খোলা হাওয়া- নতুন বছরটা কি সত্যিই নতুন হবে? by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছে বেঁচে থাকার হিসাবটা প্রতিদিনের। একটা দিন শুরু হয় আর তাদের ভাবনাজুড়ে থাকে দিনটা কীভাবে কাটানো যায়, তা নিয়ে একটা উদ্বেগ।
সপ্তাহ অথবা মাসের হিসাবটা করেন ছাপোষা মানুষ, চাকরিজীবী ও স্বল্প আয়ের মানুষ, মাসের বেতন অথবা উপার্জনটা যাঁদের সম্বল। পুরোনো হয়ে যাওয়া বছরের শেষ দিন নিয়ে অথবা নতুন বছরের প্রথম দিন নিয়ে তাঁদের আলাদা চিন্তা থাকার কথা নয়। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের একটা যা কিছু মহিমা ছিল, এখনো আছে, কিন্তু তার অভিঘাতটা এমন নয় যে অনেক দিন থেকে দিনটা নিয়ে হিসাব-নিকাশ করতে হবে।
যেদিন থেকে ইংরেজি নববর্ষ উদ্যাপনের রেওয়াজ শুরু হলো, দেখা গেল, দিনটি ঘিরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা নানা ভাবনাচিন্তা করছে, স্বপ্ন দেখছে অথবা আশঙ্কায় দুলছে; কেমন যাবে বছরটা অথবা কেমন ছিল বছরটা—এ রকম প্রশ্ন তুলছে। অনেক বছর ধরেই দেখছি, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই সালতামামির একটা তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়, জীবনের সব ক্ষেত্রে কী ঘটেছে অথবা ঘটতে পারত, তার একটা হিসাব নেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। বিশ্বায়নের যুগে বছরের হিসাবটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কতটা প্রবৃদ্ধি হলো, রপ্তানি হলো, বিদেশি মুদ্রার অর্জন হলো—এসবের বছরওয়ারি পরিসংখ্যানের এখন গুরুত্ব অনেক। পাশাপাশি শিক্ষা থেকে নিয়ে যোগাযোগ, পরিবেশনীতি থেকে নিয়ে রাজনীতি—সবখানেই সর্বাগ্রে চাই বছরের হিসাব। এ জন্যই ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির মালিকদের, পরিবেশ নিয়ন্ত্রকদের, রাজনীতিবিদদের দূরত্বটা বাড়ছে। উন্নত কৃষি-উপকরণ থেকে এ জন্য বিলাসী গাড়ি আমদানিটা গুরুত্বপূর্ণ, ছোট নদী-খালগুলো বাঁচিয়ে রাখা থেকে ভরাট করে ফেলা অনেক জরুরি অথবা খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করা থেকে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে ক্ষমতা দখলের জন্য বিরোধীদের হরতাল ও লাগাতার হরতাল ডাকা অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। জাতীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটা বড় অংশ ব্যবসায়ী, ছাত্রনেতাদের অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, নানা দলের উচ্চপদের নেতাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই নানা ব্যবসা নিয়ে আছেন। তাঁরা হিসাব করেন বছরের, অর্থবছরের, সরকারের আনন্দিত পাঁচ বছরের মেয়াদের অথবা বিরোধী দলে থাকায় অসহনীয়, কষ্টকর ও অগ্রহণযোগ্য পাঁচ বছরের মেয়াদের। আমাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ এসব মানুষ নানা ছক কাটেন, অঙ্ক করেন, কিন্তু এর সামান্য অংশজুড়েই থাকে ওই খেটে খাওয়া মানুষজন।
