ঘরমুখো মানুষের চরম ভোগান্তি-মহাসড়কগুলোতে দীর্ঘ যানজট, ঢাকা থেকে বের হওয়াই দায় by রাশেদ মেহেদী
ঢাকার চারদিকে মহাসড়কে যানজট। ঘরমুখো মানুষের রাজধানী থেকে বের হওয়াই দায় হয়ে পড়েছে। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ যেতে চন্দ্রা মোড়ে, আরিচা যেতে মানিকগঞ্জ থেকে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কাঁচপুর পার হলেই কমে যাচ্ছে গড়ির গতি, গজারিয়া থেকে একেবারে স্থবির। পাটুরিয়া এবং মাওয়া ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা ফেরির জন্য। বাস টার্মিনালে বাসের সিডিউল লণ্ডভণ্ড, কমলাপুর রেলস্টেশনে ট্রেনের সিডিউলে চরম বিপর্যয়। সদরঘাট থেকে লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গন্তব্যে রওনা। সব মিলিয়ে ঘরমুখো যাত্রীরা অসহায়, দেখার কেউ নেই।
আগের বছরগুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনসহ টার্মিনালগুলোতে যাত্রী ভোগান্তি রোধে যে নূ্যনতম ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এবার তা-ও চোখে পড়েনি। ফলে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় যাত্রীদের পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।
শুক্রবার সকালে বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন আর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ছিল যাত্রীর উপচেপড়া ভিড়। সময়মতো বাস না ছাড়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাউন্টারে বসে থেকেও বাসে উঠতে পারেননি অনেকে। নির্ধারিত সময়ের সাত ঘণ্টা পর ছেড়েছে ট্রেন। অন্যদিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ৪৫ কিলোমিটার, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৭০ কিলোমিটার, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ২০ কিলোমিটার, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গাজীপুর চৌরাস্তায় আট থেকে ১০ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া এবং মাওয়া ফেরিঘাটের
উভয় পাশেও সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট।
অবশ্য গতকালও কমলাপুর রেলস্টেশন পরিদর্শনে গিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ভবিষ্যতে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হবে, যা আগে কেউ কখনও ভাবেনি।
মহাখালী টার্মিনাল :গাজীপুরের যানজট থমকে দিয়েছে সবকিছু
সকাল ১০টায় মহাখালী টার্মিনালে টিকিট হাতে করুণ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ময়মনসিংহগামী যাত্রী আবদুল হামিদ, সঙ্গে তার স্ত্রী এবং আট ও দশ বছর বয়সী দুই সন্তান। সকাল ৮টায় টার্মিনালে এসে সৌখিন পরিবহনের টিকিট কেটেছেন। ১৬০ টাকার টিকিট ২০০ টাকায় কিনতে হয়েছে। কিন্তু দুই ঘণ্টা পর সকাল ১০টায়ও সেই বাসে উঠতে পারেননি। একই অবস্থা এনা পরিবহনের যাত্রী সদরুল আলমের। তিনিও সকাল সাড়ে ৭টায় এসে টিকিট কেটেছেন। এর মধ্যে এনা পরিবহনের একটি বাস সকাল ৯টায় ছেড়ে গেছে। তাকে তখন বলা হয়েছে, তার সিডিউল পরের বাসে। ১৫ মিনিট পর বাস আসছে। পরবর্তী এক ঘণ্টা পরও সেই ১৫ মিনিট শেষ হয়নি। টার্মিনালজুড়ে শত শত যাত্রী। প্রতিটি বাসের কাউন্টারে লম্বা লাইন। কিন্তু বাস নেই। নির্ধারিত সময়ের দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর একটা বাস আসছে, ছেড়ে যাচ্ছে। টার্মিনালের সামনের রাস্তার দু'পাশে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাস। কিন্তু ছাড়ার নাম নেই। মহাখালী টার্মিনালের এক পরিবহন কর্র্মী জানান, সৌখিন পরিবহনসহ বিভিন্ন পরিবহনের বাস যানজটের কারণে টঙ্গী স্টেশন রোড এবং গাজীপুর চৌরাস্তা থেকেই যাত্রী নিয়ে আবার ময়মনসিংহসহ ওই অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, টঙ্গী-আশুলিয়া সড়কের কামারপাড়া এলাকায় রাস্তার ওপরে বসেছে গরুর হাট। এ ছাড়া গাজীপুর চৌরাস্তায় শত শত যাত্রী জড়ো হয়েছেন বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে। অসংখ্য বাস এখানে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছে। এ কারণে চৌরাস্তা এক অর্থে অস্থায়ী টার্মিনালে পরিণত হয়েছে। এ কারণে ঢাকা ছেড়ে আসা ময়মনসিংহগামী এবং ময়মনসিংহ থেকে ঢাকাগামী বাসগুলো চৌরাস্তায় এসে দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকছে।
