রাজনৈতিক অর্থায়নে চাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি by এম সাখাওয়াত হোসেন
আমাদের রাজনীতি নির্বাচনের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিরোধী দল বিএনপি ও এর শরিকেরা একটি বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এবং আশু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের হুমকি অব্যাহত রেখেছে। অপর দিকে সরকারি দল রাস্তায় আন্দোলনকে অঙ্কুরেই প্রতিহত করার দৃঢ়প্রত্যয় প্রায় প্রতিদিন জনমানুষকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এসব বাদানুবাদের মধ্যে যা কখনো আলোচিত হয় না, তা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর পরিচালনার ক্ষেত্রে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা, জনগণের কাছে জবাবদিহি এবং আর্থিক বিষয়ক স্বচ্ছতা। দলের পরিচালনার ক্ষেত্রে যেমন গণতন্ত্র চর্চার প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন আর্থিক স্বচ্ছতা। অপর দিকে প্রয়োজন নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় আরও গতিশীল, আরও স্বচ্ছতা এবং সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য সমান সুযোগ ও আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা। এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো দলেরই, বিশেষ করে বিএনপি জোটের কোনো উদ্বেগ দেখা যায় না।
গণতান্ত্রিক পরিবেশে সব রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং নির্বাচনের মাধ্যমে নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে দেশ পরিচালনা করা। সন্দেহ নেই, এসবই নিশ্চিত করা হয় নির্দিষ্ট কাঠামোর মাধ্যমে। নিয়ম-নীতি ও আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে। নির্বাচন ব্যবস্থাপনার অন্যতম বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক অর্থায়নের ওপরে নজরদারি, রাজনৈতিক দল পরিচালনা ও নির্বাচনের জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং ব্যয়ের ওপর একধরনের স্বচ্ছতা আনয়নে সহায়তা করা।
রাজনৈতিক অর্থায়ন মানে শুধু নির্বাচনের জন্যই নয়, দল পরিচালনার জন্য অর্থের সাশ্রয় করা। রাজনৈতিক অর্থায়ন হয় বিভিন্ন উপায়ে। এ বিষয়ে স্বচ্ছতা আনয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের আইন রয়েছে নানা দেশে। আমাদের দেশে অতীতে এমন আইন ছিল না। ২০০৮ সালে নির্বাচনী ও আইনের সংস্কারের অন্যতম উপাদান ছিল এই অর্থায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলকে আরও স্বচ্ছ হতে উদ্বুদ্ধ করা। দল পরিচালনা ও নির্বাচনী খরচের সাশ্রয়ের কোনো জবাবদিহি না থাকায় ওই সময় এ ধরনের অভিযোগ সহজেই উত্থাপিত হয়। নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে। এসব কারণেই নির্বাচনী সংস্কারের সময় বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশনের যে আইন আরপিওতে (RPO) সংযোগ করা হয় আইনের ওই অধ্যায়ে ৯০ এফ(১) (a)(i)(ii) [90F(1)(a)(i)(ii)]-তে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং কোম্পানি ও কোনো সংস্থা থেকে অর্থ অনুদানের একটি সীমা নির্ধারণ করে ধারা সংযোজন করা হয়েছিল। এবং ওই ধারার (২) উপধারায় [90F(2)] রাজনৈতিক দলের অর্থায়নের জন্য কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি অনুদানপ্রাপ্ত বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও এবং বাংলাদেশি নয় এমন ব্যক্তি থেকে অনুদান গ্রহণ নিষিদ্ধ হয়েছিল।
রেজিস্ট্রেশন আইনের বিধিমালায় প্রতিবছর প্রতিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে তাদের অ্যাকাউন্টের অডিট রিপোর্টসহ পুরো বছরের হিসাবনিকাশও বাধ্যতামূলকভাবে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করার বিধি প্রণোয়ন করা হয়েছিল এবং ২০১০ সাল থেকে প্রতিটি রাজনৈতিক দল বিধির এ ধারা মেনে অডিট স্টেটমেন্ট দাখিল করে আসছে। এসব নতুন সংযোজন ছিল রাজনৈতিক অর্থায়নে যত দূর সম্ভব স্বচ্ছতা আনা।
