সরকারের ৪ বছর: আইনশৃঙ্খলা- গুম-গুপ্তহত্যার মতো ঘটনা আতঙ্ক ছড়ায় by কামরুল হাসান ও গোলাম মর্তুজা
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুরো দুই বছর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো ছিল। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া দেশে বড় ধরনের কোনো সহিংস ঘটনা সে সময় ঘটেনি। সেই অবস্থা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের যাত্রা।
কিন্তু প্রথম বছরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকলেও পরের তিন বছর সে অবস্থা আর ধরে রাখতে পারেনি সরকার। রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার, শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ছেড়ে দেওয়া, গুম, খুন, অপহরণ ও গুপ্তহত্যার মতো ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক ও উদ্বেগ দেখা দেয়।
তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, এমন কথা মানতে চান না পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা যা ঘটছে, তা সব সমাজেই ঘটে। এর বাইরে দেশে এমন কোনো বড় ঘটনা ঘটেনি। সব ক্ষেত্রেই পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় এলে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিষিদ্ধ করা হবে। সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কঠোরভাবে বন্ধ করা হবে।
কিন্তু ‘ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার’-এর নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। চরমপন্থী ও জঙ্গি তৎপরতা কমলেও বেড়ে যায় নারী ও শিশু নির্যাতন। রামুর বৌদ্ধপল্লিতে যে হামলা হয়েছে, তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তিন বছরের মাথায় এসে দেখা গেছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ যাঁদের কাজ, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে নিরঙ্কুশ সমর্থন নিয়ে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, সেটাকে কাজে লাগাতে পারেনি। নির্যাতন ও অনাচারের ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। সরকার কাজের মাধ্যমে এমন কোনো বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেনি যে এসব কমানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।’
ক্রসফায়ার, গুম ও গুপ্তহত্যা: সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকারের পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে একটি ছিল ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠা’। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ক্রসফায়ারের প্রবণতা কিছুটা কমে গেলেও হঠাৎ করেই বেড়ে যায় গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনা।
গত বছরের (২০১২) ১৭ এপ্রিল রাতে বনানীর রাস্তা থেকে গাড়িচালকসহ নিখোঁজ হন বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ডাকা হরতালে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে মামলা হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে। বিএনপির আরেক নেতা চৌধুরী আলম নিখোঁজ হন ২০১০ সালের ২৫ জুন। তাঁরও কোনো খোঁজ মেলেনি।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর চার বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৪৯৩ জন নিহত ও নিখোঁজ হয়েছে। তিন বছরে র্যা বের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছে ২৬৯ জন। ২০০৯ সালে ১২৫ জন, ২০১০ সালে ৯৩ জন ও চলতি বছরের ১১ মাসে ৫১ জন নিহত হয়েছে। এর বাইরে পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার গুলিতে তিন বছরে নিহত হয়েছে ১২২ জন। একই সময়ে র্যা বের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে ৯১ জন।
আসকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে (পরিবারের অভিযোগ অনুযায়ী) অপহূত হয়েছে ৮১ জন। এদের মধ্যে ১৮ জনের লাশ পাওয়া গেছে, দুজনকে অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যরা এখনো নিখোঁজ। চলতি বছরের ১১ মাসেই নিখোঁজ হয়েছেন ৫১ জন, যাঁদের মধ্যে ১৫ জনের লাশ পাওয়া গেছে।
পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালের ১১ মাসে ৭২৫ জন অপহূত হয়েছে। এর মধ্যে পাচার ও মুক্তিপণের জন্য ৮৮ জন অপহূত হয়েছে।
মামলা প্রত্যাহার: বর্তমান সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি সমালোচিত হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় কয়েক দফায় এ পর্যন্ত সাত হাজার ৭০১টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়। যার অনেকগুলোই নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
২০১০ সালের নভেম্বরে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতসহ ১৯ জনের নামে দায়ের করা খুনের মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে সমালোচনার মুখে পিছিয়ে যায় সরকার। লক্ষ্মীপুরের পৌর চেয়ারম্যান আবু তাহেরের ছেলে, খুনের আসামি বিপ্লবকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্ষমা করে দেন রাষ্ট্রপতি। গত ১৪ ডিসেম্বর কঠোর গোপনীয়তায় শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কুমার বিশ্বাসকে মুক্তি দেওয়া হয়। এসব কর্মকাণ্ডে সরকার সমালোচিত হয়।
খুন-অপহরণ: ২০১২ সালের সবচেয়ে আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কোনো কিনারা হয়নি। ওই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় এই দম্পতির ক্ষত-বিক্ষত দেহ মেলে।
