পুলিশ সপ্তাহ- পুলিশ কি জনগণের বন্ধু হতে পেরেছে? by সুলতানা কামাল
প্রতিবছর নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ সপ্তাহ পালন করা হয়। সেই সময়টাতেই রাজারবাগের শ্বেত গোলাকৃতির বিশাল স্মৃতিস্তম্ভটিকে গণমাধ্যমগুলো জনগণের সমক্ষে তুলে ধরার একটা সুযোগ পায়। এই স্মৃতিস্তম্ভ আমাদের বিরাট গৌরবের, আবার গভীর বেদনার সাক্ষী হয়ে আছে।
একাত্তরের ২৫ মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হিংস্রতার শিকার হয়েছিলেন রাজারবাগে অবস্থানকারী পুলিশ সদস্যরা। সারা রাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর আওতায় কামান, ট্যাংক আর মেশিনগানের গুলিতে প্রতিটি সদস্যের মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল তারা। বাঙালি পুলিশ সদস্যরা প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন হানাদারদের বিরুদ্ধে, কিন্তু সীমিত শক্তি নিয়ে তাঁদের পেরে ওঠার কোনো উপায় ছিল না। জান বাজি রেখে তাঁরা যুদ্ধ করেছেন এবং প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এই পুলিশ সদস্যরা অজানা, অতর্কিত দুর্ঘটনায় নিহত হওয়া পুলিশ সদস্য নন—এঁরা মুক্তিযোদ্ধা, যাঁদের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন জাতি হিসেবে বাস করার অধিকার অর্জন করে নিয়েছি। তাই লেখার শুরুতেই তাঁদের প্রতি জানাই গভীরতম শ্রদ্ধা।
পুলিশ বাহিনী আমাদের রাষ্ট্রীয় বাহিনী, রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত রাখা, বিচার বিভাগকে ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে’ সাহায্য করাই এই বাহিনীর মূল কাজ। এর অন্তর্নিহিত ধারণা হচ্ছে, ‘পুলিশ হবে জনগণের বন্ধু।’ আজকে যে ভাবনা ঘিরে এই লেখা নিয়ে বসেছি, সেটা হলো পুলিশ কি সত্যিকার অর্থে জনগণের বন্ধু হতে পারছে? সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থাকা পুলিশ সদস্যরা, অর্থাৎ যাঁরা মাঠে-ময়দানে, স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করেন, ভালোমন্দ মিশিয়ে জনগণের সঙ্গে তাঁদের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। তবে এঁদের মধ্যে অনেক সদস্য আছেন, যাঁরা সামগ্রিকভাবে পুলিশ বাহিনীকে রাষ্ট্রীয় থেকে সরকারি বাহিনীতে পরিণত করার অপ্রতিরোধ্য প্রবণতা অনুসরণ করে চলেন। আমাদের পুলিশ বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তি ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা তার কারণে নানা ধরনের কাজ করতে বাধ্য হন, যেটা জনগণের প্রতি বন্ধুসুলভ বলা চলে না। কখনো নিজেদের নৈতিক ও চারিত্রিক দুর্বলতার কারণেও তাঁরা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারান বা অপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তবে তাঁদের সুযোগ-সুবিধার প্রতিও যে রাষ্ট্র অথবা নীতিনির্ধারকেরা খুব মনোযোগ দিয়েছেন, তারও খুব বেশি প্রমাণ পাওয়া যায় না। এত দিন পরও পুলিশ সংস্কারের কাজটা আমরা এগিয়ে নিতে পারলাম না।
নানা সময় পেশাগত কারণে আমাদের পুলিশের সঙ্গে মিলে কাজ করতে হয়। আমাদের সংগঠন জনমনে একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছে বলে এ কথা অনস্বীকার্য যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা পুলিশের সহযোগিতাই পাই। বিশেষত, নারী পুলিশ যুক্ত হওয়ার পর। তবে সাধারণ মানুষের যে অভিজ্ঞতা, তাতে পুলিশের সহযোগিতার তুলনায় অসহযোগিতার উদাহরণের পাল্লাই ভারী। কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি চ্যানেলে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে আমার অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল। কথা হচ্ছিল দেশের আইনের শাসন নিয়ে। সেখানে অনেক সময় পুলিশ সময়মতো অথবা একেবারেই মামলা গ্রহণ না করায় ভুক্তভোগীর যে অসুবিধা হয়, সে প্রসঙ্গ ওঠায় আইনমন্ত্রী বললেন, এর বিকল্প, তাঁর ভাষায়, খুবই সহজ। ভুক্তভোগীরা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যেতে পারেন। আদালতে গিয়ে মামলা করতে পারেন এবং তিনি আমাকে এ-ও বলেন যে, আমাদের যদি অসুবিধা হয়, আমি যেন অভিযোগগুলো তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিই। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যাওয়া, আদালতের দ্বারস্থ হওয়া পদ্ধতিগতভাবেই নির্দিষ্ট নিয়ম। কিন্তু অভিযোগ আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া আইনের শাসনের কোন বিধান মেনে করা সম্ভব? পুলিশ মামলা নেবে না, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যেতে হবে, না হলে উচ্চ আদালতের কাছে আবেদন জানাতে হবে; সেটা বিধিতে লেখা যত সহজ, বাস্তবিক কি ততটাই সহজ?
এখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় যার কাজ তাকেই করতে হবে। অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, তার অবস্থান যতই ঊর্ধ্বে হোক না কেন, সবকিছু করার সময়, ক্ষমতা বা এখতিয়ার রাখে না। স্থানীয় একজন পুলিশ সদস্য মামলা নেবেন কি নেবেন না, সেই নির্দেশ আইনমন্ত্রীর কেন, কোনো মন্ত্রীর কাছ থেকেই আসবে না। সেই পুলিশ অফিসার তাঁর কার্যবিধি অনুযায়ী সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সেটাই আইনের শাসনের শর্ত। আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে হয়। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে পুলিশের একজন অত্যন্ত উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তির সঙ্গে আমার দেখা। কথায় কথায় আমরা কেন পুলিশের সমালোচনা করি সে প্রসঙ্গ এড়ানো গেল না।
তিনি আমাকে কয়েক মাস আগে লালবাগ থানার ঘটনাটির প্রসঙ্গে বললেন, ‘আপনি এত হাই-প্রোফাইল বলেই আমরা মামলা করিনি, নয়তো আমরা মামলা করতাম।’ তিনি এটুকু বলে কার বিরুদ্ধে মামলা করতেন, সেটা আর পরিষ্কার করলেন না। মামলাটি যে আমার বিরুদ্ধেই হতো, সেটা বুঝে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জানতে পারি কি মামলাটা কী নিয়ে করতেন?’ তার উত্তর না দিয়ে তিনি অন্য কারও সঙ্গে কথা বলতে চলে গেলেন, তবে বিদায় নেওয়ার আগে আমাকে অত্যন্ত সৌজন্যের সঙ্গে চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন। সেই মুহূর্তে আমি সুযোগ পাইনি তাঁকে আর কিছু প্রশ্ন করতে। কিন্তু কথাটা আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তখন থেকেই যে আমি তাঁর ভাষায় ‘হাই-প্রোফাইল’ হওয়াতে তাঁরা মামলা করেননি, তা না হলে আমার বিরুদ্ধে মামলা হতো। আমি নিজে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছি, দীর্ঘদিন আইন নিয়ে কাজও করছি, আমার বিরুদ্ধে কী কারণে মামলা হতে পারত, সেই দিনকার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তা আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। গণমাধ্যম মারফত সবাই জানে, একটি কিশোরীকে পুলিশ আটকে রেখে নির্যাতন করছে এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমি তাৎক্ষণিক থানায় যাই। আমি বারবার জানতে চেয়েছি, কিশোরীটির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে কি না। পুলিশ স্পষ্টভাবে বলেছিল, কোনো অভিযোগ ছিল না। আমার দুশ্চিন্তা হলো একজন অতি উচ্চপর্যায়ের পুলিশ কর্তাব্যক্তি কিন্তু তাঁদের একটি বিরাট দুর্বলতার কথা (মুখ ফসকে) স্বীকার করে ফেললেন—তা হলো ‘হাই-প্রোফাইল’ হলে মামলা করা হয় না—যদিও তাঁরা মনে করেন, মামলা করা উচিত ছিল। এই কথাই কিন্তু আমরা বারবার বলে আসছি এবং এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছি। সেই দিন আমি যদি ‘লো-প্রোফাইল’ বেচারি কোনো ‘সাধারণ’ নারী হতাম, তাহলে অন্যায়ভাবে একটি কিশোরীকে আটক করে তাকে হয়রানি করার বিরুদ্ধে কথা বলতে যাওয়ার ‘অপরাধে’ আমার বিরুদ্ধে মামলা হতো! অথবা অপর দুই ব্যক্তি, যাঁরা আমার মতো ‘হাই-প্রোফাইল’ নয়, তাদের মতো হাড়গোড় ভেঙে যায় প্রায় এমন পিটুনির শিকার হতাম। এই যে ‘হাই-প্রোফাইল’দের আইনের ঊর্ধ্বে থাকার কৃষ্টি