শেষ আশ্রয় সমুন্নত রাখতেই হবে by এম জি হোসেন

আইন-আদালত রাষ্ট্রের অত্যন্ত সংবেদনশীল অঙ্গ ও আস্থার স্থল। আইন-আদালত আছে বলেই সভ্যতা টিকে আছে, মরি মরি করে আমরাও টিকে আছি কোনোমতে।
একজন ন্যায়নিষ্ঠ বিচারকও মানুষ বটে কিন্তু ভিন্ন মানুষ। আদালতের প্রতি মানুষের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও আস্থার উৎস এখানেই। একজন বিচারক মিথ্যা বলতে পারেন না, অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী হয়ে কাউকে মুক্তি বা শাস্তি দেন না, কারো চোখরাঙানিতে তিনি বিচলিত হন না, দান-অনুদান ঘৃণার বস্তু মনে করে প্রত্যাখ্যান করেন, তোয়াজ বা তোষামোদেও কাতর হন না কখনো। সত্যের মোকাবেলায় শত্রুমিত্র প্রভেদ করেন না। ইনসাফের স্বার্থে নিজ ছেলেকে দণ্ড দিতেও বিচলিত হন না, কার্পণ্য করেন না নির্দোষ অপছন্দের লোকটিকেও মুক্তি দিতে। তাই বিচারক মানুষ হলেও মানুষের মধ্যে আর এক মানুষ!

রাসূল সা: বলেছেন, ‘অত্যাচারী শাসকের সামনে অকপটে হক কথা বলাই জিহাদ। সঙ্গত কারণেই কাজটা খুব সহজ নয়, আর জালিম শাসকের জন্য এর চেয়ে তিক্ত ও অসহনীয় কোনো শব্দ অভিধানে আছে বলে মনে হয় না। মজলুমের স্বার্থে জালিমের রক্তচু তার বৈষয়িক প্রাপ্তির লালসাকে উপেক্ষা করে আদালতকে এই কঠিন কাজই করতে হয় কোনো প্রকার হেজিটেশন বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই। ‘প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত স্বাধীন বিচারব্যবস্থা’Ñ এই চেতনার মূল উৎস এখানেই। খলিফা মনসুর তার অন্যায় ও অবিচারের বৈধতা দিতে যুগশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ইমাম আবু হানিফাকে দরবারে তলব করে প্রধান বিচারপতি পদ গ্রহণে প্রস্তাব করলেন। তার অসৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইমাম অবহিত ছিলেন। তার সোজা উত্তর, আমি এই পদের যোগ্য নই। খলিফার ফের অনুরোধ। ইমামের একই জবাব। খলিফা ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, আপনি মিথ্যা বলছেন। ইমাম আরো দৃঢ়তার সাথে বললেন, আপনার কথাই যদি সত্য হয়, তা হলে আমি মিথ্যাবাদী। আর একজন মিথ্যাবাদী কখনো বিচারক হতে পারে কি? এই স্পষ্ট বক্তব্যের জন্য ইমাম আবু হানিফাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কারান্তরালে তাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। বঞ্চিত করা হয়েছে জাতিকে তার অমূল্য খেদমত থেকে। আর এমন জঘন্য কাজটা করা হয়েছে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক একবার বলেছিলেন, ‘আদালতের প্রতি জনগণের আস্থাই এর শক্তি। এই আস্থা নষ্ট হয়ে গেলে পৃথিবীর সব অর্জনই শেষ হয়ে যাবে।’ প্রণিধানযোগ্য কথা বটে, যদিও তার কৃতকর্ম বিভিন্ন প্রশ্নে জর্জরিত। তবে এই আস্থা কি সহজাত, না তা সৃষ্টি করতে হয়? দুর্বলকে চোখরাঙিয়ে শক্তির কাছে আনুগত্য প্রদর্শনে বাধ্য করা যায়, কিন্তু আস্থা ও শ্রদ্ধা? মা কি কখনো তার সন্তানের প্রতি এমন শর্তারোপ করেন যে, ‘তুমি আমাকে শ্রদ্ধা ও সমীহ করতে শুরু করবে, বিনিময়ে আমিও তোমাকে স্নেহবাৎসল্য দিতে থাকব?’ কোনো নেতাও কি এমন পূর্বশর্তে কর্মীদের আনুগত্য দাবি করেন, না তারা তাকে নেতা সাজিয়ে দেবে, তারপর তিনি নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জনে তৎপর হবেন? অত্যাচারী জালিমের নয়, বরং মজলুমের শেষ আশ্রয় আদালত। তাই দুর্বল ও মজলুমেরাই সব সময় মুক্ত বা স্বাধীন আদালতের পক্ষে, আর আদালতের মর্যাদাকে তুলে রাখতে চায় সবার ওপর। পক্ষান্তরে জালিম ও স্বৈরাচার আদালতের টুঁটি টিপে ধরতে চায় সত্য তার কাছে অসহ্য বলে। তা না পারলে চোখরাঙায়, লোভ দেখায়, ভয় দেখায় মর্যাদার শিখর থেকে টেনে নামাবার। তাই স্বৈরাচার আর আদালত সব যুগেই দুর্দিনে মজলুম যখন ন্যায়বিচারে হতাশ হয়ে হা-হুতাশ করে দুঃখ বেদনায়, তখন সেই স্বৈরাচারই আদালত অবমাননার অভিযোগ পেলে ভেঙে পড়ে কৃত্রিম কান্নায়! ইদানীং কথায় কথায় যে আদালত অবমাননার দোহাই শোনা যায় তা সেই একই রোষের লক্ষণ মাত্র।

