থেমে গেল গ্রেগের কালজয়ী কণ্ঠস্বর
শুধু কথায় চিড়ে ভেজে নাÑ এমন একটি প্রবাদ আছে। কিন্তু কথা দিয়েও বিশ্বব্যাপী নিজের একটা অবস্থান তৈরি করা যায় সেটা কিন্তু একজন দেখিয়েছেন। শুধু কথা দিয়েই মুগ্ধ করে বিশ্বকে সম্মোহিত করে রাখা যায় সেটা দেখিয়েছেন টনি গ্রেগ।
ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসেবে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি। টানা তেত্রিশটি বছর পৃথিবীজুড়ে যেখানেই ক্রিকেট হয়েছে সেখানেই নিজের ভরাট, স্পষ্ট বাচনভঙ্গির অধিকারী টনির কণ্ঠস্বর শুনেছেন বিশ্বের ক্রিকেটামোদীরা। ক্রিকেট ক্যারিয়ার মাত্র ৫ বছরের হলেও ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসেবেই প্রায় তিন যুগ তিনি বিশ্বকে ভুলিয়ে রেখেছিলেন। তবে ক্রিকেটার হিসেবেও কোন অংশে কম ছিলেন না। সর্বমোট ৫৮ টেস্ট আর ২২ ওয়ানডে খেলেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন ইংল্যান্ড জাতীয় ক্রিকেট দলকে। বিশিষ্ট এ ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ টনি গ্রেগ আর নেই। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে গত ২৮ ডিসেম্বর। সিডনির সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালে চিরতরে থেমে যায় এ বিখ্যাত ধারাভাষ্যকারের কণ্ঠস্বর। দীর্ঘদেহী সুদর্শন এ ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের মাত্র ৬৬ বছর বয়সে অকালপ্রয়াণ ঘটে। গত বছরের শুরুর দিকেই ফুসফুসে ক্যান্সার আক্রান্তের বিষয়টি ধরা পড়ে। অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম ক্রীড়া বিষয়ক টিভি চ্যানেল- চ্যানেল নাইনের একজন বেতনভুক্ত ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার ছিলেন টনি। জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম টুইটারে তাঁর মৃত্যুর বিষয়ে চ্যানেলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আমাদের প্রিয় টনি গ্রেগ ৬৬ বছর বয়সে মারা গেছেন। আমরা তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবার ও বন্ধুদের গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সহ টেস্ট খেলুড়ে প্রতিটি দেশের ক্রিকেট বোর্ড এ মহান ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়ে পরিবার-পরিজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছে।সারাবিশ্বের যত অঞ্চলে ক্রিকেট ছড়িয়েছে সবখানেই টনি ধারাভাষ্যকার হিসেবে অনেক জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি অস্ট্রেলিয়াতেই বসবাস করছিলেন। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটামোদীদের কাছে একজন আকর্ষণীয় ধারাভাষ্যকার। টনির স্বভাব এবং জীবনযাপনে অসাধারণ এক আন্তর্জাতিকতার দর্শন ফুটে উঠেছে। তাঁর মৃত্যুতে টুইটারে অসংখ্য সমবেদনা বার্তার মধ্যে হ্যামন্ড বুচের ক্ষুদ্র বার্তাটি টনি গ্রেগকে এককথায় মূল্যায়নে যথেষ্ট হতে পারে, ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম, অধিনায়কত্ব করলেন ইংল্যান্ড দলের, বসবাস করলেন অস্ট্রেলিয়ায়, সমর্থক ছিলেন শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের। যেমন চমৎকার ক্রিকেটার, তেমনি ভাল একজন ধারাভাষ্যকার। তার আত্মা শান্তিতে থাকুক! প্রসঙ্গত, ‘১৯৯৬ বিশ্বকাপ শ্রীলঙ্কা জিতবে’ টনির এই ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যাওয়ায় শ্রীলঙ্কানদের কাছে তিনি অসম্ভব প্রিয় এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। টনি গ্রেগের ভেতর ক্রিকেট বিষয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব ছিল সেটা তাঁর জীবনধারা থেকেই স্পষ্ট। স্কটিশ বাবার ঔরসজাত টনি গ্রেগ দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্সটাউনে ৬ অক্টোবর ১৯৪৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯ বছরের তরুণ টনি গ্রেগ পাড়ি দেন ইংল্যান্ডের সাসেক্সের উদ্দেশে। ইংল্যান্ডের ওই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের হয়ে খেলে নিজেকে একজন ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তোলেন। এর মাত্র ৭ বছর পরই ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে ডাক পান গ্রেগ। ১৯৭২ সালের জুনে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেক হয় ২৬ বছর বয়েসী টনির ম্যানচেস্টারে। ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার দারুণ সুদর্শন এ ক্রিকেটার ছিলেন ব্যাটে-বলে সমান পারদর্শী। ৫৮ টেস্টে ব্যাটিং করে ৮ সেঞ্চুরি ও ২০ অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৪০.৪৩ গড়ে তিনি সংগ্রহ করেন ৩৫৯৯ রান, উইকেটও নিয়েছেন ১৪১টি। আর ২২ ওয়ানডে খেলে অবশ্য তেমন আহামরি কিছুই করতে পারেননি। মাত্র ২৬৯ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নিতে পেরেছিলেন ১৯ উইকেট। পরবর্তীতে ধারাভাষ্যকার হিসেবে থেকে গেছেন ক্রিকেটের সঙ্গেই। শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ১৯৭৭ সালে। অর্থাৎ ব্যাট-বল তুলে রেখেছেন ৩৫ বছর আগে। ১৯৭৯-৮০তে খেলাটা নতুন একযুগে প্রবেশ করেছিল তাঁর সৌজন্যেই। ক্রিকেট ধারাভাষ্যকেও নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পের কাছাকাছি। বেতার কিংবা টেলিভিশনে আর ভেসে আসবে না সেই দুরন্ত কণ্ঠ। ম্যাচ শুরুর আগে পিচ রিপোর্ট দিতে গিয়ে নিজের গাড়ির চাবি দিয়েও কেউ আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবেন না উইকেটের ধরন। শেষদিকে এসে বসতি গড়েন অস্ট্রেলিয়ায়। তবে ১৯৯৬ বিশ্বকাপ থেকেই তিনি মনেপ্রাণে সমর্থন দিয়ে গেছেন শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলকে। ওই দলটির কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে উন্নতির বিষয়টি অভিভূত করেছিল টনি গ্রেগকে। তাই একজন দক্ষিণ আফ্রিকান ও একজন ইংলিশ ক্রিকেটার হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করলেও ক্রিকেটপ্রীতিটাই বড় করে দেখেছেন। সমর্থন করেছেন সম্পূর্ণ অন্য একটি দেশকে। লঙ্কানদের বড় সমর্থক হিসেবেই ১৯৯৬ সালে বলেছিলেন এবার বিশ্বকাপ জিতবে লঙ্কানরা। সেটাই সত্য হয়েছিল। প্রথমবারের মতো শিরোপা জয়ের পরেই লঙ্কান ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে চোখের মণি হয়ে ওঠেন টনি। ভরাট কণ্ঠস্বর আর দারুণ বাচনভঙ্গির জন্য ক্রমেই বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটামোদীদেরও প্রিয় হয়ে ওঠেন গ্রেগ। আর এ কারণেই ক্রিকেটের জন্য অন্তঃপ্রাণ মনোভাব দেখিয়ে তিনি দেখিয়েছেন এ ক্রীড়াটি কতখানি সম্প্রীতির একটি মাধ্যম। সে কারণেই অসুস্থ থাকলেও পেশার চেয়ে নেশাটা ছাড়তে পারেননি। সফরকারী শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ডিসেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়ার তিন ম্যাচের ঘরোয়া টেস্ট সিরিজের প্রথমটিতে অবশ্য গাবায় প্রথমদিনই ছিলেন অনুপস্থিত। চ্যানেল নাইনের সঙ্গে ৩৩ বছরের সম্পর্কে সেটাই ছিল টনি গ্রেগের প্রথমবার অনুপস্থিতি। এর আগে অক্টোবরে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত টি২০ বিশ্বকাপে ধারাভাষ্য দেয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তার আগেই বছরের শুরুতে আরব আমিরাতে ধারাভাষ্য দেয়ার সময় ধরা পড়েছিল ভয়াল ব্যাধি ক্যান্সার। কিন্তু ওসব তোয়াক্কা না করেই নিজের কাজ চালু রেখেছিলেন তিনি। এত দীর্ঘ সময় ক্রিকেটের সঙ্গে থাকার পরও ব্রিসবেনে ধারাভাষ্য দেয়ার সময় তিনি বলেছেন, ‘এটা যদিও খুবই বিস্ময়কর একটি বিষয় এতদিন থাকতে পারাটা। কিন্তু আসলে খুবই সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ ছাড়া এটা কিছুই নয়। সবাই একদিন এ বিষয়টি বুঝতে পারবেন। যে ব্যক্তি ৩৩ বছর ধরে এমন কাজ করেছেন তাঁর জন্য একদিন না থাকতে পারাটা কি ধরনের অনুভূতি সেটা বোঝানো যাবে না। এমনকি আমার ছোট সন্তানও স্কুল থেকে ফিরে আমাকে সেদিন বলেছে, তুমি বাড়িতে বসে কি করছ বাবা? তোমার এখানে বসে থাকা উচিত নয়।’ গ্রেগের কাছের বন্ধু, দীর্ঘসময়ের ধারাভাষ্যসঙ্গী বিল লরি বলেছেন, ‘বিশ্বক্রিকেট সবচেয়ে মহান এক দূতকে হারাল। টনি শুধু ইংল্যান্ডের অধিনায়কই ছিলেন না, তিনি ওয়ার্ল্ড সিরিজে বিশ্ব একাদশেরও অধিনায়ক ছিলেন। যেখানেই খেলা হয়েছে, সেখানেই ছিলেন তিনি। কাজেই তিনি সর্বদাই থাকবেন আমাদের মাঝে।’ ক্রিকেট মাঠের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ডেনিস লিলি। তিনিও শোকাহত টনির মৃত্যুতে। লিলি বলেন, ‘টনি সবসময়ই একজন কঠিন প্রতিপক্ষ ছিলেন।
No comments