এবং সাধারণ মানুষের অভিযোগ নিয়ে পুলিশ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট, ম্যাজিস্ট্রেট থেকে উচ্চ আদালত, এমনকি মন্ত্রী পর্যন্ত দৌড়ানোর নিয়ম তৈরি করা হয়েছে সমাজে, তা পথ করে দিচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এবং দুর্নীতির অবাধ, অনিয়ন্ত্রিত প্রসারের। আইনমন্ত্রী বা অতি উচ্চপদস্থ সেই পুলিশ কর্মকর্তা যে এ কথাগুলো জানেন না বা বোঝেন না, সেটা তো হতে পারে না! কিন্তু এক একটি অবস্থানে পৌঁছে তাঁরা তাঁদের এ ধরনের উক্তির মর্মার্থটা যেন ভুলে যান। পুলিশ যে মামলা নিতে গড়িমসি করে, সময়মতো জরুরি পদক্ষেপ না নিয়ে, কিংবা অভিযোগ ঠিকমতো লিপিবদ্ধ না করে নানাভাবে ক্ষমতাহীন, বঞ্চিত মানুষ, অত্যাচারের শিকার বিশেষত, নারীর বিচার পাওয়ার পথ দুর্গম করে তোলে, সেটা সর্বজনবিদিত এবং পুলিশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ। সে কথা তারা মানতেই নারাজ। বরং সে প্রশ্ন উত্থাপন করি বলেই আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট। সেটা না হয়ে এই ‘অস্বীকৃতির সংস্কৃতি’ থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারলে আজ আইনের শাসনের এমন বেহাল অবস্থা হতো না।
আজ পুলিশ বাহিনী রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চরিত্র পরিবর্তিত করে সরকারি বাহিনীতে পরিণত হয়েছে—তা যে দলই সরকারে থাকুক না কেন। যে পুলিশ বাহিনী একদলের হয়ে সাদেক হোসেন খোকার মাথা ফাটায়, সেই পুলিশ বাহিনীই মো. নাসিমকে আরেক দলের হয়ে একই রকম আঘাত হানে। দলীয়করণ, আঞ্চলিকতা, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি—এসবে কতটা স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়, সে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে মানুষের মনে। আমার একসময়ের উপদেষ্টা থাকার কারণে নানান জনে নানান তদবির নিয়ে আসে আমার কাছে। একবার এক অদ্ভুত আবদার এল যে একজনের আত্মীয় পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিতে পরীক্ষা দিয়েছে। তারা খবর নিয়ে জেনেছে যে যতজন নেওয়া হবে, তার আত্মীয়টি ঠিক তার নিচের ক্রমিক নম্বরে আছে। আমি যেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বলে শেষ ক্রমিক নম্বরে যে প্রার্থী আছেন, তাঁকে এক ধাপ নিচে নামিয়ে তাঁর আত্মীয়কে এক ধাপ ওপরে উঠিয়ে দিতে বলি, যাতে করে আত্মীয়টি চাকরি পান। ব্যক্তিটির সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম, এ ধরনের নামানো-ওঠানো অত্যন্ত প্রচলিত ঘটনা, তার ধারণা আমি বললেই হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য, আমি তাদের এই আবদার রক্ষা করতে পারিনি। এসব কথা শুনে কষ্ট রাখার জায়গা খুঁজে পাই না।
পুলিশ সপ্তাহে আবারও নতুন করে প্রার্থনা, দেশ থেকে সব ধরনের অন্যায্যতা দূর হোক, আমাদেরই নিজস্ব পুলিশ বাহিনী তার নিজস্ব অবস্থানের মর্যাদায় জনমনে অর্জন করে নিক বন্ধুর আসনটি। তাদের সব রকম ত্যাগ, তিতিক্ষা, অঙ্গীকার যেন সার্থক হয়, ফলপ্রসূ হয়—এই কামনা করি।
সুলতানা কামাল: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক এবং সাবেকতত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।