গাবতলী টার্মিনালে বাসের সিডিউল লণ্ডভণ্ড :মহাসড়কে ৪৫ কিলোমিটার যানজট
গাবতলী ও কল্যাণপুরে দূরপাল্লার বাসের কাউন্টারগুলোতেও যাত্রীরা দাঁড়িয়েছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দুপুর ১২টায় কল্যাণপুরে শ্যামলী পরিবহন, এসআর ট্রাভেলস, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ঈগল পরিবহনসহ বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টারে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। কাউন্টারের সামনেও যাত্রীদের ব্যাগের ওপর বসে থাকতে দেখা যায়। ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে ইমরুল নামে এক যাত্রী জানান, সকাল সাড়ে ১০টার বাস দুপুর ১২টায়ও ছাড়েনি। কখন ছাড়বে কেউ জানে না। টার্মিনালের চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। নারী, শিশু, বৃদ্ধ সব বয়সের যাত্রীর চোখে-মুখে চরম অসহায়ত্বের ছাপ। কাউন্টারের এক কর্মচারী জানান, খুলনা থেকে রাত ১টায় রওনা দিয়ে নির্ধারিত ট্রিপের বাসটি তখন পর্যন্ত কল্যাণপুরে আসেনি। পথে দীর্ঘ সাত ঘণ্টা দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে যানজটে আটকে থাকতে হয়েছে বাসটিকে। সেই বাস না আসা পর্যন্ত কিছুই করার নেই। সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার শরীফুল ইসলাম বৃহস্পতিবার রাত ১টায় খুলনা থেকে আরএম টু বাসে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। তিনি জানান, বাসটি দৌলতদিয়া ঘাট থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার আগেই যানজটে পড়ে। তিন থেকে চার ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার পর খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, যাত্রীবাহী বাস আটকে রেখে অগ্রাধিকার দিয়ে গরুবাহী ট্রাক পার করা হচ্ছে। প্রতিটি গরুবাহী ট্রাক থেকে ৯৬০ টাকার নির্ধারিত ভাড়ার পরিবর্তে ১ হাজার ৩০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি ফেরিতে আট-দশটি ট্রাক ওঠার পর একটি-দুটি করে যাত্রীবাহী বাস উঠতে দেওয়া হচ্ছে। পরে তিনি সাড়ে ১২ ঘণ্টা পর দুপুর দেড়টায় ঢাকায় এসে পেঁৗছেন। গাবতলীতে প্রায় সব বাসের কাউন্টারেই ছিল বিশৃঙ্খল অবস্থা। বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ কামাল হোসেন জানান, যানজটের কারণে ফিরতি ট্রিপের গাড়ি আসতে পারছে না। এ কারণে সিডিউল রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। গোয়ালন্দ প্রতিনিধি জানান, শুক্রবারও দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়ার উভয় পাশে পাঁচ থেকে সাত কিলোমিটার যানজট ছিল। এ ব্যাপারে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে বিআইডবি্লউটিসির সহকারী ব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে একটি গরুর ট্রাকে পাঁচটি গরু অসুস্থ হওয়ার কারণে বেপারীদের অনুরোধে গরুবাহী ট্রাকগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ ছাড়া অতিরিক্ত তিনটি ফেরি আসার কথা থাকলেও এর মধ্যে মাত্র একটি এসেছে। ফলে নিয়মিত চলাচল করা ৯টি ফেরি দিয়েই যানবাহন পার করা হচ্ছে।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মির্জাপুর থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৪৫ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এলেঙ্গায় প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকার সড়কের অবস্থা বেহাল। আমাদের টাঙ্গাইল ও মির্জাপুর প্রতিনিধি জানান, গতকাল শনিবার ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের প্রায় ৪৫ কিলোমিটারজুড়ে দিনভর ভয়াবহ যানজটে স্থবির ছিল মহাসড়ক।
পুলিশ জানায়, মহাসড়কের করটিয়া, ঘারিন্দাসহ তিনটি স্থানে গরুবাহী ট্রাক এবং যাত্রীবাহী বাস বিকল হয়ে পড়ে। এতে সকাল ৯টার পর থেকে মহাসড়কে যানজট শুরু হয়। এ ছাড়া এলেঙ্গার কাছে একটি দুর্ঘটনা ঘটলে মহাসড়কের এ যানজট এলেঙ্গা থেকে মির্জাপুর উপজেলার ধেরুয়া পর্যন্ত প্রায় ৪৫ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত হয়। বিকল হওয়া যানগুলো রেকারের মাধ্যমে সরিয়ে নিতে প্রায় দেড়-দু'ঘণ্টা লেগে যায়। এ ব্যাপক যানজটে আটকা পড়ে ঈদে ঘরমুখো ৯০টি রুটের হাজার হাজার যাত্রী চরম দুর্ভোগের শিকার হন। হাইওয়ে পুলিশসহ পুলিশ প্রশাসনের আড়াই শতাধিক সদস্য শত চেষ্টা করেও তা দূর করতে পারেননি। হাইওয়ে মির্জাপুর থানার ওসি ছানোয়ার হোসেন জানান, এলেঙ্গা এলাকার প্রায় ১২ কিলোমিটার সড়কে খানাখন্দ এবং প্রচণ্ড ধুলার কারণে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
সায়েদাবাদ : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কের ৭০ কিলোমিটার যানজটে সব আয়োজন পণ্ড
সায়েদাবাস বাস টার্মিনালে হানিফ এন্টারপ্রাইজের কর্মকর্তা মাহবুব জানান, এবার ঈদের আগে যাত্রী হয়রানি বন্ধ করতে মালিকদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে বাসের অতিরিক্ত ট্রিপ নিয়ে যাতে সমস্যার সৃষ্টি না হয় সে জন্য বেশ কিছু ট্রিপের বিপরীতে বিকল্প বাস প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কে যানজটের কারণে বিকল্প বাস দিয়েও ট্রিপ ঠিক রাখা যায়নি। এখন অবস্থা এমন, যাত্রীদের ক্ষোভের মুখে কর্মচারীদের পালিয়ে যাওয়ার উপক্রম। সায়েদাবাদে স্টার লাইন পরিবহনে ফেনী যাওয়ার জন্য সকাল ৭টায় এসেছিলেন ফরিদ গাজী। কিন্তু দুপুর ২টা পর্যন্ত তিনি বাস পাননি। টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, সব পরিবহনের যাত্রীদের একই অবস্থা। বাসের সব ধরনের সিডিউল ভেঙে পড়েছে। এ সুযোগে ঢাকার ভেতর চলাচল করা লোকাল বাসগুলোতেও ঢাকা-কুমিল্লা, ঢাকা-নোয়াখালীসহ বিভিন্ন রুটের যাত্রী তুলতে দেখা যায়। ২২নং রুটের বেশ কিছু লোকাল বাসকে মাওয়ার যাত্রী তুলতে দেখা যায়।
আমাদের দাউদকান্দি প্রতিনিধি জানান, দেশের ব্যস্ততম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গতকাল আবারও দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে দাউদকান্দির মেঘনা-গোমতী সেতু পেরিয়ে গজারিয়ার ভবেরচর এলাকা পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। এতে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। মেঘনা-গোমতী সেতুর দাউদকান্দিতে টোল আদায়ের ছয়টি কাউন্টার থাকলেও তিনটি কাউন্টারের মাধ্যমে টোল আদায় করায় যানবাহন সঠিকভাবে পার হতে না পারায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। ফলে জনদুর্ভোগ আরও তীব্র আকার ধারণ করে। কুমিল্লার সহকারী পুলিশ সুপার (মুরাদনগর সার্কেল) জাহাঙ্গীর আলম জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত গাড়ি চলাচলই যানজটের মূল কারণ। তাছাড়া মেঘনা-গোমতী সেতুর ঝুঁকির কারণে ধীরগতিতে যানবাহন চলাচল করায় যানজট নিরসন করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। গত রোজার ঈদের মতো এবারও তিনদিন ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চলাচল বন্ধ থাকলে যানজট হতো না। এ ব্যাপারে সেতুর টোল প্লাজা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, ইচ্ছা থাকলেও ঝুঁকির কারণে একসঙ্গে অনেক গাড়ি ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চালকরা জানান, মহাসড়কে বড় বড় গর্তের কারণে গাড়ি অনেক ধীরে চালাতে হচ্ছে। এতে মহাসড়কের যানজট মহাজটে পরিণত হচ্ছে। সরেজমিন দেখা যায়, মহাসড়ক ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান দখল করে আছে। এদিকে মহাসড়কের সঙ্গে যে আঞ্চলিক সড়কগুলো এসে মিলিত হয়েছে ওইসব সড়কেও সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। মহাসড়কের দাউদকান্দির গৌরীপুর, ইলিয়টগঞ্জ, চান্দিনা বাসস্ট্যান্ড, নিমসার সড়কের দু'পাশে অবৈধভাবে দোকানপাট, সিএনজি, মাইক্রো ও অটোরিকশার স্ট্যান্ড গড়ে ওঠায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
