বিলেতের স্ন্যাপশট- এসে গেল সেই কঠিন সময় by শামীম আজাদ
গেল বছর যেমন ছিল তীব্র খরা, তেমনি অঝোর বৃষ্টিপাতে ছিল সবকিছু ভরা। ব্রিটেনে এত বন্যা এর আগে হয়নি। এটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের পর সবচেয়ে কৃচ্ছ্রসাধনার বছরও। বেড়েছে দাম অবিরাম। পেট্রল, তেল ও খাবারের। দাম বেড়েছে গাড়ি ভাড়ার, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলের।
যাতায়াতব্যবস্থার মধ্যে এ দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে রেলপথ। পুরো ইউরোপের মধ্যে ব্রিটেনেই সেই রেলের ভাড়া বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মুখে আগে ছিল ছোট ছোট কিওস্ক বা পত্রিকার দোকান। এখন তার সংখ্যা কমে গেছে। এখন মেট্রো, ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডসহ আরও কিছু কাগজ ফ্রি পাওয়া যায়। গত বছর থেকে ব্রডশিট ডেইলি ইনডিপেনডেন্ট ৫০ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত সংস্করণ দি এসেনশিয়াল ব্রিফিং বিক্রি করছে মাত্র ২০ পেনিতে। এ দেশের বাংলাদেশি স্কাই টিভিগুলোও ফ্রি। সবই চলছে ব্যবসায়িক বিজ্ঞাপনে। বাজারে ঢুকেই মানুষ খোঁজে কোথায় কোন অফার আছে, কোথায় আছে ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি’।
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এত কমেছে বলেই এবার ক্রিসমাসের পরদিন বক্সিং ডেতে সেল হয়েছে আকাশচুম্বী। ১০ মিলিয়ন বার্গেন হান্টাররা ব্যয় করেছে প্রায় ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন পাউন্ড। ভাবা যায়! এদিকে আবার সামগ্রিকভাবে হাইস্ট্রিটের ব্যবসায় ধস নেমেছে, ক্ষুদ্র ব্যবসা ঋণগ্রস্ত হয়ে উঠে গেছে, স্বল্প পুঁজি নিয়ে নবীন ব্যবসায়ী এসেছেন কম, বার্কলে, লয়েডসের পুরোনো ব্যাংকগুলো টিকে থাকার জন্য হিমশিম খেয়েছে।
চাকরিতে ছাঁটাইয়ের সঙ্গে বেড়েছে ট্যাক্স অফিস ও ইউকে বর্ডার এজেন্সির তৎপরতা। এদের এই তৎপরতায় হয়েছে বেপরোয়া ধরপাকড়। পূর্ব লন্ডনের জব সেন্টারগুলোকে নানা রকম শর্তের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অভিবাসী কমিউনিটি। রেস্টুরেন্ট ও রিটেইল চেইন শপে কর্মরত অবস্থায় বাঙালিসহ গ্রেপ্তার হয়েছে বিলেতে স্টুডেন্ট ভিসায় পড়তে আসা যুবক-যুবতী। শুধু ভিসা থাকলেই আর হচ্ছে না, ইউকেবিএ দেখছে ভিসার শর্তও। বাঁধা হয়েছে সময় ও এলাকা। কড়াকড়ি হয়েছে রিক্রুটমেন্ট পলিসিতেও। ‘অপারেশন মায়্যাপল’ নামের একটি বিশেষ অভিযানের আওতা থেকে বাদ পড়েনি বুচার শপ, ফুটপাত মার্কেট ও মাছবাজার। ইউরোজোনের নাগরিকদের প্রতি সে কড়াকড়ি নেই বলে সেখান থেকে কাজের সন্ধানে এসেছে বহু