পুলিশ বাহিনী আমাদের রাষ্ট্রীয় বাহিনী, রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত রাখা, বিচার বিভাগকে ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে’ সাহায্য করাই এই বাহিনীর মূল কাজ। এর অন্তর্নিহিত ধারণা হচ্ছে, ‘পুলিশ হবে জনগণের বন্ধু।’ আজকে যে ভাবনা ঘিরে এই লেখা নিয়ে বসেছি, সেটা হলো পুলিশ কি সত্যিকার অর্থে জনগণের বন্ধু হতে পারছে? সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থাকা পুলিশ সদস্যরা, অর্থাৎ যাঁরা মাঠে-ময়দানে, স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করেন, ভালোমন্দ মিশিয়ে জনগণের সঙ্গে তাঁদের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। তবে এঁদের মধ্যে অনেক সদস্য আছেন, যাঁরা সামগ্রিকভাবে পুলিশ বাহিনীকে রাষ্ট্রীয় থেকে সরকারি বাহিনীতে পরিণত করার অপ্রতিরোধ্য প্রবণতা অনুসরণ করে চলেন। আমাদের পুলিশ বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তি ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা তার কারণে নানা ধরনের কাজ করতে বাধ্য হন, যেটা জনগণের প্রতি বন্ধুসুলভ বলা চলে না। কখনো নিজেদের নৈতিক ও চারিত্রিক দুর্বলতার কারণেও তাঁরা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারান বা অপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তবে তাঁদের সুযোগ-সুবিধার প্রতিও যে রাষ্ট্র অথবা নীতিনির্ধারকেরা খুব মনোযোগ দিয়েছেন, তারও খুব বেশি প্রমাণ পাওয়া যায় না। এত দিন পরও পুলিশ সংস্কারের কাজটা আমরা এগিয়ে নিতে পারলাম না।
নানা সময় পেশাগত কারণে আমাদের পুলিশের সঙ্গে মিলে কাজ করতে হয়। আমাদের সংগঠন জনমনে একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছে বলে এ কথা অনস্বীকার্য যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা পুলিশের সহযোগিতাই পাই। বিশেষত, নারী পুলিশ যুক্ত হওয়ার পর। তবে সাধারণ মানুষের যে অভিজ্ঞতা, তাতে পুলিশের সহযোগিতার তুলনায় অসহযোগিতার উদাহরণের পাল্লাই ভারী। কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি চ্যানেলে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে আমার অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল। কথা হচ্ছিল দেশের আইনের শাসন নিয়ে। সেখানে অনেক সময় পুলিশ সময়মতো অথবা একেবারেই মামলা গ্রহণ না করায় ভুক্তভোগীর যে অসুবিধা হয়, সে প্রসঙ্গ ওঠায় আইনমন্ত্রী বললেন, এর বিকল্প, তাঁর ভাষায়, খুবই সহজ। ভুক্তভোগীরা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যেতে পারেন। আদালতে গিয়ে মামলা করতে পারেন এবং তিনি আমাকে এ-ও বলেন যে, আমাদের যদি অসুবিধা হয়, আমি যেন অভিযোগগুলো তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিই। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যাওয়া, আদালতের দ্বারস্থ হওয়া পদ্ধতিগতভাবেই নির্দিষ্ট নিয়ম। কিন্তু অভিযোগ আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া আইনের শাসনের কোন বিধান মেনে করা সম্ভব? পুলিশ মামলা নেবে না, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যেতে হবে, না হলে উচ্চ আদালতের কাছে আবেদন জানাতে হবে; সেটা বিধিতে লেখা যত সহজ, বাস্তবিক কি ততটাই সহজ?
এখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় যার কাজ তাকেই করতে হবে। অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, তার অবস্থান যতই ঊর্ধ্বে হোক না কেন, সবকিছু করার সময়, ক্ষমতা বা এখতিয়ার রাখে না। স্থানীয় একজন পুলিশ সদস্য মামলা নেবেন কি নেবেন না, সেই নির্দেশ আইনমন্ত্রীর কেন, কোনো মন্ত্রীর কাছ থেকেই আসবে না। সেই পুলিশ অফিসার তাঁর কার্যবিধি অনুযায়ী সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সেটাই আইনের শাসনের শর্ত। আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে হয়। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে পুলিশের একজন অত্যন্ত উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তির সঙ্গে আমার দেখা। কথায় কথায় আমরা কেন পুলিশের সমালোচনা করি সে প্রসঙ্গ এড়ানো গেল না।
তিনি আমাকে কয়েক মাস আগে লালবাগ থানার ঘটনাটির প্রসঙ্গে বললেন, ‘আপনি এত হাই-প্রোফাইল বলেই আমরা মামলা করিনি, নয়তো আমরা মামলা করতাম।’ তিনি এটুকু বলে কার বিরুদ্ধে মামলা করতেন, সেটা আর পরিষ্কার করলেন না। মামলাটি যে আমার বিরুদ্ধেই হতো, সেটা বুঝে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জানতে পারি কি মামলাটা কী নিয়ে করতেন?’ তার উত্তর না দিয়ে তিনি অন্য কারও সঙ্গে কথা বলতে চলে গেলেন, তবে বিদায় নেওয়ার আগে আমাকে অত্যন্ত সৌজন্যের সঙ্গে চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন। সেই মুহূর্তে আমি সুযোগ পাইনি তাঁকে আর কিছু প্রশ্ন করতে। কিন্তু কথাটা আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তখন থেকেই যে আমি তাঁর ভাষায় ‘হাই-প্রোফাইল’ হওয়াতে তাঁরা মামলা করেননি, তা না হলে আমার বিরুদ্ধে মামলা হতো। আমি নিজে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছি, দীর্ঘদিন আইন নিয়ে কাজও করছি, আমার বিরুদ্ধে কী কারণে মামলা হতে পারত, সেই দিনকার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তা আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। গণমাধ্যম মারফত সবাই জানে, একটি কিশোরীকে পুলিশ আটকে রেখে নির্যাতন করছে এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমি তাৎক্ষণিক থানায় যাই। আমি বারবার জানতে চেয়েছি, কিশোরীটির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে কি না। পুলিশ স্পষ্টভাবে বলেছিল, কোনো অভিযোগ ছিল না। আমার দুশ্চিন্তা হলো একজন অতি উচ্চপর্যায়ের পুলিশ কর্তাব্যক্তি কিন্তু তাঁদের একটি বিরাট দুর্বলতার কথা (মুখ ফসকে) স্বীকার করে ফেললেন—তা হলো ‘হাই-প্রোফাইল’ হলে মামলা করা হয় না—যদিও তাঁরা মনে করেন, মামলা করা উচিত ছিল। এই কথাই কিন্তু আমরা বারবার বলে আসছি এবং এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছি। সেই দিন আমি যদি ‘লো-প্রোফাইল’ বেচারি কোনো ‘সাধারণ’ নারী হতাম, তাহলে অন্যায়ভাবে একটি কিশোরীকে আটক করে তাকে হয়রানি করার বিরুদ্ধে কথা বলতে যাওয়ার ‘অপরাধে’ আমার বিরুদ্ধে মামলা হতো! অথবা অপর দুই ব্যক্তি, যাঁরা আমার মতো ‘হাই-প্রোফাইল’ নয়, তাদের মতো হাড়গোড় ভেঙে যায় প্রায় এমন পিটুনির শিকার হতাম। এই যে ‘হাই-প্রোফাইল’দের আইনের ঊর্ধ্বে থাকার