এর কয়েক দিন পর ৫ মার্চ গভীর রাতে গুলশানে নিজের ভাড়া বাড়ির অদূরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ আল আলী। এ মামলায় পাঁচজনকে ফাঁসির রায় দিয়েছেন আদালত।
গত ৯ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা রাজপথ অবরোধের সময় পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় বিশ্বজিৎ দাস নামের এক তরুণকে পিটিয়ে-কুপিয়ে হত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ছাত্রলীগকে আড়াল করে এ ঘটনায় অন্যদের ফাঁসাতে চাইলে সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। এরপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারে বাধ্য হয় পুলিশ।
গত বছর আলোচিত ছিল মুক্তিপণ আদায়ের জন্য শিশু অপহরণের বিষয়টি। কয়েকটি শিশুকে হত্যাও করা হয়। সবচেয়ে আলোচিত ছিল পরাগ অপহরণ। রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জ থেকে গত ১১ নভেম্বর মা, বোন ও গাড়িচালকের পায়ে গুলি করে ছয় বছরের পরাগকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। মুক্তির জন্য তার বাবা বিমল মণ্ডল ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়েছেন বলে র্যা ব দাবি করলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও ডিবি তা অস্বীকার করেছে। পুলিশের হিসাবে ওই বছরের ১১ মাসে ৭৬৮টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে।
গত ২০১০ সালের ১৩ আগস্ট সংসদ ভবন এলাকায় সাংসদ নুরুন্নবী শাওনের পিস্তলের গুলিতে নিহত হন যুবলীগের নেতা মো. ইব্রাহিম। এ হত্যা মামলার দায়সারা অভিযোগপত্র দিয়েছে সিআইডি।
র্যা ব-পুলিশের বর্বরতা: ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুরের সাটুরিয়া গ্রামে আসামি ধরতে গিয়ে কলেজপড়ুয়া লিমন হোসেনের পায়ে গুলি করে র্যা ব। পরে তাঁর বাঁ পা কেটে বাদ দিতে হয়। তাঁকে সন্ত্রাসী সাজিয়ে মামলাও করা হয়। একই বছরের ১৫ জুলাই রাতে রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকায় গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরকে। থানায় নিয়ে তাঁকে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। এর কয়েক দিন পর ২৭ জুলাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে চরকাঁকড়ায় সামছুদ্দিন মিলন নামের এক তরুণকে ডাকাত হিসেবে জনতার হাতে তুলে দেয় পুলিশ। পরে জনতা মিলনকে পিটিয়ে হত্যা করে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ এস এম শাহজাহান এ প্রসঙ্গে বলেন, যাঁরা আইন প্রয়োগ করবেন তাঁদের আইনের শাসনের প্রতি সম্মান থাকা উচিত। তাঁরাই যদি মানবাধিকার, সংবিধান ও আইনবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্বীকার করেছেন, গত চার বছরে দেশে চরমপন্থী ও জঙ্গিবাদ কমে গেলেও নীরব চাঁদাবাজির মতো প্রচলিত ও অন্যান্য সংঘবদ্ধ অপরাধ দমন করতে ব্যর্থ হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একইভাবে সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের মতো আলোচিত ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। সরকারি দলের কর্মীরা বিভিন্ন স্থানে দরপত্র দখল নিয়ে অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শন করলেও বিভিন্ন সময়ে পুলিশকে নীরব থাকতে দেখা যায়।
তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, এমন কথা মানতে চান না পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা যা ঘটছে, তা সব সমাজেই ঘটে। এর বাইরে দেশে এমন কোনো বড় ঘটনা ঘটেনি। সব ক্ষেত্রেই পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় এলে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিষিদ্ধ করা হবে। সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কঠোরভাবে বন্ধ করা হবে।
কিন্তু ‘ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার’-এর নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। চরমপন্থী ও জঙ্গি তৎপরতা কমলেও বেড়ে যায় নারী ও শিশু নির্যাতন। রামুর বৌদ্ধপল্লিতে যে হামলা হয়েছে, তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তিন বছরের মাথায় এসে দেখা গেছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ যাঁদের কাজ, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে নিরঙ্কুশ সমর্থন নিয়ে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, সেটাকে কাজে লাগাতে পারেনি। নির্যাতন ও অনাচারের ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। সরকার কাজের মাধ্যমে এমন কোনো বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেনি যে এসব কমানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।’
ক্রসফায়ার, গুম ও গুপ্তহত্যা: সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকারের পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে একটি ছিল ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠা’। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ক্রসফায়ারের প্রবণতা কিছুটা কমে গেলেও হঠাৎ করেই বেড়ে যায় গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনা।
