যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা by কর্নেল (অব.) এস এম শওকত আলী
সদ্য অতিক্রান্ত ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস। ৩০ লাখ শহীদ ও তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম আর অগণিত বাঙালির সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এ মহান বিজয় দিবস।
১৯৭১ সালের এই দিনে অকুতোভয় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বলে খ্যাত দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্য আর তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। দীর্ঘ ৯ মাসে ইতিহাসের অবর্ণনীয় বর্বরতা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের ফলে এ দেশের অগণিত মা হয়েছেন সন্তানহারা, বোন হয়েছেন স্বামীহারা, ভাই হয়েছেন বোনহারা, পিতা হয়েছেন পুত্রহারা আর স্বামী হয়েছেন স্ত্রীহারা। তদানীন্তন পূর্ব বাংলার এ অনুন্নত জনপদের সব যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। লুণ্ঠন করা হয়েছে ব্যাংক, ট্রেজারি, স্বর্ণালংকারসহ সব মূল্যবান সম্পদ। অবশেষে পরাজয় যখন অবশ্যম্ভাবী তখন অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের, এ জাতিকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে। আর এই হত্যাযজ্ঞে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল এ দেশের কুসন্তান রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী।
এবারের বিজয় দিবসে বাঙালি জাতি আনন্দ-বেদনা আর বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লাখো শহীদকে। দেশব্যাপী বিজয় দিবস উদ্যাপিত হয়েছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ও অঙ্গীকার নিয়ে। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ের ৪১ বছর পূর্তি উপলক্ষে এবার দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে একটু আলাদা ধরনের বাড়তি উদ্দীপনা লক্ষ করা গেছে। এই বিজয় উৎসবে তাই দেখা গেছে, ৮০ বছরের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোরসহ সর্বস্তরের মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার। কিছু চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া কেউই বাদ যায়নি এই মহান বিজয় দিবস উদ্যাপনে। এবারের বিজয় দিবসে প্রতিটি বাঙালির দীপ্ত অঙ্গীকার ছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামসমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির বিশেষ করে এ প্রজন্ম অগ্নিশপথে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যেকোনো মূল্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন
করার জন্য।
বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীনতার পর পরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এবং দালাল আইন প্রণয়ন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু করেন। তখন প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সারা দেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য পরিচালনা করা হচ্ছিল। তাদের মধ্যে ১১ হাজারের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়ে বিচারকার্য চলছিল এবং ৭৬৮ জনের ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে এই সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম অপরাধী বন্দিদের মুক্তি দেন। তবে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, ভবিষ্যতে অধিকতর তদন্তে তাদের বড় সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে বন্দি করা হবে। বাকি যারা হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের মতো কঠিন অপরাধে সম্পৃক্ত ছিল, তাদের বিচারকার্য চলতে থাকে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে ইতিহাসের নির্মম ও জঘন্যতম হত্যার শিকার হন। মরহুম জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুধু বন্ধই করেননি, তিনি মৌলবাদীদের জন্য এ দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ নিষ্কণ্টক করে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী করেন শাহ আজিজকে এবং মন্ত্রী বানান আবদুল আলিমকে (বর্তমানে যুদ্ধাপরাধে বন্দি অবস্থায় বিচারাধীন)। মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সেক্টর কমান্ডারের পক্ষে সাজাপ্রাপ্ত এবং চার্জশিটভুক্ত বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের বেকসুর খালাস দেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত ছিল, জাতি বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্ম তা জানতে চায়। যে যুদ্ধাপরাধীরা স্বাধীনতাযুদ্ধে এ দেশে অগণিত হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ এ দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে, সেই