যা–ই হোক, ওপরের সংশোধনীর আলোকে নিরীক্ষণ করা অ্যাকাউন্টের দাখিলের মাধ্যমে কিছুটা হলেও রাজনৈতিক দলের অর্থায়নের বিষয়ে স্বচ্ছতার সূত্রপাত হয়েছে। রাজনৈতিক দলের অর্থায়নের যে ব্যবস্থা আইন দ্বারা তৈরি করা হয়েছে, তা নিরূপণ করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। রাজনৈতিক অর্থায়ন যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ও জবাবদিহির ক্ষেত্র সম্প্রসারণ না করা হয়, তবে দেশের নির্বাচনীব্যবস্থা যেমন স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য হবে না, তেমনি রাজনৈতিক দলের স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্রায়ণের প্রচেষ্টা আদৌ সফল হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। রাজনৈতিক অর্থায়নের বিষয় ছাড়াও রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির নির্বাচনী অর্থের সাশ্রয় এবং খরচের বিবরণ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দাখিল করার বিধান রয়েছে যথাক্রমে ধারা ৪৪ সিসিসি (44 ccc) এবং ধারা ৪৪ সি (44c)। অন্যথায় প্রার্থীর ও দলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও বিধান রয়েছে। তথাপি এসব জায়গায় আরও স্বচ্ছতা আনার জন্য আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে আরও স্বচ্ছ, ভোটার তথা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে আরও স্বচ্ছ করার এবং প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
রাজনৈতিক অর্থায়নের বিষয়টি শুধু বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে দুর্বল দিক তেমন নয়, বরং বহু উঠতি গণতান্ত্রিক দেশের বড় সমস্যা। প্রতিবেশী ভারতেও রাজনৈতিক অর্থায়নের বিষয়টি তেমন স্বচ্ছ নয়। তবে ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক অর্থায়নের বিষয়টি অনেকটা নিয়ন্ত্রিত ও স্বচ্ছ রাখতে সে দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা যথেষ্ট সচেতন। সম্প্রতি কংগ্রেস নেত্রী ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে দলের তহবিল থেকে বাণিজ্যিক সংস্থাকে কর্জ দেওয়ায় কোর্টে অভিযোগ উত্থাপনের পর মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ যে ভারতে আইনগতভাবে রাজনৈতিক দলের কর মওকুফ অর্থ থেকে কংগ্রেসের মুখপত্র এক পত্রিকাকে দেওয়া এবং সেখান থেকে লাভবান হওয়ার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজির বিরুদ্ধে নির্বাচনে অবৈধভাবে দলের জন্য অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তারও হয়েছেন। সারকোজির বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তিনি ২০০৭ ও ২০১২ সালে নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য বেআইনিভাবে অর্থ জোগাড় করেছেন। তিনিই প্রথম সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট, যাঁকে কোনো অপরাধজনিত কারণে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। অপর দিকে ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বারলুসকোনি এক ঘনিষ্ঠজন থেকে অর্থের বিনিময়ে তাঁর দলে ভেড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশের নির্বাচনী আইনে কিছুটা নিয়ন্ত্রণের ধারা থাকলেও সেগুলো যেমন পর্যাপ্ত নয়, তেমনি প্রয়োগও সঠিকভাবে করা হচ্ছে না।
