মার্চের ষড়যন্ত্র: ফারুক, চেসল ও কিসিঞ্জার by মিজানুর রহমান খান

শোকের মাস আগস্ট না হয়ে মার্চ হতে পারত। কারণ পঁচাত্তরের মার্চে বা তার আগেই কৃচক্রীরা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছিল। অন্তত মার্কিন দলিলে তেমন ইঙ্গিত স্পষ্ট। পঁচাত্তরের ২২ মার্চ ঢাকা থেকে আরভিং চেসল আট পৃষ্ঠার এক গোপন তারবার্তায় সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে আলোচনা করেন। এতে সম্ভাব্য একটি অভ্যুত্থানের খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী, রক্ষীবাহিনী কার কী ভূমিকা হতে পারে, তা বিশ্লেষণ করেছেন চেসল। এমনকি ট্যাংকগুলোরও উল্লেখ করেছেন তিনি। এই কেব্ল আরও নির্দিষ্টভাবে এই প্রশ্ন সামনে এনেছে যে হেনরি কিসিঞ্জার মুজিবকে সতর্ক করার কথা জানতে চেয়েছেন, সেটি কে কবে কোথায় কখন কীভাবে করেছিল? সেই সতর্কীকরণের বয়ান সংবলিত নথি ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের উচিত প্রকাশ করা।
র–এর প্রধান আর এন কাও মুজিবকে অভ্যুত্থানকারীদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে পঁচাত্তরের মার্চে তাঁর এক বিশ্বস্ত সহচরকে পাঠিয়েছিলেন। আর এই মার্চেই চেসল লিখলেন, ‘আমাদের আরেকটি সন্দেহ হলো এমন সম্ভাবনা যে মুজিব তার নিজের বা ভারতীয় বা সোভিয়েত গোয়েন্দা সূত্রে ষড়যন্ত্র টের পেয়ে যেতে পারেন এবং তা ব্যর্থ করে দিতে পারেন। আমরা এটাও বাদ দিতে পারি না যে মুজিব হয়তো ষড়যন্ত্রকারীদের পরিচয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেন।’ চেসল এরপর আরও লিখলেন, ‘অপহরণ চেষ্টাকালে মুজিবকে যদি হত্যা করা হয়, তাহলে অভ্যুত্থানকারীরা প্রাথমিকভাবে বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়তে পারে।’ এই কেব্লটি লেখার ঠিক ৪৮ ঘণ্টা আগে যা ঘটল, তা–ও কি কাকতালীয়? আসুন আমরা ওই ট্যাংক সরবরাহকারী মিসর ঘুরে আসি।
নীল নদ বিধৌত মনোরম নগর আসওয়ান। হেনরি কিসিঞ্জারের মধ্যপ্রাচ্য ‘দৌড়ঝাঁপ কূটনীতি’র অন্যতম লীলাভূমি আনোয়ার সাদতের মিসর। ১৯৭৫ সালের মার্চ। এই কূটনীতির কারণেই কিসিঞ্জার আসওয়ানে এসেছেন।
১৯৭৫ সালের ২২ জানুয়ারি। সকাল ১০টা ২০। আরভিং চেসল ঢাকা থেকে পাঠানো ‘অভ্যুত্থানের গুজব’ শীর্ষক তারবার্তায় লিখেছিলেন, ‘সামরিক অভ্যুত্থান–সংক্রান্ত কিছু গুজব ইঙ্গিত দিচ্ছে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মার্চ হলো সবচেয়ে অনুকূল সময়। দেশের সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে বাংলাদেশ সরকারের সামনে কোনো আশা নেই এবং কর্তৃত্ববাদের একটি বড় ডোজ গলাধঃকরণই এখন বঙ্গবন্ধুর জন্য অত্যন্ত লোভনীয় বিষয়।’
তবে মার্চ মাসটাই কেন ও কীভাবে সবচেয়ে অনুকূল মনে হলো, তার উত্তর আমরা ওই তারবার্তায় পাই না। তবে হেনরি কিসিঞ্জার নিয়ন্ত্রিত ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল নির্দিষ্টভাবে সিআইএ-কে সম্পৃক্ত করে মার্চেই একটি দলিল তৈরি করল। তার শিরোনাম হলো কিনা ‘সিআইএ এবং বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থান’। যদিও এর দ্বারা সিআইএর সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে কোনো স্থির ধারণায় পেঁৗছা যায় না। ১৯৭১ সালটি শেষ হয়ে এলে কিসিঞ্জারের ক্ষমতা ও এখতিয়ারের আরও বিস্তৃতি ঘটেছিল।
তবে আজও এটা অজ্ঞাত যে আনোয়ার সাদত ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের রিকন্সিলিয়েশনে কীভাবে কী ভূমিকা রেখেছিলেন। বাংলাদেশিরা তাঁকে কেবল এক রেজিমেন্ট ট্যাংক (৩২টি) প্রদানের জন্য মনে রেখেছে। তোফায়েল আহমেদ আমাকে বলেছেন, ট্যাংক উপহার তাঁকে অবাক করেছিল। মিসরের সেই ট্যাংকে চেপে সৈয়দ ফারুক রহমান রক্তস্নাত অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর যাতে বিচার না হতে পারে, সে জন্য হেনরি কিসিঞ্জার কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। পিকিংয়ে মাও সেতুংকে কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বিষয়টি প্রয়োজনে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অংশে পরিণত করবেন। এ রকম প্রেক্ষাপটে সাদত ভুট্টোর পক্ষে মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। বাংলাদেশকে ট্যাংক প্রদান এবং ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে বিনা বিচারে ছাড়িয়ে নেওয়ার বিষয়টিও সাদত কাকতালীয়ভাবে এমন একটি প্রেক্ষাপটে করেছিলেন, যখন সবেমাত্র তিনি সোভিয়েতদের সঙ্গে তাঁর দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক সমাহিত করেছেন এবং হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে গোপন কূটনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। সাদতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কিসিঞ্জারের হোয়াইট হাউস ইয়ার্সে খুবই স্পষ্ট: ‘আমার সরকারি কর্মজীবনে সম্ভবত আনোয়ার সাদত ছাড়া চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গেই আমার আলোচনা ছিল দীর্ঘ ও গভীরতর।’
‘অভ্যুত্থান ও সিআইএ’ শীর্ষক ওই নথি প্রস্তুত হয়েছিল ২০ মার্চ ১৯৭৫। বৃহস্পতিবার। রাত ১০টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তিনি সাদতের সঙ্গে বৈঠক করেন। ২১ মার্চ সকাল ১০টা ১০ মিনিটে কিসিঞ্জার আসওয়ান ত্যাগ করেন।
১৯৭৩ সালের ১৭ মার্চ দিল্লি থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মইনিহান কিসিঞ্জারকে জানিয়েছিলেন, মিসরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী [মোহাম্মদ হাসান] আল জায়াত ৮ থেকে ১১ মার্চ ভারত সফর করেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (পশ্চিম এশিয়া উত্তর আমেরিকা বিভাগ) ও ভারতে মিসরীয় চার্জ পৃথকভাবে বলেছেন, ‘জায়েদ ২৩ মার্চ বাংলাদেশে যাবেন। সেখানে এখন তাঁদের ট্রেড মিশন আছে। মিসরীয় চার্জ বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারত বা বাংলাদেশ মিসরকে চাপ দিচ্ছে না। তবে মিসরীয় স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত মিসর, সিরিয়া ও লিবিয়া একত্রে নেবে। ভারতীয় উপসচিব মনে করেন যে এ সিদ্ধান্ত নিতে মিসরকে তার অধিকতর রক্ষণশীল আর্থিক পৃষ্ঠপোষক সৌদি আরব ও লিবিয়া প্রভাবিত করবে।’
আমাদের অনুসন্ধানে ২০ মার্চ তারিখটি ইঙ্গিতবহ হয়ে ওঠে। কারণ, ঠিক এই দিনটিতেই ফারুক রহমান ঢাকায় জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এর এক বছর আগেই ‘একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তার নির্দেশে’ ফারুক মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহান্স লিখেছেন, অনেক চেষ্টা–চরিত্র চালিয়ে ফারুক ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হন। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।
উল্লেখ্য, ফারুক যখন জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান, তখন তিনি তৎকালীন অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল কর্নেল মঈনকে জিয়ার বাসভবন ত্যাগ করতে দেখেন। প্রয়াত মেজর জেনারেল (অব.) মঈনুল হোসেন চৌধুরী এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য বইতে লিখেছেন, ‘পরদিন আমি অফিসে জেনারেল জিয়ার কাছে বিষয়টি তুলি। তিনি আমাকে বললেন, হ্যাঁ ফারুক এসেছিল। তিনি এভাবে জুনিয়র অফিসারদের তাঁর বাড়িতে আসা নিরুৎসাহিত করতে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীদের বলে দিয়েছেন।’ ম্যাসকারেনহান্স লিখেছেন, ‘জেনারেল জিয়া যদিও চক্রান্তকারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হননি। কিন্তু এটাও ঠিক যে তিনি ফারুককে গ্রেপ্তারও করেননি। উপরন্তু নিজেকে নিরাপদ রাখতে যখন তিনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তখন তিনি চক্রান্তের দিকে চোখ বন্ধ করে রাখেন। ফারুকের বক্তব্য অনুযায়ী, জিয়া তাঁর এডিসিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ফারুক যাতে আর কখনো তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না পারেন।’