মজলুম জনগণের আশ্রয় ও ভরসার এই শেষ দুর্গটির নড়বড়ে অবস্থায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ‘স্কাইপ কেলেঙ্কারি’ সব কিছু গুঁড়িয়ে দিলো যেন। কেউ কেউ বলছেন ন্যায়বিচারের স্বার্থে আমার দেশ একটা কাজ করেছে, জালিমের সামনে হক কথা বলার যে দুঃসাহস দেখিয়েছে, তা সাংবাদিকতার ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। কেউ বলেছেন ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রকাশ নিন্দনীয় হলেও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কোনো গোপন তথ্য জানা থাকলে তা প্রকাশ করা শুধু উচিতই নয়, বরং মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে তা জরুরিও, আর ধর্মের দিক থেকে ফরজ কাজ। পক্ষান্তরে সরকার ও বাদি পক্ষের লোকেরা বলছেন, আমার দেশ আড়িপাতার কাজ করে আইন লঙ্ঘন করেছে, তার পর তা প্রকাশ করে বড় রকমের গুনাহ করেছে। সুতরাং আড়িপাতা ও বিচারকাজে বাধা সৃষ্টির জন্য দেশদ্রোহিতার শাস্তি হওয়া দরকার। কথায় বলে ‘ল ইজ নাথিং বাট কমন সেন্স’ কিন্তু এই গুণীজনদের বিবেক নামের রাডারটি এতই দুর্বল ও অকর্ম যে এরা এমন স্বামী-স্ত্রীর একান্তে কথোপকথন আর একজন বিচারকের ভালো জায়গায় বদলি বা প্রমোশনের বিনিময়ে সরকারের মনঃপূত একটি রায় প্রদানে গোপন সংলাপের মধ্যে কোনো পার্থক্যই ধরতে পারেন না। এই গুণীজনদের স্মরণ আছে কী, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের একটি গোপন ষড়যন্ত্র ফাঁস হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল, আর এই অসামান্য কৃতিত্বের জন্য সংশ্লিষ্ট মিডিয়াও উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। দুর্নীতির অভিযোগ ফাঁস হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কত দেশে কত ‘রাজা-উজির’ এর ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে, কিন্তু কোথাও গোপন বিষয় আড়িপাতার অভিযোগে শাস্তি হয়েছে কারো?

‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন, প্রয়োজনে খালেদা জিয়াও গ্রেফতার হতে পারেন’Ñ এমন উচ্চারণ যখন অনেকের মুখেই শুনি। এই সব কথা ‘পুরনো ভাঙা কলের গান’ এর মতো শোনালেও এ বেলা হাতেনাতে প্রমাণ হয়েই গেল বিশ্বজিৎ হত্যার নায়কদের শিবির বলে চালিয়ে দেয়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায়। বিশ্বজিৎ হত্যার মামলাও নেয়া হলো অবশেষে, কিন্তু মালিবাগ মোড়ে চার হত্যা, পল্টন মোড়ে ছয় খুনের মামলা প্রত্যাহার হলো কোন আইনের স্বার্থে? ইব্রাহিম ও লোকমান হত্যাসহ অগণিত মামলা ঝুলিয়ে কেন? কোন অনুরাগ বিরাগবর্জিত মহত্ত্বের খাতিরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনিরাও নাজাত পায়? সন্ত্রাসী বিকাশ মুক্ত, আর বন্দী কেন ক্ষতবিক্ষত মানবতা?

কবি নজরুল বলেছিলেন, ‘যে যত ভণ্ড ধড়িবাজ, সেই তত বলবান, নিতি নব ছোরা গড়িয়া কসাই বলে জ্ঞান!’ সুতরাং আদালতের স্বাধীনতা আর স্বচ্ছতার জন্য লড়তে হয়েছে সদা মজলুমদেরই। তাই আসুন আমরা সবাই অন্তত একটি বিষয় একমত হই যে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মজলুমের স্বার্থরক্ষায় আদালতের সর্বোচ্চ মর্যাদা নিশ্চিত করি, মিথ্যের মরীচিকায় সত্যকে অস্পষ্ট ও সন্দিগ্ধ না করি।
       

No comments

Powered by Blogger.