নরসিংদীর এসপি ক্লোজড, তদন্ত ডিবিতে ট্রেনে আগুনে ৫শ’ জনের বিরুদ্ধে ২ মামলা : রাজু ও লোকমানের বিবাদের নেপথ্যে
নরসিংদীর পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে গতকাল। ক্লোজ করা হয়েছে দুই এএসপিকেও। তাদের তলব করা হয়েছে ঢাকায়। অভিযোগ রয়েছে —মন্ত্রী গ্রুপের আশীর্বাদধন্য এ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মেয়র লোকমানের শীতল সম্পর্ক ছিল। এমনকি একটি ডাকাতি মামলা প্রভাবশালীদের চাপে এসপি না নেয়ায় মেয়র এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা নিতে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। অন্যদিকে লোকমান হত্যা মামলাটি ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।দুর্বল পারফরম্যান্স ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য গতকাল সকালে নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাস উদ্দিন ভুঞাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ক্লোজড করা হয় এএসপি
বিজয় বসাক (অপরাধ শাখা) ও এনামুল কবীরকে (বিশেষ শাখা)। পুলিশের আইজি বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এদিকে ট্রেনে আগুন ও স্টেশন ভাংচুরের ঘটনায় ভৈরব জিআরপি থানায় দুটি মামলা হয়েছে। দুই মামলায় ৪শ’ থেকে ৫শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এদিকে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ আলম মিয়াসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র নেতা জানান, এসপি আক্কাসের সঙ্গে নিহত মেয়র লোকমান হোসেনের সম্পর্ক ভালো ছিল না। মেয়রের মৃত্যুর এক মাস আগেও গত ২৮-০৯-১১ইং তারিখে তার মহল্লা বাসাইলে প্রবাসী মাইনউদ্দিনের বাড়িতে ডাকাতি হয়। এ ঘটনায় পুলিশ প্রথমে মামলা নিতে চায়নি। পরে মেয়র এসপিকে ফোন করে মামলা নেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু এতে তিনি অনীহা প্রকাশ করেন। পরে সদর ওসির সামনেই মেয়র এসপিকে বলেন, ৫ হাজার লোক নিয়ে আসছি মামলা নেবেন না কেন, সেটাই বলতে হবে আপনাকে।
অবস্থা বেগতিক দেখে পরে এসপি দ্রুত ওসিকে মামলা নেয়ার নির্দেশ দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এ মামলার আইও জানান, ডাকাতি মামলার ৮ আসামির মধ্যে ৬ জনকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে তারা। অথচ এ মামলাটি পুলিশ সুপার নিতে চাননি।
এসব কারণে পুলিশ সুপারের সঙ্গে মেয়রের সম্পর্ক কখনই ভালো ছিল না। এছাড়া মন্ত্রীর নির্দেশ তামিল করতে এই এসপি সম্প্রতি মেয়রের ভাই শাহীনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা গ্রহণ করেছেন। শুধু তাই নয়, মন্ত্রীর নির্দেশ তামিল করতে এই এসপি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীসহ অনেক নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করে মন্ত্রীর ইচ্ছা পূরণ করেছেন। মেয়র প্রকাশ্যে তা প্রতিবাদ করতেন বলেও জানান তিনি।
রাজু ও লোকমানের বিবাদের নেপথ্যে
মন্ত্রী-মেয়র বিরোধের শুরু ছাত্র সংসদ নির্বাচন থেকে। শুরু থেকেই লোকমান হোসেনকে মেনে নিতে পারেনি নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা ভয় পেতেন লোকমানের জনপ্রিয়তাকে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ও ব্যবসায়ীদের কাছে লোকমান ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়।
তাই শুরু থেকেই জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা চেয়েছেন লোকমানকে আটকাতে। আর এর অংশ হিসেবে তারা বারবার বেছে নেন নরসিংদী সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে। এবার এ নির্বাচনে লোকমানের সঙ্গে সরাসরি বিবাদে জড়িয়ে পড়েন টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ও তার ভাই সালাউদ্দিন বাচ্চুসহ জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা। শেষ ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২৯ জুন, ২০১০। এ নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলে ভিপি প্রার্থী হিসেবে রনি মোল্লাকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং মন্ত্রী ও তার ভাই সমর্থিত গ্রুপ মনোনয়ন দিতে চায়।
