ঘাতকের বিচার হয়েছে, জিঘাংসার হয়নি by বেলাল বেগ
বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি হওয়ায় বাঙালীর বুক থেকে আত্মগ্লানির জগদ্দল পাথর নেমে গেছে। দেশে অরাজকতার অমানিশা শেষে আইনের শাসনের রক্তিম সূর্যোদয় হয়েছে।
এ যেন আরেকটি একাত্তর, আরেকটি বিজয়, দিগন্তে আশার আরও একটি সুবর্ণরেখা। কিন্তু তার পরেও আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না। কারণ একাত্তরের পর আমরা অবিশ্বাস্য, অচিন্তনীয় পঁচাত্তর দেখেছি। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ড এমনই নৃশংস, লোমহর্ষক, হূদয়বিদারক ও অকস্মাৎ ছিল যে, দেশের মানুষ স্তম্ভিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। সে মানসিক বিপর্যয় ও বিবশ দশা কাটিয়ে উঠতে জাতির বহু বছর সময় লেগেছে। মানুষের ভরসা আওয়ামী লীগের যে নৌকা তাও হয়ে পড়েছিল কাণ্ডারীবিহীন, হালহারা। একাত্তরে যে জনগণ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে 'যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায়' প্রস্তুত ছিল, পঁচাত্তরের জাতীয় বিপদে অপ্রস্তুত থাকায় তারা অসহায় বোধ করেছে। তাই পঁচাত্তরে কী হয়েছিল তার তাৎপর্য অনুধাবন এবং সে সম্বন্ধে করণীয় নিরূপণে জনগণ সময় নিয়েছে। শত্রুরা তারই সুযোগ নিয়ে জাতিকে অন্ধকারে রেখে চৌত্রিশ বছর অপমান, নির্যাতন ও নি্ে#৬৩৭৪৩;ষণ করেছে।আমরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পাঁচজনকে নিশ্চিহ্ন করেছি কিন্তু এখনও ছয়জন পলাতক আছে। ওরা খতম না হওয়া পর্যন্ত পরিপূর্ণ স্বস্তি পাব না। সুতরাং শত্রু শিকারে আমাদের অভিযান শ্লথ করা যাবে না। তবে এ কথা বলা যায় যে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত ঐ ভীতু, কাপুরুষদের অন্তরে যে অগ্রিম মৃতু্যযাতনা ঢুকিয়ে দিয়েছে, তাতেই ওরা তাদের গহ্বর থেকে আর সহজে বেরুবে না।
পঁচাত্তরে ষড়যন্ত্রের নীলনকশার একটি অংশ ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে তাৎণিকভাবে নেতৃত্বহীন করা। আমরা সবেমাত্র বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার করেছি। এরা ছিল মূল ষড়যন্ত্রের একটি ুদ্র অংশ। এদের ফাঁসিতে বাংলাদেশের শত্রুদের লোকবলে সামান্য তি হয়েছে মাত্র, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য, ল্য ও কর্মকাণ্ডে কোন আঘাত লাগেনি। এ ঘটনায় তারা অবশ্যই তাদের সতর্কতা আরও বাড়াবে এবং আমাদের বিপদের ঝুঁকি আরও একটু বাড়বে।
আমাদের বিজ্ঞ বিচারকগণ পরামর্শ দিয়েছেন এমন আইন প্রবর্তনের যা বেআইনী মতা দখল অসম্ভব করবে। আমরা আশা করব সরকার তা অবিলম্বে হাতে নেবে। কিন্তু তার পরেও বাংলাদেশের শত্রুদের নিরস্ত করা যাবে না। কারণ সুদীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে তাদের দুর্গ দুর্ভেদ্য করা হয়েছে।
মহাকবি হোমারের ইলিয়াড কাব্যে ট্রয়ের যুদ্ধে রাজা এখিলিসের অস্ত্রসজ্জার বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, তার শরীরের গোড়ালি ছাড়া তীর বিদ্ধ হবার আর কোন ফাঁক ছিল না। সেখানেই তীর দাগিয়ে প্যারিস এখিলিসকে হত্যা করেছিল। আমাদের শত্রুদেরও এখিলিস হিল বের করতে হবে।