একটা নতুন বছরের আগমনে নড়েচড়ে বসে এই নিয়ন্তা সমাজ, যার চোখ থাকে খেটে খাওয়া মানুষজনের জীবনের ছোট ছবিটার বদলে বড় বড় পরিসংখ্যান আর উন্নয়ন-অনুন্নয়নের বড় ছবিটাতে। এ দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি—যত নীতি আর বিধি-প্রবিধি, প্রকল্প আর পরিকল্পনা, বরাদ্দ-বিবেচনা আর রূপরেখা-কর্মযজ্ঞ যেহেতু এই সমাজই নিয়ন্ত্রণ করে, এর ভাবনাজুড়ে থাকে বড় বড় হিসাব। নতুন বছরের শুরুতে তারা খেরো খাতা খুলে পুরোনো-নতুনের হিসাব কষতে থাকে, তা রীতিমতো লজ্জায় ফেলে দেয় গঞ্জের ব্যবসায়ীর সালতামামির হিসাবটা। সেই ব্যবসায়ীর খাতায় লাল কালি পড়লেও তিনি নতুন বছরে খদ্দেরদের একটা বাতাসা, একটুখানি পানি বা চা খাওয়াতে ভোলেন না। কিন্তু নিয়ন্তা সমাজের খেরো খাতায় লাল দাগ পড়লে দেশে আগুন জ্বলে। এই সমাজ লাল কালিতে বিশ্বাস করে না। লাল কালির দাগ পড়তে পারে দেশের খেরো খাতায়, কিন্তু তাদের খাতায় কখনো নয়।
বেশ কয়েক বছর থেকে হয়তো সে জন্যই দেখতে পাই, বছরের হিসাব নেওয়াটা বেশ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সমাজের কাছে এবং আমরা যারা নানা পেশায় আছি, সুশীল সমাজের অংশ হিসেবে নিজেদের কিছুটা উচ্চমার্গীয় ভাবি, আমরাও ক্রমে ক্রমে সেই সমাজে ঢুকে যাচ্ছি, যার হিসাবের খাতায় লাভটাই একমাত্র শর্ত। এ বছরও দেখতে পাচ্ছি, এই সমাজের বড় বড় মহাজন হিসাবের খাতা নিয়ে বসেছেন। এই বছরটা গুরুত্বপূর্ণ নানা কারণে, সে জন্য এসব হিসাবে নিষ্পত্তির ওপর নির্ভর করবে দেশের মানুষের ভাগ্যে কী থাকবে। মোটা দাগে অবশ্য বলে দেওয়া যায়, যা থাকবে তার নাম ভোগান্তি ও বিপর্যয়।
বছরটার প্রধান গুরুত্ব এই, এটি নির্বাচনী বছর। নির্বাচন মানে ক্ষমতার পালাবদল। হয় ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় থেকে যাওয়া অথবা ক্ষমতা থেকে বিদায় হওয়া। এই পালাবদল আমাদের কাছে দূরের অনেক দেশে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। নির্বাচন হয়, নির্বাচনে জয়-পরাজয় হয়, জয়-পরাজয় মেনে নেওয়া হয় এবং রাষ্ট্রের, জনগণের জীবন নির্বাচনের আগে ও পরে চলে প্রতিদিনের মতো। অনেক দেশে নির্বাচনের জন্য এক মাসও সময় পাওয়া যায় না, কিন্তু তাতে প্রচারণায় উনিশ-বিশ হয় না। ‘২০১৩ সাল নির্বাচনের বছর’—এ রকম একটা উত্তেজক ভাবনা নিয়ে এক বছর আগে থেকেই রাজপথ-জনপথ গরম করে, সারা দেশে তুলকালাম ঘটিয়ে একটা মহারণের প্রস্তুতি নিয়ে দেশের বারোটা বাজাতে নামে না কোনো দল। এই কাজ করি আমরা, অথচ ২০ বছর ধরে গণতন্ত্রের পথেই তো আছি আমরা। ২০ বছর! অথচ নির্বাচন কার অধীনে হবে, এ বিষয়ের কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। দেশটার অনেক অর্জন, অনেক তার সম্ভাবনা। গত কয়েক মাসে আমাদের চারদিকে তাকিয়ে আমার একটা প্রত্যয় জন্মেছে, এই দেশ চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর আমরা যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে কত দূরে এসে গেছি। আরও কত দূরে আমরা যেতে পারি, তার সম্ভাবনাটাও কত উজ্জ্বল। অথচ পাকিস্তানের দিকে তাকান। দেশটা এখন একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রের লজ্জা নিয়ে কোনো রকম টিকে আছে। সে দেশের বাচ্চাদের যারা টিকা দেয়, তাদের গুলি করে মারা হয়। মেয়েদের স্কুলে বোমা মারা হয়। গণতন্ত্রের জন্মদাতা গ্রিসের দিকে তাকান, দেশটার জনসংখ্যা কত কম, অথচ দেউলিয়া হতে বসেছে। পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতার ধ্বজাধারী মিসরের দিকে তাকান। দেশটা গণতন্ত্র পেয়েছে এক বছরও হয়নি এবং এরই মধ্যে একটা সহিংস ভবিষ্যৎ নিয়ে সে দেশের মানুষ শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ সে তুলনায় অনেক এগিয়ে। এ দেশে মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে, স্কুলে যাতে যায়, সে জন্য অনেক দরিদ্র বাবা উদয়াস্ত খাটেন। বাচ্চাদের টিকা দেওয়ার সফলতার জন্য দেশটা পুরস্কৃত হয়েছে। এ দেশে গণমাধ্যম যে ভাষায় সরকারের সমালোচনা করে, তার অর্ধেক তীব্রতা নিয়ে করলে অনেক দেশে, এমনকি প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে এর ওপর সরকারের খড়্গ নেমে আসত।
গত ৪১ বছরে লিখে রাখার মতো, বড়াই করার মতো অর্জন বাংলাদেশের অনেক। ২০১২ সালের তালিকাটাও নিতান্ত ছোট নয়। সালতামামি নেওয়া সমাজের অংশ হিসেবে যদি একটা হিসাব আমি নিতে বসি, তাহলে হতাশার অন্ধকারের চেয়ে আশার আলোটাই বেশি করে দেখব। মনে হবে, একটা বছর তো ভালোমন্দে মিশিয়ে নেহাত খারাপ যায়নি এবং সেই সঙ্গে একটা বিশ্বাস জন্মাবে, নতুন বছরেও নিশ্চয় অর্জনের তালিকাটা আরও হবে।
হবে নিশ্চয়। প্রবাসী শ্রমিকেরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে আরও বেশি অর্থ পাঠাবেন। মেহনতি মানুষের শ্রমে-ঘামে এবং আগুনে পুড়ে ঝলসে যাওয়ার বিনিময়ে আমাদের আমদানি আয় আরও বাড়বে, আমাদের কৃষক রোদে-বৃষ্টিতে পুড়ে-ভিজে তিন বেলার অন্ন জোগাড় করবেন এবং গত বছরের তুলনায় বেশি হারেই। দেশের উন্নয়নের বড় ছবিটা নিশ্চয় আরও বড় হবে, কিন্তু তা হবে ছোট অনেক ছবিতে অনেক ছোট-বড় উন্নতির যোগফল হিসেবেই। এই ছোট ছবিগুলো আমরা দেখি না। এসএসসি ও এইচএসসির ফল দিলে আমাদের কাগজে ঢাকার বড় বড় স্কুলের কৃতী শিক্ষার্থীদের ছবি ছাপা হয়, কোনো প্রত্যন্ত গ্রামের একটি ছেলে বা মেয়ে, যে পরিবারের জন্য উপার্জন করে, পরিশ্রম করে, পাশাপাশি পড়াশোনা করে কৃতকার্য হলো বা হতে অপারগ হলো, তার ছবি কখনো ছাপা হয় না। আমরা বড় ছবি দেখতেই আগ্রহী এখন, যেহেতু বড় ছবিটা আমাদের বড় বড় হিসাব করতে সাহায্য করে।
নতুন বছরে এই বড় হিসাবের নানা ছক ছোট ছবিগুলোকে ঢেকে দেবে, এমন আশঙ্কা আমাদের। এখনই হুংকার শুনছি বিশাল এক যুদ্ধের। সরকারি দল বলছে, নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে; বিরোধী দল বলছে, তা হলে রক্তগঙ্গা বইবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষায় এখন আগুন ও বারুদ। এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি তুলেছে নতুন সংঘাতের আশঙ্কা। যুদ্ধাপরাধীদের দলটি সব শক্তি নিয়ে নেমেছে বিচারকাজটি ঠেকাতে, একে উল্টে দিতে। বিএনপি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এদের। খালেদা জিয়া বলছেন, আওয়ামী লীগের ভেতরে যেসব যুদ্ধাপরাধী আছে, আগে তাদের বিচার করতে হবে। কেন, আগে কেন? কাদের অপরাধ বেশি? নাকি চারপাশের যুদ্ধাপরাধীদের দিকে তাঁর চোখ পড়ে না? তিনি তো বলতে পারতেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে চলুক, পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকা যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার করতে হবে, তাহলে তাঁকে সাধুবাদ জানাতাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে গিয়ে, দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে গিয়ে ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করে নতুন বছরে তাঁর দল দেশবাসীকে কী উপহার দেবে?
