বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও তথ্য অধিকার আইন by সুরাইয়া বেগম
তথ্য অধিকার আইন- ২০০৯ গত বছরের ১ জুলাই থেকে বাংলাদেশে কার্যকর হয়েছে, যা কিনা বাংলাদেশের সবচেয়ে যুগান্তকারী একটি আইন। নতুন রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত যত নতুন আইন তৈরি হয়েছে তার মধ্যে এই আইনটিই রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মতা স্থাপনের জন্যে সবচেয়ে কার্যকরী একটি হাতিয়ার।
বিশেষ করে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত, বঞ্চিত ও পিছিয়ে থাকা মানুষরা যাতে এ আইনটি কাজে লাগিয়ে সমাজে তাদের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে পারে, অবস্থানের পরিবর্তন করতে পারে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নিজেদের মতা প্রয়োগ করতে পারে তার জন্যই এই আইন। এই আইনের মাধ্যমে যে সকল সরকারী তথ্য আগে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যেত না, সরকারী গোপনীয়তা আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকত, এখন তা জনগণের পাবার জন্যে সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এই আইনটি প্রয়োগ করে জনগণ যেমন তাদের কাঙ্তি কিছু তথ্য পেতে পারে, তেমনি তার মাধ্যমে সরকারের কাজে স্বচ্ছতা, সততা ও জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে পারে। এই তথ্য অধিকার আইনটির কার্যকারিতা একমাত্র জনগণই এর ব্যবহার ও প্রয়োগের মাধ্যমেই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এই ল্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করে একটি প্রতিষ্ঠান রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ্স বাংলাদেশ (রিইব) গত ৩-৬ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে কুষ্টিয়াতে হরিজন জনগোষ্ঠীর মধ্যে "গণগবেষণা ও তথ্য অধিকার আইন বিষয়ক" এক কর্মশালা সম্পন্ন করে। রিইব বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে গবেষণামূলক কাজে সহায়তা করে আসছে ২০০২ সাল থেকে। রিইব দারিদ্র্য বিমোচনের সাথে অন্তজ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আত্মোন্নয়ন ও জীবনমান পরিবর্তনে সহায়ক গণগবেষণা তথা পার্টিসিপেটরি এ্যাকশন রিসার্চ পদ্ধতিকে প্রয়োগ করে থাকে। এই কর্মশালায় কুষ্টিয়া, কুমারখালী, পাবনা, রাজবাড়ী, রাজশাহী, খুলনা, মাগুরা, সাতীরা, নীলফামারী, সৈয়দপুর, বাগেরহাট প্রভৃতি জেলা থেকে হরিজন, বেদে এবং ঋষি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালা পরিচালনায় সহায়কের ভূমিকা পালন করেন রিইব প্রতিনিধি।এই কর্মশালায় আগত অংশগ্রহণকারীদের 'গণগবেষণা' কিংবা 'তথ্য অধিকার আইন' সম্পর্কে কোন পূর্ব ধারণা ছিল না। তাই কর্মশালা শুরু করতে হয়েছিল এজেন্ডা নির্ধারণ দিয়ে। অংশগ্রহণকারীরা হরিজন হলেও তারা প্রায় সকলেই শিতি ছিল এবং তাদের সকলের অংশগ্রহণের এজেন্ডা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এজেন্ডার প্রথম এবং দ্বিতীয় বিষয় ছিল গণগবেষণা কি এবং তথ্য অধিকার আইন বলতে কি বুঝায়। এ ছাড়াও তাদের বিভিন্ন সমস্যা এবং অধিকারের কথা তারা তুলে ধরে। যার মধ্যে হরিজনদের চাকরির সমস্যা, বাসস্থানের সমস্যা, শিা েেত্র বৈষম্য, সরকারের সেপটিনেট কর্মসূচীতে অন্তভর্ুক্তিহীনতা, আইনগত অধিকার, জাতিগত বৈষম্য, নারী ও শিশুদের প্রতি বঞ্চনা, পরনির্ভরশীলতা, মদ্যপান ও মদের