ইতিহাস পার্থিব জীবনের ভালোমন্দের আলখ্য by ড. মুহম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন

ইতিহাসের জনক হেরাডোটাসই সর্বপ্রথম একটি ব্যাপক ও বাস্তবভিত্তিক ইতিহাস রচনা করেন। তার সেই গ্রন্থের নাম গ্রিক-পারসিক যুদ্ধের বিবরণ।
ওই ইতিহাসে তিনি লিডিয়ার রাজা ক্রোসাসের রাজত্বকাল থেকে (৫৬০-৫৪৮ খ্রিষ্টপূর্ব) গ্রিকদের কাছে আক্রমণকারী পারসকিদের শোচনীয় পরাজয়ের বিবরণ দেন। তার এই বিবরণ ছিল বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি তথ্যভিত্তিক উপস্থাপন। ইতিহাসচর্চার আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ঐতিহাসিক ঘটনার গভীরে নিহিত কর্মকরণ উন্মোচন করা। প্রকৃত ঐতিহাসিকের ধর্মই হলো ঘটনার কারণ ও গতিপ্রকৃতি উদঘাটনে অবিরাম নানা ধরনের প্রশ্ন ও অনুসন্ধান অব্যাহত রাখা।

ঐতিহাসিকমাত্রই তথ্যের ভুল পরিবেশন করতে পারেন না। অনুরাগে বিরাগে প্রভাবিত হয়ে বা নিজস্ব মতামতকে প্রতিষ্ঠা করতে আপন খেয়ালখুশিতে ইতিহাসসংশ্লিষ্ট কোনো সংখ্যার উল্লেখ, স্থানের নামকরণ বা ঘটনার বিবরণে ভুল তথ্য দিতে পারেন না। তথ্য-উপাত্ত ছাড়া কেউ ইতিহাসসংক্রান্ত বিষয়ের বিবরণ দিলে সেটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ঐতিহাসিককে অবশ্য নিরপেক্ষ ও সত্যাশ্রয়ী হতে হবে। ঐতিহাসিকমাত্রই স্বীকার করেন, ইতিহাসের বিবরণ হওয়া উচিত পক্ষপাতহীন ও কর্মনৈর্ব্যক্তিক। একজন প্রকৃত ঐতিহাসিক তার ইতিহাসসংশ্লিষ্ট বিষয় উপস্থাপনে মিথ্যা প্রচারণা, ব্যক্তিগত অনুভূতি, রাগ, অনুরাগ এবং পূর্বনির্ধারিত চিন্তাধারা থেকে নিজেকে দূরে রাখবেন। ইতিহাসের নিজস্ব একটা গতিপথ আছে। অসত্যের ভিত্তিতে এটাকে চেপে রাখা যায় না। চেপে রাখা ইতিহাস সত্যের আলোয় বেরিয়ে আসে। ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে কোনো অর্থপূর্ণ আলোচনায় সিদ্ধান্ত দেয়া সম্ভব নয়। আবার কোনো বিষয় সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত না হয়ে, তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত না হয়ে, তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন না করে কোনো মন্তব্য দিলে তার ফলাফল বিজ্ঞসমাজে কোনো রেখাপাত করতে পারে না। এ জন্য ইতিহাস বিষয়ে কিছু বলতে হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গভীর জ্ঞান থাকতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস প্রণয়নে উৎসের অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ অত্যাবশ্যক।

মধ্যযুগীয় নেতৃস্থানীয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে ইংরেজ, ফরাসি, ইতালীয় ও বাইজানটাইন ঐতিহাসিকদের বুদ্ধিদীপ্ত উপলব্ধিতে, বিষয়বস্তুর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে, ঘটনাবলির আলোচনায় আমরা প্রকৃত ঐতিহাসিকের গুণাবলি লক্ষ করি। এসব ঐতিহাসিকের মধ্যে ইবনে খালদুন, আল বিরুনী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে কলহন সমধিক উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া মিনাহাজ-উস-সিরাজ, আমির খসরু, জিয়াউদ্দীন বারানী, শেখ আবুল ফজল, মোহাম্মদ কাসিম হিন্দুশাহী প্রমুখ ঐতিহাসিকের প্রায় সবাই ইতিহাস রচনায় সঠিক ও নিরপেক্ষ ছিলেন। তাদের মধ্যে কিছু ঐতিহাসিকের বিবরণে কিছুটা ভাবপ্রবণতা লক্ষ করা গেলেও ইতিহাস রচনার মূল ধারা থেকে তারা ছিটকে পড়েছেন সেটা বলা যাবে না। ঐতিহাসিক আল বিরুনী উপমহাদেশে আগমনের পর সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন। তার রচিত গ্রন্থ তহকিক-ই-হিন্দ (An Eqnquiry in to India)। গ্রন্থে হিন্দু আচার-আচরণ, সাহিত্য, দর্শন, গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে অনেক বিবরণ রয়েছে। এ জন্য ওই সময়ের ইতিহাস রচনায় আল বিরুনীর বইটির সহায়তা খুবই দরকার। এ ছাড়া আল বিলাদুরী, হাসান নিজামী, আল মাসুদী ইবন-উল-আথির প্রভৃতি আরব লেখকদের রচনাবলি ইতিহাসের সঠিক উৎসভিত্তিক অতি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। প্রকৃত ঐতিহসিকদের বিবরণ উৎসভিত্তিক এবং ঘটনাবলির সঠিক প্রতিফলন থাকতে হবে।

দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশের ইতিহাস রচনায় বাস্তব ঘটনার গভীরে নিহিত কার্যকারণ উদঘাটন করার প্রবণতা দেখা যায় না। ১৯৭০ সালের গণভোটে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পাকিস্তানের সামরিক সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দমননীতির পথ বেছে নেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকাসহ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র সামরিক হামলা শুরু করে। ফলে শুরু হয় জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধে কত লোক নিহত হয় তা গণনা করা হয়নি। বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে এটা সর্বদলীয় জনযুদ্ধ হলেও নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ। এ জন্য ১৯৭১ সালে ৮ মাস ২২ দিনের যুদ্ধে এ দেশের কতজন লোককে প্রাণ দিতে হয়েছে তার সঠিক হিসাব গ্রহণ ও তালিকা প্রণয়ন মোটেও অসম্ভব কাজ ছিল না। কিন্তু সেটা না করায় আগামী দিনে ইতিহাস লেখকদের বর্ণনায় দেখা দেবে বহুমুখিতা ও বৈচিত্র্য। কেননা ইতিহাস লেখার দায়িত্ব ঐতিহাসিকদের যাদের বর্ণনায় ভিত্তি হতে হবে তথ্যভিত্তিক।

যেটা ঘটে যায় ঐতিহাসিককে সেটা চূড়ান্ত বলেই ধরে নিতে হয়। অনেকটা সমসাময়িক ঘটনা যেমন পাকিস্তানের দুই অংশের ভাঙন এবং পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় নতুন নামে, নতুন পতাকায়। এ দেশের স্বাধীনতা বিষয়ে পর্যালোচনায় গেলে একজন ঐতিহাসিককে অনেক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মোকাবেলা করতে হবে। অনেককেই বলতে শুনেছি জুলফিকার আলী ভুট্টো বিরোধী দলের নেতৃত্ব গ্রহণে সম্মত হলে বা ইয়াহিয়া খান কোনোরূপ ভূমিকা ব্যাখ্যা না দিয়েই অনির্দিষ্ট কালের জন্য ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের সভা স্থগিত ঘোষণা না করলে অথবা ২৫ মার্চ (১৯৭১) তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী সামরিক হামলা না চালালে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নই আসত না। কারণ, শেখ মুজিব ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে অনড় থেকে শান্তিপূর্ণভাবে একটা সমাধান চেয়েছিলেন। অবশ্য এ ধরনের জল্পনাকল্পনা ইতিহাসের বিষয় নয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে নানা কারণে পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি হয়েছে। তবে ১৯৭১ সালের এপ্রিল-মে পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিরোধী লোক ছিল না বললেই চলে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বলতে গেলে কেউ ছিল না। জেলখানা থেকে সব ধরনের অপরাধী বেরিয়ে আসে। অভিযোগ আছে তাদের মধ্যে অনেকে মুক্তিযুদ্ধের নাম করে পারিবারিকভাবে বিরোধী পক্ষকে হেনস্তা করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের হত্যা করেছে। এভাবে বিরোধ ও বিভেদের পথ উন্মুক্ত হয়েছে। আসলে ওই সব লোক প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধা ছিল না।

এমনই একটা প্রতিকূল পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে এক কালের পাকিস্তানের শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর প্রতিভা, উপমহাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ভাইস প্রেসিডেন্ট আবুল মনসুর আহমদ ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন তা নিম্নরূপ : ‘ভারতের বিরুদ্ধে সত্যমিথ্যা অভিযোগ করিয়া কার্যত ও পরিণামে পাকিস্তানের সামরিক শাসনকর্তারা ভারতের সুবিধা করিয়াই দিতেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের অসন্তোষ ও বিদ্রোহ যে পরিণামে ভারতের স্বার্থেরই অনুকূল, এটা ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগণ বরাবর বুঝিতেন। যেকোনো কাণ্ডজ্ঞানীরই তা বুঝিবার কথা। পাকিস্তানী শাসকের তা বুঝা উচিত ছিল। কিন্তু তাঁরা তা বুঝেন নাই বলিয়াই মনে হয়। এ অবস্থা ভারতে অনুকূল হওয়ায় ভারত সরকার ও ভারতবাসী যে পূর্ব পাকিস্তানের অসন্তোষ ও বিদ্রোহে ইন্ধন জোগাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। (রাজনীতির পঞ্চাশ বছর-পৃ: ৫৮৬)

বস্তুত ইতিহাস মানবজাতির বুদ্ধিগত ও নৈতিক আদর্শের ধারক ও বাহক। এর সাথে রাজনীতিও জড়িত। এ জন্য প্রকৃত ঐতিহাসিক বিভিন্ন উৎস উপাত্ত আয়ত্তে এনে খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে সঠিকভাবে উপলব্ধির জন্য নিরলস পরিশ্রম করে থাকেন। বিশ্লেষণ ছাড়া নিরেট সত্য উদঘাটন অসম্ভব। এ জন্য কোনো ব্যক্তিবিশেষের ঘোষণা দিয়ে বা কোনো দলের অতিশয়োক্তির মাধ্যমে ইতিহাসকে অতিরঞ্জন বা বিকৃতির কবলে নিয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি উদ্ভবের মাধ্যমেই ইতিহাস-আরব্ধ সত্যের ধারক হতে পারে। ইতিহাস এমন একটি বিজ্ঞান যাকে জ্ঞানপিপাসু সচেতন ব্যক্তিদের শিক্ষণীয় বিষয়ের সংগ্রহশালা বলা যায়। প্রকৃত ইতিহাস সত্যের ভিত্তি। এটাকে ভালোমন্দ, সুবিচার-অবিচার, পাপপুণ্য ও পার্থিব জীবনের আলেখ্য হতে হবে। একজন লেখক পার্থিব জীবনের সাময়িক রাগ, বিরাগ বা স্বার্থের কারণে ভালোমন্দ যেটাই লিখুন শেষ বিচারের দিনে তাকে স্রষ্টার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে।
       


No comments

Powered by Blogger.