কোরবানির গরু-খাসির অস্বাভাবিক দাম : হাটে প্রচুর গরু : ক্রেতা কম by আলাউদ্দিন আরিফ

কদিন পর ঈদুল আজহা। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের গবাদিপশুর হাটগুলো এরই মধ্যে বেশ জমে উঠেছে। পুরোদমে শুরু হয়েছে বেচাকেনা। ক্রেতারা বলছেন, এবার গরুর দাম অস্বাভাবিক। কিন্তু বিক্রেতারা বলছেন, গরু পালনে খরচ অনুযায়ী দাম পাচ্ছেন না। ঢাকায় গবাদিপশুর হাটগুলোয় গতকাল বিকাল থেকে জমজমাট বেচাকেনা শুরু হয়েছে। বর্ডার উন্মুক্ত থাকায় সব হাটেই দেশি গরুর পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক ভারতীয় গরু তোলা হয়েছে।সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা ও মারাত্মক যানজটের কারণে বেপারিরা গরু নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছাতে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন।


গতকাল ঢাকার গাবতলীসহ অন্যান্য পশুর হাটে দাম নিয়ে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। একই আকারের গরু একজন কিনছেন ৪০ হাজার টাকায়, আরেকজন কিনছেন ৩৩ হাজার টাকায়। হাটে প্রায় সব ক্রেতাই বলছেন দাম নাগালের বাইরে। কিন্তু চড়া দামেও সন্তুষ্ট নন বিক্রেতারা। তারা বলছেন, গরু পালনে খরচ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে, সে হিসেবে গরুর দাম কম। সবকিছু ছাড়িয়ে খাসির দাম হয়ে উঠেছে
আকাশচুম্বী। বড় খাসির দাম চাওয়া হয়েছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। মাঝারি ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। আর ছোট খাসির দাম ৪ থেকে ৮ হাজার টাকা চাচ্ছেন বিক্রেতারা।
ঢাকার অস্থায়ী হাটগুলোতে পশুর দাম সম্পর্কে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে পাওয়া গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ঢাকার দ্বিতীয় বৃহত্তম হাট আরমানিটোলা মাঠে ক্রেতারা বলেছেন, দাম অস্বাভাবিক বেশি। আবার উত্তরা-আজমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, আফতাবনগর ইস্টার্ন হাউজিং মাঠে যাওয়া ক্রেতারা বলছেন, দাম মোটামুটি সহনীয়। গতকাল নগরীর হাটগুলোতে দেখা গেছে জুমার নামাজের পর বিপুলসংখ্যক ক্রেতা হাটে গেছেন। বেচাকেনাও শুরু হয়েছে। তবে বেপারিরা এখনও দাম ছাড়ছেন না। ক্রেতারাও কম দামে গবাদিপশু কেনার আশায় ঘুরছেন। দামে মিলে গেলে কিনে নিচ্ছেন।
ঢাকার সর্ববৃহত্ হাট বসেছে ঢাকার গাবতলীতে। মূল হাট ছাড়িয়ে বেড়িবাঁধ, দ্বীপনগর, আমিনবাজার ব্রিজ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে গাবতলীর হাট। হাজার হাজার ছোট-বড়-মাঝারি রংবেরংয়ের গরু তোলা হয়েছে হাটে। বেপারিরা জানান, দুপুরের পর হাটের অবস্থা কিছুটা ভালো হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজ্জাক বেপারি, তসলিম বেপারি, মমিন বেপারি, সিঙ্গাইরের রহমান বেপারি, কুষ্টিয়ার আনোয়ার বেপারিসহ অনেকেই হাটে বিশাল বিশাল গরু তুলেছেন। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বাদশা মিয়া তার একটি ষাঁড়ের দাম চাচ্ছেন ৭ লাখ টাকা। তিনি দাবি করছেন ৪ লাখ টাকা দাম উঠেছে। একই এলাকার বিশু মণ্ডল তার ষাঁড়ের দাম চাইছেন ৬ লাখ টাকা। দাম নাকি উঠেছে সাড়ে ৩ লাখ টাকা। বাজারে দেড় থেকে ১৫ লাখ টাকা দাম হাঁকা গরু তোলা হয়েছে কয়েক হাজার। যদিও এসব বড় গরুর ক্রেতা কম।
বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ২৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা দামের গরুর। সাধারণ ও মধ্যবিত্ত মানুষ এরকম দামে গরু কেনেন। কল্যাণপুর থেকে দু’ভাই শওকত আলী ও শরাফত আলী হাটে গেছেন গরু কিনতে। তাদের বাজেট ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু যে গরুটিই পছন্দ করেন—বিক্রেতারা দাম চাইছেন ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। শওকত আলী বলেন, গতবছর যে আকারের গরু ৪৫ হাজার টাকায় কিনেছেন, এবার সেই গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে ৭০ হাজার টাকা। আড়াই মণ মাংস হবে—এ আকারের গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে ৭০ হাজার টাকা, যা অবিশ্বাস্য।
দেখতে বাছুরের চেয়ে একটু বড় একটি ষাঁড় কিনেছেন পীরেরবাগের আহসান হাবিব। দাম নিয়েছে ৩৬ হাজার টাকা। তিনি বলেন, গতবছর এই আকারের গরু পাওয়া গেছে ২৫-২৬ হাজার টাকায়। কিন্তু এবার বেপারিরা দাম কমাচ্ছেন না। বাউনিয়া এলাকার বাসিন্দা কাজল ৪০ হাজার টাকায় একটি বলদ কিনেছেন। তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবে গরুটির দাম ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। শেওড়াপাড়ার রোমেল বাচুরের মতো দেখতে একটি ষাঁড় কিনেছেন ২২ হাজার টাকায়। পাশেই আরেক ক্রেতা সাব্বির বললেন, আমি হলে এই গরু ১৫ হাজার টাকার বেশি দামে কিনতাম না।
বগুড়ার আবদুর রহিম সাদা একটি ষাঁড়ের দাম চাচ্ছেন দু’লাখ টাকা। কিন্তু ক্রেতারা সর্বোচ্চ দাম বলছেন ৯০ হাজার টাকা। সিঙ্গাইরের রহমান বেপারি তার গরুর দাম চাচ্ছেন ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। ঢাকার টোলারবাগ এলাকার বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন গরুটি কিনতে চাইছেন। তারা ৭ ভাগে কোরবানি দেবেন। গরুটির দাম বলেছেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। নাজিম উদ্দিন বলেন, এই গরুর দাম কোনোভাবেই এক লাখ টাকার ওপরে হওয়া উচিত নয়। কিন্তু বিক্রেতা দাম যা চাইছেন, তাতে দিগুণ মনে হচ্ছে। গরুর দাম বেশি কেন জানতে চাইলে গেরস্থ বা বেপারি সবারই বক্তব্য : গরুর খাবারের দাম বেড়েছে, পরিবহন খরচ বেড়েছে; তাই কীভাবে কম দামে গরু বিক্রি করব। সিঙ্গাইরের রহমান বেপারি জানান, একটি গরুকে দৈনিক প্রায় ৩০০ টাকার খাবার দিতে হয়। এরপর অন্যান্য খরচ। সে অনুপাতে গরুর দাম পাওয়া যাচ্ছে না। তবে গতকাল বিকাল থেকে হাট কিছুটা ভালো হয়েছে বলে জানান তিনি।
গাবতলীতে ১২ লাখ টাকার ষাঁড় : আশুলিয়ার আলী হোসেন তার নিজের পোষা কালো রঙের একটি ষাঁড় হাটে তুলেছেন। গরুটির নাম ‘রাজা’। দেখতেও রাজার মতো। হাটের সেরা গরুর একটি। গরুটির দাম চাইছেন ১২ লাখ টাকা। আলী হোসেন বলেন, এক বছর আগে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় ফ্রিজিয়ান জাতের ষাঁড়টি কিনে লালন-পালন করেছেন। প্রতিদিন গরুটির পেছনে খরচ করেছেন প্রায় ৫শ’ টাকা। ৮ লাখ টাকার ওপরে ষাঁড়টি বিক্রির ইচ্ছে তার। ওই ষাড়টির পাশেই আরও প্রায় ৫০টি ষাঁড় তোলা হয়েছে। প্রত্যেকটি ষাঁড়ের দাম চাওয়া হচ্ছে ৫ লাখ টাকার ওপরে।
খাসির দাম ৫০ হাজার টাকা : পাবনার হাজীর হাটের খাসি ব্যবসায়ী গনি বেপারি। তিনি ৯০টি খাসি নিয়ে গাবতলী হাটে গেছেন। বড় খাসিটির দাম চাইছেন ৫০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ৯০টি খাসির মধ্যে প্রায় ২০টি বিক্রি করেছেন। সিরাজগঞ্জের মো. সেলিম তুলেছেন ৫০টি খাসি। তিনি বলেন, ৬ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দামের খাসি আছে তার কাছে। মিরপুর ১ নম্বর বড়বাগ এলাকার আবদুস সাত্তার একটি খাসি কিনেছেন ৮ হাজার টাকায়। তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবে খাসিটির দাম ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা হতে পারে। কিন্তু কেউ দাম ছাড়ে না। তাই বেশি দামে কিনতে হলো।