ওই বার্তাটি যদি বাস্তবে আসওয়ানে না–ও পাঠানো হয়, তাহলেও সন্দেহাতীত ধারণা হয় যে ওই বার্তা আসওয়ানে পাঠাতে অন্তত একটা চিন্তাভাবনা ওয়াশিংটনে হয়েছিল। ‘সিআইএ এবং বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থান’ হেনরি কিসিঞ্জারের মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এবং সেই গুরুত্বের মাত্রা আমরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারি যে দৃশ্যত গুজবনির্ভর একটা বার্তা সফররত কিসিঞ্জারের কাছে আসওয়ানে পাঠানো হয় কিংবা পরিকল্পনার মধ্যে আসে।
১৯৭৪ সালের ২২ আগস্ট ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল প্যাট্রিক মইনিহান বলেন, ‘ভারতীয় কর্মকর্তারা অন্তত স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ বিরোধী দল নেই। ভারতীয়রা যদিও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার সমস্যা স্বীকার করেন, কিন্তু তাঁরা যুক্তি দেন যে সেখানে তিনটি উপদলের অস্তিত্ব রয়েছে। এবং সে কারণে সামরিক বাহিনীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা অল্প।’
২০ মার্চের ওই দলিলের মূল মুদ্রিত বিষয়বস্তু পাইনি। এটি ‘ঢাকার মার্কিন দূতাবাস, সিআইএ, ভারত ও পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাসে পাঠানোর উল্লেখ দেখা যায়। এই দলিলটি ছাড়াও আরও চারটি তারবার্তা নির্দেশ করে যে ১৯৭৫ সালের মার্চে বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থান বিষয়ে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এবং ঢাকা ও দিল্লির মার্কিন দূতাবাসের মধ্যে বার্তা বিনিময় ঘটে। কিন্তু এই তারবার্তাগুলোর একটিরও মূল মুদ্রিত পাঠ পাওয়া যায়নি। যদিও চারটি তারবার্তারই শিরোনাম ‘অভ্যুত্থানের গুজব’। ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে প্রস্তুত চারটি পৃথক ইলেকট্রনিক তারবার্তার মধ্যে ওই তারবার্তাটির শিরোনামই কেবল ব্যতিক্রম। তবে প্রতিটি দলিলের অভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও বিষয়বস্তু হচ্ছে, এগুলোর একটিও কনফিডেন্সিয়াল নয়, ‘সিক্রেট’। এর প্রতিটিতে মুজিবের ‘সরকার উৎখাত’ কথাটি রয়েছে। ২৪ মার্চের ইলেকট্রনিক তারবার্তাটির নম্বর ১৯৭৫নিউডিই০৩৯৮৮। সময়: বেলা একটা (সোমবার)। এটির মূল মুদ্রিত পাঠ্য ‘পাওয়া যায় না’ উল্লেখ আছে। এই তারবার্তার প্রেরক: দিল্লির মার্কিন দূতাবাস। প্রাপক: ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। এটির একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এর ট্যাগে ‘ইন্দিরা প্রিয়দির্শনী (নেহরু) গান্ধী। [গান্ধী, ইন্দিরা] কথাটি মুদ্রিত আছে।
পঞ্চাশের দশকে চেসল ইতিহাস ও পররাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াতেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ’৫৬ সালে গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ হিসেবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে যোগ দিয়েছিলেন। ’৭২-৭৬ সালে ঢাকায় তিনি ডেপুটি চিফ অব মিশন ছিলেন। মার্কিন কংগ্রেস যদি একটি তদন্ত করত, তাহলে অনেক কিছুই জানা যেত। সেখানে নিশ্চয় কেনেডির মতো কোনো বাংলাদেশ বন্ধু, যিনি ফারুককে কিসিঞ্জারের দ্বারা রাজনৈতিক আশ্রয় মঞ্জুরের মুহূর্তে বিরোধিতা করেছিলেন, প্রশ্ন করতেন, মি. চেসল, ‘ভিত্তিহীন গুজবগুলোর’ ভিত্তি কী ছিল? চক্রান্তকারীদের সম্পর্কে আপনার কেন দরদ প্রকাশ পেল? কেন আপনি অভ্যুত্থানকারীদের সম্পর্কে লিখলেন, ‘তাঁরা ধৈর্য হারাচ্ছে। তা ছাড়া আরও বিলম্ব ঘটার জন্য ভয়ও পাচ্ছে। কারণ দেরি হলে তো ফাঁস হয়ে যেতে পারে। মুজিব যাতে ভারতপন্থী ও সোভিয়েতপন্থীদের সহায়তায় বাকশালকে সংহত করার সময় না পান, সে জন্য এখনই তাঁকে সরিয়ে দিতে হবে।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.