নতুন বছরটা প্রকৃতই নতুন হতে পারত, ঝকঝকে নতুন হতে পারত, অর্জনে অর্জনে রঙিন হতে পারত, যদি ক্ষমতার (এবং ক্ষমতার হাত ধরে আখের গোছানো আর অর্থবিত্ত ও মানুষের দণ্ডমুণ্ডের মালিক হওয়ার) মোহ ও জেদটা কমত শ্রদ্ধাভাজন নেতা-নেত্রী এবং তাঁদের সহকর্মীদের। যদি প্রকৃতই ব্যক্তি থেকে দল এবং দল থেকে দেশটা বড় হতো তাঁদের কাছে, তাহলে গণতন্ত্রের চর্চাগুলো সংহত হতো, দেশটাকে নিয়েই সব আয়োজন হতো সব দলের। তাহলে নির্বাচন নিয়ে মানুষের উৎসাহ ও উদ্দীপনা থাকত, শঙ্কা থাকত না।
বিপরীত চিত্রটাই তো এখন বাস্তব। ২০১৩ সাল হবে আমাদের জন্য একটা মহাবিপর্যয়ের বছর, আমাকে জানিয়েছেন এক রিকশাচালক। তিনি সুশীল সমাজের অংশ নন বলে তাঁর কথাকে আমি ফেলে দিতে পারি না। কিন্তু ভাবি, মহাবিপর্যয়ের দামটি কী দাঁড়াবে শেষ পর্যন্ত? চিরস্থায়ী অস্থিতিশীলতা? হানাহানি? অনুন্নয়ন? ব্যর্থ রাষ্ট্রের দলে ঢুকে পড়া?
নতুন বছরটা তাহলে কি নতুন হবে, না মহাপুরাতন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
যেদিন থেকে ইংরেজি নববর্ষ উদ্যাপনের রেওয়াজ শুরু হলো, দেখা গেল, দিনটি ঘিরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা নানা ভাবনাচিন্তা করছে, স্বপ্ন দেখছে অথবা আশঙ্কায় দুলছে; কেমন যাবে বছরটা অথবা কেমন ছিল বছরটা—এ রকম প্রশ্ন তুলছে। অনেক বছর ধরেই দেখছি, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই সালতামামির একটা তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়, জীবনের সব ক্ষেত্রে কী ঘটেছে অথবা ঘটতে পারত, তার একটা হিসাব নেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। বিশ্বায়নের যুগে বছরের হিসাবটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কতটা প্রবৃদ্ধি হলো, রপ্তানি হলো, বিদেশি মুদ্রার অর্জন হলো—এসবের বছরওয়ারি পরিসংখ্যানের এখন গুরুত্ব অনেক। পাশাপাশি শিক্ষা থেকে নিয়ে যোগাযোগ, পরিবেশনীতি থেকে নিয়ে রাজনীতি—সবখানেই সর্বাগ্রে চাই বছরের হিসাব। এ জন্যই ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির মালিকদের, পরিবেশ নিয়ন্ত্রকদের, রাজনীতিবিদদের দূরত্বটা বাড়ছে। উন্নত কৃষি-উপকরণ থেকে এ জন্য বিলাসী গাড়ি আমদানিটা গুরুত্বপূর্ণ, ছোট নদী-খালগুলো বাঁচিয়ে রাখা থেকে ভরাট করে ফেলা অনেক জরুরি অথবা খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করা থেকে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে ক্ষমতা দখলের জন্য বিরোধীদের হরতাল ও লাগাতার হরতাল ডাকা অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। জাতীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটা বড় অংশ ব্যবসায়ী, ছাত্রনেতাদের অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, নানা দলের উচ্চপদের নেতাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই নানা ব্যবসা নিয়ে আছেন। তাঁরা হিসাব করেন বছরের, অর্থবছরের, সরকারের আনন্দিত পাঁচ বছরের মেয়াদের অথবা বিরোধী দলে থাকায় অসহনীয়, কষ্টকর ও অগ্রহণযোগ্য পাঁচ বছরের মেয়াদের। আমাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ এসব মানুষ নানা ছক কাটেন, অঙ্ক করেন, কিন্তু এর সামান্য অংশজুড়েই থাকে ওই খেটে খাওয়া মানুষজন।
একটা নতুন বছরের আগমনে নড়েচড়ে বসে এই নিয়ন্তা সমাজ, যার চোখ থাকে খেটে খাওয়া মানুষজনের জীবনের ছোট ছবিটার বদলে বড় বড় পরিসংখ্যান আর উন্নয়ন-অনুন্নয়নের বড় ছবিটাতে। এ দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি—যত নীতি আর বিধি-প্রবিধি, প্রকল্প আর পরিকল্পনা, বরাদ্দ-বিবেচনা আর রূপরেখা-কর্মযজ্ঞ যেহেতু এই সমাজই নিয়ন্ত্রণ করে, এর ভাবনাজুড়ে থাকে বড় বড় হিসাব। নতুন বছরের শুরুতে তারা খেরো খাতা খুলে পুরোনো-নতুনের হিসাব কষতে থাকে, তা রীতিমতো লজ্জায় ফেলে দেয় গঞ্জের ব্যবসায়ীর সালতামামির হিসাবটা। সেই ব্যবসায়ীর খাতায় লাল কালি পড়লেও তিনি নতুন বছরে খদ্দেরদের একটা বাতাসা, একটুখানি পানি বা চা খাওয়াতে ভোলেন না। কিন্তু নিয়ন্তা সমাজের খেরো খাতায় লাল দাগ পড়লে দেশে আগুন জ্বলে। এই সমাজ লাল কালিতে বিশ্বাস করে না। লাল কালির দাগ পড়তে পারে দেশের খেরো খাতায়, কিন্তু তাদের খাতায় কখনো নয়।
বেশ কয়েক বছর থেকে হয়তো সে জন্যই দেখতে পাই, বছরের হিসাব নেওয়াটা বেশ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সমাজের কাছে এবং আমরা যারা নানা পেশায় আছি, সুশীল সমাজের অংশ হিসেবে নিজেদের কিছুটা উচ্চমার্গীয় ভাবি, আমরাও ক্রমে ক্রমে সেই সমাজে ঢুকে যাচ্ছি, যার হিসাবের খাতায় লাভটাই একমাত্র শর্ত। এ বছরও দেখতে পাচ্ছি, এই সমাজের বড় বড় মহাজন হিসাবের খাতা নিয়ে বসেছেন। এই বছরটা গুরুত্বপূর্ণ নানা কারণে, সে জন্য এসব হিসাবে নিষ্পত্তির ওপর নির্ভর করবে দেশের মানুষের ভাগ্যে কী থাকবে। মোটা দাগে অবশ্য বলে দেওয়া যায়, যা থাকবে তার নাম ভোগান্তি ও বিপর্যয়।
বছরটার প্রধান গুরুত্ব এই, এটি নির্বাচনী বছর। নির্বাচন মানে ক্ষমতার পালাবদল। হয় ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় থেকে যাওয়া অথবা ক্ষমতা থেকে বিদায় হওয়া। এই পালাবদল আমাদের কাছে দূরের অনেক দেশে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। নির্বাচন হয়, নির্বাচনে জয়-পরাজয় হয়, জয়-পরাজয় মেনে নেওয়া হয় এবং রাষ্ট্রের, জনগণের জীবন নির্বাচনের আগে ও পরে চলে প্রতিদিনের মতো। অনেক দেশে নির্বাচনের জন্য এক মাসও সময় পাওয়া যায় না, কিন্তু তাতে প্রচারণায় উনিশ-বিশ হয় না। ‘২০১৩ সাল নির্বাচনের বছর’—এ রকম একটা উত্তেজক ভাবনা নিয়ে এক বছর আগে থেকেই রাজপথ-জনপথ গরম করে, সারা