কৃষ্টি এবং সাধারণ মানুষের অভিযোগ নিয়ে পুলিশ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট, ম্যাজিস্ট্রেট থেকে উচ্চ আদালত, এমনকি মন্ত্রী পর্যন্ত দৌড়ানোর নিয়ম তৈরি করা হয়েছে সমাজে, তা পথ করে দিচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এবং দুর্নীতির অবাধ, অনিয়ন্ত্রিত প্রসারের। আইনমন্ত্রী বা অতি উচ্চপদস্থ সেই পুলিশ কর্মকর্তা যে এ কথাগুলো জানেন না বা বোঝেন না, সেটা তো হতে পারে না! কিন্তু এক একটি অবস্থানে পৌঁছে তাঁরা তাঁদের এ ধরনের উক্তির মর্মার্থটা যেন ভুলে যান। পুলিশ যে মামলা নিতে গড়িমসি করে, সময়মতো জরুরি পদক্ষেপ না নিয়ে, কিংবা অভিযোগ ঠিকমতো লিপিবদ্ধ না করে নানাভাবে ক্ষমতাহীন, বঞ্চিত মানুষ, অত্যাচারের শিকার বিশেষত, নারীর বিচার পাওয়ার পথ দুর্গম করে তোলে, সেটা সর্বজনবিদিত এবং পুলিশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ। সে কথা তারা মানতেই নারাজ। বরং সে প্রশ্ন উত্থাপন করি বলেই আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট। সেটা না হয়ে এই ‘অস্বীকৃতির সংস্কৃতি’ থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারলে আজ আইনের শাসনের এমন বেহাল অবস্থা হতো না।
আজ পুলিশ বাহিনী রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চরিত্র পরিবর্তিত করে সরকারি বাহিনীতে পরিণত হয়েছে—তা যে দলই সরকারে থাকুক না কেন। যে পুলিশ বাহিনী একদলের হয়ে সাদেক হোসেন খোকার মাথা ফাটায়, সেই পুলিশ বাহিনীই মো. নাসিমকে আরেক দলের হয়ে একই রকম আঘাত হানে। দলীয়করণ, আঞ্চলিকতা, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি—এসবে কতটা স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়, সে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে মানুষের মনে। আমার একসময়ের উপদেষ্টা থাকার কারণে নানান জনে নানান তদবির নিয়ে আসে আমার কাছে। একবার এক অদ্ভুত আবদার এল যে একজনের আত্মীয় পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিতে পরীক্ষা দিয়েছে। তারা খবর নিয়ে জেনেছে যে যতজন নেওয়া হবে, তার আত্মীয়টি ঠিক তার নিচের ক্রমিক নম্বরে আছে। আমি যেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বলে শেষ ক্রমিক নম্বরে যে প্রার্থী আছেন, তাঁকে এক ধাপ নিচে নামিয়ে তাঁর আত্মীয়কে এক ধাপ ওপরে উঠিয়ে দিতে বলি, যাতে করে আত্মীয়টি চাকরি পান। ব্যক্তিটির সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম, এ ধরনের নামানো-ওঠানো অত্যন্ত প্রচলিত ঘটনা, তার ধারণা আমি বললেই হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য, আমি তাদের এই আবদার রক্ষা করতে পারিনি। এসব কথা শুনে কষ্ট রাখার জায়গা খুঁজে পাই না।
পুলিশ সপ্তাহে আবারও নতুন করে প্রার্থনা, দেশ থেকে সব ধরনের অন্যায্যতা দূর হোক, আমাদেরই নিজস্ব পুলিশ বাহিনী তার নিজস্ব অবস্থানের মর্যাদায় জনমনে অর্জন করে নিক বন্ধুর আসনটি। তাদের সব রকম ত্যাগ, তিতিক্ষা, অঙ্গীকার যেন সার্থক হয়, ফলপ্রসূ হয়—এই কামনা করি।
সুলতানা কামাল: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক এবং সাবেকতত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।
No comments