যুদ্ধাপরাধীরা- যাদের মধ্যে অনেকে ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ছিল। তাদের কেন মুক্তি দেওয়া হলো? কী মজবুরি বা বাধ্যবাধকতা ছিল এর পেছনে? মরহুম জিয়াউর রহমান সাহেব! আপনি কি স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ সংক্ষুব্ধ পরিবার কিংবা তাদের আপনজনদের জিজ্ঞাসার উত্তর দেবেন? উত্তর দেবেন কি তিন লাখ ধর্ষিত বীরাঙ্গনাকে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। আপনাকেও করেনি। ক্ষমতা, ঐশ্বর্য, প্রতিপত্তি, জৌলুস ও দম্ভ ক্ষণস্থায়ী। ইতিহাসের রায় চিরন্তন। যত দিন চন্দ্র-সূর্য থাকবে, পৃথিবী থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে- আপনার প্রতি এ প্রশ্ন রণিত হবে বারবার-প্রতিবার। কারণ '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের নিঃশর্ত-বেকসুর মুক্তি দেওয়া মানে বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা।
যুদ্ধাপরাধ বলতে যুদ্ধকালীন জেনেভা কনভেনশনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যুদ্ধের প্রচলিত রীতিনীতির কোনো তোয়াক্কা না করে যদি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো হীন অপরাধ ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে সংঘটিত বা সম্পন্ন করাকে বোঝায়। বিশেষ করে যুদ্ধের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত নয়, যারা নিরস্ত্র-নিরীহ জনসাধারণ কিংবা যুদ্ধাহত বা যুদ্ধবন্দি। প্রশ্ন হতে পারে, যুদ্ধাপরাধের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল কেন! সাধারণ দৃষ্টিতে যুদ্ধ শেষে যেসব অপরাধ যুদ্ধক্ষেত্র বা যুদ্ধের প্রচলিত রীতিনীতি, আইন-কানুন ও শৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটিয়ে সংঘটিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সমাজ পুনর্গঠনের স্বার্থে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত আবশ্যক। ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্তদের সুবিচার নিশ্চিত, আর ক্ষতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন আর দোষীদের কৃত অপরাধের যথাযথ শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ বিচারের উদ্দেশ্য কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়; বরং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ঘৃণ্য অপরাধীদের মাফ করে দেওয়ার সংস্কৃতির অবসান, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সুবিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা এবং জাতিকে দীর্ঘদিন সিন্দবাদের বুড়োর মতো কাঁধে চড়ে বসে থাকা ভয়ংকর কলঙ্ক থেকে মুক্ত করতেই অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে এই বিচারকার্য পরিচালিত হচ্ছে।
একদিকে যেমন জামায়াতের যুদ্ধাপরাধ বিচার ইস্যুতে বিএনপির সহযোগিতার বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়ে, অন্যদিকে বিএনপি তার নিজ ঘরের বিরাজমান দুর্বলতাগুলো একে একে কেটে জামায়াতসহ অন্যান্য ছোট দল নিয়ে গড়ে তোলে ১৮ দলের ঐক্যজোট। এ সুযোগে জামায়াত পূর্ণ উদ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ ও তাদের বন্দি নেতাদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ২০১২-এর নভেম্বর থেকে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর। জামায়াত ও শিবিরকর্মীরা তাদের চিরায়ত বেশ পরিবর্তন করে নতুন বেশে পুলিশের ওপর দেশব্যাপী উপর্যুপরি চোরাগোপ্তা হামলা চালায়। পুড়িয়ে দেয় পুলিশের গাড়িসহ অগণিত বেসরকারি গাড়ি। তাই তো ১৮ দলের যেকোনো সমাবেশের অধিকাংশজুড়েই থাকে যুদ্ধাপরাধে বন্দি জামায়াত নেতাদের ছবিসহ মুক্তির দাবির পক্ষে ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড। এর মধ্যে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনাল-১-এর সাবেক প্রধান বিচারপতি নিজামুল হক এবং প্রবাসে অবস্থানরত আন্তর্জাতিক অপরাধসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়া উদ্দীনের মধ্যে স্কাইপের মাধ্যমে কথোপকথন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিচারপতি নিজামুল হক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করেন। সুযোগ পেয়ে যায় জ্ঞানপাপী মওদুদ আহমদ গং। দাবি তোলা হয় ট্রাইব্যুনাল-১-এর সব বিচারকার্য প্রথম থেকে শুরু করার। যদিও এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। এ শুধু চলমান বিচারকার্য বানচাল অথবা বিলম্বিত করার সমন্বিত অপচেষ্টা মাত্র।
অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যতই চক্রান্ত হোক না কেন, বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার হবেই। কারণ এটা এ দেশের আপামর জনসাধারণ বিশেষ করে এ প্রজন্মের মানুষের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা। যেটা শুধু আবেগের নয়, চেতনার আর বিশ্বাসেরও। এ ক্ষেত্রে আমরা একটা সহজ-সরল হিসাব মেলাতেই পারি যে, ১৯৭১ সালে দেশি-বিদেশি যে শক্তিগুলো আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তারাই আজ বিভিন্নভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সামনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও সেদিন বিএনপির জন্ম হয়নি; কিন্তু এ দলটির আদর্শের যারা ধারক বা বাহক- তারা অনেকেই সেদিন স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। মরহুম জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ১৯৭৭-৭৮ সালে এ রাজনৈতিক দলটির নিউক্লিয়াস কারা তৈরি করেছিল? জামায়াত-মুসলিম লীগ আর উগ্রপন্থী বাম দল। আর এরাই যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বিএনপির সঙ্গে যে মুষ্টিমেয় শিখণ্ডী মুক্তিযোদ্ধা আছে, তাদের মেরুদণ্ড এত শক্ত নয় যে বুক চিতিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে দাঁড়াবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো- আদর্শগতভাবেও বিএনপি যুদ্ধাপরাধ বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে পারে না। তবে এটা হবে স্ববিরোধী বা আত্মসাংঘর্ষিক। কারণ এ দলটির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম জিয়াউর রহমান নিজেই ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিনা শর্তে মুক্তি দিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো না কোনো সন্ধি, বোঝাপড়া বা দুরভিসন্ধি ছিল। তা না হলে কেন পারছেন না বিএনপিতে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক বা মুক্তিযোদ্ধা তাঁরা এর প্রতিবাদ করতে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে আদর্শ ও এর চেতনায় যেসব মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সে কথা আর জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে কই। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন আবেগে বা পরিস্থিতির শিকার হয়ে। তাই তো ১৯৭১ সালের সব মুক্তিযোদ্ধাকে পাওয়া যাচ্ছে না, সে যুদ্ধে যারা শুধু বিরোধিতাই করেনি, এ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর চালিয়েছে অমানবিক ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সেই নরপশুদের অপরাধের বিচারের পাশে। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও প্রতিবন্ধকতা ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের বিরুদ্ধেও ছিল, তেমনি আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধেও আছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সব প্রতিবন্ধকতা নিশ্চিহ্ন করে যেমন আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম লাল সবুজের জাতীয় পতাকা, তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এ যুদ্ধেও আমাদের কোনো প্রতিবন্ধকতা দাবিয়ে রাখতে পারবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই হবে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও কলাম লেখক
এবারের বিজয় দিবসে বাঙালি জাতি আনন্দ-বেদনা আর বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লাখো শহীদকে। দেশব্যাপী বিজয় দিবস উদ্যাপিত হয়েছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ও অঙ্গীকার নিয়ে। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ের ৪১ বছর পূর্তি উপলক্ষে এবার দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে একটু আলাদা ধরনের বাড়তি উদ্দীপনা লক্ষ করা গেছে। এই বিজয় উৎসবে তাই দেখা গেছে, ৮০ বছরের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোরসহ সর্বস্তরের মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার। কিছু চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া কেউই বাদ যায়নি এই মহান বিজয় দিবস উদ্যাপনে। এবারের বিজয় দিবসে প্রতিটি বাঙালির দীপ্ত অঙ্গীকার ছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামসমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির বিশেষ করে এ প্রজন্ম অগ্নিশপথে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যেকোনো মূল্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন
করার জন্য।
বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীনতার পর পরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এবং দালাল আইন প্রণয়ন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু করেন। তখন প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সারা দেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য পরিচালনা করা হচ্ছিল। তাদের মধ্যে ১১ হাজারের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়ে বিচারকার্য চলছিল এবং ৭৬৮ জনের ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে এই সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম অপরাধী বন্দিদের মুক্তি দেন। তবে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, ভবিষ্যতে অধিকতর তদন্তে তাদের বড় সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে বন্দি করা হবে। বাকি যারা হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের মতো কঠিন অপরাধে সম্পৃক্ত ছিল, তাদের বিচারকার্য চলতে থাকে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে ইতিহাসের নির্মম ও জঘন্যতম হত্যার শিকার হন। মরহুম জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুধু বন্ধই করেননি, তিনি মৌলবাদীদের জন্য এ দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ নিষ্কণ্টক করে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী করেন শাহ আজিজকে এবং মন্ত্রী বানান আবদুল আলিমকে (বর্তমানে যুদ্ধাপরাধে বন্দি অবস্থায় বিচারাধীন)। মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সেক্টর কমান্ডারের পক্ষে সাজাপ্রাপ্ত এবং চার্জশিটভুক্ত বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের বেকসুর খালাস দেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত ছিল, জাতি বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্ম তা জানতে চায়। যে যুদ্ধাপরাধীরা স্বাধীনতাযুদ্ধে এ দেশে অগণিত হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ এ দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে, সেই যুদ্ধাপরাধীরা- যাদের মধ্যে অনেকে ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ছিল। তাদের কেন মুক্তি দেওয়া হলো? কী মজবুরি বা বাধ্যবাধকতা ছিল এর পেছনে? মরহুম জিয়াউর রহমান সাহেব! আপনি কি স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ সংক্ষুব্ধ পরিবার কিংবা তাদের আপনজনদের জিজ্ঞাসার উত্তর দেবেন? উত্তর দেবেন কি তিন লাখ ধর্ষিত বীরাঙ্গনাকে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। আপনাকেও করেনি। ক্ষমতা, ঐশ্বর্য, প্রতিপত্তি, জৌলুস ও দম্ভ ক্ষণস্থায়ী। ইতিহাসের রায় চিরন্তন। যত দিন চন্দ্র-সূর্য থাকবে, পৃথিবী থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে- আপনার প্রতি এ প্রশ্ন রণিত হবে বারবার-প্রতিবার। কারণ '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের নিঃশর্ত-বেকসুর মুক্তি দেওয়া মানে বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা।
যুদ্ধাপরাধ বলতে যুদ্ধকালীন জেনেভা কনভেনশনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যুদ্ধের প্রচলিত রীতিনীতির কোনো তোয়াক্কা না করে যদি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো হীন অপরাধ ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে সংঘটিত বা সম্পন্ন করাকে বোঝায়। বিশেষ করে যুদ্ধের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত নয়, যারা নিরস্ত্র-নিরীহ জনসাধারণ কিংবা যুদ্ধাহত বা যুদ্ধবন্দি। প্রশ্ন হতে পারে, যুদ্ধাপরাধের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল কেন! সাধারণ দৃষ্টিতে যুদ্ধ শেষে যেসব অপরাধ যুদ্ধক্ষেত্র বা যুদ্ধের প্রচলিত রীতিনীতি, আইন-কানুন ও শৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটিয়ে সংঘটিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সমাজ পুনর্গঠনের স্বার্থে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত আবশ্যক। ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্তদের সুবিচার নিশ্চিত, আর ক্ষতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন আর দোষীদের কৃত অপরাধের যথাযথ শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ বিচারের উদ্দেশ্য কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়; বরং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ঘৃণ্য অপরাধীদের মাফ করে দেওয়ার সংস্কৃতির অবসান, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সুবিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা এবং জাতিকে দীর্ঘদিন সিন্দবাদের বুড়োর মতো কাঁধে চড়ে বসে থাকা ভয়ংকর কলঙ্ক থেকে মুক্ত করতেই অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে এই বিচারকার্য পরিচালিত হচ্ছে।