দেশে তুলকালাম ঘটিয়ে একটা মহারণের প্রস্তুতি নিয়ে দেশের বারোটা বাজাতে নামে না কোনো দল। এই কাজ করি আমরা, অথচ ২০ বছর ধরে গণতন্ত্রের পথেই তো আছি আমরা। ২০ বছর! অথচ নির্বাচন কার অধীনে হবে, এ বিষয়ের কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। দেশটার অনেক অর্জন, অনেক তার সম্ভাবনা। গত কয়েক মাসে আমাদের চারদিকে তাকিয়ে আমার একটা প্রত্যয় জন্মেছে, এই দেশ চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর আমরা যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে কত দূরে এসে গেছি। আরও কত দূরে আমরা যেতে পারি, তার সম্ভাবনাটাও কত উজ্জ্বল। অথচ পাকিস্তানের দিকে তাকান। দেশটা এখন একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রের লজ্জা নিয়ে কোনো রকম টিকে আছে। সে দেশের বাচ্চাদের যারা টিকা দেয়, তাদের গুলি করে মারা হয়। মেয়েদের স্কুলে বোমা মারা হয়। গণতন্ত্রের জন্মদাতা গ্রিসের দিকে তাকান, দেশটার জনসংখ্যা কত কম, অথচ দেউলিয়া হতে বসেছে। পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতার ধ্বজাধারী মিসরের দিকে তাকান। দেশটা গণতন্ত্র পেয়েছে এক বছরও হয়নি এবং এরই মধ্যে একটা সহিংস ভবিষ্যৎ নিয়ে সে দেশের মানুষ শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ সে তুলনায় অনেক এগিয়ে। এ দেশে মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে, স্কুলে যাতে যায়, সে জন্য অনেক দরিদ্র বাবা উদয়াস্ত খাটেন। বাচ্চাদের টিকা দেওয়ার সফলতার জন্য দেশটা পুরস্কৃত হয়েছে। এ দেশে গণমাধ্যম যে ভাষায় সরকারের সমালোচনা করে, তার অর্ধেক তীব্রতা নিয়ে করলে অনেক দেশে, এমনকি প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে এর ওপর সরকারের খড়্গ নেমে আসত।
গত ৪১ বছরে লিখে রাখার মতো, বড়াই করার মতো অর্জন বাংলাদেশের অনেক। ২০১২ সালের তালিকাটাও নিতান্ত ছোট নয়। সালতামামি নেওয়া সমাজের অংশ হিসেবে যদি একটা হিসাব আমি নিতে বসি, তাহলে হতাশার অন্ধকারের চেয়ে আশার আলোটাই বেশি করে দেখব। মনে হবে, একটা বছর তো ভালোমন্দে মিশিয়ে নেহাত খারাপ যায়নি এবং সেই সঙ্গে একটা বিশ্বাস জন্মাবে, নতুন বছরেও নিশ্চয় অর্জনের তালিকাটা আরও হবে।
হবে নিশ্চয়। প্রবাসী শ্রমিকেরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে আরও বেশি অর্থ পাঠাবেন। মেহনতি মানুষের শ্রমে-ঘামে এবং আগুনে পুড়ে ঝলসে যাওয়ার বিনিময়ে আমাদের আমদানি আয় আরও বাড়বে, আমাদের কৃষক রোদে-বৃষ্টিতে পুড়ে-ভিজে তিন বেলার অন্ন জোগাড় করবেন এবং গত বছরের তুলনায় বেশি হারেই। দেশের উন্নয়নের বড় ছবিটা নিশ্চয় আরও বড় হবে, কিন্তু তা হবে ছোট অনেক ছবিতে অনেক ছোট-বড় উন্নতির যোগফল হিসেবেই। এই ছোট ছবিগুলো আমরা দেখি না। এসএসসি ও এইচএসসির ফল দিলে আমাদের কাগজে ঢাকার বড় বড় স্কুলের কৃতী শিক্ষার্থীদের ছবি ছাপা হয়, কোনো প্রত্যন্ত গ্রামের একটি ছেলে বা মেয়ে, যে পরিবারের জন্য উপার্জন করে, পরিশ্রম করে, পাশাপাশি পড়াশোনা করে কৃতকার্য হলো বা হতে অপারগ হলো, তার ছবি কখনো ছাপা হয় না। আমরা বড় ছবি দেখতেই আগ্রহী এখন, যেহেতু বড় ছবিটা আমাদের বড় বড় হিসাব করতে সাহায্য করে।