লৌহজং প্রতিনিধি জানান, ঘরমুখো মানুষের ভিড়ে মাওয়া পরিণত হয়েছে জনসমুদ্রে। সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চৌরাস্তা থেকে ২ কিলোমিটার দূরে খানবাড়ি পর্যন্ত যানজট ছড়িয়ে পড়ে। ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় সারিবদ্ধভাবে সহস্রাধিক যানবাহন মহাসড়কের পাশে আটকে থাকে। লোকাল বাসের যাত্রীরা দুই কিলোমিটার দূরে নেমে হেঁটে মাওয়া ঘাটে গিয়ে লঞ্চ, স্পিডবোট ও ট্রলারে করে পদ্মা পাড়ি দেন। এ সময় দীর্ঘ পথ হেঁটে ঘাটে আসতে যাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিশেষ করে নারী ও শিশু যাত্রীদের ভোগান্তি ছিল অসহনীয়। ভিড় এড়াতে অনেক যাত্রীকেই সহজ ও সংক্ষিপ্ত রাস্তায় ঘাটে যেতে মহাসড়ক ছেড়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে বিকল্প পথে যেতে দেখা যায়।
ঢাকা থেকে খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, বাগেরহাট, মাদারীপুর, টেকেরহাট, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জগামী ও ঢাকা-মাওয়া রুটের লোকাল বাসগুলোতে ছাদে ও ভেতরে ছিল উপচেপড়া ভিড়। গত ঈদে মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটে ঈদ স্পেশাল সার্ভিসসহ ১৬টি ফেরি চলাচল করলেও এ ঈদে দেওয়া হয়েছে ১৪টি ফেরি। দুটি ফেরি কম থাকায় ১৪টি ফেরি সার্বক্ষণিক চালু থাকলেও সকালে অতিরিক্ত গাড়ির চাপে ঘাটে পারাপারের অপেক্ষায় আটকা পড়ে সহস্রাধিক গাড়ি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি লাইনে রেখে ফেরি পারাপার হতে হচ্ছে।
ট্রেনের সিডিউল ঠিক হলো না :যোগাযোগমন্ত্রীর দীর্ঘমেয়াদি আশ্বাস
গত বৃহস্পতিবার কমলাপুর রেলস্টেশন পরিদর্শনে এসে যোগাযোগমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, শুক্রবারের মধ্যে ট্রেনের সব সিডিউল ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু গতকাল শুক্রবার সকালে তিনি আরও এক দফা কমলাপুর এসে বলেন, নরসিংদীর ঘটনার কারণে ট্রেনের সিডিউলে সমস্যা হয়েছে। বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পর পরিস্থিতি পুরোপুরি ঠিক হচ্ছে না। ঈদের পরও ট্রিপ নিয়ে কিছুটা সমস্যা থাকতে পারে। আমরা সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদ পর্যন্ত সময় দিন, এমন অনেক কিছুই দেখবেন যা আগে কখনও দেখেননি। মানুষের এ ভোগান্তির চিত্র থাকবে না।
কমলাপুর রেলস্টেশন সূত্র জানায়, সকালে লালমনিরহাটগামী ট্রেন ছাড়তে সাত ঘণ্টা দেরি হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেটগামী ট্রেন তিন থেকে চার ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি রুটের ট্রেন এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ছে। এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন যাত্রীরা। লালমনিরহাটগামী যাত্রী সোহেলী আকতার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সমস্যা হয়েছে নরসিংদীতে, তার জন্য নর্থ বেঙ্গলের রুটে কেন সমস্যা হবে? কমলাপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের লোকাল ট্রেনগুলোতে শুধু কামরার ভেতরেই নয়, ছাদেও শত শত মানুষ উঠতে দেখা যায়। এদিকে বিকেলে কুমিল্লায় একটি মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হলে ঢাকা-নোয়াখালী এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ট্রেন চলাচল সাময়িক বন্ধ থাকে। ফলে দুর্ভোগ আরও এক দফা বাড়ে।
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল : সদরঘাটে ভোর থেকেই ঢল নামে মানুষের। ভিড়ের চাপে পন্টুন পার হয়ে লঞ্চে উঠতেই অনেককে পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ। ঢাকা-হুলারহাট, ঢাকা-কাউখালী, ঢাকা-চাঁদপুর, ঢাকা-ভোলা রুটের প্রতিটি লঞ্চকে দেখা যায় অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে। কেবিন বুকিং নিয়েও অভিযোগ করেন যাত্রীরা। দ্বীপরাজ নামে একটি লঞ্চে আগে থেকে কেবিন বুকিং দেওয়ার পরও তার কেবিনে অন্য যাত্রী তুলে দেওয়ার অভিযোগ করেন বরিশালগামী লুৎফর রহমান। অবশ্য লঞ্চের এক কর্মচারী জানান, যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে ছোটখাটো সমস্যা হচ্ছে। বিভিন্ন লঞ্চে একশ' টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া নেওয়ারও অভিযোগ করেন যাত্রীরা। ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের ছাত্র আসাদ জানান, তিনি বরিশালে যাওয়ার জন্য বাসের টিকিট কেটেছিলেন। ভয়াবহ যানজটের খবর পেয়ে সড়কপথের পরিবর্তে নৌপথকেই ভালো মনে করেছেন। তার বক্তব্য, একবার কষ্ট করে লঞ্চে উঠতে পারলে বাড়ি যাওয়া যাবে। অন্তত পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে না।
শুক্রবার সকালে বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন আর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ছিল যাত্রীর উপচেপড়া ভিড়। সময়মতো বাস না ছাড়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাউন্টারে বসে থেকেও বাসে উঠতে পারেননি অনেকে। নির্ধারিত সময়ের সাত ঘণ্টা পর ছেড়েছে ট্রেন। অন্যদিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ৪৫ কিলোমিটার, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৭০ কিলোমিটার, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ২০ কিলোমিটার, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গাজীপুর চৌরাস্তায় আট থেকে ১০ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া এবং মাওয়া ফেরিঘাটের
উভয় পাশেও সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট।
অবশ্য গতকালও কমলাপুর রেলস্টেশন পরিদর্শনে গিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ভবিষ্যতে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হবে, যা আগে কেউ কখনও ভাবেনি।
মহাখালী টার্মিনাল :গাজীপুরের যানজট থমকে দিয়েছে সবকিছু
সকাল ১০টায় মহাখালী টার্মিনালে টিকিট হাতে করুণ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ময়মনসিংহগামী যাত্রী আবদুল হামিদ, সঙ্গে তার স্ত্রী এবং আট ও দশ বছর বয়সী দুই সন্তান। সকাল ৮টায় টার্মিনালে এসে সৌখিন পরিবহনের টিকিট কেটেছেন। ১৬০ টাকার টিকিট ২০০ টাকায় কিনতে হয়েছে। কিন্তু দুই ঘণ্টা পর সকাল ১০টায়ও সেই বাসে উঠতে পারেননি। একই অবস্থা এনা পরিবহনের যাত্রী সদরুল আলমের। তিনিও সকাল সাড়ে ৭টায় এসে টিকিট কেটেছেন। এর মধ্যে এনা পরিবহনের একটি বাস সকাল ৯টায় ছেড়ে গেছে। তাকে তখন বলা হয়েছে, তার সিডিউল পরের বাসে। ১৫ মিনিট পর বাস আসছে। পরবর্তী এক ঘণ্টা পরও সেই ১৫ মিনিট শেষ হয়নি। টার্মিনালজুড়ে শত শত যাত্রী। প্রতিটি বাসের কাউন্টারে লম্বা লাইন। কিন্তু বাস নেই। নির্ধারিত সময়ের দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর একটা বাস আসছে, ছেড়ে যাচ্ছে। টার্মিনালের সামনের রাস্তার দু'পাশে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাস। কিন্তু ছাড়ার নাম নেই। মহাখালী টার্মিনালের এক পরিবহন কর্র্মী জানান, সৌখিন পরিবহনসহ বিভিন্ন পরিবহনের বাস যানজটের কারণে টঙ্গী স্টেশন রোড এবং গাজীপুর চৌরাস্তা থেকেই যাত্রী নিয়ে আবার ময়মনসিংহসহ ওই অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, টঙ্গী-আশুলিয়া সড়কের কামারপাড়া এলাকায় রাস্তার ওপরে বসেছে গরুর হাট। এ ছাড়া গাজীপুর চৌরাস্তায় শত শত যাত্রী জড়ো হয়েছেন বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে। অসংখ্য বাস এখানে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছে। এ কারণে চৌরাস্তা এক অর্থে অস্থায়ী টার্মিনালে পরিণত হয়েছে। এ কারণে ঢাকা ছেড়ে আসা ময়মনসিংহগামী এবং ময়মনসিংহ থেকে ঢাকাগামী বাসগুলো চৌরাস্তায় এসে দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকছে।
গাবতলী টার্মিনালে বাসের সিডিউল লণ্ডভণ্ড :মহাসড়কে ৪৫ কিলোমিটার যানজট
