ইতি-নেতি-পাকিস্তানকেই প্রমাণ করতে হবে সে জীবিত by মাসুদা ভাট্টি
সাতচল্লিশে ভারত ভাগ যে এক ভয়ংকর নারকীয় সিদ্ধান্ত ছিল তা প্রমাণিত হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে রক্তপাত আর হানাহানির মধ্য দিয়ে। আর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান যে আসলে কোনো রাষ্ট্র নয়, মূলত জিন্নাহর মাথার মধ্যে থাকা একটি কনসেপ্ট মাত্র তা প্রমাণিত হলো আটচলি্লশে জিন্নাহর ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে।
কারণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সর্বনাশী চিন্তা যাঁর মাথা থেকে বের হয়েছিল তিনি যে আসলে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন চাননি তা গবেষণার বিষয় নয়, সাদা চোখেই বোঝা গিয়েছিল। তারপর থেকে পাকিস্তানের ইতিহাস যে পথেই প্রবাহিত হয়েছে, সে পথটাই আসলে ধ্বংসের, নির্মাণ বলতে আমরা কিছু দেখতে পাই কি? পাকিস্তানের সাবেক অঙ্গ, পূর্ব বাংলা শুধু দূরত্ব ও বৈষম্যের কারণেই যে মূল শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল তা নয়, বরং পাকিস্তান কনসেপ্টে পূর্ব বাংলা কোথাও ছিলই না। যেখানে পশ্চিমের প্রতিটি প্রদেশের আদ্যক্ষর নিয়ে পাকিস্তান শব্দটি গঠিত হয়েছিল সেখানে পূর্ব বাংলা কোথাও ছিলই না। তার মানে শুরু থেকেই দুই পাকিস্তান, পূর্ব ও পশ্চিম প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং শুরু থেকেই দুটি ভিন্ন পরিচিতি নিয়েই অবস্থান করছিল। বিস্ময়কর যে, এ ভিন্নতা সত্ত্বেও দুই দশকের বেশি সময় একত্রিত ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রকাঠামো এক থাকলেও ভিন্নতা ক্রমে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠছিল এবং শেষ পর্যন্ত একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান আলাদা হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, তারপর থেকে ক্রমে মূল পাকিস্তানের পদস্খলনই হয়েছে, তা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা অন্য যেকোনো দিক থেকেই উল্লেখ করা হোক না কেন।
সাতচলি্লশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত যে পাকিস্তানকে আমরা দেখি তা পুরোপুরি রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, আন্তসংঘাতময় এবং ফলাফল পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ভারত একই সঙ্গে স্বাধীনতা লাভ করেও কি করে ভারতের সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে তা গবেষণার বিষয় হলেও একটি সহজ সিদ্ধান্ত হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা, সাধারণ মানুষের রাজনীতি সচেতনতা বাড়িয়ে গণতন্ত্রের মৌলিক সুবিধাগুলো জনসাধারণের জন্য সহজলভ্য করা এবং স্বাজাত্যবোধ অক্ষুণ্ন রেখে একটি জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটানোই এর মূল কারণ; পাকিস্তানে যা সর্বৈব অনুপস্থিত ছিল। আমরা দেখেছি, বেলুচিস্তানের মরুভূমিতে জিন্নাহর বলতে গেলে অপমৃত্যু, লিয়াকত আলী খানের মৃত্যু, ইস্কান্দার মির্জার মৃত্যু_পাকিস্তানের নেতৃত্বের এ মৃত্যু-তালিকাই আসলে পাকিস্তানের রাজনীতির অসারতা প্রমাণ করে। তারপর একাত্তরে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়া একটি সশস্ত্র রাজনৈতিক যুদ্ধ এবং যার নিট ফলাফল ৩০ লাখ বাঙালি নিধন, আসলে কোনো দেশের অন্তর্গত রাজনৈতিক অসূয়ার বলি এত মৃত্যুর কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাকিস্তান যে গণহত্যার মতো নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞেও পিছপা নয়, রাজনৈতিক অসূয়া চরিতার্থ করতে একাত্তর আসলে তারই প্রমাণ বহন করে। কিন্তু একাত্তরের পরের পাকিস্তানে আমরা কী দেখি? আবারও সেই রক্তপাত, রাজনৈতিক অসূয়া চরিতার্থ করতে একের পর এক রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা, কখনো ফাঁসিতে ঝুলিয়ে, কখনো গুপ্তহত্যায়, কখনো প্রকাশ্যে গুলি করে। আর জনগণকে গণতন্ত্রের মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখার এ রকম প্রকৃষ্ট উদাহরণ আধুনিক পৃথিবীতে আর দুটি দেখা যাবে না। আরব রাষ্ট্রগুলো এখনো পর্যন্ত জনবিদ্রোহ এড়াতে পারছে তার জনগণকে অর্থনৈতিক সুবিধাদি দিয়ে। কিন্তু পাকিস্তানে জনগণ যে রাষ্ট্রক্ষমতার মালিক হতে পারে এ ধারণাটিই কখনো শেকড় পায়নি। বরং সাবেক জমিদার শ্রেণী (ফিউডাল লর্ড) এখনো পাকিস্তানে বর্তমান। আর এ জমিদার শ্রেণীর প্রধান রক্ষক দেশটির সেনাবাহিনী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পদ্ধতিও উন্মুক্ত নয়, বিশেষ করে সাবেক সেনা কর্মকর্তার সন্তানরাই মূলত সেনাবাহিনীর উচ্চপদে আসীন হয় এবং তাদের সঙ্গে দেশের জমিদার শ্রেণী থেকেও নেওয়া হয় কিছু, আর সাধারণ সৈনিক নিয়োগেও সেখানে প্রাধান্য পায় মধ্যশ্রেণী। সুতরাং শ্রেণী ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী সার্বিকভাবে কখনো জনগণের পক্ষে দাঁড়াবে না, সেটাই স্বাভাবিক। দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বও কিন্তু সেনাবাহিনীর মতোই, সমাজের উঁচুতলার বাসিন্দারাই কেবল রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বর্তমান পাকিস্তান বলি কিংবা সাবেক, এমন কোনো নেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না যার পারিবারিক অবস্থান সমাজের নিম্নস্তরে। জিন্নাহ থেকে আজকের গিলানি, প্রত্যেকেই পারিবারিকভাবে সমৃদ্ধ এবং ঐহিত্যগত ও অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। যে কারণে পাকিস্তানের রাজনীতি বরাবরই হেঁটেছে সমাজের উচ্চবিত্ত ও সেনাবাহিনীর মধ্যে আপসরফার পথ ধরে। যখনই একপক্ষ আরেক পক্ষের স্বার্থহানি ঘটিয়েছে তখনই দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়েছে এবং রক্তপাত বা রক্তপাত ছাড়াই সেনাবাহিনী পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা দখল করেছে। এর মধ্যে পাকিস্তানের দুই প্রধান বিদেশি বন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রভাব তো রয়েছেই। তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জর্জ বুশের আরো তথাকথিত যুদ্ধে পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বন্ধুর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এ কথা কেউই বিশ্বাস করেনি, পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্র, যেখানে সেনাবাহিনী দেশের ভেতর বিশৃঙ্খলা বজায় রাখে শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতা গ্রহণের জন্য এবং এ বিশৃঙ্খলার জন্য ধর্মকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সেই পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদ দমনে আন্তরিক থাকবে। বরং পাকিস্তান এ সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বরাদ্দকৃত অর্থ সাহায্য নিয়ে সন্ত্রাসবাদকেই আরো শক্তিশালী করবে, হয়েছেও তাই। সেনাবাহিনী একদিকে দেশের ভেতর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইসলামের বিপক্ষে