কিন্তু এ মনোনয়ন মেনে নেননি লোকমান হোসেন। তিনি এ পদে তার ভাই শামীম নেওয়াজকে মনোনীত করেন। শামীম বর্তমানে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।
বড় ভাইয়ের সমর্থন নিয়ে শামীম ভিপি নির্বাচনে অংশ নেন। এর প্রতিবাদে রনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জেলা আওয়ামী লীগ এবং মন্ত্রীর আশীর্বাদ নিয়ে। নির্বাচনে শামীমকে হারানোর জন্য আদাজল খেয়ে নামে লোকমানবিরোধী গ্রুপ। কিন্তু লোকমানের জনপ্রিয়তার কাছে ভেসে যায় মন্ত্রীর আশীর্বাদ। বিপুল ভোটে জয়ী হন শামীম। এরপর থেকেই জেলা ও আওয়ামী লীগ, মন্ত্রী এবং তার ভাইয়ের রোষানলে পড়েন লোকমান।
লোকমানবিরোধীরা বিএনপির সঙ্গে যোগসাজশে মেতে ওঠেন লোকমানকে প্রতিহত করতে। কিন্তু বারবার টার্গেট করেও লোকমানের জনপ্রিয়তার কাছে হেরে যায় প্রতিপক্ষ।
কিন্তু এবার হয়তো তারা আর হারতে চায়নি শহর থেকে মাদক ও সন্ত্রাস তাড়ানো লোকমানের কাছে। তাই দলীয় কার্যালয়েই পরিকল্পিতভাবে ৫টি বুলেটে থামিয়ে দিয়েছে আধুনিক শহরের এ স্বপ্ন নির্মাতাকে।
মেয়র হওয়ার পরই একটি আধুনিক শহর হিসেবে তার শহর গড়তে চেয়েছিলেন। এরই স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০০৯ ও ২০১০ সালে পরপর দু’বার জিতে নেন দেশে সেরা মেয়র হিসেবে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) পুরস্কার।
স্থানীয়দের ধারণা, লোকমান হোসেনের জনপ্রিয়তায় ক্ষুণ্ন হয় আওয়ামী লীগপাড়া হিসেবেখ্যাত শহরের ব্যাপারীপাড়ার নেতাদের রাজনৈতিক শক্তি। এতে ক্ষেপে ওঠেন ব্যাপারীপাড়ার নেতারা। এর সঙ্গে যোগ হয় মন্ত্রী রাজুর সঙ্গে বিরোধ। মন্ত্রীর সঙ্গে লোকমানের বিরোধ ছিল চোখে পড়ার মতো। মন্ত্রী যে বৈঠকে উপস্থিত থাকতেন, লোকমান সেখানে যেতেন না।
সবশেষে নরসিংদী সরকারি কলেজ মাঠে আয়োজিত পৌর বাণিজ্যমেলা সম্পর্কেও মন্ত্রীকে কিছু জানানো থেকে বিরত থাকেন লোকমান। শহরের নতুন ডাকঘর উদ্বোধনেও মন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানাননি তিনি।
ট্রেনে আগুন ও ভাংচুরের ঘটনায় দুই মামলা
বিডিনিউজ জানায়, পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার প্রতিবাদে আন্তঃনগর এগারোসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন ও স্টেশন ভাংচুরের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। স্টেশন ভাঙচুরের ঘটনায় মামলাটি করেছেন মাস্টার মরণ চন্দ্র দাস। এ ছাড়া এগারোসিন্দুর ট্রেনের পরিচালক আবদুল বারি বাদী হয়েছেন ট্রেন পোড়ানোর ঘটনায় দায়ের করা মামলার। ভৈরব জিআরপি থানায় করা উভয় মামলায় ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে মরণ চন্দ্র সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
গত মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হোসেন। এ হত্যার প্রতিবাদে নরসিংদীতে ৭২ ঘণ্টার হরতাল ডাকে জেলা ছাত্রলীগ। হরতালের প্রথম দিন সকাল ১০টার দিকে নরসিংদী স্টেশন এলাকায় এগারোসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধরা। এতে ওই ট্রেনের নয়টি বগি পুড়ে যায়। এ ছাড়া লোকমানের নিহত হওয়ার খবর পেয়ে মঙ্গলবার রাতে তাত্ক্ষণিক রেলওয়ে স্টেশনে ব্যাপক ভাংচুর করা হয়।