নতুন বছরে এই বড় হিসাবের নানা ছক ছোট ছবিগুলোকে ঢেকে দেবে, এমন আশঙ্কা আমাদের। এখনই হুংকার শুনছি বিশাল এক যুদ্ধের। সরকারি দল বলছে, নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে; বিরোধী দল বলছে, তা হলে রক্তগঙ্গা বইবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষায় এখন আগুন ও বারুদ। এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি তুলেছে নতুন সংঘাতের আশঙ্কা। যুদ্ধাপরাধীদের দলটি সব শক্তি নিয়ে নেমেছে বিচারকাজটি ঠেকাতে, একে উল্টে দিতে। বিএনপি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এদের। খালেদা জিয়া বলছেন, আওয়ামী লীগের ভেতরে যেসব যুদ্ধাপরাধী আছে, আগে তাদের বিচার করতে হবে। কেন, আগে কেন? কাদের অপরাধ বেশি? নাকি চারপাশের যুদ্ধাপরাধীদের দিকে তাঁর চোখ পড়ে না? তিনি তো বলতে পারতেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে চলুক, পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকা যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার করতে হবে, তাহলে তাঁকে সাধুবাদ জানাতাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে গিয়ে, দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে গিয়ে ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করে নতুন বছরে তাঁর দল দেশবাসীকে কী উপহার দেবে?
নতুন বছরটা প্রকৃতই নতুন হতে পারত, ঝকঝকে নতুন হতে পারত, অর্জনে অর্জনে রঙিন হতে পারত, যদি ক্ষমতার (এবং ক্ষমতার হাত ধরে আখের গোছানো আর অর্থবিত্ত ও মানুষের দণ্ডমুণ্ডের মালিক হওয়ার) মোহ ও জেদটা কমত শ্রদ্ধাভাজন নেতা-নেত্রী এবং তাঁদের সহকর্মীদের। যদি প্রকৃতই ব্যক্তি থেকে দল এবং দল থেকে দেশটা বড় হতো তাঁদের কাছে, তাহলে গণতন্ত্রের চর্চাগুলো সংহত হতো, দেশটাকে নিয়েই সব আয়োজন হতো সব দলের। তাহলে নির্বাচন নিয়ে মানুষের উৎসাহ ও উদ্দীপনা থাকত, শঙ্কা থাকত না।
বিপরীত চিত্রটাই তো এখন বাস্তব। ২০১৩ সাল হবে আমাদের জন্য একটা মহাবিপর্যয়ের বছর, আমাকে জানিয়েছেন এক রিকশাচালক। তিনি সুশীল সমাজের অংশ নন বলে তাঁর কথাকে আমি ফেলে দিতে পারি না। কিন্তু ভাবি, মহাবিপর্যয়ের দামটি কী দাঁড়াবে শেষ পর্যন্ত? চিরস্থায়ী অস্থিতিশীলতা? হানাহানি? অনুন্নয়ন? ব্যর্থ রাষ্ট্রের দলে ঢুকে পড়া?
নতুন বছরটা তাহলে কি নতুন হবে, না মহাপুরাতন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments