ইন্টারনেট কি বৃহৎ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে মূল : জন নটন অনুবাদ : by এনামুল হক
সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা। সেই বিশেষ শব্দটা অবশ্য কেউ ব্যবহার করে না। সর্বদা ‘শাসন পরিচালনা’ বা প্রবিধানের কথাই বলা হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা হলো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে।
১৯৯৩ সালে ইন্টারনেট প্রথম জনগণের চেতনার রাজ্যে সবেগে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে বড় প্রশ্নটি দাঁড়িয়েছে এই যে, মুদ্রণ শিল্পের পর থেকে সবচেয়ে বিধ্বংসী এই যোগাযোগ প্রযুক্তিটিকে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার কাঠামোগুলো অর্থাৎ আমাদের বিশ্বে আধিপত্যকারী ও এর উন্নয়নের গতিপথ নির্ধারণকারী কর্পোরেশনগুলো দখল করে নেবে কিনা। তারপর থেকে এই নেটওয়ার্কের বিবর্তনে সংবাদ হওয়ার যোগ্য কার্যত প্রতিটি ঘটনাই আসলে ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ দখলের চলমান যুদ্ধে আরেকটি সংঘর্ষেরই রূপ ধারণ করেছে মাত্র।বিগত বছরটি এ ধরনের দুটি সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। দুবাইয়ে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) এক সম্মেলনের আয়োজন করেছে যার মহিমান্বিত নাম দেয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগবিষয়ক বিশ্ব সম্মেলন (ডব্লিউসিআইটি-১২)। আইটিইউ হচ্ছে জাতিসংঘের একটি সংস্থা সেখানে কেতাদুরস্ত অথচ রাজনৈতিক দিক দিয়ে নিষ্প্রভ ইঞ্জিনিয়াররা নিয়োজিত এবং যা কিনা গড় অযোগ্যতাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক আমলাদের দ্বারা পরিচালিত।
সম্মেলনের বাহ্যত উদ্দেশ্য ছিল আইটিইউ নিয়মিত যেসব কাজ করে থাকে সেগুলো করা। আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে সমন্বয় সৃষ্টিকারী বিধিব্যবস্থাগুলোকে হালনাগাদ করাÑ যেমন ডায়ালিং কোড, মোবাইল রোমিং চার্জ ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু যেহেতু আইটিইউ হলো জাতিসংঘের একটি সংস্থা যার প্রতিটি সদস্য দেশের একটি করে ভোট আছে তাই কিছু কিছু সরকার এই সম্মেলনকে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণের কাজটা নিজেদের কব্জায় আনা শুরু করার একটা সুযোগ হিসেবে গণ্য করেছে।
এ কাজ করার পেছনে তাদের উদ্দেশ্যের মধ্যে যথেষ্ট ভিন্নতা রয়েছে। কোন কোন দেশ সংশোধিত আইটি বিধিবিধানকে ইন্টারনেটের জগতে বর্তমানে আধিপত্যকারী পশ্চিমী কোম্পানিগুলোর ওপর শুল্ক ধার্যের একটা কৌশল হিসেবে দেখেছে। অন্যরা তাদের সীমান্তের ভেতর দিয়ে ইলেকট্রনিকগত ভাবে প্রবাহিত বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ হিসেবে দেখে। আবার কিছু কিছু দেশ আছে যারা এ গুলোকে ইন্টারনেটের কারিগরি ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনগুলোর ওপর পাশ্চাত্য দেশগুলোর (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের) বজ্রমুষ্টি শিথিল করার উপায় হিসেবে দেখে।
শেষপর্যন্ত এ ধরনের বিভিন্ন উচ্চাভিলাষ অপূর্ণই থেকে গেছে যদিও বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে সমাপ্ত এই সম্মেলনের চূড়ান্ত ইশতেহারে কিছু অর্থহীন শব্দাবলীকে স্থান দেয়া হয়েছে।
অন্তর্নিহিত বাস্তবতা ছিল এই যে সম্মেলনকে নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার উপায় হিসেবে ব্যবহারের প্রয়াস পাওয়া স্বৈরাচারী এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর এজেন্ডা মেনে নিতে পাশ্চাত্যের অধিকাংশ দেশই সাফ অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এসব সত্ত্বেও ডব্লিউসিআইটি-১২ ছিল ইন্টারনেটের বিবর্তনে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কারণ এর মধ্য দিয়ে দেখা গেছে যে, এই নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণের যুদ্ধ শুধু যে চলছে তাই নয়, এর তীব্রতাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এদিকে আরেক অংশে আরেকটি সুস্পষ্ট খ-যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছে। সম্প্রতি অযৌক্তিক অঙ্কে ফেসবুকের কিনে নেয়া ফটো-শেয়ারিং সার্ভিস ইনস্টাগ্রাম হঠাৎ করেই তার শর্তাবলী বদলে ফেলেছে। নতুন শর্তাবলীর অধীনে এই সার্ভিসের হতভাগা ব্যবহারকারীদের এই মর্মে সম্মত হতে হবে যে ইনস্টাগ্রাম তাদের যে কোন বা সমস্ত ফটোগ্রাফ নিজের একক ইচ্ছানুযায়ী বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করতে পারবে।
এ নিয়ে এমন এক ঝড় ওঠে যে, কোম্পানি খানিকটা পিছু হটে আসে। বেশিরভাগ লোক এ ঘটনাকে পুরনো ইন্টারনেট প্রবচনের স্রেফ আরেক দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখে। সেটা হলো সার্ভিস যদি বিনা মাসুলে হয় তাহলে আপনি হলেন সেই সার্ভিসের ফসল। অন্যরা এটাকে আরেকভাবে দেখছে। তারা ভাবছে ফেসবুক যেভাবে পারছে তার শতকোটিরও বেশি ব্যবহারকারীর কাছ থেকে অর্থ দৌহন করে নিতে যে বদ্ধপরিকর এটাই তার প্রমাণ। তবে একজন এর ব্যাখ্যা দিয়েছে এইভাবে, অবশ্যম্ভাবী বাস্তবতা হলো বৃহৎ ইন্টারনেট কর্পোরেশনগুলো যে কি পরিসরে তার ব্যবহারকারীদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে এর মধ্য দিয়ে তা পরিস্ফুট।
আর ফেসবুক যে কি পরিসরে বৃহৎ এক কর্পোরেশন আমরা আগে কখনও দেখিনি। এর খদ্দেরের বা ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক শ’ কোটিরও বেশি। এই সংখ্যা হলো বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মোট সংখ্যার অর্ধেকের নিচে।
দু’বছর আগে আমি যখন নেট সংক্রান্ত উপলব্ধির বিষয়ে বই লিখছিলাম তখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করি যে, আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের অনেকের ধারণা ওয়েবই হলো ইন্টারনেট।
রয়াল সোসাইটির এক সম্মেলনে কফি বিরতির সময় আমি ওয়েবের আবিষ্কর্তা টিম বার্নাস-লী’র কাছে এ কথাটা উল্লেখ করেছিলাম। উনি বলেছিলেন ‘ওটা কিছু না। এখন সম্ভবত ২০ কোটি লোক আছে যারা মনে করে ফেসবুক হলো ইন্টারনেট।’ এই সংখ্যাকে ৪ বা ৫ দিয়ে গুণ করুন তাহলে বর্তমান চিত্রটা পেয়ে যাবেন।
ইন্টারনেটের প্রথমদিকে সেই উত্তেজনাকর দিনগুলোতে অর্থাৎ ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে আমরা নেটভুক্ত নাগরিকরা বিশ্বাস করেছি যে, নেটওয়ার্ক সত্যিই নজিরবিহীন কিছু একটা। এ এমন এক যোগাযোগ ব্যবস্থা যা আমাদের সমাজের প্রতিষ্ঠিত কাঠামোগুলোর নাগালের বাইরে।
গ্রেটফুল ডেভের গীতিকার জন পেরী বারলো যখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার প্রতি চরম ঘৃণা নিয়ে তার ‘ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্স অব সাইবার স্পেস’ ঘোষণা করেছিলেন আমরা তখন তাতে সম্মতি ও সমর্থন দিয়েছিলাম। এর শুরুটা ছিল এই কথাগুলো দিয়ে ‘মাংস ও ইস্পাতের তৈরি হে ক্লান্ত দানব, আমি সাইবারস্পেস থেকে, মননের নতুনে আবাসস্থল থেকে এসেছি। ভবিষ্যতের তরফ থেকে আমি অতীতে তোমাকে বলছি আমাদের একা থাকতে দাও। আমাদের মধ্যে তুমি কাক্সিক্ষত নও। তোমাদের কোন সার্বভৌম্ব নেই অথচ আমরা সার্বভৌমত্ব সঞ্চয় করি।’
ভবিষ্যদ্বাণীর মতোই প্রমাণিত হয়েছে যে, উপরোক্ত সরকারগুলো ব্যাপারটা সেভাবে দেখেনি। ডব্লিউসিআইটি-১২ সম্মেলনে দেখা গেছে, ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তারা হয়ত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, তাই বলে তারা হাল ছেড়ে দেবে না। বারলো যা চিন্তাও করেননি সেটাই ঘটছে। আরেক দল নিয়ন্ত্রণ প্রয়াসীও মঞ্চে নেমে পড়বেÑ ফেসবুক, গুগল, এ্যামাজন ও এ্যাপেল। এবং এক অর্থে তারা এ মুহূর্তে এ কাজে সরকারগুলোর চেয়েও বেশি এগিয়ে চলেছে।
বিংশ শতাব্দীতে শিল্পোদ্যোক্তারা ছিল থিওড়া ভেইন, এডলফ জুকর ও ডেভিড সার্নঅকের মতো মানুষজন। আমাদের যুগে তাঁরা হলেন স্টিভ জবস, গুগল বয়েস, জেফ বেজোস ও মার্ক জুকারবার্গ। তাঁরা তাঁদের আগের প্রজন্মের লোকদের মতো কি একই সাফল্য ভোগ করতে পারবে এবং নেট নিয়ন্ত্রণ করার কাজের সমাপ্তি টানতে পারবে? আমাদের সবার কাছে সেটাই হলো ৬৪ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।
No comments