রাজনৈতিক দলের অর্থের প্রয়োজন যে কারণে হয়ে থাকে, তার মুখ্য উদ্দেশ্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য দলকে প্রস্তুতকরণ। অবশ্য এর মধ্যে সাংগঠনিক তৎপরতা ও দল পরিচালনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত যেসব খাতে দলের অর্থ ব্যবহৃত হয়, তার মধ্যে কয়েকটি খাতের উল্লেখ করছি। এক. নির্বাচনসংক্রান্ত ও দলীয় প্রার্থীর জন্য, দুই. পুনর্নির্বাচনে প্রার্থীর জন্য, তিন. দলের কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রশিক্ষণ, চার. দলের নীতিনির্ধারণী ধারণাপত্র তৈরি ও দলের মতবাদ প্রচার, পাঁচ. দল পরিচালনার জন্য দৈনন্দিন খরচ এবং ছয়. নির্বাচনী বিষয়ে ভোটারদের সচেতনতা বাড়ানো। বর্তমানে ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক কোম্পানিসহ অন্যান্য অনুমোদিত সংস্থা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রদেয় অনুদান, স্বপ্রণোদিত প্রদানের সীমা বৃদ্ধি করা হলেও ওই সব খাত থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তদুপরি এসব অনুদান ঐচ্ছিক কি না, তা–ও জানার উপায় নেই।
২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশন থেকে রাজনৈতিক দলকে অনুদান প্রদানের যে সুপারিশ করা হয়েছিল, সেখানে অনুদান প্রদানকারীর এই অর্থ করমুক্ত রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাতে সায় দেয়নি। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক সরকারের কাছে একই বিষয়ে পুনরায় সুপারিশ করা হলেও তা কার্যকর হয়নি। এ ব্যবস্থা ব্যক্তির অনুদানের জন্যও প্রযোজ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। সে ক্ষেত্রে একদিকে অনুদান প্রদানকারী যেমন উৎসাহিত হবেন, তেমনি অর্থায়নে স্বচ্ছতা আসবে। সরকারের পক্ষেও নিবিড় নিরীক্ষণ করা সম্ভব হবে। রাজনৈতিক অর্থায়নে অনুদান একটি স্বীকৃত পদ্ধতি; একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের মোট অর্থে, যা বার্ষিক প্রতিবেদনে দেওয়া হয়ে থাকে, তা যতই অবাস্তব মনে হোক, কর রেয়াত দেওয়া যেতে পারে। তাতে আরও স্বচ্ছতা এবং সঠিক চিত্রও পাওয়া যেতে পারে।
রাজনৈতিক অর্থায়ন বিশ্বব্যাপী বহুল চর্চিত। বিষয়টি নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নির্বাচনে কালোটাকার ব্যবহার ঠেকাতে অর্থায়নের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পণ্ডিতদের মতে, এ অর্থায়ন প্রধানত তিনটি স্বীকৃত উপায়ে হয়ে থাকে। প্রথমত. রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বৈধ চাঁদা, দ্বিতীয়ত. ব্যক্তি ও কোম্পানি থেকে অনুদান এবং তৃতীয়ত. সরকারি অনুদান বিশেষ করে নির্বাচনী ব্যয়ে কিছুটা সহায়তা প্রদান। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে তৃণমূল পর্যায়েও স্বীকৃত পদ্ধতিতে ‘ফান্ড তৈরি’ জোগাড় করার বিধি রয়েছে। বর্তমান আরপিওতে উল্লিখিত প্রথম দুই পদ্ধতিতে অর্থায়নের উল্লেখ রয়েছে। তৃতীয় পদ্ধতি অর্থাৎ নির্বাচনী খরচ পাবলিক ফান্ড বা সরকারি কোষাগার থেকে প্রদান করা যায় কি না, তা নিয়ে অতীতে একবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এমনকি একটি খসড়াও তৈরি করাও হয়েছিল কিন্তু পূর্বতন নির্বাচন কমিশন সময়ের অভাবে এই প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে পারেনি। বর্তমানে এ নিয়ে কোনো আলোচনাও শোনা যায় না। আমাদের মতো দেশে যেখানে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা প্রতিনিয়ত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর শুধু নির্বাচন নিয়ে আন্দোলনে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার কোনো উন্নতি হবে কি না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও কালোটাকার অগাধ ব্যবহারের মতো সুযোগ বহাল রেখে যে পদ্ধতি বা সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক না কেন, তাতে সুফল বয়ে আনবে কি না সন্দেহ রয়েছে।
আমাদের রাজনৈতিক অর্থায়নের চিত্র একধরনের চাঁদাবাজি, সরকারি টেন্ডারবাজি এবং বহুল আলোচিত মনোনয়ন-বাণিজ্য। এ ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ডের হাত থেকে দল, রাজনীতি ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে বের করে আনতে হলে রাজনৈতিক অর্থায়নের সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগ বিশেষভাবে আবশ্যক। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। আমাদের মতো দেশে যেখানে রাজনৈতিক অর্থায়ন, বিশেষ করে নির্বাচনের প্রাক্কালে, মানে আইনবহির্ভূত উপায়ে অর্থায়ন, সে পথ থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পেতে হলে আমি মনে করি, সরকারি কোষাগার থেকে অনুদানের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা অত্যাবশ্যক।
এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
গণতান্ত্রিক পরিবেশে সব রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং নির্বাচনের মাধ্যমে নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে দেশ পরিচালনা করা। সন্দেহ নেই, এসবই নিশ্চিত করা হয় নির্দিষ্ট কাঠামোর মাধ্যমে। নিয়ম-নীতি ও আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে। নির্বাচন ব্যবস্থাপনার অন্যতম বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক অর্থায়নের ওপরে নজরদারি, রাজনৈতিক দল পরিচালনা ও নির্বাচনের জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং ব্যয়ের ওপর একধরনের স্বচ্ছতা আনয়নে সহায়তা করা।
রাজনৈতিক অর্থায়ন মানে শুধু নির্বাচনের জন্যই নয়, দল পরিচালনার জন্য অর্থের সাশ্রয় করা। রাজনৈতিক অর্থায়ন হয় বিভিন্ন উপায়ে। এ বিষয়ে স্বচ্ছতা আনয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের আইন রয়েছে নানা দেশে। আমাদের দেশে অতীতে এমন আইন ছিল না। ২০০৮ সালে নির্বাচনী ও আইনের সংস্কারের অন্যতম উপাদান ছিল এই অর্থায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলকে আরও স্বচ্ছ হতে উদ্বুদ্ধ করা। দল পরিচালনা ও নির্বাচনী খরচের সাশ্রয়ের কোনো জবাবদিহি না থাকায় ওই সময় এ ধরনের অভিযোগ সহজেই উত্থাপিত হয়। নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে। এসব কারণেই নির্বাচনী সংস্কারের সময় বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশনের যে আইন আরপিওতে (RPO) সংযোগ করা হয় আইনের ওই অধ্যায়ে ৯০ এফ(১) (a)(i)(ii) [90F(1)(a)(i)(ii)]-তে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং কোম্পানি ও কোনো সংস্থা থেকে অর্থ অনুদানের একটি সীমা নির্ধারণ করে ধারা সংযোজন করা হয়েছিল। এবং ওই ধারার (২) উপধারায় [90F(2)] রাজনৈতিক দলের অর্থায়নের জন্য কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি অনুদানপ্রাপ্ত বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও এবং বাংলাদেশি নয় এমন ব্যক্তি থেকে অনুদান গ্রহণ নিষিদ্ধ হয়েছিল।
রেজিস্ট্রেশন আইনের বিধিমালায় প্রতিবছর প্রতিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে তাদের অ্যাকাউন্টের অডিট রিপোর্টসহ পুরো বছরের হিসাবনিকাশও বাধ্যতামূলকভাবে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করার বিধি প্রণোয়ন করা হয়েছিল এবং ২০১০ সাল থেকে প্রতিটি রাজনৈতিক দল বিধির এ ধারা মেনে অডিট স্টেটমেন্ট দাখিল করে আসছে। এসব নতুন সংযোজন ছিল রাজনৈতিক অর্থায়নে যত দূর সম্ভব স্বচ্ছতা আনা।
যা–ই হোক, ওপরের সংশোধনীর আলোকে নিরীক্ষণ করা অ্যাকাউন্টের দাখিলের মাধ্যমে কিছুটা হলেও রাজনৈতিক দলের অর্থায়নের বিষয়ে স্বচ্ছতার সূত্রপাত হয়েছে। রাজনৈতিক দলের অর্থায়নের যে ব্যবস্থা আইন দ্বারা তৈরি করা হয়েছে, তা নিরূপণ করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। রাজনৈতিক অর্থায়ন যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ও জবাবদিহির ক্ষেত্র সম্প্রসারণ না করা হয়, তবে দেশের নির্বাচনীব্যবস্থা যেমন স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য হবে না, তেমনি রাজনৈতিক দলের স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্রায়ণের প্রচেষ্টা আদৌ সফল হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। রাজনৈতিক অর্থায়নের বিষয় ছাড়াও রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির নির্বাচনী অর্থের সাশ্রয় এবং খরচের বিবরণ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দাখিল করার বিধান রয়েছে যথাক্রমে ধারা ৪৪ সিসিসি (44 ccc) এবং ধারা ৪৪ সি (44c)। অন্যথায় প্রার্থীর ও দলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও বিধান রয়েছে। তথাপি এসব জায়গায় আরও স্বচ্ছতা আনার জন্য আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে আরও স্বচ্ছ, ভোটার তথা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে আরও স্বচ্ছ করার এবং প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
রাজনৈতিক অর্থায়নের বিষয়টি শুধু বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে দুর্বল দিক তেমন নয়, বরং বহু উঠতি গণতান্ত্রিক দেশের বড় সমস্যা। প্রতিবেশী ভারতেও রাজনৈতিক অর্থায়নের বিষয়টি তেমন স্বচ্ছ নয়। তবে ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক অর্থায়নের বিষয়টি অনেকটা নিয়ন্ত্রিত ও স্বচ্ছ রাখতে সে দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা যথেষ্ট সচেতন। সম্প্রতি কংগ্রেস নেত্রী ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে দলের তহবিল থেকে বাণিজ্যিক সংস্থাকে কর্জ দেওয়ায় কোর্টে অভিযোগ উত্থাপনের পর মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ যে ভারতে আইনগতভাবে রাজনৈতিক দলের কর মওকুফ অর্থ থেকে কংগ্রেসের মুখপত্র এক পত্রিকাকে দেওয়া এবং সেখান থেকে লাভবান হওয়ার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজির বিরুদ্ধে নির্বাচনে অবৈধভাবে দলের জন্য অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তারও হয়েছেন। সারকোজির বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তিনি ২০০৭ ও ২০১২ সালে নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য বেআইনিভাবে অর্থ জোগাড় করেছেন। তিনিই প্রথম সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট, যাঁকে কোনো অপরাধজনিত কারণে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। অপর দিকে ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বারলুসকোনি এক ঘনিষ্ঠজন থেকে অর্থের বিনিময়ে তাঁর দলে ভেড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশের নির্বাচনী আইনে কিছুটা নিয়ন্ত্রণের ধারা থাকলেও সেগুলো যেমন পর্যাপ্ত নয়, তেমনি প্রয়োগও সঠিকভাবে করা হচ্ছে না।
রাজনৈতিক দলের অর্থের প্রয়োজন যে কারণে হয়ে থাকে, তার মুখ্য উদ্দেশ্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য দলকে প্রস্তুতকরণ। অবশ্য এর মধ্যে সাংগঠনিক তৎপরতা ও দল পরিচালনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত যেসব খাতে দলের অর্থ ব্যবহৃত হয়, তার মধ্যে কয়েকটি খাতের উল্লেখ করছি। এক. নির্বাচনসংক্রান্ত ও দলীয় প্রার্থীর জন্য, দুই. পুনর্নির্বাচনে প্রার্থীর জন্য, তিন. দলের কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রশিক্ষণ, চার. দলের নীতিনির্ধারণী ধারণাপত্র তৈরি ও দলের মতবাদ প্রচার, পাঁচ. দল পরিচালনার জন্য দৈনন্দিন খরচ এবং ছয়. নির্বাচনী বিষয়ে ভোটারদের সচেতনতা বাড়ানো। বর্তমানে ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক কোম্পানিসহ অন্যান্য অনুমোদিত সংস্থা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রদেয় অনুদান, স্বপ্রণোদিত প্রদানের সীমা বৃদ্ধি করা হলেও ওই সব খাত থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তদুপরি এসব অনুদান ঐচ্ছিক কি না, তা–ও জানার উপায় নেই।