লোক। আর এরা এসে হু হু করে নানান পরিসরে ‘অদক্ষ’ শ্রমিকের স্থান দখল করেছে। ইউরোজোনে ইতালিতেই ছিল সবচেয়ে বেশি অবৈধ এশীয়। ২০১২ সালে তাদের বৈধতা দেওয়ায় তারাও এসেছে বিলেতে। ফলে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টগুলোতে চাপ পড়েছে আরও বেশি। বিলেতে প্রতিষ্ঠিত যে আধা ডজন বাংলা সাপ্তাহিক আছে, সেগুলো খুললেই দেখা গেছে রেস্টুরেন্ট, টেকঅ্যাওয়ে এবং গ্রোসারি শপে বিক্রির হিড়িক।
জনসংখ্যা জরিপে দেখা গেছে, গেল বছরই ছিল অভিবাসীদের বছর। লন্ডনে এখন সবচেয়ে বেশি অভিবাসীর বাস। লন্ডনে এখন যত বেশি ইংলিশ, তার চেয়ে বেশি ব্রিটিশ। এই ব্রিটিশদের আদি দেশ বিলেত নয়। বিশ্বের নানা দেশ থেকে এঁরা বা তাঁদের পিতা কিংবা তাঁদের পিতামহ বিবিধ কারণে এ দেশে এসেছিলেন। কয়েক পুরুষের বসবাসে তাঁরা এ দেশের জলহাওয়ায় বড় হয়েছেন, দত্তক মাতাকে ভালোবেসেছেন, এ দেশের হয়ে বৈশ্বিক নানা প্রতিযোগিতায় প্রতিনিধিত্ব করছেন এ দেশেরই হয়ে। দেহবর্ণ না বদলালেও বদলেছে তাঁদের পরিচয়। দেশে এখন শ্যামলবরণ মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি।
এখন লন্ডনের লেস্টার স্কয়ার, ইলফোর্ড, আপটন পার্ক, সাউথ হলের সিনেমা হলে নিয়মিত হিন্দি ছবি চলে। লেস্টার স্কয়ারে চলে ইংরেজি সাবটাইটেলে, অন্যান্য স্থানে উভয়ই। ঈদ, নববর্ষ, দেওয়ালি উদ্যাপিত হচ্ছে স্কুলের ঐচ্ছিক ছুটিতে। ক্রিসমাসের দিনে এরা চলতে দিচ্ছে ঈদ ধামাকা, চার্চে চলছে বাংলা স্কুল আর বিজয় দিবস সেলিব্রেশন, খুলতে দিচ্ছে মাদ্রাসা ও মসজিদ। এরা অদ্ভুত এক সহনশীল জাতি! ব্যবসায়িকভাবেই বাজারজাত করছে মুসলমান ছেলেমেয়ের আঁকা ক্রিসমাস কার্ড।
এই বহুজাতিক ব্রিটেনের অভিবাসী আগ্রাসনের সবচেয়ে বড় প্রতিফলন দেখা গেছে ২০১২ অলিম্পিকে। ব্রিটেনের পাওয়া পদকের এক-তৃতীয়াংশের বেশি এসেছে অভিবাসীদের নৈপুণ্যে। ব্রিটেনের অর্জিত ৬৫ মেডেলের মধ্যে ২৪টি লাভ করেছে এই অভিবাসীরাই। ফেবিয়ান সোসাইটির সাবেক সম্পাদক বলেছেন, অলিম্পিকের এতগুলো বছরে এ বছরই ব্রিটেন এত ভালো করছে আর তার কারণ এই বদলে যাওয়া ব্রিটেন বলেই। যে অসাধারণ অলিম্পিক উদ্বোধন উদ্যাপিত হয়েছিল, তার বেশির ভাগ স্বেচ্ছাসেবীই ছিলেন অভিবাসী।
ব্রিটেন অভিবাসী লেখক হিসেবে আশা, এ অভিজ্ঞতা থেকে কট্টর রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন নিজেকে আরও উদার ও সংস্কারমুক্ত করবেন, আর তাঁর সহযোগী ও কোয়ালিশন সরকারের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী লিবারেল ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি নিক ক্লেগ আরও উচ্চকিত হবেন। আর প্রধান বিরোধী দল পার্লামেন্টে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো আরও গুছিয়ে তুলবেন। না হলে বিলেতের বাঙালিসহ সব অভিবাসী চরম আর্থিক সংকটে পড়বেন। বর্তমানে দ্বিতীয় দফায় অর্থনৈতিক মন্দা অতিক্রম করছে ব্রিটেন। আর এই মন্দার প্রভাব এসে পড়ছে বিলেতে বসবাসরত সবার জীবনে। অভিবাসীদের নিয়েই আমেরিকা। কিন্তু অনুরূপ অবস্থায় তারা কেবল টিকে থাকেনি, কাটিয়েও উঠছে। আমরা সবাই জানি, তাদের এ কাটিয়ে ওঠার পেছনে নেতৃত্বের বিচক্ষণতা ও সদিচ্ছাই কাজ করেছে। এখানেও তাই হওয়া বাঞ্ছনীয়। আর এটাই ব্রিটেনের ২০১৩-এর প্রধান চ্যালেঞ্জ।
শামীম আজাদ: ব্রিটেনে অভিবাসী কবি।
shetuli@yahoo.com
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এত কমেছে বলেই এবার ক্রিসমাসের পরদিন বক্সিং ডেতে সেল হয়েছে আকাশচুম্বী। ১০ মিলিয়ন বার্গেন হান্টাররা ব্যয় করেছে প্রায় ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন পাউন্ড। ভাবা যায়! এদিকে আবার সামগ্রিকভাবে হাইস্ট্রিটের ব্যবসায় ধস নেমেছে, ক্ষুদ্র ব্যবসা ঋণগ্রস্ত হয়ে উঠে গেছে, স্বল্প পুঁজি নিয়ে নবীন ব্যবসায়ী এসেছেন কম, বার্কলে, লয়েডসের পুরোনো ব্যাংকগুলো টিকে থাকার জন্য হিমশিম খেয়েছে।
চাকরিতে ছাঁটাইয়ের সঙ্গে বেড়েছে ট্যাক্স অফিস ও ইউকে বর্ডার এজেন্সির তৎপরতা। এদের এই তৎপরতায় হয়েছে বেপরোয়া ধরপাকড়। পূর্ব লন্ডনের জব সেন্টারগুলোকে নানা রকম শর্তের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অভিবাসী কমিউনিটি। রেস্টুরেন্ট ও রিটেইল চেইন শপে কর্মরত অবস্থায় বাঙালিসহ গ্রেপ্তার হয়েছে বিলেতে স্টুডেন্ট ভিসায় পড়তে আসা যুবক-যুবতী। শুধু ভিসা থাকলেই আর হচ্ছে না, ইউকেবিএ দেখছে ভিসার শর্তও। বাঁধা হয়েছে সময় ও এলাকা। কড়াকড়ি হয়েছে রিক্রুটমেন্ট পলিসিতেও। ‘অপারেশন মায়্যাপল’ নামের একটি বিশেষ অভিযানের আওতা থেকে বাদ পড়েনি বুচার শপ, ফুটপাত মার্কেট ও মাছবাজার। ইউরোজোনের নাগরিকদের প্রতি সে কড়াকড়ি নেই বলে সেখান থেকে কাজের সন্ধানে এসেছে বহু লোক। আর এরা এসে হু হু করে নানান পরিসরে ‘অদক্ষ’ শ্রমিকের স্থান দখল করেছে। ইউরোজোনে ইতালিতেই ছিল সবচেয়ে বেশি অবৈধ এশীয়। ২০১২ সালে তাদের বৈধতা দেওয়ায় তারাও এসেছে বিলেতে। ফলে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টগুলোতে চাপ পড়েছে আরও বেশি। বিলেতে প্রতিষ্ঠিত যে আধা ডজন বাংলা সাপ্তাহিক আছে, সেগুলো খুললেই দেখা গেছে রেস্টুরেন্ট, টেকঅ্যাওয়ে এবং গ্রোসারি শপে বিক্রির হিড়িক।