একদিকে যেমন জামায়াতের যুদ্ধাপরাধ বিচার ইস্যুতে বিএনপির সহযোগিতার বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়ে, অন্যদিকে বিএনপি তার নিজ ঘরের বিরাজমান দুর্বলতাগুলো একে একে কেটে জামায়াতসহ অন্যান্য ছোট দল নিয়ে গড়ে তোলে ১৮ দলের ঐক্যজোট। এ সুযোগে জামায়াত পূর্ণ উদ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ ও তাদের বন্দি নেতাদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ২০১২-এর নভেম্বর থেকে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর। জামায়াত ও শিবিরকর্মীরা তাদের চিরায়ত বেশ পরিবর্তন করে নতুন বেশে পুলিশের ওপর দেশব্যাপী উপর্যুপরি চোরাগোপ্তা হামলা চালায়। পুড়িয়ে দেয় পুলিশের গাড়িসহ অগণিত বেসরকারি গাড়ি। তাই তো ১৮ দলের যেকোনো সমাবেশের অধিকাংশজুড়েই থাকে যুদ্ধাপরাধে বন্দি জামায়াত নেতাদের ছবিসহ মুক্তির দাবির পক্ষে ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড। এর মধ্যে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনাল-১-এর সাবেক প্রধান বিচারপতি নিজামুল হক এবং প্রবাসে অবস্থানরত আন্তর্জাতিক অপরাধসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়া উদ্দীনের মধ্যে স্কাইপের মাধ্যমে কথোপকথন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিচারপতি নিজামুল হক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করেন। সুযোগ পেয়ে যায় জ্ঞানপাপী মওদুদ আহমদ গং। দাবি তোলা হয় ট্রাইব্যুনাল-১-এর সব বিচারকার্য প্রথম থেকে শুরু করার। যদিও এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। এ শুধু চলমান বিচারকার্য বানচাল অথবা বিলম্বিত করার সমন্বিত অপচেষ্টা মাত্র।
অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যতই চক্রান্ত হোক না কেন, বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার হবেই। কারণ এটা এ দেশের আপামর জনসাধারণ বিশেষ করে এ প্রজন্মের মানুষের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা। যেটা শুধু আবেগের নয়, চেতনার আর বিশ্বাসেরও। এ ক্ষেত্রে আমরা একটা সহজ-সরল হিসাব মেলাতেই পারি যে, ১৯৭১ সালে দেশি-বিদেশি যে শক্তিগুলো আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তারাই আজ বিভিন্নভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সামনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও সেদিন বিএনপির জন্ম হয়নি; কিন্তু এ দলটির আদর্শের যারা ধারক বা বাহক- তারা অনেকেই সেদিন স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। মরহুম জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ১৯৭৭-৭৮ সালে এ রাজনৈতিক দলটির নিউক্লিয়াস কারা তৈরি করেছিল? জামায়াত-মুসলিম লীগ আর উগ্রপন্থী বাম দল। আর এরাই যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বিএনপির সঙ্গে যে মুষ্টিমেয় শিখণ্ডী মুক্তিযোদ্ধা আছে, তাদের মেরুদণ্ড এত শক্ত নয় যে বুক চিতিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে দাঁড়াবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো- আদর্শগতভাবেও বিএনপি যুদ্ধাপরাধ বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে পারে না। তবে এটা হবে স্ববিরোধী বা আত্মসাংঘর্ষিক। কারণ এ দলটির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম জিয়াউর রহমান নিজেই ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিনা শর্তে মুক্তি দিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো না কোনো সন্ধি, বোঝাপড়া বা দুরভিসন্ধি ছিল। তা না হলে কেন পারছেন না বিএনপিতে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক বা মুক্তিযোদ্ধা তাঁরা এর প্রতিবাদ করতে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে আদর্শ ও এর চেতনায় যেসব মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সে কথা আর জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে কই। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন আবেগে বা পরিস্থিতির শিকার হয়ে। তাই তো ১৯৭১ সালের সব মুক্তিযোদ্ধাকে পাওয়া যাচ্ছে না, সে যুদ্ধে যারা শুধু বিরোধিতাই করেনি, এ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর চালিয়েছে অমানবিক ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সেই নরপশুদের অপরাধের বিচারের পাশে। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও প্রতিবন্ধকতা ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের বিরুদ্ধেও ছিল, তেমনি আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধেও আছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সব প্রতিবন্ধকতা নিশ্চিহ্ন করে যেমন আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম লাল সবুজের জাতীয় পতাকা, তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এ যুদ্ধেও আমাদের কোনো প্রতিবন্ধকতা দাবিয়ে রাখতে পারবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই হবে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও কলাম লেখক
No comments