হাট কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : গাবতলী হাটের পরিচালক মো. সোহেল জানান, বর্ডারে ঝামেলা নেই। দেশি গরুর পাশাপাশি ভারতীয় গরুও আসছে প্রচুর। তাই গরুর অভাব নেই। অভাব শুধু ক্রেতার। ৬ কোটি ৭০ লাখ ৫০ হাজার টাকায় হাটের ইজারা নিয়েছেন তারা। ভ্যাট, ট্যাক্স, সিকিউরিটিসহ সাড়ে ৮ কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছে। রয়েছে ভলান্টিয়ারসহ প্রায় ১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। হাটে পশুও আছে প্রচুর। কিন্তু সে অনুযায়ী বিক্রি নেই। শেয়ারবাজারে ধস, অর্থনীতির মন্দা—এসব কারণে এবার আশানুরূপ বিক্রি নাও হতে পারে। অন্যান্য বছর এ সময়ে যে হারে হাসিল হয়, এবার তার অর্ধেক হচ্ছে। তিনি আরও জানান, গতকাল বিকাল থেকে কিছু ক্রেতা হাটে নেমেছেন। বিক্রিও হয়েছে মোটামুটি। তবে আশানুরূপ নয়। তারা শতকরা ৫ টাকা বা হাজারে ৫০ টাকা হিসেবে হাসিল আদায় করছেন। আজ ও আগামীকাল ভালো বিক্রির আশা করছেন তিনি। হাটে বেপারি ও ক্রেতাদের নিরাপত্তার জন্য র্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা বাহিনী ছাড়াও তাদের নিজস্ব ভলান্টিয়ার রয়েছে। হাটে রয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। আছে জালটাকা শনাক্তের কমপক্ষে ১৫টি মেশিন।
নয়াবাজার হাট : আরমানিটোলা-নয়াবাজার এলাকায় বসানো হয়েছে পশুর ডিজিটাল হাট। গতকাল পর্যন্ত ২৫ থেকে ৩০ হাজার গরু তোলা হয়েছে বলে ইজারাদাররা জানান। এই হাটে গাভী বা বলদের তুলনায় ষাঁড়ের চাহিদা বেশি। এখানের ক্রেতারা মূলত পুরনো ঢাকার বাসিন্দা। হাট পরিচালনা কমিটির লোকজন জানান, সকালের দিকে অল্প কিছু কেনাবেচা হলেও বিকালে মোটামুটি ভালো বিক্রি হয়েছে। দেশি গরুর চেয়ে ভারতীয় গরুর আধিক্য এ হাটে। এতে গরুর দাম কিছুটা কম হওয়ার কথা থাকলেও ক্রেতা-বিক্রেতার মুখে শোনা যায় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। তারা বলছেন, দাম এখনও নাগালের মধ্যে আসেনি। আর আশানুরূপ দাম না পাওয়ার আক্ষেপে মুখ ভার বিক্রেতাদের অনেকের। সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য বিশাল এ হাটে মোট ৬৫টি হাসিল বুথ বসানো হয়েছে। ইজারাদারের নিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার।
নয়াবাজার হাটের ব্যবস্থাপক মো. শফিকুল হক বলেন, প্রতিটি মোড়ে রয়েছে নিজস্ব নিরাপত্তা বুথ। বসানো হয়েছে সিসিটিভি।
গরুর হাটে জালটাকা শনাক্ত করতে বিভিন্ন স্থানে চেকিং মেশিন বসানো হয়েছে। রয়েছে পুলিশি নিরাপত্তা। সব মিলিয়ে এবার হাটে ভোগান্তি কম বলে দাবি করলেন পরিচালনায় নিয়োজিত একাধিক সদস্য।
হাট এলাকার বিভিন্ন বুথ থেকে মলম পার্টি, ছিনতাইকারী ও পকেটমার থেকে সাবধান থাকতে মাইকের মাধ্যমে বার বার সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের।
পুরনো ঢাকার ঐতিহ্য অনুযায়ী এখানকার লোকজন ঈদের ক’দিন আগেই গরু কেনেন। চিলমারী থেকে আসা ওমর আলী বেপারি জানালেন, প্রতিবারের মতো এবারও তিনি গরুর একটি বড় চালান নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। ভালো বিক্রির আশা তার; কিন্তু সে অনুযায়ী ক্রেতা পাচ্ছেন না।
অন্যান্য হাট : নগরীর অন্য হাটগুলোতেও প্রচুর গরু তোলা হয়েছে। দুপুরের পর ক্রেতারা হাটে নেমেছেন। বিক্রিও শুরু হয়েছে। আজ থেকে পুরোদমে বেচাকেনা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন ইজারাদাররা।

No comments

Powered by Blogger.