স্টেশন মাস্টার মরণ চন্দ্র দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মামলায় আগুনে নয়টি বগি পুড়ে যাওয়ায় রেলওয়ের এক কোটি ৮৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর ভাংচুরের কারণে স্টেশনের আর্থিক ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়েছে তিন কোটি ৬৫ লাখ ২২ হাজার ৮০০ টাকা।
দুটি মামলা হলেও কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি বলে জানান মরণ চন্দ্র। এর আগে হত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ছোট ভাইকে প্রধান আসামি করে ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহতের ভাই মো. কামরুজ্জামান।
লোকমান হত্যা মামলা ডিবিতে
নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেনকে হত্যার ঘটনায় টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ছোট ভাইসহ ১৪ জনকে আসামি করে দায়ের মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সদর থানার ওসি আনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, শুক্রবার সকালে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
মামলার আসামিরা হলেন—টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ছোট ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব মাসুদুর রহমান মুরাদ, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল মতিন সরকার, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজউদ্দীন ভূঁইয়া, সদর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম, শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মিয়া মো. মঞ্জুর, নরসিংদী শহর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন সরকার, মোবারক হোসেন, মনোয়ার হোসেন খান, হিরণ মিয়া, তারেক আহমেদ, কবীর সরকার, আজিজ মিয়া ও মামুন।
টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ছোট ভাই বাচ্চুকে মামলার আসামি করা প্রসঙ্গে বাদী কামরুজ্জামান বৃহস্পতিবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘বাচ্চু সার্কিট হাউজে বসে আমার ভাইকে হত্যার পরিকল্পনা করেছেন।’
অবিলম্বে আসামিদের গ্রেফতারের দাবি জানান তিনি।
নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের আগামী কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। এ ইচ্ছার কথা তিনি বিভিন্ন জনকে জানিয়েছিলেন। মন্ত্রীর ভাই সালাউদ্দিন বাচ্চুর নামও একই পদে আলোচনায় থাকায় দুজনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে বলে স্থানীয় নেতারা জানান। লোকমান হত্যাকাণ্ডে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর মদত রয়েছে বলেও এরই মধ্যে অভিযোগ করেছেন নরসিংদী ছাত্রলীগ নেতারা।
এদিকে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ আলম মিয়াসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র নেতা জানান, এসপি আক্কাসের সঙ্গে নিহত মেয়র লোকমান হোসেনের সম্পর্ক ভালো ছিল না। মেয়রের মৃত্যুর এক মাস আগেও গত ২৮-০৯-১১ইং তারিখে তার মহল্লা বাসাইলে প্রবাসী মাইনউদ্দিনের বাড়িতে ডাকাতি হয়। এ ঘটনায় পুলিশ প্রথমে মামলা নিতে চায়নি। পরে মেয়র এসপিকে ফোন করে মামলা নেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু এতে তিনি অনীহা প্রকাশ করেন। পরে সদর ওসির সামনেই মেয়র এসপিকে বলেন, ৫ হাজার লোক নিয়ে আসছি মামলা নেবেন না কেন, সেটাই বলতে হবে আপনাকে।
অবস্থা বেগতিক দেখে পরে এসপি দ্রুত ওসিকে মামলা নেয়ার নির্দেশ দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এ মামলার আইও জানান, ডাকাতি মামলার ৮ আসামির মধ্যে ৬ জনকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে তারা। অথচ এ মামলাটি পুলিশ সুপার নিতে চাননি।
