পুলিশের সেবা সপ্তাহ না দাবি সপ্তাহ by সুমন রহমান
ইংরেজি নতুন বছর এলেই পুলিশের
ক্ষমতায়তনের দাবি ওঠে নানাভাবে। পুলিশ সপ্তাহ আয়োজন করে সরকারপ্রধানের
কাছে দাবি উপস্থাপন করাই এখন আনুষ্ঠানিকতা ও রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
অন্য
সবাই যখন নতুন বছরে দেশের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি, আশা-প্রত্যাশার বাণী
নিয়ে হাজির হন, তখন পুলিশ হাজির হয় দাবি নিয়ে। আর তাতে পুলিশ যত প্রশংসা
করে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কিছু ক্ষেত্রে সরকারপ্রধান ও অন্য মন্ত্রীরা
তার চেয়ে বেশি যেন সমীহ করে পুলিশকে। পুলিশ বলে কথা! যদি বিপদের দিন
সাহায্য পাওয়া যায়, পুলিশের লাঠিপেটা থেকে পরিত্রাণ কিংবা মামলা থেকে
অব্যাহতি পাওয়া যায়, পয়সার বিনিময়ে হলেও জমিজমা উদ্ধার করা যায়Ñ তাতে
কম কী! ফলে অনেক ক্ষমতাধর এমনকি সরকারপ্রধানকেও পুলিশের কল্যাণে যেন ব্যস্ত
হতে দেখা যায়। আর এতে পুলিশ ভুলে যায় জনগণের কল্যাণের কথা ।
এভাবেই আগামী ২২ থেকে ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ পর্যন্ত আসছে পুলিশ সপ্তাহের নামে পুলিশের দাবি সপ্তাহ। এ পুলিশ সপ্তাহে আশা করা হবেÑ আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে নতুন পদক্ষেপের কথা, জনগণের সামাজিক নিরাপত্তার কথা, ছিনতাইকারী, মলমপার্টি-সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে পুলিশের নতুন পদক্ষেপের কথা, থানায় জিডি এজাহার করতে গেলে আর কোনো হয়রানি না হওয়ার কথা, নিরপেক্ষ তদন্তের আশার বাণী, ধনী-গরিব সবার জন্য সমান সেবার কথা, যানজট নিরসনে নতুন পদক্ষেপের কথা। কিন্তু কেউ তা বলেন না। এবারো বলবে কি না সেটি জানা নেই। তবে গত বছরের ৩ থেকে ৬ জানুয়ারিতে আয়োজিত পুলিশ সপ্তাহের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, এসবের কোনো কথাই আলোচনা হবে না এবারের পুলিশ সপ্তাহেও। এ সপ্তাহে কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে আগেও বলতে শোনা যায়নিÑ এখন থেকে পুলিশ নিরপেক্ষ হবে, রাজনৈতিক তল্পিবাহক হবে না, থানায় পোস্টিংয়ের জন্য নিলামমূল্যে অর্থ দিতে হবে না, থানা থেকেও কোনো পারসেনটেজ যাবে না পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে। পুলিশ এখন থেকে আর কোনো দোকানপাট, হাটবাজার, ফুটপাথ, ব্যবসায়ী, শিল্পকারখানা, সন্ত্রাসী, পতিতা কারো কাছ থেকেই চাঁদা নেবে না! পুলিশ কর্তৃক লিমন, কাদের ও মিলনসহ অনেক যুবকের নির্মম নির্যাতনের কথাও আলোচিত হবে না। বরং এবারের পুলিশ সপ্তাহে শুরুতেই হয়তো পুলিশ প্রধানমন্ত্রীকে রাজারবাগে দাওয়াত দিয়ে এনে অনেক দাবি পেশ করবে। বলবে পুলিশকে নিয়ে পৃথক বিভাগ করার কথা, যেখানে আইজিপি এ বিভাগ চালাবেন। হয়তো আরো দাবি উত্থাপিত হবেÑ পুলিশ কারো নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, সচিবের পদমর্যাদার আরো (গ্রেড-১) তিনটি পদ চাই, আইজিপি হবেন ফোর-স্টার জেনারেল। র্যাবের ব্যাটালিয়ন ও সব কার্যক্রম জেলা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। সব নিয়োগের ক্ষমতা থাকতে হবে পুলিশের একক নিয়ন্ত্রণে। সর্বত্র শুধু ক্ষমতার দাবি জানানো হবে আর তাতেই সন্তুষ্ট হবেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি হয়তো ঘোষণা দেবেনÑ পুলিশের সব দাবি পূরণ করা হবে। তা না হলে পুলিশ সপ্তাহ কেন! পুলিশ সপ্তাহের কর্মসূচিতে পুলিশের আত্মশুদ্ধি, আত্মসমালোচনা কিংবা জনগণের সেবাধর্মী কোনো কথা বলা হবে না।