গত বছরের (২০১২) ১৭ এপ্রিল রাতে বনানীর রাস্তা থেকে গাড়িচালকসহ নিখোঁজ হন বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ডাকা হরতালে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে মামলা হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে। বিএনপির আরেক নেতা চৌধুরী আলম নিখোঁজ হন ২০১০ সালের ২৫ জুন। তাঁরও কোনো খোঁজ মেলেনি।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর চার বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৪৯৩ জন নিহত ও নিখোঁজ হয়েছে। তিন বছরে র্যা বের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছে ২৬৯ জন। ২০০৯ সালে ১২৫ জন, ২০১০ সালে ৯৩ জন ও চলতি বছরের ১১ মাসে ৫১ জন নিহত হয়েছে। এর বাইরে পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার গুলিতে তিন বছরে নিহত হয়েছে ১২২ জন। একই সময়ে র্যা বের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে ৯১ জন।
আসকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে (পরিবারের অভিযোগ অনুযায়ী) অপহূত হয়েছে ৮১ জন। এদের মধ্যে ১৮ জনের লাশ পাওয়া গেছে, দুজনকে অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যরা এখনো নিখোঁজ। চলতি বছরের ১১ মাসেই নিখোঁজ হয়েছেন ৫১ জন, যাঁদের মধ্যে ১৫ জনের লাশ পাওয়া গেছে।
পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালের ১১ মাসে ৭২৫ জন অপহূত হয়েছে। এর মধ্যে পাচার ও মুক্তিপণের জন্য ৮৮ জন অপহূত হয়েছে।
মামলা প্রত্যাহার: বর্তমান সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি সমালোচিত হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় কয়েক দফায় এ পর্যন্ত সাত হাজার ৭০১টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়। যার অনেকগুলোই নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
২০১০ সালের নভেম্বরে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতসহ ১৯ জনের নামে দায়ের করা খুনের মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে সমালোচনার মুখে পিছিয়ে যায় সরকার। লক্ষ্মীপুরের পৌর চেয়ারম্যান আবু তাহেরের ছেলে, খুনের আসামি বিপ্লবকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্ষমা করে দেন রাষ্ট্রপতি। গত ১৪ ডিসেম্বর কঠোর গোপনীয়তায় শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কুমার বিশ্বাসকে মুক্তি দেওয়া হয়। এসব কর্মকাণ্ডে সরকার সমালোচিত হয়।
খুন-অপহরণ: ২০১২ সালের সবচেয়ে আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কোনো কিনারা হয়নি। ওই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় এই দম্পতির ক্ষত-বিক্ষত দেহ মেলে।
এর কয়েক দিন পর ৫ মার্চ গভীর রাতে গুলশানে নিজের ভাড়া বাড়ির অদূরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ আল আলী। এ মামলায় পাঁচজনকে ফাঁসির রায় দিয়েছেন আদালত।
গত ৯ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা রাজপথ অবরোধের সময় পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় বিশ্বজিৎ দাস নামের এক তরুণকে পিটিয়ে-কুপিয়ে হত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ছাত্রলীগকে আড়াল করে এ ঘটনায় অন্যদের ফাঁসাতে চাইলে সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। এরপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারে বাধ্য হয় পুলিশ।
গত বছর আলোচিত ছিল মুক্তিপণ আদায়ের জন্য শিশু অপহরণের বিষয়টি। কয়েকটি শিশুকে হত্যাও করা হয়। সবচেয়ে আলোচিত ছিল পরাগ অপহরণ। রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জ থেকে গত ১১ নভেম্বর মা, বোন ও গাড়িচালকের পায়ে গুলি করে ছয় বছরের পরাগকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। মুক্তির জন্য তার বাবা বিমল মণ্ডল ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়েছেন বলে র্যা ব দাবি করলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও ডিবি তা অস্বীকার করেছে। পুলিশের হিসাবে ওই বছরের ১১ মাসে ৭৬৮টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে।
গত ২০১০ সালের ১৩ আগস্ট সংসদ ভবন এলাকায় সাংসদ নুরুন্নবী শাওনের পিস্তলের গুলিতে নিহত হন যুবলীগের নেতা মো. ইব্রাহিম। এ হত্যা মামলার দায়সারা অভিযোগপত্র দিয়েছে সিআইডি।
র্যা ব-পুলিশের বর্বরতা: ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুরের সাটুরিয়া গ্রামে আসামি ধরতে গিয়ে কলেজপড়ুয়া লিমন হোসেনের পায়ে গুলি করে র্যা ব। পরে তাঁর বাঁ পা কেটে বাদ দিতে হয়। তাঁকে সন্ত্রাসী সাজিয়ে মামলাও করা হয়। একই বছরের ১৫ জুলাই রাতে রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকায় গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরকে। থানায় নিয়ে তাঁকে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। এর কয়েক দিন পর ২৭ জুলাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে চরকাঁকড়ায় সামছুদ্দিন মিলন নামের এক তরুণকে ডাকাত হিসেবে জনতার হাতে তুলে দেয় পুলিশ। পরে জনতা মিলনকে পিটিয়ে হত্যা করে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ এস এম শাহজাহান এ প্রসঙ্গে বলেন, যাঁরা আইন প্রয়োগ করবেন তাঁদের আইনের শাসনের প্রতি সম্মান থাকা উচিত। তাঁরাই যদি মানবাধিকার, সংবিধান ও আইনবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্বীকার করেছেন, গত চার বছরে দেশে চরমপন্থী ও জঙ্গিবাদ কমে গেলেও নীরব চাঁদাবাজির মতো প্রচলিত ও অন্যান্য সংঘবদ্ধ অপরাধ দমন করতে ব্যর্থ হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একইভাবে সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের মতো আলোচিত ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। সরকারি দলের কর্মীরা বিভিন্ন স্থানে দরপত্র দখল নিয়ে অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শন করলেও বিভিন্ন সময়ে পুলিশকে নীরব থাকতে দেখা যায়।
No comments