে দেশনাকালে শ্রীমৎ মহাস্থবির বনভান্তে পরম সুখ ও শান্তি লাভে তথাগত ভগবান গৌতম বুদ্ধের অহিংসা পরম নীতি অবলম্বনের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, জাতিতে জাতিতে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে এবং সব ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সুখ ও শান্তিতে থাকতে হলে সব ধরনের অপকর্ম, পাপ, হিংসা, বিদ্বেষ, অসত্য ও অজ্ঞানতা পরিহার করে সব সময় সৎ, ন্যায় ও সত্যের পথে চলতে হবে। পাপীরা সব সময় অপকর্মে লিপ্ত হয়। অপকর্ম মানুষের অমঙ্গল ও বিপদ ডেকে আনে। এ সবই অজ্ঞানতার কারণ। তাই যাবতীয় অপকর্ম পরিহার করে সৎকর্ম সম্পাদনই অতি উত্তম মঙ্গল।

No comments

Powered by Blogger.