এসব কারণে পুলিশ সুপারের সঙ্গে মেয়রের সম্পর্ক কখনই ভালো ছিল না। এছাড়া মন্ত্রীর নির্দেশ তামিল করতে এই এসপি সম্প্রতি মেয়রের ভাই শাহীনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা গ্রহণ করেছেন। শুধু তাই নয়, মন্ত্রীর নির্দেশ তামিল করতে এই এসপি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীসহ অনেক নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করে মন্ত্রীর ইচ্ছা পূরণ করেছেন। মেয়র প্রকাশ্যে তা প্রতিবাদ করতেন বলেও জানান তিনি।
রাজু ও লোকমানের বিবাদের নেপথ্যে
মন্ত্রী-মেয়র বিরোধের শুরু ছাত্র সংসদ নির্বাচন থেকে। শুরু থেকেই লোকমান হোসেনকে মেনে নিতে পারেনি নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা ভয় পেতেন লোকমানের জনপ্রিয়তাকে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ও ব্যবসায়ীদের কাছে লোকমান ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়।
তাই শুরু থেকেই জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা চেয়েছেন লোকমানকে আটকাতে। আর এর অংশ হিসেবে তারা বারবার বেছে নেন নরসিংদী সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে। এবার এ নির্বাচনে লোকমানের সঙ্গে সরাসরি বিবাদে জড়িয়ে পড়েন টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ও তার ভাই সালাউদ্দিন বাচ্চুসহ জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা। শেষ ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২৯ জুন, ২০১০। এ নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলে ভিপি প্রার্থী হিসেবে রনি মোল্লাকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং মন্ত্রী ও তার ভাই সমর্থিত গ্রুপ মনোনয়ন দিতে চায়।
কিন্তু এ মনোনয়ন মেনে নেননি লোকমান হোসেন। তিনি এ পদে তার ভাই শামীম নেওয়াজকে মনোনীত করেন। শামীম বর্তমানে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।
বড় ভাইয়ের সমর্থন নিয়ে শামীম ভিপি নির্বাচনে অংশ নেন। এর প্রতিবাদে রনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জেলা আওয়ামী লীগ এবং মন্ত্রীর আশীর্বাদ নিয়ে। নির্বাচনে শামীমকে হারানোর জন্য আদাজল খেয়ে নামে লোকমানবিরোধী গ্রুপ। কিন্তু লোকমানের জনপ্রিয়তার কাছে ভেসে যায় মন্ত্রীর আশীর্বাদ। বিপুল ভোটে জয়ী হন শামীম। এরপর থেকেই জেলা ও আওয়ামী লীগ, মন্ত্রী এবং তার ভাইয়ের রোষানলে পড়েন লোকমান।
লোকমানবিরোধীরা বিএনপির সঙ্গে যোগসাজশে মেতে ওঠেন লোকমানকে প্রতিহত করতে। কিন্তু বারবার টার্গেট করেও লোকমানের জনপ্রিয়তার কাছে হেরে যায় প্রতিপক্ষ।
কিন্তু এবার হয়তো তারা আর হারতে চায়নি শহর থেকে মাদক ও সন্ত্রাস তাড়ানো লোকমানের কাছে। তাই দলীয় কার্যালয়েই পরিকল্পিতভাবে ৫টি বুলেটে থামিয়ে দিয়েছে আধুনিক শহরের এ স্বপ্ন নির্মাতাকে।
মেয়র হওয়ার পরই একটি আধুনিক শহর হিসেবে তার শহর গড়তে চেয়েছিলেন। এরই স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০০৯ ও ২০১০ সালে পরপর দু’বার জিতে নেন দেশে সেরা মেয়র হিসেবে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) পুরস্কার।
স্থানীয়দের ধারণা, লোকমান হোসেনের জনপ্রিয়তায় ক্ষুণ্ন হয় আওয়ামী লীগপাড়া হিসেবেখ্যাত শহরের ব্যাপারীপাড়ার নেতাদের রাজনৈতিক শক্তি। এতে ক্ষেপে ওঠেন ব্যাপারীপাড়ার নেতারা। এর সঙ্গে যোগ হয় মন্ত্রী রাজুর সঙ্গে বিরোধ। মন্ত্রীর সঙ্গে লোকমানের বিরোধ ছিল চোখে পড়ার মতো। মন্ত্রী যে বৈঠকে উপস্থিত থাকতেন, লোকমান সেখানে যেতেন না।
সবশেষে নরসিংদী সরকারি কলেজ মাঠে আয়োজিত পৌর বাণিজ্যমেলা সম্পর্কেও মন্ত্রীকে কিছু জানানো থেকে বিরত থাকেন লোকমান। শহরের নতুন ডাকঘর উদ্বোধনেও মন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানাননি তিনি।
ট্রেনে আগুন ও ভাংচুরের ঘটনায় দুই মামলা