জনসংখ্যা জরিপে দেখা গেছে, গেল বছরই ছিল অভিবাসীদের বছর। লন্ডনে এখন সবচেয়ে বেশি অভিবাসীর বাস। লন্ডনে এখন যত বেশি ইংলিশ, তার চেয়ে বেশি ব্রিটিশ। এই ব্রিটিশদের আদি দেশ বিলেত নয়। বিশ্বের নানা দেশ থেকে এঁরা বা তাঁদের পিতা কিংবা তাঁদের পিতামহ বিবিধ কারণে এ দেশে এসেছিলেন। কয়েক পুরুষের বসবাসে তাঁরা এ দেশের জলহাওয়ায় বড় হয়েছেন, দত্তক মাতাকে ভালোবেসেছেন, এ দেশের হয়ে বৈশ্বিক নানা প্রতিযোগিতায় প্রতিনিধিত্ব করছেন এ দেশেরই হয়ে। দেহবর্ণ না বদলালেও বদলেছে তাঁদের পরিচয়। দেশে এখন শ্যামলবরণ মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি।
এখন লন্ডনের লেস্টার স্কয়ার, ইলফোর্ড, আপটন পার্ক, সাউথ হলের সিনেমা হলে নিয়মিত হিন্দি ছবি চলে। লেস্টার স্কয়ারে চলে ইংরেজি সাবটাইটেলে, অন্যান্য স্থানে উভয়ই। ঈদ, নববর্ষ, দেওয়ালি উদ্যাপিত হচ্ছে স্কুলের ঐচ্ছিক ছুটিতে। ক্রিসমাসের দিনে এরা চলতে দিচ্ছে ঈদ ধামাকা, চার্চে চলছে বাংলা স্কুল আর বিজয় দিবস সেলিব্রেশন, খুলতে দিচ্ছে মাদ্রাসা ও মসজিদ। এরা অদ্ভুত এক সহনশীল জাতি! ব্যবসায়িকভাবেই বাজারজাত করছে মুসলমান ছেলেমেয়ের আঁকা ক্রিসমাস কার্ড।
এই বহুজাতিক ব্রিটেনের অভিবাসী আগ্রাসনের সবচেয়ে বড় প্রতিফলন দেখা গেছে ২০১২ অলিম্পিকে। ব্রিটেনের পাওয়া পদকের এক-তৃতীয়াংশের বেশি এসেছে অভিবাসীদের নৈপুণ্যে। ব্রিটেনের অর্জিত ৬৫ মেডেলের মধ্যে ২৪টি লাভ করেছে এই অভিবাসীরাই। ফেবিয়ান সোসাইটির সাবেক সম্পাদক বলেছেন, অলিম্পিকের এতগুলো বছরে এ বছরই ব্রিটেন এত ভালো করছে আর তার কারণ এই বদলে যাওয়া ব্রিটেন বলেই। যে অসাধারণ অলিম্পিক উদ্বোধন উদ্যাপিত হয়েছিল, তার বেশির ভাগ স্বেচ্ছাসেবীই ছিলেন অভিবাসী।
ব্রিটেন অভিবাসী লেখক হিসেবে আশা, এ অভিজ্ঞতা থেকে কট্টর রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন নিজেকে আরও উদার ও সংস্কারমুক্ত করবেন, আর তাঁর সহযোগী ও কোয়ালিশন সরকারের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী লিবারেল ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি নিক ক্লেগ আরও উচ্চকিত হবেন। আর প্রধান বিরোধী দল পার্লামেন্টে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো আরও গুছিয়ে তুলবেন। না হলে বিলেতের বাঙালিসহ সব অভিবাসী চরম আর্থিক সংকটে পড়বেন। বর্তমানে দ্বিতীয় দফায় অর্থনৈতিক মন্দা অতিক্রম করছে ব্রিটেন। আর এই মন্দার প্রভাব এসে পড়ছে বিলেতে বসবাসরত সবার জীবনে। অভিবাসীদের নিয়েই আমেরিকা। কিন্তু অনুরূপ অবস্থায় তারা কেবল টিকে থাকেনি, কাটিয়েও উঠছে। আমরা সবাই জানি, তাদের এ কাটিয়ে ওঠার পেছনে নেতৃত্বের বিচক্ষণতা ও সদিচ্ছাই কাজ করেছে। এখানেও তাই হওয়া বাঞ্ছনীয়। আর এটাই ব্রিটেনের ২০১৩-এর প্রধান চ্যালেঞ্জ।
শামীম আজাদ: ব্রিটেনে অভিবাসী কবি।
shetuli@yahoo.com
No comments