গাবতলী ও কল্যাণপুরে দূরপাল্লার বাসের কাউন্টারগুলোতেও যাত্রীরা দাঁড়িয়েছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দুপুর ১২টায় কল্যাণপুরে শ্যামলী পরিবহন, এসআর ট্রাভেলস, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ঈগল পরিবহনসহ বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টারে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। কাউন্টারের সামনেও যাত্রীদের ব্যাগের ওপর বসে থাকতে দেখা যায়। ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে ইমরুল নামে এক যাত্রী জানান, সকাল সাড়ে ১০টার বাস দুপুর ১২টায়ও ছাড়েনি। কখন ছাড়বে কেউ জানে না। টার্মিনালের চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। নারী, শিশু, বৃদ্ধ সব বয়সের যাত্রীর চোখে-মুখে চরম অসহায়ত্বের ছাপ। কাউন্টারের এক কর্মচারী জানান, খুলনা থেকে রাত ১টায় রওনা দিয়ে নির্ধারিত ট্রিপের বাসটি তখন পর্যন্ত কল্যাণপুরে আসেনি। পথে দীর্ঘ সাত ঘণ্টা দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে যানজটে আটকে থাকতে হয়েছে বাসটিকে। সেই বাস না আসা পর্যন্ত কিছুই করার নেই। সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার শরীফুল ইসলাম বৃহস্পতিবার রাত ১টায় খুলনা থেকে আরএম টু বাসে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। তিনি জানান, বাসটি দৌলতদিয়া ঘাট থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার আগেই যানজটে পড়ে। তিন থেকে চার ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার পর খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, যাত্রীবাহী বাস আটকে রেখে অগ্রাধিকার দিয়ে গরুবাহী ট্রাক পার করা হচ্ছে। প্রতিটি গরুবাহী ট্রাক থেকে ৯৬০ টাকার নির্ধারিত ভাড়ার পরিবর্তে ১ হাজার ৩০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি ফেরিতে আট-দশটি ট্রাক ওঠার পর একটি-দুটি করে যাত্রীবাহী বাস উঠতে দেওয়া হচ্ছে। পরে তিনি সাড়ে ১২ ঘণ্টা পর দুপুর দেড়টায় ঢাকায় এসে পেঁৗছেন। গাবতলীতে প্রায় সব বাসের কাউন্টারেই ছিল বিশৃঙ্খল অবস্থা। বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ কামাল হোসেন জানান, যানজটের কারণে ফিরতি ট্রিপের গাড়ি আসতে পারছে না। এ কারণে সিডিউল রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। গোয়ালন্দ প্রতিনিধি জানান, শুক্রবারও দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়ার উভয় পাশে পাঁচ থেকে সাত কিলোমিটার যানজট ছিল। এ ব্যাপারে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে বিআইডবি্লউটিসির সহকারী ব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে একটি গরুর ট্রাকে পাঁচটি গরু অসুস্থ হওয়ার কারণে বেপারীদের অনুরোধে গরুবাহী ট্রাকগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ ছাড়া অতিরিক্ত তিনটি ফেরি আসার কথা থাকলেও এর মধ্যে মাত্র একটি এসেছে। ফলে নিয়মিত চলাচল করা ৯টি ফেরি দিয়েই যানবাহন পার করা হচ্ছে।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মির্জাপুর থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৪৫ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এলেঙ্গায় প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকার সড়কের অবস্থা বেহাল। আমাদের টাঙ্গাইল ও মির্জাপুর প্রতিনিধি জানান, গতকাল শনিবার ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের প্রায় ৪৫ কিলোমিটারজুড়ে দিনভর ভয়াবহ যানজটে স্থবির ছিল মহাসড়ক।
পুলিশ জানায়, মহাসড়কের করটিয়া, ঘারিন্দাসহ তিনটি স্থানে গরুবাহী ট্রাক এবং যাত্রীবাহী বাস বিকল হয়ে পড়ে। এতে সকাল ৯টার পর থেকে মহাসড়কে যানজট শুরু হয়। এ ছাড়া এলেঙ্গার কাছে একটি দুর্ঘটনা ঘটলে মহাসড়কের এ যানজট এলেঙ্গা থেকে মির্জাপুর উপজেলার ধেরুয়া পর্যন্ত প্রায় ৪৫ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত হয়। বিকল হওয়া যানগুলো রেকারের মাধ্যমে সরিয়ে নিতে প্রায় দেড়-দু'ঘণ্টা লেগে যায়। এ ব্যাপক যানজটে আটকা পড়ে ঈদে ঘরমুখো ৯০টি রুটের হাজার হাজার যাত্রী চরম দুর্ভোগের শিকার হন। হাইওয়ে পুলিশসহ পুলিশ প্রশাসনের আড়াই শতাধিক সদস্য শত চেষ্টা করেও তা দূর করতে পারেননি। হাইওয়ে মির্জাপুর থানার ওসি ছানোয়ার হোসেন জানান, এলেঙ্গা এলাকার প্রায় ১২ কিলোমিটার সড়কে খানাখন্দ এবং প্রচণ্ড ধুলার কারণে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