বিডিনিউজ জানায়, পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার প্রতিবাদে আন্তঃনগর এগারোসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন ও স্টেশন ভাংচুরের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। স্টেশন ভাঙচুরের ঘটনায় মামলাটি করেছেন মাস্টার মরণ চন্দ্র দাস। এ ছাড়া এগারোসিন্দুর ট্রেনের পরিচালক আবদুল বারি বাদী হয়েছেন ট্রেন পোড়ানোর ঘটনায় দায়ের করা মামলার। ভৈরব জিআরপি থানায় করা উভয় মামলায় ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে মরণ চন্দ্র সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
গত মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হোসেন। এ হত্যার প্রতিবাদে নরসিংদীতে ৭২ ঘণ্টার হরতাল ডাকে জেলা ছাত্রলীগ। হরতালের প্রথম দিন সকাল ১০টার দিকে নরসিংদী স্টেশন এলাকায় এগারোসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধরা। এতে ওই ট্রেনের নয়টি বগি পুড়ে যায়। এ ছাড়া লোকমানের নিহত হওয়ার খবর পেয়ে মঙ্গলবার রাতে তাত্ক্ষণিক রেলওয়ে স্টেশনে ব্যাপক ভাংচুর করা হয়।
স্টেশন মাস্টার মরণ চন্দ্র দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মামলায় আগুনে নয়টি বগি পুড়ে যাওয়ায় রেলওয়ের এক কোটি ৮৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর ভাংচুরের কারণে স্টেশনের আর্থিক ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়েছে তিন কোটি ৬৫ লাখ ২২ হাজার ৮০০ টাকা।
দুটি মামলা হলেও কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি বলে জানান মরণ চন্দ্র। এর আগে হত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ছোট ভাইকে প্রধান আসামি করে ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহতের ভাই মো. কামরুজ্জামান।
লোকমান হত্যা মামলা ডিবিতে
নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেনকে হত্যার ঘটনায় টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ছোট ভাইসহ ১৪ জনকে আসামি করে দায়ের মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সদর থানার ওসি আনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, শুক্রবার সকালে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
মামলার আসামিরা হলেন—টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ছোট ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব মাসুদুর রহমান মুরাদ, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল মতিন সরকার, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজউদ্দীন ভূঁইয়া, সদর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম, শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মিয়া মো. মঞ্জুর, নরসিংদী শহর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন সরকার, মোবারক হোসেন, মনোয়ার হোসেন খান, হিরণ মিয়া, তারেক আহমেদ, কবীর সরকার, আজিজ মিয়া ও মামুন।
টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ছোট ভাই বাচ্চুকে মামলার আসামি করা প্রসঙ্গে বাদী কামরুজ্জামান বৃহস্পতিবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘বাচ্চু সার্কিট হাউজে বসে আমার ভাইকে হত্যার পরিকল্পনা করেছেন।’
অবিলম্বে আসামিদের গ্রেফতারের দাবি জানান তিনি।
নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের আগামী কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। এ ইচ্ছার কথা তিনি বিভিন্ন জনকে জানিয়েছিলেন। মন্ত্রীর ভাই সালাউদ্দিন বাচ্চুর নামও একই পদে আলোচনায় থাকায় দুজনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে বলে স্থানীয় নেতারা জানান। লোকমান হত্যাকাণ্ডে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর মদত রয়েছে বলেও এরই মধ্যে অভিযোগ করেছেন নরসিংদী ছাত্রলীগ নেতারা।
No comments