সোনালী ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারী ॥ এবার ৫ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুদকের ২৬ মামলা দায়ের- ভুয়া প্রতিষ্ঠানের গ্যারান্টর তানভীর মাহমুদসহ আসামি ৩৫
সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে সাড়ে তিন শ’ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় এবার ৫টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২৬টি মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মঙ্গলবার রমনা থানায় দায়ের করা মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে অর্থ আত্মসাতকারী প্রতিষ্ঠানের ১৮ এবং জালিয়াতিতে সহায়তার অভিযোগে সোনালী ব্যাংকের ১৭ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এর আগে সোনালী ব্যাংকের একই শাখা থেকে ফান্ডেড এক হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে হলমার্ক গ্রুপের ৭ ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ২০ জনমিলে ২৭ জনকে আসামি করে ১১টি মামলা করেছিল সংস্থাটি।এবার দায়ের করা ২৬ মামলার ৫টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হলমার্ক গ্রুপের কোন প্রতিষ্ঠান জড়িত না থাকলেও দুটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের গ্যারান্টার হওয়ায় গ্রুপটির এমডি তানভীর মাহমুদ এবং জিএম তুষার আহমেদকে পৃথক দুটি মামলায় আসামি করা হয়েছে। ৩৫ আসামির মধ্যে ছয়জন হলমার্ক গ্রুপের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার আছেন। তাঁদের তিনজন ইতোমধ্যে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন। অপর তিনজন রিমান্ডে রয়েছেন। বাকি আসামিদের গ্রেফতার করা হবে বলে জানালেন দুদক কর্মকর্তা মীর জয়নুল আবদীন শিবলী।
দুদকের অনুসন্ধান সূত্র জানায়, হলমার্ক গ্রুপের মতো করে সেনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে টি এ্যান্ড ব্রাদার্স, প্যারাগন নিট এ্যান্ড কম্পোজিট, খানজাহান আলী সোয়েটার, নকশি নিট কম্পোজিট এবং ডি এন স্পোর্টস। ওই পাঁচ প্রতিষ্ঠান ব্যাংকিং খাতের প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট (পিএসসি), ফরেন বিল পারচেজ (এফবিপি), পেমেন্ট এ্যাগেইনস্ট ডকুমেন্ট (পিএডি) ও ইনল্যান্ড বিল পারচেজে (আইবিপি) অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে। এর মধ্যে ফান্ডেড অর্থ আছে ৩ ৫০ কোটি ৩৭ লাখ ৮২ হাজার ৩১৫ টাকা। এ বিপুল পরিমাণ অর্থের টিএ্যান্ড ব্রাদার্স নিট কস্পোজিট পিএসসি, এফবিপি ও পিএডির মাধ্যমে ৩২০ কোটি টাকা আত্মসাত করে। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানের বিরদ্ধে ১৪টি মামলা করা হয়েছে। নকশি নিট কম্পোজিট লিমিটেড পিএসসি ও আইবিপির মাধ্যমে ১১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে তিনটি মামলা, খানজাহান আলী সোয়েটার লিমিটেড পিএসসি খাতে এক কোটি ১৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে একটি মামলা, প্যারাগন নিট কম্পোজিট লিমিটেড পিএসসি, এফবিপি, পিএডি ও আইবিপির মাধ্যমে সাড়ে ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পাঁচটি মামলা, এবং ডি এন স্পোর্টস পিএসসি, আইবিপি ও এফবিপির মাধ্যমে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে তিনটি মামলা করেছে দুদক। ২৬টি মামলার বাদী হলেন দুদকের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী, উপ-পরিচালক এস এম এম আখতার হামিদ ভুঞা, সহকারী পরিচালক মোঃ মশিউর রহমান, নাজমুচ্ছায়াদাত, উপ-সহকারী পরিচালক মোঃ মজিবুর রহমান, মোঃ জয়নুল আবদীন।
পাঁচ প্রতিষ্ঠানের আসামিরা হলেন টি এ্যান্ড ব্রাদার্সের চেয়ারম্যান জিনাত ফাতেমা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাওহীদ হোসেন ও পরিচালক তসলিম হাসান। প্যারাগন নিট এ্যান্ড কম্পোজিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল হাসান রাজা, পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন ও এস এম মনিরুজ্জামান, হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান তানভীর মাহমুদ। তানভীর প্যারাগন গ্রুপের ম-ল ট্রেডার্স নামক নামসর্বস্ব একটি প্রতিষ্ঠানের গ্যারান্টার হয়েছেন। বাস্তবে এ নামে কোন প্রতিষ্ঠান নেই। প্যারাগনের পরিচালক সাইফুল হাসান রাজা এক সময়ে হলমার্ক গ্রুপের পরিচালক ছিলেন। নকশি নিটের চেয়ারম্যান আমেনা বেগম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আবদুল মালেক, মোঃ জামির হোসেন এবং হলমার্ক গ্রুপের জিএম তুষার আহমেদ। তুষার আহমেদ এ গ্রুপের কোন কর্তাব্যক্তি নন। কিন্তু তিনি নকশি নিট নামে একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের গ্যারন্টার হন। এই মামলার আরেক আসামি আব্দুল মালেক একসময় হলমার্ক গ্রুপের কর্মকর্তা ছিলেন। খানজাহান সোয়েটারের চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম মোল্লা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল জলিল শেখ, পরিচালক মোঃ রফিকুল ইসলাম, মীর মোঃ শওকত আলীকে আসামি করা হয়েছে। ডি এন স্পোর্টসের মামলার আসামিরা হলেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোতাহার উদ্দিন চৌধুরী, তাঁর মেয়ে পরিচালক ফাহমিদা আখতার (শিখা) ও ফাহমিদার স্বামী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুর রহমান।
সোনালী ব্যাংকের আসামি হলেন সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমান, সাবেক সহকারী উপমহাব্যবস্থাপক সাইফুল হাসান, নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মতিন, অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান ও ধানম-ি শাখার বর্তমান জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরী, ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ূন কবির, প্রধান কার্যালয়ের জিএম অফিসের ডিএমডি মাইনুল হক ও আতিকুর রহমান, মহাব্যবস্থাপক আ ন ম মাশরুরুল হুদা সিরাজী, ননী গোপাল নাথ ও মীর মহিদুর রহমান, সাবেক জিএম সবিতা সিরাজ, ডিজিএম ভগবতী মজুমদার, শেখ আলতাফ হোসেন, মোঃ সফিজউদ্দিন আহমেদ ও কানিজ ফাতেমা চৌধুরী, এজিএম মোঃ কামরুল হোসেন খান, আশরাফ আলী পাটোয়ারী, মোঃ আবুল হাসান ও মোঃ খুরশিদ আলম। মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ, জিএম তুষার আহমেদ, সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমান, ডিজিএম শেখ আলতাফ হোসেন, মোঃ সফিজউদ্দিন আহমেদ এবং জিএম মীর মহিদুর রহমান হলমার্ক গ্রুপের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার রয়েছেন।
মামলাপরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে দুদক উপ-পরিচালক এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান টিমের প্রধান মীর জয়নুল আবদীন শিবলী বলেন, সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে হলমার্কসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠান ঋণপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে তিন হাজার ৬০৬ কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। এর মধ্যে ফান্ডেড অর্থের বিপরীতে দুই ধাপে ৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ননফান্ডেড অর্থের অনুসন্ধান চলছে। তিনি বলেন, এবারের মামলার দু’জন আসামি সাইফুল ইসলাম রাজা এবং আব্দুল মালেক নামের দুই ব্যক্তি একসময় হলমার্ক গ্রুপের চাকরি করতেন। তারা হলমার্ক গ্রুপকে অর্থ আত্মসাতের ফাঁকফোকর দেখিয়ে আড়াই হাজার কোটি লোপাট করানোর পাশাপাশি নিজেরা ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে টাকা আত্মসাত করেন। মূলত এ দুই ব্যক্তি এ কেলেঙ্কারীর হোতা বলে তিনি জানান। প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বা সোনালী ব্যাংকের কোন পরিচালক এ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ এখন পর্যন্ত দুদক পায়নি বলে উল্লেখ করেন শিবলী। তবে তদন্তে যদি কারও নাম আসে, তিনি যত বড় ব্যাক্তিই হোক তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
No comments