সায়েদাবাদ : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কের ৭০ কিলোমিটার যানজটে সব আয়োজন পণ্ড
সায়েদাবাস বাস টার্মিনালে হানিফ এন্টারপ্রাইজের কর্মকর্তা মাহবুব জানান, এবার ঈদের আগে যাত্রী হয়রানি বন্ধ করতে মালিকদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে বাসের অতিরিক্ত ট্রিপ নিয়ে যাতে সমস্যার সৃষ্টি না হয় সে জন্য বেশ কিছু ট্রিপের বিপরীতে বিকল্প বাস প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কে যানজটের কারণে বিকল্প বাস দিয়েও ট্রিপ ঠিক রাখা যায়নি। এখন অবস্থা এমন, যাত্রীদের ক্ষোভের মুখে কর্মচারীদের পালিয়ে যাওয়ার উপক্রম। সায়েদাবাদে স্টার লাইন পরিবহনে ফেনী যাওয়ার জন্য সকাল ৭টায় এসেছিলেন ফরিদ গাজী। কিন্তু দুপুর ২টা পর্যন্ত তিনি বাস পাননি। টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, সব পরিবহনের যাত্রীদের একই অবস্থা। বাসের সব ধরনের সিডিউল ভেঙে পড়েছে। এ সুযোগে ঢাকার ভেতর চলাচল করা লোকাল বাসগুলোতেও ঢাকা-কুমিল্লা, ঢাকা-নোয়াখালীসহ বিভিন্ন রুটের যাত্রী তুলতে দেখা যায়। ২২নং রুটের বেশ কিছু লোকাল বাসকে মাওয়ার যাত্রী তুলতে দেখা যায়।
আমাদের দাউদকান্দি প্রতিনিধি জানান, দেশের ব্যস্ততম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গতকাল আবারও দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে দাউদকান্দির মেঘনা-গোমতী সেতু পেরিয়ে গজারিয়ার ভবেরচর এলাকা পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। এতে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। মেঘনা-গোমতী সেতুর দাউদকান্দিতে টোল আদায়ের ছয়টি কাউন্টার থাকলেও তিনটি কাউন্টারের মাধ্যমে টোল আদায় করায় যানবাহন সঠিকভাবে পার হতে না পারায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। ফলে জনদুর্ভোগ আরও তীব্র আকার ধারণ করে। কুমিল্লার সহকারী পুলিশ সুপার (মুরাদনগর সার্কেল) জাহাঙ্গীর আলম জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত গাড়ি চলাচলই যানজটের মূল কারণ। তাছাড়া মেঘনা-গোমতী সেতুর ঝুঁকির কারণে ধীরগতিতে যানবাহন চলাচল করায় যানজট নিরসন করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। গত রোজার ঈদের মতো এবারও তিনদিন ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চলাচল বন্ধ থাকলে যানজট হতো না। এ ব্যাপারে সেতুর টোল প্লাজা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, ইচ্ছা থাকলেও ঝুঁকির কারণে একসঙ্গে অনেক গাড়ি ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চালকরা জানান, মহাসড়কে বড় বড় গর্তের কারণে গাড়ি অনেক ধীরে চালাতে হচ্ছে। এতে মহাসড়কের যানজট মহাজটে পরিণত হচ্ছে। সরেজমিন দেখা যায়, মহাসড়ক ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান দখল করে আছে। এদিকে মহাসড়কের সঙ্গে যে আঞ্চলিক সড়কগুলো এসে মিলিত হয়েছে ওইসব সড়কেও সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। মহাসড়কের দাউদকান্দির গৌরীপুর, ইলিয়টগঞ্জ, চান্দিনা বাসস্ট্যান্ড, নিমসার সড়কের দু'পাশে অবৈধভাবে দোকানপাট, সিএনজি, মাইক্রো ও অটোরিকশার স্ট্যান্ড গড়ে ওঠায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
লৌহজং প্রতিনিধি জানান, ঘরমুখো মানুষের ভিড়ে মাওয়া পরিণত হয়েছে জনসমুদ্রে। সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চৌরাস্তা থেকে ২ কিলোমিটার দূরে খানবাড়ি পর্যন্ত যানজট ছড়িয়ে পড়ে। ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় সারিবদ্ধভাবে সহস্রাধিক যানবাহন মহাসড়কের পাশে আটকে থাকে। লোকাল বাসের যাত্রীরা দুই কিলোমিটার দূরে নেমে হেঁটে মাওয়া ঘাটে গিয়ে লঞ্চ, স্পিডবোট ও ট্রলারে করে পদ্মা পাড়ি দেন। এ সময় দীর্ঘ পথ হেঁটে ঘাটে আসতে যাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিশেষ করে নারী ও শিশু যাত্রীদের ভোগান্তি ছিল অসহনীয়। ভিড় এড়াতে অনেক যাত্রীকেই সহজ ও সংক্ষিপ্ত রাস্তায় ঘাটে যেতে মহাসড়ক ছেড়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে বিকল্প পথে যেতে দেখা যায়।