২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশন থেকে রাজনৈতিক দলকে অনুদান প্রদানের যে সুপারিশ করা হয়েছিল, সেখানে অনুদান প্রদানকারীর এই অর্থ করমুক্ত রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাতে সায় দেয়নি। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক সরকারের কাছে একই বিষয়ে পুনরায় সুপারিশ করা হলেও তা কার্যকর হয়নি। এ ব্যবস্থা ব্যক্তির অনুদানের জন্যও প্রযোজ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। সে ক্ষেত্রে একদিকে অনুদান প্রদানকারী যেমন উৎসাহিত হবেন, তেমনি অর্থায়নে স্বচ্ছতা আসবে। সরকারের পক্ষেও নিবিড় নিরীক্ষণ করা সম্ভব হবে। রাজনৈতিক অর্থায়নে অনুদান একটি স্বীকৃত পদ্ধতি; একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের মোট অর্থে, যা বার্ষিক প্রতিবেদনে দেওয়া হয়ে থাকে, তা যতই অবাস্তব মনে হোক, কর রেয়াত দেওয়া যেতে পারে। তাতে আরও স্বচ্ছতা এবং সঠিক চিত্রও পাওয়া যেতে পারে।
রাজনৈতিক অর্থায়ন বিশ্বব্যাপী বহুল চর্চিত। বিষয়টি নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নির্বাচনে কালোটাকার ব্যবহার ঠেকাতে অর্থায়নের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পণ্ডিতদের মতে, এ অর্থায়ন প্রধানত তিনটি স্বীকৃত উপায়ে হয়ে থাকে। প্রথমত. রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বৈধ চাঁদা, দ্বিতীয়ত. ব্যক্তি ও কোম্পানি থেকে অনুদান এবং তৃতীয়ত. সরকারি অনুদান বিশেষ করে নির্বাচনী ব্যয়ে কিছুটা সহায়তা প্রদান। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে তৃণমূল পর্যায়েও স্বীকৃত পদ্ধতিতে ‘ফান্ড তৈরি’ জোগাড় করার বিধি রয়েছে। বর্তমান আরপিওতে উল্লিখিত প্রথম দুই পদ্ধতিতে অর্থায়নের উল্লেখ রয়েছে। তৃতীয় পদ্ধতি অর্থাৎ নির্বাচনী খরচ পাবলিক ফান্ড বা সরকারি কোষাগার থেকে প্রদান করা যায় কি না, তা নিয়ে অতীতে একবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এমনকি একটি খসড়াও তৈরি করাও হয়েছিল কিন্তু পূর্বতন নির্বাচন কমিশন সময়ের অভাবে এই প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে পারেনি। বর্তমানে এ নিয়ে কোনো আলোচনাও শোনা যায় না। আমাদের মতো দেশে যেখানে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা প্রতিনিয়ত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর শুধু নির্বাচন নিয়ে আন্দোলনে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার কোনো উন্নতি হবে কি না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও কালোটাকার অগাধ ব্যবহারের মতো সুযোগ বহাল রেখে যে পদ্ধতি বা সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক না কেন, তাতে সুফল বয়ে আনবে কি না সন্দেহ রয়েছে।
আমাদের রাজনৈতিক অর্থায়নের চিত্র একধরনের চাঁদাবাজি, সরকারি টেন্ডারবাজি এবং বহুল আলোচিত মনোনয়ন-বাণিজ্য। এ ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ডের হাত থেকে দল, রাজনীতি ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে বের করে আনতে হলে রাজনৈতিক অর্থায়নের সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগ বিশেষভাবে আবশ্যক। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। আমাদের মতো দেশে যেখানে রাজনৈতিক অর্থায়ন, বিশেষ করে নির্বাচনের প্রাক্কালে, মানে আইনবহির্ভূত উপায়ে অর্থায়ন, সে পথ থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পেতে হলে আমি মনে করি, সরকারি কোষাগার থেকে অনুদানের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা অত্যাবশ্যক।
এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
No comments