পঁচাত্তরের সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের তাৎণিক, মধ্যবর্তী ও চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ও ল্যাবলী সুনির্দিষ্ট ছিল। আমরা ল্য করলাম বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ামাত্রই বাংলাদেশ বেতার রেডিও বাংলাদেশ এবং জয়বাংলা জিন্দাবাদ হয়ে গেল। দেশবাসী বুঝল অভু্যত্থানকারীরা বাংলাদেশবিরোধী এবং পাকিস্তানপন্থী। মধ্যবর্তী ল্যসমূহের মাঝে অন্তভর্ুক্ত ছিল মুক্তিযুদ্ধার্জিত বাংলাদেশ ধ্বংসের জন্য আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বহীন ও দুর্বল করা। সেনাবাহিনী, প্রশাসন, রাজনীতির নিরঙ্কুশ দখল নেয়া। ষড়যন্ত্রের এ স্তরে নেতৃত্বদানের জন্য গোপনে নিযুক্ত কমান্ডার জিয়াউর রহমান 'মানি ইজ নো প্রবলেম' এবং 'আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দি পলিটিশিয়ানস' বলে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এ কাজগুলো করার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি পদদলনের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন ছিল কারিশমাযুক্ত জিয়ার নিজস্ব একটি ভাবমূর্তি। তিনি নতুন করে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে আখ্যায়িত হলেন। প্রতিদিন ঘটা করে তাঁর পদযাত্রা, খাল কাটা উদ্বোধন এবং তাঁর ছাত্র সমাবেশ, নাঙ্গা-পা ডাক্তার কর্মসূচী ইত্যাদি রাতারাতি জিয়াকে একজন অতিমানব বানিয়ে ফেলে। এ অতিমানবের শক্তি বহন ও ধারনের জন্য 'বিএনপি' নামে তাঁকে একটি দলও বানিয়ে দেয়া হলো। সেদিন যদি জামায়াতের জনগ্রহণযোগ্যতা থাকত, আদৌও বিএনপির জন্ম হতো না। বস্তুত বিএনপির জন্ম হয়েছিল ভবিষ্যতে জামায়াতকে রা ও সুপ্রতিষ্ঠত করার জন্য। ঐ কাজটি হওয়ামাত্রই জিয়াকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
পঁচাত্তরের ষড়যন্ত্রকারীদের চূড়ান্ত ল্য ছিল বাংলাদেশকে ইসলামী লেবাস পরিয়ে আমেরিকার হাতে তুলে দেয়া। আমেরিকা ইসলামপ্রীতিডোর দিয়ে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানকে বেঁধে নিয়ে তার বিশ্বরাজনীতির ল্যগুলো হাসিল করে চলেছে। বাংলাদেশ হাতে থাকলে তার বহুবিধ লাভ আছে। ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত পর্যায় সফল হওয়ায় অর্থাৎ আমেরিকা-সৌদি আরব-পাকিস্তানের পরম নির্ভরশীল অনুচর জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আমেরিকা এখন নিশ্চিন্তে বাংলাদেশকে মধ্যপন্থী মুসলিম দেশ বলে সোহাগ করে। আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির কাছে গণতান্ত্রিক বা ধর্মনিরেপে বাংলাদেশের কোন দাম নেই। ধর্মভীরু, দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ মুসলমানদের হাতে রাখার জন্য তাদের দরকার জামায়াত-বিএনপির মতো ধর্মগুলানো রাজনৈতিক সংগঠন।
পঁচাত্তরের ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে যে মেধা, দতা ও পেশাদারিত্ব দেখা গেছে, তাতে ঝানু আমেরিকান, পাকিস্তানী ও চীনা গোয়েন্দাদের সংশ্লেষ আন্দাজ করা যায়। এত আয়োজন করে বাঙালীর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ নেতাকে হত্যারই প্রয়োজন হতো না যদি তিনি ভারত-সোভিয়েত জোট ও সমাজতন্ত্রের পথে না হাঁটতেন এবং মুক্তবাজার অর্থনীতিকে সালাম জানাতেন। জিয়া, এরশাদ, খালেদা, তারেক, জামায়াত, বিএনপি, জাপা ইত্যাদি নানা খলনায়ক ও আবর্জনারও জন্ম হতো না। আমেরিকার মুসলিম-প্রেম তথা জামায়াত-পেয়ার সেদিন যেমন, আজও তেমন মোল্লার মুরগি পোষা। অথচ মানবতাবিরোধী, ধর্মান্ধ, নৃশংস খুনী এবং জিঘাংসার আদর্শ দ্বারা গঠিত এ প্রতিষ্ঠানটিকে পঁচাত্তরের ষড়যন্ত্রীরা গোপনে জোর করে বাংলাদেশে ঢুকিয়েছিল। ওদেরই প্রশ্রয়ে বলীয়ান হয়ে জামায়াত বাংলাদেশে মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার পাশাপাশি অস্ত্রের রাজনীতির হুমকিও দিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতেরই রক্তচুর ভয়ে বিএনপির গণতন্ত্রে ফেরা সম্ভব হচ্ছে না।
মজার কথা, এই জামায়াতকেই আবার স্বাধীনতার শত্রুদের এখিলিস হিল হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। বৈদেশিক কূটনীতির অস্ত্র এবং স্থানীয় ব্যবস্থাসমূহ একসঙ্গে প্রয়োগ করে আমরা জামায়াতকে তার রাজনীতিসহ উৎখাত করে দিতে পারি।
জামায়াত উৎখাত অভিযানে প্রথম কাজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। কয়েকটি বিচার কার্য সম্পূর্ণ হলেই একাত্তরে তাদের ভূমিকা আর একবার জনগণের সামনে চলে আসবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপরবর্তী বর্তমান পরিবেশে জামায়াতীদের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা উদ্ঘাটিত করা গেলে জনমনে তাদের প্রতি যে ঘৃণার সঞ্চার হবে তাতে তারা ভালভাবেই দমিত হবে। দ্বিতীয়ত, জামায়াতের রাজনীতির ভিত্তি ইসলাম ধর্মের একটি বিকৃত ব্যখ্যা। জামায়াতের ধৃষ্টতার কারণে ইসলামের শান্তি ও কল্যাণের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে তাতে আগ্রাসী রাজনীতি ও অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যাচ্ছে। দেশ-বিদেশের ইসলামী পণ্ডিত, দেশীয় আলেম-ওলামা, শিক ও শিতি সমাজ সকলের সমন্বয়ে একটি ব্যাপক ও লাগাতার আন্দোলন গড়ে তোলা হলে জামায়াতের গলাবাজদের ধর্মধাপ্পা চিরকালের জন্য স্তব্ধ করা যাবে। সর্বশেষে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার পর জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ করা হলে বাংলাদেশ ধর্ম-রাজনীতির অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে। ইতোমধ্যে বিএনপিকে গণতন্ত্রের পথে আসার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। জিয়ার ভূয়ো ইমেজ (সিআইএর দলিলানুযায়ী বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন) নিয়ে বিএনপিকে গুলিয়ে খাচ্ছে দলটির এক শ্রেণীর নেতা-কর্মী। সে ঘৃণ্য চক্র থেকে দলটি বেরিয়ে এসে দেশের গণতান্ত্রিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতি বেশি মনোযোগ দিলে তারাও ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের অপবাদ থেকে মুক্ত হবে। জামায়াতকে তাদের আর দরকার যেন না হয়, সে চেষ্টায় আওয়ামী লীগের সহযোগিতা থাকা উচিত।
একবিংশ শতাব্দীর চাহিদা অনুযায়ী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমনস্ক কম্পিউটার জানা বংশধর তৈরিও জামায়াত তথা ধর্মধাপ্পার রাজনীতি বিলোপে খুবই প্রয়োজনীয়। জামায়াতী রাজনীতির ধ্বংসই বাংলাদেশে জিঘাংসার রাজনীতির অবসান ঘটাবে।
No comments