চাঁদের অপর পিঠ কেউ দেখে না by ফারুক ওয়াসিফ

ভালো সেনাপতি কখনো অপ্রশিক্ষিত সেনাদের রণাঙ্গনে পাঠান না। তাতে ক্ষতি দুই দিকেই—এরা বেশি মারে এবং বেশি মরে। বিখ্যাত স্টার ট্রেক চলচ্চিত্রে এ রকম এক সেনাপতির সংলাপ ছিল: আমার সেনারাই আমার পরিবার। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী ভালো মানুষ, কিন্তু ভালো সেনাপতি নন। তিনি সবুজ শিক্ষার্থীদের এমন সব পাবলিক ‘পরীক্ষায়’ পাঠাচ্ছেন, যার জন্য তারা তৈরি নয়। আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি ১৯৯৪ সালে। আমাদের সময়েও পরীক্ষার আগে জ্বর আসত উত্তর জানা বা মুখস্থ করার কাজে। এখন জ্বর আসে পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র পাওয়া না-পাওয়ার উত্তেজনায়।
শিক্ষামন্ত্রী ঠিকই বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতিতে মুখস্থের বালাই নেই। হয় জানতে হবে, নয়তো প্রশ্নফাঁসের সুফল নিতে হবে। পরীক্ষার ভীতিকর ঐতিহ্য তাঁর আমলেই দূরীভূত হলো। পরীক্ষা নামের এই মহাযজ্ঞে ‘পরীক্ষার্থীরা’ উপর্যুপরিভাবে পাস করেছে, জিপিএ–৫ পাচ্ছে। রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়া হচ্ছে। বাংলার ঘরে ঘরে অনেক আনন্দ, পাড়া-গ্রামে মিষ্টির ফোয়ারা। কিন্তু একজন শিক্ষকের মন খুব খারাপ আজ। তিনি শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। পরীক্ষার ফল শুনে বৃহস্পতিবারের প্রথম আলোয় তিনি বলেছেন, ‘আমার জানামতে, প্রায় সবাই এবার পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র পেয়েছিল। শুধু যেসব ছেলে-মেয়ে সৎ ছিল, তারা নেয়নি। সুতরাং এই পরীক্ষার ফল আমার পক্ষে গুরুত্বসহকারে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই মূল্যায়নও করতে পারছি না।’
অথচ আমাদের শিক্ষামন্ত্রী কয়েক দিন আগেও সংসদে এলান করেছেন, ‘গত পাঁচ বছরে কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি’। মুহম্মদ জাফর ইকবাল একা নন। গণমাধ্যমের সংবাদে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিস্তর প্রমাণ হাজির রয়েছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসতে আমরা পারছি না। কারণ, এই সত্যের কোনো শক্তি নেই, সে কেবলই করে বঞ্চনা।
বঞ্চনার শিকার হয়েছে দেশের শিক্ষার্থীরা। অতীতে বঞ্চনার কারণ ছিল শিক্ষায় বৈষম্য, শিক্ষার মানের অবনতি ইত্যাদি। অতীতের সব বঞ্চনার ওপর সাড়ে ষোলো আনা হিসেবে তারা এখন যথাযথ পরীক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। না তারা, না শিক্ষার কান্ডারিরা—কেউই বলতে পারবে না, এখনকার উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা আসলে কেমন শিক্ষিত। যারা প্রশ্নপত্র নেয়নি, মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁদের সৎ বলেছেন, বোকা বলেননি। যারা প্রশ্নপত্র দুর্নীতির ফল ‘লাভ’ করেছে, তাদেরও তিনি অসৎ বলেননি। তবে সরল বুদ্ধিতে তারা এবং তাদের অনেক অভিভাবক ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়েছেন। এই সরকারের আমলে তারা উত্তীর্ণ হয়েছে বটে, তবে জীবনের পরীক্ষায় তারা অপ্রস্তুত অবস্থায়ই প্রবেশ করল। তাদের নিয়ে ভয়, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়, এত পাস, এত ডিগ্রি, এত সনদ; কিন্তু নিজেকে বা দেশকে এরা কী দেবে?