খুব সফলভাবে দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছে আবার অন্যদিকে আল-কায়েদা বা তালেবান জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এখন এক মহাশক্তিতে পরিণত করেছে, যা পুরো উপমহাদেশকে এখন অশান্ত করে তুলেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ৬০ বছর পর আমরা পাকিস্তানের কাছ থেকে এত সব নেতিবাচক পুরস্কারের মধ্যে সবচেয়ে বড় যা পেয়েছি তা হলো, উপমহাদেশকে পুরোপুরি অশান্ত করে তোলায় পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য সফলতা। এখন গোটা উপমহাদেশের একজন মানুষও নিরাপদ নয় এই ধর্মবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে। আর পাকিস্তান? পাকিস্তান তো এখন নামমাত্র একটি দেশ, সেখানে কার্যত কোনো কেন্দ্রীয় শাসন আছে কি না তা রীতিমতো গবেষণা করে প্রমাণ করার বিষয়। বর্তমানে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির যে ঝুলন্ত সংসদ দেশ চালাচ্ছে তা ভাঙল বলে। সেখানেও ইসলামপন্থীরা প্রথমে বেরিয়েছে, এর পর গিয়েছে ভারত থেকে আসা মোহাজের বা রিফিউজিদের দল এমকিউএম, ফলে দেশটিতে যেকোনো সময় সংসদ ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ঘটবে এবং হতে পারে আবারও জাতির ত্রাতা হিসেবে সেনাবাহিনী শাসনক্ষমতা গ্রহণ করবে এবং আবারও হয়তো কয়েকজন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে, পাকিস্তান রাষ্ট্র এখনো টিকে আছে। তবে রবি ঠাকুরের কাদম্বিনীর মতো পাকিস্তানকেও এখন মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে, পাকিস্তান মরে নাই।
কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকায় পাকিস্তানবিষয়ক খবরের প্রথম বাক্যটি থাকে এ রকম, 'পাকিস্তানে আবার রাজনৈতিক টানাপড়েন শুরু হয়েছে।' আসলে বাক্যটি সঠিক নয়, সঠিক বাক্যটি হবে, পাকিস্তান নামের একটি রাজনীতির ভাগাড়ে শুকনো হাড় নিয়ে হিংস্র প্রাণিকুলের লড়াই শুরু হয়েছে। কোনো একটি দেশ সম্পর্কে এ রকম তীব্র নেতিবাচক বাক্য লেখা মোটেও সমীচীন নয়। কিন্তু পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে এর চেয়ে ভালো বাক্য যিনি লিখতে পারবেন তিনি নিঃসন্দেহে নমস্য। নমস্য হতে কে না চায়? কিন্তু এ ক্ষেত্রে নমস্য হওয়া গেল না বলে দুঃখিত। তবে ভয় লাগছে এটা ভেবে যে বাংলাদেশের পাকিস্তান-অনুসারীরা না আবার এখানেও একই পথে চলতে শুরু করেন। যদিও বর্তমান সংসদের পরিস্থিতি পাকিস্তানের মতো নয়, তার পরও পাকিস্তানের ভূত তো বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক শক্তির ওপর এখনো ভর করে আছে, পাকিস্তানের ধ্বংস দেখেও যে তারা কোনো শিক্ষা নেয়নি, ভয়টা আসলে সে কারণেই।
লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ
editor@ekpokkho.com
সাতচলি্লশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত যে পাকিস্তানকে আমরা দেখি তা পুরোপুরি রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, আন্তসংঘাতময় এবং ফলাফল পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ভারত একই সঙ্গে স্বাধীনতা লাভ করেও কি করে ভারতের সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে তা গবেষণার বিষয় হলেও একটি সহজ সিদ্ধান্ত হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা, সাধারণ মানুষের রাজনীতি সচেতনতা বাড়িয়ে গণতন্ত্রের মৌলিক সুবিধাগুলো জনসাধারণের জন্য সহজলভ্য করা এবং স্বাজাত্যবোধ অক্ষুণ্ন রেখে একটি জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটানোই এর মূল কারণ; পাকিস্তানে যা সর্বৈব অনুপস্থিত ছিল। আমরা দেখেছি, বেলুচিস্তানের মরুভূমিতে জিন্নাহর বলতে গেলে অপমৃত্যু, লিয়াকত আলী খানের মৃত্যু, ইস্কান্দার মির্জার মৃত্যু_পাকিস্তানের নেতৃত্বের এ মৃত্যু-তালিকাই আসলে পাকিস্তানের রাজনীতির অসারতা প্রমাণ করে। তারপর একাত্তরে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়া একটি সশস্ত্র রাজনৈতিক যুদ্ধ এবং যার নিট ফলাফল ৩০ লাখ বাঙালি নিধন, আসলে কোনো দেশের অন্তর্গত রাজনৈতিক অসূয়ার বলি এত মৃত্যুর কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাকিস্তান যে গণহত্যার মতো নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞেও পিছপা নয়, রাজনৈতিক অসূয়া চরিতার্থ করতে একাত্তর আসলে তারই প্রমাণ বহন করে। কিন্তু একাত্তরের পরের পাকিস্তানে আমরা কী দেখি? আবারও সেই রক্তপাত, রাজনৈতিক অসূয়া চরিতার্থ করতে একের পর এক রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা, কখনো ফাঁসিতে ঝুলিয়ে, কখনো গুপ্তহত্যায়, কখনো প্রকাশ্যে গুলি করে। আর জনগণকে গণতন্ত্রের মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখার এ রকম প্রকৃষ্ট উদাহরণ আধুনিক পৃথিবীতে আর দুটি দেখা যাবে না। আরব রাষ্ট্রগুলো এখনো পর্যন্ত জনবিদ্রোহ এড়াতে পারছে তার জনগণকে অর্থনৈতিক সুবিধাদি দিয়ে। কিন্তু পাকিস্তানে জনগণ যে রাষ্ট্রক্ষমতার মালিক হতে পারে এ ধারণাটিই কখনো শেকড় পায়নি। বরং সাবেক জমিদার শ্রেণী (ফিউডাল লর্ড) এখনো পাকিস্তানে বর্তমান। আর এ জমিদার শ্রেণীর প্রধান রক্ষক দেশটির সেনাবাহিনী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পদ্ধতিও উন্মুক্ত নয়, বিশেষ করে সাবেক সেনা কর্মকর্তার সন্তানরাই মূলত সেনাবাহিনীর উচ্চপদে আসীন হয় এবং তাদের সঙ্গে দেশের জমিদার শ্রেণী থেকেও নেওয়া হয় কিছু, আর সাধারণ সৈনিক নিয়োগেও সেখানে প্রাধান্য পায় মধ্যশ্রেণী। সুতরাং শ্রেণী ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী সার্বিকভাবে কখনো জনগণের পক্ষে দাঁড়াবে না, সেটাই স্বাভাবিক। দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বও কিন্তু সেনাবাহিনীর মতোই, সমাজের উঁচুতলার বাসিন্দারাই কেবল রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বর্তমান পাকিস্তান বলি কিংবা সাবেক, এমন কোনো নেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না যার পারিবারিক অবস্থান সমাজের নিম্নস্তরে। জিন্নাহ থেকে আজকের গিলানি, প্রত্যেকেই পারিবারিকভাবে সমৃদ্ধ এবং ঐহিত্যগত ও অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। যে কারণে পাকিস্তানের রাজনীতি বরাবরই হেঁটেছে সমাজের উচ্চবিত্ত ও সেনাবাহিনীর মধ্যে আপসরফার পথ ধরে। যখনই একপক্ষ আরেক পক্ষের স্বার্থহানি ঘটিয়েছে তখনই দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়েছে এবং রক্তপাত বা রক্তপাত ছাড়াই সেনাবাহিনী পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা দখল করেছে। এর মধ্যে পাকিস্তানের দুই প্রধান বিদেশি বন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রভাব তো রয়েছেই। তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জর্জ বুশের আরো তথাকথিত যুদ্ধে পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বন্ধুর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এ কথা কেউই বিশ্বাস