গত বছর পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী সভায় পুলিশের সমন্বয়ক আইজিপি ফনীভূষণ চৌধুরীর বক্তব্যেই পুলিশের বেপরোয়া দুর্নীতি ও সেবার মান সম্পর্কে একটা চিত্র ফুটে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘পুলিশে দুর্নীতি বেড়েছে, সেবার মান কমেছে, চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে, থানায় গিয়ে মানুষ ভালো ব্যবহার পাচ্ছে না, প্রতিকার পাচ্ছে না, থানায় মামলা বা জিডি নিতে পুলিশ অনীহা প্রকাশ করে, চেকপোস্টের নামে পুলিশ প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মানুষকে হয়রানি করে, এ সরকার পুলিশের জন্য অনেক কিছু করলেও পুলিশের কাছ থেকে জনগণ সেবাদানের নিশ্চয়তা পাচ্ছে না, পুলিশের প্রশিক্ষণ-মোটিভেশন ঠিকমতো হচ্ছে না, জবাবদিহি নিশ্চিত হচ্ছে না।’ তিনি রাজারবাগের ওই সভায় আরো কথা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাকে জোর করে বসিয়ে দেয়া হয়। তবে তার বক্তব্যকে সমর্থন করে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেনÑ ‘থানায় পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তার কিছু হলেও সঠিক’। আর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বলেছিলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের অস্তিত্ব আছে। পুলিশকে আরো সুশৃঙ্খল হওয়া দরকার। দেশী-বিদেশী কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও পুলিশকে সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলা হয়েছে। দেশ এখন পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
পুলিশ সপ্তাহে ২২ জানুয়ারি (২০১৩) তারিখ রাতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিরাট নৈশভোজের আয়োজন করা হচ্ছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সচিব, শিল্পপতিরা আসবেন। আবার পুলিশের ক্ষমতায়নের দাবি তোলা হবে। পর দিন ২৩ জানুয়ারি আবার প্রধানমন্ত্রীর দফতরে সব বড় বড় পুলিশ কর্মকর্তাকে দাওয়াত দিয়ে সম্মেলন করবেন প্রধানমন্ত্রী। তখন আবারো প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি তোলা হবেÑ ‘আইজিপিকে আরো ক্ষমতা দিতে হবে।’ চাই আরো মর্যাদাÑ থ্রি স্টার জেনারেলের মতো। এ মর্যাদার মানে কি সাধারণ মানুষ জানে না। এ ক্ষমতার দাবি না হয়ে যদি সেবার মান উন্নয়নের কথা বলা হতোÑ তাতে জনগণ আশ্বস্ত হতেন। সব থানাকে সেবার মানভিত্তিক টু স্টার, থ্রি-স্টার, ফোর স্টার, ফাইভ স্টার হলে জনগণ উপকৃত হতো। কিন্তু পুলিশ চায় ক্ষমতার থ্রি স্টার! গত বছর পুলিশ সপ্তাহে পুলিশের দুর্নীতির কথা ফাঁস করে দেয়ায় আইজিপি ফনীভূষণকে অন্য কোনো অনুষ্ঠানে যেতে দেয়া হয়নি। গত বছর পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী পুলিশের দাবি শুনে গণতন্ত্র রক্ষায় তার অব্যাহত সমর্থনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কারণ পুলিশ ছাড়া এ দেশ রক্ষা ও উন্নয়ন আর কেউ করতে পারে না।
এ বছর পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী হয়তোবা একই ঘোষণা দেবেন এবং দাবিগুলো পূরণ করবেন। পুলিশের জন্য গত চার বছরে অনেক উন্নয়ন করা হয়েছে। সব কর্মকর্তাকে এক কোটি ২০ লাখ টাকার দামের পাজেরো গাড়ি, সাভার-আমিন-বাজার-টঙ্গী-গুলশান-বসুন্ধরাতে ফাট বা প্লট বরাদ্দ, দুইবার বা তিনবার জাতিসঙ্ঘ মিশনে প্রেরণ, স্ত্রী-কন্যার জন্য গাড়ি, জুতা বা জামাকাপড় পরিষ্কারের জন্য রানার, বাজারঘাট করার জন্য কনস্টেবল এবং কর্মকর্তাদের মোবাইল, কলম, ডাইরি, ব্যাগ ইত্যাদি রাখার জন্য দেয়া হয়েছে পৃথক রানার। আর সব কর্মকর্তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য দেয়া হয়েছে বডিগার্ড। কিন্তু জনগণের নিরাপত্তায় তাদের সময় কোথায়?
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে পুলিশের জন্য রেশনভাতা ১০০% করা হয়েছে, মাসিক ভাতা দেয়া হয়েছে, শিল্প পুলিশ, মহিলা পুলিশ গঠন করা হয়েছে, সাহসিকতার কাজের জন্য রাষ্ট্রপতি পদক প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রতি থানার জন্য পিকআপ, মোটরসাইকেল দেয়া হয়েছে, জ্বালানি ও তদন্ত খরচ বৃদ্ধি করা হয়েছে। পুলিশের জন্য নতুন ৩২ হাজার জনবলের অনুমোদন ও নতুন ২৮ হাজার জনবলকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ মিশনে মহিলা পুলিশসহ নিয়মিত পুলিশ ইউনিট প্রেরণ করা হচ্ছে। নতুন থানা ভবন ও পুলিশ ব্যারাক নির্মাণ করা হয়েছে। ২০টি জেলায় পুলিশের হাসপাতাল করা হয়েছে। এত প্রাপ্তির পরও এ দেশের পুলিশ কর্মকর্তারা জনগণের কথা বলতে ভুুলে যান। সেবাদানের কথা বলতে চান না। গত বছর পুলিশ সপ্তাহের তৃতীয় দিনে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আয়োজন করা হয়েছিল মধ্যাহ্নভোজের। এ ভোজে আবার দাবি তোলা হয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইজিপি দিয়ে পৃথক পুলিশ বিভাগ গঠন, পুলিশকে রক্ষার জন্য আইনজীবী দল গঠন, পুলিশের জন্য ৭০ শতাংশ ভাতা দাবি, সম্মানী বেতন, পুলিশের সন্তানদের শিক্ষার উন্নয়নের জন্য স্কুল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান ইত্যাদি। পুলিশের এসব দাবি বাস্তবায়িত না হওয়ায় মনঃুণœ হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম! শোনা যায় তিনি পুলিশের মুখপাত্র। পুলিশের দাবি শুনলেই তিনি কাতর হয়ে পড়েন। এ কাতর এমনিই হননি। তিনি আকাশে মাঝে মাঝে কালো মেঘ দেখতে পান! শোনা যায়, তিনি পুলিশের ক্ষমতায়নের জন্য গোপনে পত্র দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এই উপদেষ্টার কল্যাণে ৪০ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম পিএসসির চেয়ারম্যান হয়েছেন পুলিশের একজন অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি। ওই উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও জনপ্রশাসন সচিবের কল্যাণে পুলিশের আইজিপিকে সচিব পদ থেকে টেনে সিনিয়র সচিব করা হয়েছে। ডিএমপি থেকে গত ২০১২ সালের একটি ক্যালেন্ডার প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে আইজি ও পুলিশ কমিশনারের কৃতিত্বের ছবি ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পেশাগত দায়িত্ব পালনের কোনো ছবি ছিল না।
গত বছর পুলিশ সপ্তাহের শেষ দিনে ৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সভায় পুলিশ কর্মকর্তারা আরো ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য দাবি তোলেন। তারা পুলিশ সংস্কার অধ্যাদেশ করতে বলেন। পুলিশ সংস্কারের কথা তুলে আইজিপি সেনাবাহিনীর মতো পুলিশ প্রধান হতে চান। পুলিশ সংস্কারের দাবি অনুযায়ী পুলিশ বাহিনী কোনো মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। এমনকি পুলিশ কর্মকর্তা (ক্যাডার সার্ভিসে) নিয়োগ, বদলি সবই করবে পুলিশ প্রধান। সব পুলিশ কর্মকর্তার থাকবে অফুরন্ত ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ। রাস্তায় বের হলেই তার থাকতে হবে বাধাহীন ক্ষমতা। আনসার ও কারা বাহিনীকেও নিয়ন্ত্রণে নিতে চান পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তারা আর সিভিল সার্ভিসে থাকতেন চান না, তারা প্যারামিলিটারি বাহিনী হতে চান। এমন সব কথা বলা আছে পুলিশ সংস্কার অধ্যাদেশে। জনগণের কল্যাণ কিংবা পুলিশ সদস্যের কল্যাণকর কোনো কথা নেই সংস্কার খসড়ায়। শুধুই ক্ষমতা বৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতা আর স্বাধীনতা। এ সংস্কার বাস্তবায়িত না হওয়ায় পুলিশ কর্মকর্তারা সরকারের ওপর নাখোশ। পুলিশ এখন নিজেদের আর সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা ভাবতে রাজি নন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে জেলায় ডিসি কর্তৃক পুলিশের সব নিয়ন্ত্রণকে মুক্ত করে দেন। পুলিশের আইজি পদটি তখন ছিল যুগ্ম সচিবের পদমর্যাদার। এখন টুস্টার, থ্রিস্টার জেনারেল ভাবনায় আইজিপি। তাই পুলিশ এখন নিয়ন্ত্রণহীন। কোথায় কোনো চেইন অব কমান্ড কিংবা নিয়ন্ত্রণ নেই। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও পুলিশের বেপরোয়া হয়ে ওঠার এটি একটি অন্যতম কারণ।
পুলিশের এখন অনেক দাবি, অনেক চাওয়া। কল্যাণ ও সেবাদানের পরিবর্তে পুলিশের শুধু দাবি আর দাবি। এ দাবিনামা দিন দিন বাড়ছে। গণতন্ত্র রক্ষার নামে এ ধরনের ক্ষমতা বৃদ্ধির দাবি কতটুকু যুক্তিযুক্ত, তা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, সচেতন নাগরিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ না দেখলে দেশ উন্নয়নের পরিবর্তে সঙ্ঘাতের দিকে এগিয়ে যাবে কি না ভেবে দেখা দরকার। গণতন্ত্র রক্ষা মানে পুলিশের ক্ষমতা বৃদ্ধি নয় এটা বুঝতে হবে। পুলিশ সপ্তাহ যেন দাবি সপ্তাহে পরিণত না হয়, বরং সেবা সপ্তাহে পরিণত হবে সেটাই নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : একজন গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী
এভাবেই আগামী ২২ থেকে ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ পর্যন্ত আসছে পুলিশ সপ্তাহের নামে পুলিশের দাবি সপ্তাহ। এ পুলিশ সপ্তাহে আশা করা হবেÑ আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে নতুন পদক্ষেপের কথা, জনগণের সামাজিক নিরাপত্তার কথা, ছিনতাইকারী, মলমপার্টি-সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে পুলিশের নতুন পদক্ষেপের কথা, থানায় জিডি এজাহার করতে গেলে আর কোনো হয়রানি না হওয়ার কথা, নিরপেক্ষ তদন্তের আশার বাণী, ধনী-গরিব সবার জন্য সমান সেবার কথা, যানজট নিরসনে নতুন পদক্ষেপের কথা। কিন্তু কেউ তা বলেন না। এবারো বলবে কি না সেটি জানা নেই। তবে গত বছরের ৩ থেকে ৬ জানুয়ারিতে আয়োজিত পুলিশ সপ্তাহের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, এসবের কোনো কথাই আলোচনা হবে না এবারের পুলিশ সপ্তাহেও। এ সপ্তাহে কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে আগেও বলতে শোনা যায়নিÑ এখন থেকে পুলিশ নিরপেক্ষ হবে, রাজনৈতিক তল্পিবাহক হবে না, থানায় পোস্টিংয়ের জন্য নিলামমূল্যে অর্থ দিতে হবে না, থানা থেকেও কোনো পারসেনটেজ যাবে না পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে। পুলিশ এখন থেকে আর কোনো দোকানপাট, হাটবাজার, ফুটপাথ, ব্যবসায়ী, শিল্পকারখানা, সন্ত্রাসী, পতিতা কারো কাছ থেকেই চাঁদা নেবে না! পুলিশ কর্তৃক লিমন, কাদের ও মিলনসহ অনেক যুবকের নির্মম নির্যাতনের কথাও আলোচিত হবে না। বরং এবারের পুলিশ সপ্তাহে শুরুতেই হয়তো পুলিশ প্রধানমন্ত্রীকে রাজারবাগে দাওয়াত দিয়ে এনে অনেক দাবি পেশ করবে। বলবে পুলিশকে নিয়ে পৃথক বিভাগ করার কথা, যেখানে আইজিপি এ বিভাগ চালাবেন। হয়তো আরো দাবি উত্থাপিত হবেÑ পুলিশ কারো নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, সচিবের পদমর্যাদার আরো (গ্রেড-১) তিনটি পদ চাই, আইজিপি হবেন ফোর-স্টার জেনারেল। র্যাবের ব্যাটালিয়ন ও সব কার্যক্রম জেলা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। সব নিয়োগের ক্ষমতা থাকতে হবে পুলিশের একক নিয়ন্ত্রণে। সর্বত্র শুধু ক্ষমতার দাবি জানানো হবে আর তাতেই সন্তুষ্ট হবেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি হয়তো ঘোষণা দেবেনÑ পুলিশের সব দাবি পূরণ করা হবে। তা না হলে পুলিশ সপ্তাহ কেন! পুলিশ সপ্তাহের কর্মসূচিতে পুলিশের আত্মশুদ্ধি, আত্মসমালোচনা কিংবা জনগণের সেবাধর্মী কোনো কথা বলা হবে না।
গত বছর পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী সভায় পুলিশের সমন্বয়ক আইজিপি ফনীভূষণ চৌধুরীর বক্তব্যেই পুলিশের বেপরোয়া দুর্নীতি ও সেবার মান সম্পর্কে একটা চিত্র ফুটে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘পুলিশে দুর্নীতি বেড়েছে, সেবার মান কমেছে, চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে, থানায় গিয়ে মানুষ ভালো ব্যবহার পাচ্ছে না, প্রতিকার পাচ্ছে না, থানায় মামলা বা জিডি নিতে পুলিশ অনীহা প্রকাশ করে, চেকপোস্টের নামে পুলিশ প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মানুষকে হয়রানি করে, এ সরকার পুলিশের জন্য অনেক কিছু করলেও পুলিশের কাছ থেকে জনগণ সেবাদানের নিশ্চয়তা পাচ্ছে না, পুলিশের প্রশিক্ষণ-মোটিভেশন ঠিকমতো হচ্ছে না, জবাবদিহি নিশ্চিত হচ্ছে না।’ তিনি রাজারবাগের ওই সভায় আরো কথা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাকে জোর করে বসিয়ে দেয়া হয়। তবে তার বক্তব্যকে সমর্থন করে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেনÑ ‘থানায় পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তার কিছু হলেও সঠিক’। আর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বলেছিলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের অস্তিত্ব আছে। পুলিশকে আরো সুশৃঙ্খল হওয়া দরকার। দেশী-বিদেশী কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও পুলিশকে সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলা হয়েছে। দেশ এখন পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
পুলিশ সপ্তাহে ২২ জানুয়ারি (২০১৩) তারিখ রাতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিরাট নৈশভোজের আয়োজন করা হচ্ছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সচিব, শিল্পপতিরা আসবেন। আবার পুলিশের ক্ষমতায়নের দাবি তোলা হবে। পর দিন ২৩ জানুয়ারি আবার প্রধানমন্ত্রীর দফতরে সব বড় বড় পুলিশ কর্মকর্তাকে দাওয়াত দিয়ে সম্মেলন করবেন প্রধানমন্ত্রী। তখন আবারো প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি তোলা হবেÑ ‘আইজিপিকে আরো ক্ষমতা দিতে হবে।’ চাই আরো মর্যাদাÑ থ্রি স্টার জেনারেলের মতো। এ মর্যাদার মানে কি সাধারণ মানুষ জানে না। এ ক্ষমতার দাবি না হয়ে যদি সেবার মান উন্নয়নের কথা বলা হতোÑ তাতে জনগণ আশ্বস্ত হতেন। সব থানাকে সেবার মানভিত্তিক টু স্টার, থ্রি-স্টার, ফোর স্টার, ফাইভ স্টার হলে জনগণ উপকৃত হতো। কিন্তু পুলিশ চায় ক্ষমতার থ্রি স্টার! গত বছর পুলিশ সপ্তাহে পুলিশের দুর্নীতির কথা ফাঁস করে দেয়ায় আইজিপি ফনীভূষণকে অন্য কোনো অনুষ্ঠানে যেতে দেয়া হয়নি। গত বছর পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী পুলিশের দাবি শুনে গণতন্ত্র রক্ষায় তার অব্যাহত সমর্থনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কারণ পুলিশ ছাড়া এ দেশ রক্ষা ও উন্নয়ন আর কেউ করতে পারে না।
এ বছর পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী হয়তোবা একই ঘোষণা দেবেন এবং দাবিগুলো পূরণ করবেন। পুলিশের জন্য গত চার বছরে অনেক উন্নয়ন করা হয়েছে। সব কর্মকর্তাকে এক কোটি ২০ লাখ টাকার দামের পাজেরো গাড়ি, সাভার-আমিন-বাজার-টঙ্গী-গুলশান-বসুন্ধরাতে ফাট বা প্লট বরাদ্দ, দুইবার বা তিনবার জাতিসঙ্ঘ মিশনে প্রেরণ, স্ত্রী-কন্যার জন্য গাড়ি, জুতা বা জামাকাপড় পরিষ্কারের জন্য রানার, বাজারঘাট করার জন্য কনস্টেবল এবং কর্মকর্তাদের মোবাইল, কলম, ডাইরি, ব্যাগ ইত্যাদি রাখার জন্য দেয়া হয়েছে পৃথক রানার। আর সব কর্মকর্তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য দেয়া হয়েছে বডিগার্ড। কিন্তু জনগণের নিরাপত্তায় তাদের সময় কোথায়?
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে পুলিশের জন্য রেশনভাতা ১০০% করা হয়েছে, মাসিক ভাতা দেয়া হয়েছে, শিল্প পুলিশ, মহিলা পুলিশ গঠন করা হয়েছে, সাহসিকতার কাজের জন্য রাষ্ট্রপতি পদক প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রতি থানার জন্য পিকআপ, মোটরসাইকেল দেয়া হয়েছে, জ্বালানি ও তদন্ত খরচ বৃদ্ধি করা হয়েছে। পুলিশের জন্য নতুন ৩২ হাজার জনবলের অনুমোদন ও নতুন ২৮ হাজার জনবলকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ মিশনে মহিলা পুলিশসহ নিয়মিত পুলিশ ইউনিট প্রেরণ করা হচ্ছে। নতুন থানা ভবন ও পুলিশ ব্যারাক নির্মাণ করা হয়েছে। ২০টি জেলায় পুলিশের হাসপাতাল করা হয়েছে। এত প্রাপ্তির পরও এ দেশের পুলিশ কর্মকর্তারা জনগণের কথা বলতে ভুুলে যান। সেবাদানের কথা বলতে চান না। গত বছর পুলিশ সপ্তাহের তৃতীয় দিনে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আয়োজন করা হয়েছিল মধ্যাহ্নভোজের। এ ভোজে আবার দাবি তোলা হয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইজিপি দিয়ে পৃথক পুলিশ বিভাগ গঠন, পুলিশকে রক্ষার জন্য আইনজীবী দল গঠন, পুলিশের জন্য ৭০ শতাংশ ভাতা দাবি, সম্মানী বেতন, পুলিশের সন্তানদের শিক্ষার উন্নয়নের জন্য স্কুল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান ইত্যাদি। পুলিশের এসব দাবি বাস্তবায়িত না হওয়ায় মনঃুণœ হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম! শোনা যায় তিনি পুলিশের মুখপাত্র। পুলিশের দাবি শুনলেই তিনি কাতর হয়ে পড়েন। এ কাতর এমনিই হননি। তিনি আকাশে মাঝে মাঝে কালো মেঘ দেখতে পান! শোনা যায়, তিনি পুলিশের ক্ষমতায়নের জন্য গোপনে পত্র দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এই উপদেষ্টার কল্যাণে ৪০ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম পিএসসির চেয়ারম্যান হয়েছেন পুলিশের একজন অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি। ওই উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও জনপ্রশাসন সচিবের কল্যাণে পুলিশের আইজিপিকে সচিব পদ থেকে টেনে সিনিয়র সচিব করা হয়েছে। ডিএমপি থেকে গত ২০১২ সালের একটি ক্যালেন্ডার প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে আইজি ও পুলিশ কমিশনারের কৃতিত্বের ছবি ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পেশাগত দায়িত্ব পালনের কোনো ছবি ছিল না।
গত বছর পুলিশ সপ্তাহের শেষ দিনে ৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সভায় পুলিশ কর্মকর্তারা আরো ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য দাবি তোলেন। তারা পুলিশ সংস্কার অধ্যাদেশ করতে বলেন। পুলিশ সংস্কারের কথা তুলে আইজিপি সেনাবাহিনীর মতো পুলিশ প্রধান হতে চান। পুলিশ সংস্কারের দাবি অনুযায়ী পুলিশ বাহিনী কোনো মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। এমনকি পুলিশ কর্মকর্তা (ক্যাডার সার্ভিসে) নিয়োগ, বদলি সবই করবে পুলিশ প্রধান। সব পুলিশ কর্মকর্তার থাকবে অফুরন্ত ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ। রাস্তায় বের হলেই তার থাকতে হবে বাধাহীন ক্ষমতা। আনসার ও কারা বাহিনীকেও নিয়ন্ত্রণে নিতে চান পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তারা আর সিভিল সার্ভিসে থাকতেন চান না, তারা প্যারামিলিটারি বাহিনী হতে চান। এমন সব কথা বলা আছে পুলিশ সংস্কার অধ্যাদেশে। জনগণের কল্যাণ কিংবা পুলিশ সদস্যের কল্যাণকর কোনো কথা নেই সংস্কার খসড়ায়। শুধুই ক্ষমতা বৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতা আর স্বাধীনতা। এ সংস্কার বাস্তবায়িত না হওয়ায় পুলিশ কর্মকর্তারা সরকারের ওপর নাখোশ। পুলিশ এখন নিজেদের আর সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা ভাবতে রাজি নন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে জেলায় ডিসি কর্তৃক পুলিশের সব নিয়ন্ত্রণকে মুক্ত করে দেন। পুলিশের আইজি পদটি তখন ছিল যুগ্ম সচিবের পদমর্যাদার। এখন টুস্টার, থ্রিস্টার জেনারেল ভাবনায় আইজিপি। তাই পুলিশ এখন নিয়ন্ত্রণহীন। কোথায় কোনো চেইন অব কমান্ড কিংবা নিয়ন্ত্রণ নেই। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও পুলিশের বেপরোয়া হয়ে ওঠার এটি একটি অন্যতম কারণ।
পুলিশের এখন অনেক দাবি, অনেক চাওয়া। কল্যাণ ও সেবাদানের পরিবর্তে পুলিশের শুধু দাবি আর দাবি। এ দাবিনামা দিন দিন বাড়ছে। গণতন্ত্র রক্ষার নামে এ ধরনের ক্ষমতা বৃদ্ধির দাবি কতটুকু যুক্তিযুক্ত, তা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, সচেতন নাগরিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ না দেখলে দেশ উন্নয়নের পরিবর্তে সঙ্ঘাতের দিকে এগিয়ে যাবে কি না ভেবে দেখা দরকার। গণতন্ত্র রক্ষা মানে পুলিশের ক্ষমতা বৃদ্ধি নয় এটা বুঝতে হবে। পুলিশ সপ্তাহ যেন দাবি সপ্তাহে পরিণত না হয়, বরং সেবা সপ্তাহে পরিণত হবে সেটাই নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : একজন গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী
No comments