লাইসেন্স সংক্রান্ত সমস্যা এবং হরিজন ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সমৃদ্ধি কিভাবে বাড়ানো যায় ইত্যাদি। তাদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই কয়েকজন বর্ণনা করেন তাঁদের জীবনের এগিয়ে যাবার ঘটনা। এর মধ্যে রাজশাহী সুগার মিলের হরিজন বাবুলাল বাঁশফোর বর্ণনা করেন তাঁর শিা অর্জনের পটভূমি, সৈয়দপুরের হরিজন সদস্য কালু বাঁশফোর বর্ণনা করেন তাঁদের সামষ্টিক উদ্যোগ এবং পরিশেষে ব্যর্থতার একটি ঘটনা। এ সব ঘটনাকে বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে গণগবেষক, উজ্জীবক, উজ্জীবকের বৈশিষ্ট্য, সামষ্টিক বোধ, আত্মনির্ভরশীলতা, উজ্জীবক এবং সঞ্চালকের মধ্যেকার বিভাজন, কমিউনিটির নিজেদের সমস্যা চিহ্নতকরণ এবং সমাধানে এ্যাকশনে যাওয়া, প্র্যাকটিস ইত্যাদি বিষয়। শিা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, জীবিকা, কৃষি, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ তৈরি বা মেরামত, সামাজিক সুরা ইত্যাদি নানা বিষয়েও প্রান্তিক জনগণ সরকারের কাছ থেকে এই ধরনের সঠিক তথ্য আদায় করতে পারলে অনেক উপকৃত হবে। এর ফলে সরকারী কর্তৃপসমূহও তাদের কাজে স্বচ্ছতা, সততা ও জবাবদিহিতা স্থাপন করতে উদ্যোগী হবে, তা বলা যায়। আর তা নিশ্চিত করার জন্যেই দেশে তথ্য অধিকার আইন চালু হয়েছে। একে কাজে লাগাতে হবে জনগণকেই। তা না হলে এই আইন কাগুজে আইনই থেকে যাবে, জনগণের কোন উপকারে আসবে না। তাই জনগণকেই উদ্যোগী হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপরে কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্যে আবেদন করতে হবে। তবে সেসব তথ্যই শুধু চাইতে হবে যেসব তথ্য সরকার প্রকাশ করেনি বা সাধারণত করে না।
এই আলোচনার ফলশ্রুতিতে তথ্য অধিকার আইনকে কিভাবে ব্যবহার করা যায় এ প্রসঙ্গে সবাই আলোচনা করে কয়েকটি ইসু্যতে তথ্য জানার জন্য আবেদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কুষ্টিয়া থেকেই তা শুরু করার জন্য সকলে একমত হয়। সেখানে হরিজনরা যথাযথ সরকারী তথ্য না জানার জন্য কি কি সমস্যার সম্মুখীন হয় তার অন্বেষণেই সবাই আলোচনা করে। সেখানে তারা কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করে।
এক. বাংলাদেশে এই একবিংশ শতাব্দীতেও দলিত ও হরিজনরা প্রতিনিয়ত অস্পৃশ্যতার শিকার হয় বৃহত্তর সমাজের কাছ থেকে। সমজে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই তাদের জীবনযাপন করতে হয়, 'পাবলিক স্পেস' ব্যবহারের সুযোগ তাঁরা পান না। এ বিচ্ছিন্নতা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানসিক। তাদের প্রবেশাধিকার নেই, সাধারণ স্কুলে যেতে পারে না। কারণ তাদের পাশে অন্য সম্প্রদায়ের শিাথর্ীরা বসতে চায় না, শিকরাও প্রায়শ তাদের অবজ্ঞার চোখে দেখেন।
দুই. হরিজনরা পুরুষানুক্রমে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাসহ নানান পাবলিক/প্রাইভেট সেক্টরে পরিচ্ছন্নতাকমর্ী হিসেবে নিয়োজিত, কিন্তু তাদের মজুরি খুবই কম_পৌরসভার ম্যানুয়েলে মাসিক মাত্র ৮০০ থেকে ১২০০ টাকার উল্লেখ আছে। তাদের চাকরিও ও বেশিরভাগ েেত্র স্থায়ী করা হয় না, মাস্টার রোলে কাজ করতে হয়। এরপরও আগে সকল সুইপার পদে একমাত্র হরিজনরাই চাকরি পেত। কিন্তু বর্তমানে এই পদটি ঝাড়দার, সুইপার এবং মেথর _এই তিনভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। 'জাতি সুইপার' বিষয়টি এখন আর প্রাধান্য পাচ্ছে না নিয়োগদানের েেত্র। ফলে এখন সুইপার পদে সরকারী চাকরিতে বাঙালী মুসলমানরাও নিয়োগ পাচ্ছে। এর ফলে হরিজনরা বেকারত্বে ভুগছে। যেহেতু তারা একটি নির্দিষ্ট এলাকায় গণ্ডিবদ্ধ জীবনযাপন করে, তাদের আনুষ্ঠানিক শিার অভাব আর কোন দতার সুযোগ সৃষ্টি করে না। ফলে অন্য কোন কাজে তারা সম্পৃক্ত হতে পারছে না, বেকারত্ব বাড়ছে।
তিন. বাংলাদেশে আগমনকৃত হরিজন সম্প্রদায় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বসবাস করত। তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও জীবন যাত্রার মান খুবএকটা ভাল ছিল না। তখন তারা এ ধরনের নোংরা পরিষ্কারের কাজ করত না। তাদের পেশা ছিল বাঁশের জিনিসপত্র তৈরি ও বাজারে বিক্রি করা। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাদেরকে ভারতের গোরখপুর, ছাপরা, বলিহা, বিহার, পাটনা, মতিহারী, মুজাফফরপুর, ভাগলপুর, এলাহাবাদসহ বিভিন্ন প্রদেশ থেকে চাকরি ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় যারা এদেশে আসল, তাদেরকে শহরের নোংরা পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত করা হলো। তারা নোংরা কাজ করতে অস্বীকার করলে ব্রিটিশ সরকার হরিজন সম্প্রদায়ের ওপর অমানবিক নির্যাতন, অত্যাচার, নিপীড়ন শুরু করে। ব্রিটিশ প্রশাসন হরিজন সম্প্রদায়কে কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে বের করে যে তাদের লোভ কিসের প্রতি। দেখা গেল যারা এ দেশে এসেছিল তাদের কেউ কেউ মদের নেশা করে। ব্রিটিশ প্রশাসন কৌশলে তাদের হাতে মদের বোতল তুলে দেয় এবং মদ খেয়ে কাজ করার পরামর্শ দেয়। দেখা যায় মদ খেয়ে কাজ করলে তাদের প েকরা সম্ভব। অনেকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নোংরা পরিষ্কারের কাজ শুরু করে দেয়। এভাবে যুগ যুগ ধরে বংশানুক্রমে মদ খাওয়া তাদের নেশায় পরিণত হলো এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেল।
এই তিনটি ইসু্য নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় সবাই এতটাই উদ্বুদ্ধ হয় যে, কর্মশালা শেষে অংশগ্রহণকারী সকল হরিজন, বেদে, ঋষি জনগোষ্ঠী এবং রিইব প্রতিনিধি কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়রের কাছে দুটি আবেদনপত্র এবং জেলা প্রশাসক অফিসের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাছে একটি আবেদনপত্র প্রেরণ করে। যেসব বিষয়ে তথ্য প্রাপ্তির জন্য আবেদন করা হয় তা হচ্ছে_
১. হরিজন পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা এবং শিক নিয়োগ নীতি নীতিমালার কপি।
২. যে বিধিমালার ভিত্তিতে কুষ্টিয়া পৌরসভায় হরিজনদের নিয়োগ দেয়া হয় তার কপি।
৩. কুষ্টিয়া জেলায় যে সকল ব্যক্তির নামে দেশী মদ বিক্রি করার জন্য কার্ড ইসু্য করা হয়েছে তাদের নামের তালিকার কপি।
৪. জনপ্রতি প্রতিদিন কত পরিমাণ দেশী মদ বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে সে সংক্রান্ত তথ্যের কপি।
এই আবেদনের অনুলিপি হরিজন ও দলিত জনগোষ্ঠী তথ্য কমিশনের কাছেও প্রেরণ করে। আবেদন জমা দেবার পর আলোচনায় সকলেই প্রকাশ করেন তাঁদের অনুভূতির কথা। সেখানে একটা কথাই ঘুরেফিরে আসে যে, জেলা প্রশাসক অফিস কিংবা মেয়রের অফিসে আবেদন জমা দেবার সময় তারা অনুভব করেছে একটি অন্তর্নিহিত শক্তিকে : তাদের সামষ্টিকতার বোধ এবং তাদের আইনগত অধিকারের বোধ। যা কিনা তাদেরকে মাথা উঁচু করে নির্ভীকতায় এগিয়ে যাবার শক্তি দিয়েছে।
No comments