করেনি, পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্র, যেখানে সেনাবাহিনী দেশের ভেতর বিশৃঙ্খলা বজায় রাখে শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতা গ্রহণের জন্য এবং এ বিশৃঙ্খলার জন্য ধর্মকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সেই পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদ দমনে আন্তরিক থাকবে। বরং পাকিস্তান এ সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বরাদ্দকৃত অর্থ সাহায্য নিয়ে সন্ত্রাসবাদকেই আরো শক্তিশালী করবে, হয়েছেও তাই। সেনাবাহিনী একদিকে দেশের ভেতর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইসলামের বিপক্ষে খুব সফলভাবে দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছে আবার অন্যদিকে আল-কায়েদা বা তালেবান জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এখন এক মহাশক্তিতে পরিণত করেছে, যা পুরো উপমহাদেশকে এখন অশান্ত করে তুলেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ৬০ বছর পর আমরা পাকিস্তানের কাছ থেকে এত সব নেতিবাচক পুরস্কারের মধ্যে সবচেয়ে বড় যা পেয়েছি তা হলো, উপমহাদেশকে পুরোপুরি অশান্ত করে তোলায় পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য সফলতা। এখন গোটা উপমহাদেশের একজন মানুষও নিরাপদ নয় এই ধর্মবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে। আর পাকিস্তান? পাকিস্তান তো এখন নামমাত্র একটি দেশ, সেখানে কার্যত কোনো কেন্দ্রীয় শাসন আছে কি না তা রীতিমতো গবেষণা করে প্রমাণ করার বিষয়। বর্তমানে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির যে ঝুলন্ত সংসদ দেশ চালাচ্ছে তা ভাঙল বলে। সেখানেও ইসলামপন্থীরা প্রথমে বেরিয়েছে, এর পর গিয়েছে ভারত থেকে আসা মোহাজের বা রিফিউজিদের দল এমকিউএম, ফলে দেশটিতে যেকোনো সময় সংসদ ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ঘটবে এবং হতে পারে আবারও জাতির ত্রাতা হিসেবে সেনাবাহিনী শাসনক্ষমতা গ্রহণ করবে এবং আবারও হয়তো কয়েকজন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে, পাকিস্তান রাষ্ট্র এখনো টিকে আছে। তবে রবি ঠাকুরের কাদম্বিনীর মতো পাকিস্তানকেও এখন মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে, পাকিস্তান মরে নাই।
কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকায় পাকিস্তানবিষয়ক খবরের প্রথম বাক্যটি থাকে এ রকম, 'পাকিস্তানে আবার রাজনৈতিক টানাপড়েন শুরু হয়েছে।' আসলে বাক্যটি সঠিক নয়, সঠিক বাক্যটি হবে, পাকিস্তান নামের একটি রাজনীতির ভাগাড়ে শুকনো হাড় নিয়ে হিংস্র প্রাণিকুলের লড়াই শুরু হয়েছে। কোনো একটি দেশ সম্পর্কে এ রকম তীব্র নেতিবাচক বাক্য লেখা মোটেও সমীচীন নয়। কিন্তু পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে এর চেয়ে ভালো বাক্য যিনি লিখতে পারবেন তিনি নিঃসন্দেহে নমস্য। নমস্য হতে কে না চায়? কিন্তু এ ক্ষেত্রে নমস্য হওয়া গেল না বলে দুঃখিত। তবে ভয় লাগছে এটা ভেবে যে বাংলাদেশের পাকিস্তান-অনুসারীরা না আবার এখানেও একই পথে চলতে শুরু করেন। যদিও বর্তমান সংসদের পরিস্থিতি পাকিস্তানের মতো নয়, তার পরও পাকিস্তানের ভূত তো বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক শক্তির ওপর এখনো ভর করে আছে, পাকিস্তানের ধ্বংস দেখেও যে তারা কোনো শিক্ষা নেয়নি, ভয়টা আসলে সে কারণেই।
লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ
editor@ekpokkho.com
No comments