কাঁদছে লোকমানের পরিবার : আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে by মাজহারুল পারভেজ

মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে নরসিংদীতে লেজে-গোবরে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি দলের এই নেতাকে টিঅ্যান্ডটি মন্ত্রীর ভাই সালাউদ্দিন বাচ্চু ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা-ক্যাডাররা মিলে খুন করেছে—প্রামাণ্য এই বিবরণ সংবলিত মামলা হওয়ার পরও বিচারের বাণী সেখানে কাঁদবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। হত্যাকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নরসিংদী শহরেই তারা আছে বলে অভিযোগ। তাদেরগ্রেফতার করার কোনো উদ্যোগ নেই। নিহত লোকমানের স্ত্রীর কান্না থামছে না। সরকারি দলের কয়েকজন মহিলা এমপি তার সঙ্গে দেখা করলে তিনি প্রবল আকুতি জানান, তার স্বামী হত্যার যেন দ্রুত বিচার হয়।


প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানান তিনি। লোকমান হোসেনের স্ত্রী তার দুই অবুঝ সন্তানকে কোলে নিয়ে যখন কাঁদছিলেন, কোনো সান্ত্বনাতেই তাদের শান্ত করা যাচ্ছিল না। লোকমান হোসেনের পরিবার খুব আশা করছিল প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে সান্ত্বনা ও দ্রুত কঠোর বিচারের আশ্বাস পাবে তারা। কিন্তু মামলা হওয়ার পরও খুনি-আসামিদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ না নেয়ায় তারা হতাশ। বাদীর অভিযোগ
নিহতের ছোট ভাই মামলার বাদী কামরুজ্জামান কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলেন, সন্ত্রাসীরা শুধু আমার ভাইকে নয়, দেশের একজন শ্রেষ্ঠ মেয়রকে নির্দয়ভাবে মারার তিন দিন অতিক্রান্ত হলেও এফআইআরভুক্ত ১৪ আসামির কাউকেই আটক করতে পারেনি। এর বেশি আমার কিছু বলার নেই।
আসামিরা সবাই ক্রিমিনাল
নরসিংদী পৌর এলাকার ব্রাহ্মন্দী মহল্লার ব্যবসায়ী সোহেল ভুঞা জানান, এ মামলায় যে ১৪ জনকে আসামি করা হয়েছে তাদের অতীত ইতিহাস কলঙ্কময়। তারা একে অপরের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে হত্যা, রাহাজানি, জমি জবরদখল ও নারী নির্যাতনসহ নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে তাদের নানা অপকর্ম আরও বেড়ে যায়। আর মন্ত্রীর শেল্টার ও তার ভাইয়ের নির্দেশেই জননন্দিত এই মানুষটিকে তারা নৃশংসভাবে খুন করার সাহস পেয়েছে।
জেলা আওয়মী লীগের প্রচার সম্পাদক শামসুল আলম ভুঞা রাখিল বলেন, নরসিংদীর মানুষকে উন্নয়ন আর শান্তি থেকে বঞ্চিত করার জন্যই লোকমান হোসেনকে খুন করা হয়েছে। তিনি আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বলেন, প্রশাসন কারও অঙ্গুলির নির্দেশে এই মামলা নিয়ে কোনো অবহেলা করলে নরসিংদীর মানুষ তা শক্ত হাতে প্রতিহত করবে।
আসামিদের তিনজনই পরাজিত মেয়র প্রার্থী
গত পৌর নির্বাচনে যারা মেয়র প্রার্থী ছিলেন তাদের মধ্যে তিন খুনি পরাজিত মেয়র প্রার্থী। তারা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল মতিন সরকার, শহর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মোবারক হোসেন মোবা ও নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি তারেক আহমেদ।
প্রতিবাদ সভা
এদিকে পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার প্রতিবাদে প্রতিবাদ সভা করেছে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগ। আজ বিকাল সাড়ে ৪টায় জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে এ প্রতিবাদ সভা হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঞা, সহ-সভাপতি শওকত আলী ইঞ্জিনিয়ার, প্রচার সম্পাদক শামসুল আলম ভূঞা রাখিলসহ অন্যান্য স্থানীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন।
তবে ঘটনার তিনদিন অতিক্রান্ত হলেও পুলিশ কেন আসামি ধরতে পারেনি এব্যাপারে টু শব্দটি উচ্চারণ করেননি কোনো নেতা। তাছাড়া শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আসামি মন্তাজ উদ্দিনের বড় ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঞাকে এ মঞ্চে দেখে অনেক শোকাহত মানুষকে নানা কটূক্তি করতে শোনা গেছে।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার রাত ৮টায় নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সভা করার সময় সন্ত্রাসীরা তাকে বুকে, পেটে ও হাতে ৫টি গুলি করে পালিয়ে যায়। পরে দ্রুত তাকে গুরুতর আহতাবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে সদর ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর ওটিতে রাত ১১টায় তিনি মারা যান।
ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা লোকমানের পরিবারের
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম জানায়, সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে তার পরিবার।
শুক্রবার নরসিংদীর বাসাইল এলাকার নিজ বাড়িতে এ আশঙ্কার কথা জানান নিহতের স্ত্রী নুসরাত জাহান বুবলি ও লোকমানের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম।
তারা বলেন, লোকামান হোসেন নরসিংদীর গণমানুষের নেতা ছিলেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের একজন বিচক্ষণ ও নিবেদিতপ্রাণ নেতা ছিলেন। তাকে হত্যার সুষ্ঠু বিচার নিয়ে আমাদের আশঙ্কা রয়েছে।
কারণ হিসেবে তারা বলেন, এ হত্যার ঘটনায় দলের ষড়যন্ত্রকারী কয়েকজন নেতার নাম এসেছে। তারা দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে প্রভাবিত করতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।
তারা এ সময় বলেন, যদিও প্রধানমন্ত্রী আশা দিয়েছেন, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে। তারপরও আমাদের ধারণা, যতই দিন গড়াবে এ বিষয়টি ততই আড়ালে চলে যাবে। এক সময় দেখা যাবে, লোকমান হত্যার সুষ্ঠু বিচারের পরিবর্তে আমরাই নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে গেছি।
এজন্য তারা গণমাধ্যমসহ সবার প্রতি সহযোগিতার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রীর সান্ত্বনা আশা করেছিল লোকমানের পরিবার
প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সান্ত্বনার বাণী আশা করেছিল সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত নরসিংদী পৌর মেয়র লোকমানের পরিবার। তারা আশা করেছিল, প্রধানমন্ত্রী অন্তত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলবেন।
নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারি কলেজের ভিপি এবং নিহত লোকমানের ছোট ভাই শামীম বাংলানিউজকে বলেন, ‘ভাই হারিয়ে অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছি। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমরা আশা করেছিলাম, অভিভাবকহীন আমাদের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী অন্তত একবার টেলিফোন করে সান্ত্বনা দেবেন এবং অভয় দিয়ে এ হত্যার সুবিচারের কথা বলবেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মিডিয়ার মাধ্যমে শোক প্রকাশ করেছেন এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের পাঠিয়েছেন। কিন্তু এতে তো আমরা সান্ত্বনা খুঁজে পাই না।’
শামীম বলেন, ‘আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি, তখনই আমাদের বাবা মারা যান। বড় ভাই তখন থেকেই আমাদের বাবার মতো আগলে রেখে মানুষ করেছেন। কখনওই বাবার অভাব বুঝতে দেননি।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তো অনেক সময়ই অনেককে ফোন করে খোঁজ নিয়ে থাকেন। লোকমান হোসেনের মতো একজন জনপ্রিয় নেতাকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যার পর তিনি আমাদের সান্ত্বনা দেবেন, এমন আশা তো আমরা করতেই পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ভাই রাজনীতি করে যে শেখ হাসিনার হাতকেই শক্তিশালী করেছেন, তার প্রমাণ তো তার হত্যার পর এখানে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা। এছাড়া আমার ভাইয়ের জানাজায় যে লাখ লাখ লোক অংশ নিয়েছেন, তাও তো তিনি টেলিভিশনে দেখেছেন।’

No comments

Powered by Blogger.