সত্যিকার পরীক্ষাগুলো হয় জীবনের পথে, চাকরিতে, উচ্চশিক্ষার সুযোগে। সেখানে তো কেউ তাদের ছাড় দেবে না। আজ যে পরীক্ষার্থী ৫০ নম্বর পাওয়ার যোগ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুবাদে সে ৮০-৯০ পেয়ে উত্তীর্ণ হচ্ছে। কিন্তু জীবনের পরীক্ষা এমনই নিশ্ছিদ্র যে, এই বাড়তি নম্বর পাওয়ার খেসারত সেখানে বহুগুণে দিতে হবে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীরা অসততার সবক নিয়েছে। অদৃষ্টপূর্ব পাস আর অসম্ভব জিপিএ–৫–এর বড়াই দিয়ে সরকার কৃতিত্ব দাবি করার সুযোগ পেলেও, শিক্ষার সর্বনাশ হচ্ছে এই পথেই।
শিক্ষামন্ত্রী যতই বড়াই করুন, নিশ্ছিদ্র পরীক্ষাপদ্ধতির নমুনা সোনার পাথরবাটিতে পরিণত হবে। আসলে প্রশ্নটা পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ে নয়, স্বয়ং পরীক্ষা নিয়েই। এভাবে উত্তীর্ণরা কতটা যোগ্য, তা বোঝা যাবে একটি পরিসংখ্যানে। ২০১২ সালে স্নাতক সম্মান প্রথম বর্ষে ক, খ ও গ ইউনিটে জিপিএ-৫ পাওয়া ৪৪ হাজার ৬৪২ জন শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বসেছিলেন। এর মধ্যে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ১৯ হাজার ৮৬৮ জন বা প্রায় ৪৫ শতাংশ। বাকি ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ দূরের কথা, পাসই করতে পারেননি। ২০১০ ও ২০১১ সালে এই অনুত্তীর্ণের হার ছিল যথাক্রমে ৫২ ও ৫৩ শতাংশ। আজকে ভালো ফল করা শিক্ষার্থীদের হাসি-খুশি-সুখী ছবি সবাই ছাপছে, প্রচার করছে। কিন্তু মাত্র কয়েক মাস পরে এদের অধিকাংশই যখন ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পেরে হতাশায় নিমজ্জিত হবে, যখন হতাশা থেকে অনেকে ভুল পথে পা বাড়াবে, যখন তাদের জন্য তাদের পরিবারে নেমে আসবে অন্ধকার; সেই অন্ধকারের ছবি কোথাও প্রচারিত হবে না। কেউ তাদের মনে রাখবে না। প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী পাসের রেকর্ড নিয়ে গর্ব করে যাবেন, কিন্তু এদের জীবনের দায়দায়িত্ব কীভাবে নেবেন তাঁরা? চাঁদের অপর পিঠ কেউ দেখে না।
ভালো ফল করা শিক্ষার্থীদেরই যখন এমন দুর্গতির ভয়, তখন যারা ভালো ফল করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের কী হবে? পাবলিক পরীক্ষা পাবলিক তথা সর্বজনের পরীক্ষা। সরকার, শিক্ষাব্যবস্থা ও অভিভাবকের যত্ন ও নিষ্ঠা ছাড়া পাবলিক পরীক্ষার পাবলিক সুফল আসে না। কিন্তু আমরা দেখি, সরকার দায়িত্ব নেবে না, অভিভাবক বুঝতে চাইবেন না, সব দোষ হবে ওই সব শিক্ষার্থীর, যারা সোনার হরিণ ধরতে পারেনি। পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভুল করবে, গাফিলতি করবে, কিন্তু তার দায় শোধ করতে হবে প্রাইভেট তথা ব্যক্তিগত জীবনে। একেই বলে পাবলিক সমস্যার প্রাইভেট ভোগান্তি।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.