ঢাকা থেকে খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, বাগেরহাট, মাদারীপুর, টেকেরহাট, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জগামী ও ঢাকা-মাওয়া রুটের লোকাল বাসগুলোতে ছাদে ও ভেতরে ছিল উপচেপড়া ভিড়। গত ঈদে মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটে ঈদ স্পেশাল সার্ভিসসহ ১৬টি ফেরি চলাচল করলেও এ ঈদে দেওয়া হয়েছে ১৪টি ফেরি। দুটি ফেরি কম থাকায় ১৪টি ফেরি সার্বক্ষণিক চালু থাকলেও সকালে অতিরিক্ত গাড়ির চাপে ঘাটে পারাপারের অপেক্ষায় আটকা পড়ে সহস্রাধিক গাড়ি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি লাইনে রেখে ফেরি পারাপার হতে হচ্ছে।
ট্রেনের সিডিউল ঠিক হলো না :যোগাযোগমন্ত্রীর দীর্ঘমেয়াদি আশ্বাস
গত বৃহস্পতিবার কমলাপুর রেলস্টেশন পরিদর্শনে এসে যোগাযোগমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, শুক্রবারের মধ্যে ট্রেনের সব সিডিউল ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু গতকাল শুক্রবার সকালে তিনি আরও এক দফা কমলাপুর এসে বলেন, নরসিংদীর ঘটনার কারণে ট্রেনের সিডিউলে সমস্যা হয়েছে। বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পর পরিস্থিতি পুরোপুরি ঠিক হচ্ছে না। ঈদের পরও ট্রিপ নিয়ে কিছুটা সমস্যা থাকতে পারে। আমরা সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদ পর্যন্ত সময় দিন, এমন অনেক কিছুই দেখবেন যা আগে কখনও দেখেননি। মানুষের এ ভোগান্তির চিত্র থাকবে না।
কমলাপুর রেলস্টেশন সূত্র জানায়, সকালে লালমনিরহাটগামী ট্রেন ছাড়তে সাত ঘণ্টা দেরি হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেটগামী ট্রেন তিন থেকে চার ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি রুটের ট্রেন এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ছে। এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন যাত্রীরা। লালমনিরহাটগামী যাত্রী সোহেলী আকতার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সমস্যা হয়েছে নরসিংদীতে, তার জন্য নর্থ বেঙ্গলের রুটে কেন সমস্যা হবে? কমলাপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের লোকাল ট্রেনগুলোতে শুধু কামরার ভেতরেই নয়, ছাদেও শত শত মানুষ উঠতে দেখা যায়। এদিকে বিকেলে কুমিল্লায় একটি মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হলে ঢাকা-নোয়াখালী এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ট্রেন চলাচল সাময়িক বন্ধ থাকে। ফলে দুর্ভোগ আরও এক দফা বাড়ে।
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল : সদরঘাটে ভোর থেকেই ঢল নামে মানুষের। ভিড়ের চাপে পন্টুন পার হয়ে লঞ্চে উঠতেই অনেককে পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ। ঢাকা-হুলারহাট, ঢাকা-কাউখালী, ঢাকা-চাঁদপুর, ঢাকা-ভোলা রুটের প্রতিটি লঞ্চকে দেখা যায় অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে। কেবিন বুকিং নিয়েও অভিযোগ করেন যাত্রীরা। দ্বীপরাজ নামে একটি লঞ্চে আগে থেকে কেবিন বুকিং দেওয়ার পরও তার কেবিনে অন্য যাত্রী তুলে দেওয়ার অভিযোগ করেন বরিশালগামী লুৎফর রহমান। অবশ্য লঞ্চের এক কর্মচারী জানান, যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে ছোটখাটো সমস্যা হচ্ছে। বিভিন্ন লঞ্চে একশ' টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া নেওয়ারও অভিযোগ করেন যাত্রীরা। ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের ছাত্র আসাদ জানান, তিনি বরিশালে যাওয়ার জন্য বাসের টিকিট কেটেছিলেন। ভয়াবহ যানজটের খবর পেয়ে সড়কপথের পরিবর্তে নৌপথকেই ভালো মনে করেছেন। তার বক্তব্য, একবার কষ্ট করে লঞ্চে উঠতে পারলে বাড়ি যাওয়া যাবে। অন্তত পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে না।
No comments