স্বাধীনতার মতাদর্শ by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অবদান পাকিস্তানের কলোনিকাল থেকে সেক্যুলার রাজনীতির বোধ তৈরি করা। এই বোধ তৈরির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ করেছে বিভিন্ন বাম দল।
কলোনিকালে, পাকিস্তান আমলে, পাকিস্তান রাষ্ট্র, পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিচালক মুসলিম লীগ, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং মুসলিম লীগ ও সেনাবাহিনীর সহযোগী জামায়াতে ইসলাম সেক্যুলার রাজনীতির বিরোধিতা করেছে। তাদের বক্তব্য : যারা সেক্যুলার রাজনীতি করে তারা হিন্দু, হিন্দুরা পাকিস্তানে সংখ্যালঘু, আর যারা নন-সেক্যুলার রাজনীতি করে তারা মুসলমান।মুসলমানের শত্রু হিন্দু, হিন্দুদের কোন অধিকার নেই রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণ ও রাষ্ট্রের পরিচালনার ক্ষেত্রে। পাকিস্তানের মুসলমান আবার দু’ভাগে বিভক্ত : প্রথম ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্দা, তারা শাসক; দ্বিতীয় ভাগ পূর্ববাংলার বাসিন্দা, তারা শাসিত, তারা হিন্দুদের প্রভাব বলয়ের মধ্যে বসবাস করে। এদিক থেকে পূর্ব বাংলার বাসিন্দারা মুসলমান কমিউনিটির অন্তর্গত নয়। এভাবে, আমাদের সমাজে ও রাষ্ট্রে ‘আমরা’ ও ‘তারা’র বোধ তৈরি হয়েছে। আমাদের বিপরীতে তারা, পাকিস্তান রাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। ‘আমরা’র বোধ থেকে, সেক্যুলার, নন-কম্যুনাল বাঙালী কমিউনিট গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন বাম দল প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বাঙালী কমিউনিটির যারা সদস্য তাদের ওপর বাঙালী সমাজ উদ্ভূত রাজনীতির দাবি আছে। আওয়ামী লীগ ও বামদলগুলো সেক্যুলার রাজনীতি কমিউনিটির যারা সদস্য তাদের ওপর অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছে। এই রাজনীতি বহুত্ববাদী কমিউনিটি প্রতিষ্ঠাতা যে দরকার, এই বোধ বাস্তব রাজনীতির ক্ষেত্রে সামনে এনেছে। ব্যক্তি ও গণতন্ত্রের দিক থেকে, এই প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা দেখেছি ও বুঝেছি। ব্রিটিশ ভারতের কলোনিয়াল রাজনীতি ও পাকিস্তান আমলের কলোনিয়াল রাজনীতি একটি কমিউনিটির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে, বিভিন্ন স্মারকের সম্ভাবনা তৈরি নষ্ট করে দিয়েছে। তার দরুন বিভিন্ন কমিউনিটির শক্তি বাড়েনি ও বিভিন্ন স্মারকের সম্ভাবনার মধ্যে দিয়ে প্রকৃত স্বাধীনতা গড়ে ওঠেনি। কলোনির বাংলাদেশে কিংবা কলোনির ভারতবর্ষে আমরা হিন্দু হতে চেয়েছি, ‘মুসলমান’ হতে চেয়েছি।
পাকিস্তান রাষ্ট্র এই বোধকে স্ফীত করেছে। হিন্দুর বোধ থেকে মুসলমানের বোধ, কিংবা মুসলমানের বোধ থেকে হিন্দুর বোধ বিবেচনা করার দরুন আমরা গণতান্ত্রিক কমিউনিটি গড়তে পরিনি। সেজন্য আমরা মানুষের মধ্যকার, সমাজের মধ্যকার নানা বিভিন্নতা বুঝতে পারিনি ও শ্রদ্ধা করতে শিখিনি। এ ক্ষেত্রে, আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন বামদল কাজ করেছে, ধর্মজ উগ্রবোধের বিপরীতে লিবারেল মূল্যবোধ তৈরি করতে সচেষ্ট থেকেছে। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিকতা, মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা এখানেই। বিএনপি ও জামায়াত অনুপ্রাণিত সংগঠনগুলো মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিকতা নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেছে, মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনার বিরোধিতা করেছে।
লিবারেল মূল্যবোধ তৈরির সমস্যা নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিভিন্ন বামদল কোন্ কোন্ দিকে ভেবেছে? বাংলাদেশে কিংবা ভারতবর্ষের নানা পর্বের ইতিহাসে বিভিন্ন মত ও দর্শন প্রবল। বিএনপি ও জামায়াত এসব বিভিন্নতা কিংবা হিন্দু ও মুসলমানের ভিন্নতা নিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে খেলছে।
বিভিন্ন মত ও দর্শনের গন্তব্য ভিন্ন, মূল্যবোধ ভিন্ন, যেমন জৈন বৌদ্ধ হিন্দু ইসলাম। এর একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই, বিভিন্ন সমাজ বিভিন্ন সময়ে এসবের অনুকরণ করেছে, কখনও বা এই সমাজের বিভিন্ন অংশ, কিংবা বিভিন্ন ব্যক্তি। এ সব বিভিন্ন বিপরীতের মেলবন্ধন ঘটেনি। তৎসত্ত্বেও বিভিন্ন বিপরীতের আরাধনা একসঙ্গে হয়েছে। এ সবের মিল নেই, কিন্তু তাদের বিভিন্নতা কিংবা বৈচিত্র্য অনিঃশেষ নয়, তার কারণ মানুষের স্বরূপ কিংবা স্বভাব বিভিন্ন ও পরিবর্তনের অধীন হওয়া সত্ত্বেও কিছু উৎসগত মিল থাকতেও পারে, যদি স্বভাব ও স্বরূপকে মানুষী বলতেই হয়। একটি সবল সংস্কৃতি ভিন্নতাকে একটি সূত্রে ধরে রাখে। এটা সীমার বাইরে মানুষের স্বভাব কাজ করে না। ভাঙ্গন কিংবা অসম্পূর্ণ মানবিকতার ভিত্তিতে সমাজ কিংবা সংস্কৃতি নির্মাণ করা যায় না। মানবিকতার সীমাবদ্ধতার মধ্যে, মত ও দর্শনের যাত্রা ভিন্ন এবং তা বহুদূর বিস্তৃত। আওয়ামী লীগ ও বামদলগুলো পর্যায়ে পর্যায়ে মানুষী স্বরূপের ভিন্নতা রাজনীতিতে নিয়ে এসেছে এবং চ্যালেঞ্জ নিক্ষেপ করেছে কলোনিকালে মুসলিম লীগ ও জামায়াতের বিরুদ্ধে; কলোনিউত্তর কালে বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে। কলোনিকালে আওয়ামী লীগ ও বামদলগুলো দাঙ্গার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। কলোনিউত্তর কালে আওয়ামী লীগ ও বামদলগুলো সংখ্যালঘু হিন্দু আহমদিয়া বৌদ্ধদের রক্ষণের দায়িত্ব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গ্রহণ করেছে। বিএনপি-জামায়াত সংখ্যালঘু নিধন তাদের রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি বলে চিহ্নিত করেছে। এই স্ট্র্যাটেজির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও বামদলগুলোর রাজনীতি কিভাবে শক্তি অর্জন করেছে? কোন সংস্কৃতির মূল্যবোধ অন্য সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন কিংবা একই সংস্কৃতির কোনরূপ থেকে ভিন্ন কিংবা একই ব্যক্তির জীবনের বিভিন্ন পর্ব ভিন্ন থাকতেই পারে। এসব আপেক্ষিকতা মূল্যবোধ নয়, বরং বহুত্ববাদের মূল্যবোধের ধারণা মাত্র। এই ধারণা স্তরবিন্যস্ত নয়, শ্রেষ্ঠ কিংবা নিকৃষ্ট, উৎকর্ষ কিংবা অপকর্ষ নয়। এখানে স্বীকার করতেই হয়, আমরা কাইজ্যা করতে শিখেছি, কিন্তু বহুত্ববাদের মূল্যবোধ কি করে তৈরি করতে হয় তা শিখিনি। কলোনিকালে আওয়ামী লীগ ও বামদলগুলোর এ ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ তীক্ষè ও প্রখর ছিল। বর্তমানে, মনে হয়, এ ক্ষেত্রে তাদের পর্যবেক্ষণ তীক্ষèও নয়, প্রখরও নয়। এই শিথিলতার সুযোগ গ্রহণ করেছে বিএনপি-জামায়াত, ধর্মান্ধতার সঙ্গে অর্থের সংযোগ ঘটিয়েছে, তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করেছে প্রযুক্তির মাধ্যমে। বাঙালী জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এই স্বাধীনতার অর্থ সর্বাইকে সিভিক অধিকার দিতে হবে।
ব্রিটিশ কলোনিকালে কিংবা পাকিস্তানী কলোনিকালে কিংবা জিয়াউর রহমানের সামরিককালে বিএনপি-জামায়াত রাজনীতির অন্তঃসার হচ্ছে একটি একক এথনিক গ্রুপের সকল সিভিল অধিকার হরণ। সেজন্য, বাংলাদেশে এখন সময় এসেছে রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ ও এথনিক সেলফ-এ্যাসার্সনের মধ্যকার পার্থক্য ও বিভাজন নির্ণয় করা। বিএনপি-জামায়াতের কাছে স্বাধীনতার অর্থ একটি একক এথনিক অরিজিন, অর্থাৎ মুসলমান সমাজ সকল অধিকার সকল সুযোগ-সুবিধা পাবে, বাকি সমাজগুলো প্রবল সমাজের অধীন থাকবে।
এ মতাদর্শ থেকে উ™ূ¢ত হয় দাঙ্গা, হাঙ্গামা, লুণ্ঠন, রাহাজানি; উদ্ভূত হয় নারী ধর্ষণের জঘন্যতা; উদ্ভূত হয় অর্থ সম্পদের মোহ। এই মতাদর্শ, যদি মতাদর্শ বলা যায়, কলোনিকালে প্রাখর্য লাভ করতে পারেনি স্বাধীনতার মতাদর্শের কূলছাপানো প্লাবনের কারণে। আওয়ামী লীগ ও বামদলগুলো স্বাধীনতার মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, একথা সত্যি, কিন্তু স্বাধীনতার মতাদর্শের মধ্যে প্রোথিত লোভ ও লালসার লাগাম টেনে ধরতে পারেনি।
এক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত লোভ ও লালসাকে রাজনীতির স্ট্র্যাটেজি করে তুলেছে। আওয়ামী লীগ ও বামদলগুলো কখনও কখনও এই স্ট্র্যাটেজির কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছে। এই তিক্ত সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। স্বাধীনতার মতাদর্শ ও লোভ লালসার মতাদর্শ কখনও এক নয়, কখনও এক হতে পারে না। এ হচ্ছে লড়াই এবং এই লড়াইয়ে জিততে হবে।
No comments