সময়ের প্রতিধ্বনি-চাই নতুন ধারার রাজনীতি by মোস্তফা কামাল
নতুন বছরের শুরুতেই রাজনীতিতে এক ধরনের শুভ ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। গেল বছরের অসহিষ্ণু রাজনীতির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা আছে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ভেতরে ভেতরে নাকি উভয় দল আলোচনাও শুরু করেছে। এটা শুভ লক্ষণ বলা যায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সংকট সমাধানের একমাত্র পথই হচ্ছে আলোচনা। বিএনপির সাড়া পেলে আগামী নির্বাচন নিয়ে শিগগিরই সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায়।
এর আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলানিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আলোচনায় বসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর একটি ফোন কলই যথেষ্ট। বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত আছে। কিন্তু তখন সরকারের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই হরতাল-অবরোধের মতো কিছু কর্মসূচি জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আর তাতে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতি এক অরাজক অবস্থার দিকে ধাবিত হয়।
অবরোধ প্রতিরোধের নামে ছাত্রলীগ নামধারী একদল সশস্ত্র ক্যাডার নিরীহ বিশ্বজিৎকে প্রকাশ্যে রাজপথে কুপিয়ে ও খুঁচিয়ে হত্যা করে। বিশ্বজিৎ বারবার নিজেকে হিন্দু এবং কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয় বলে প্রাণভিক্ষা চাইলেও ওই পাষণ্ডদের মন গলাতে পারেনি। নির্মম পৈশাচিকতার শিকার হয় বিশ্বজিৎ। ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের মিডিয়ার কর্মীরাও এই নির্মম দৃশ্যের ছবি তুলতেই ব্যস্ত ছিলেন। অনেকে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলেন। কিন্তু তাঁরা কেউই বিশ্বজিৎকে বাঁচাতে এগিয়ে যাননি। একজন মানুষও যদি সাহস করে বিশ্বজিৎকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে যেত, তাহলে হয়তো তাঁকে বাঁচানো যেত। দুর্ভাগ্য আমাদের। আমরা তাঁকে বাঁচাতে পারিনি। আজ মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন উঁকি দেয়, কোথায় গেল আমাদের মানবতা! আমরা কি এভাবেই অন্যায়ের কাছে মাথানত করব? আমাদের নীরবতার সুযোগ নিয়ে এভাবেই কি অপশক্তি দাপিয়ে বেড়াবে?
বিশ্বজিতের এ ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেই ওয়ান/ইলেভেন-পূর্ববর্তী সময়ের লগি-বৈঠার মিছিলের কথা। পল্টন এলাকায় রাজপথে লগি-বৈঠার মিছিল থেকে প্রতিপক্ষের কর্মীদের প্রকাশ্যে হত্যা করে সেই লাশের ওপর দাঁড়িয়ে উল্লাস করা হয়েছিল। মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কী করে! আমরা দেখলাম, ওই ঘটনার পর পরই ওয়ান/ইলেভেনের ঘটনা ঘটল! মনে হলো, পরিকল্পিতভাবে দেশকে গভীর সংকটের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আবারও সেই একই প্রক্রিয়ায় দেশকে আরেকটি ঝুঁকির মুখে ঢেলে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে।
এটা ঠিক, বিশ্বজিৎ হত্যার পুরো দায় চেপেছে সরকারের ওপর। সরকারের ভাবমূর্তির ওপর যেন টর্নেডো আঘাত হেনেছিল। সেই আঘাত সামলাতে সরকার বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের জামায়াত-শিবির বানানোর চেষ্টা করেছিল। সরকারের পক্ষ থেকে প্রেস ব্রিফিং করে বলা হয়েছিল, ওরা ছাত্রলীগের ভেতরে ঢুকে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়েছে। আসলে তাদের পুরো পরিবার জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। গণমাধ্যম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ওরা কারা? এ বিষয়ের ওপর গণমাধ্যমে একের পর এক রিপোর্ট প্রকাশের পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে সরকার। ফলে এ ইস্যুতে সরকার ও গণমাধ্যম মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়। দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। শেষ পর্যন্ত হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করায় সরকারের শেষ রক্ষা হয়। তবে এটা ঠিক, এখনকার যুগে কোনো কিছু চেপে রাখা যায় না। গণমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কোনো ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা একসময় বুমেরাং হয়।
আমাদের বিশ্বাস, বিশ্বজিতের ঘটনাটি রাজনীতিকদের চোখ খুলে দিয়েছে। তাঁদের ভুল শোধরানোর একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। কি আওয়ামী লীগ কি বিএনপি- উভয় পক্ষের নেতাদেরই উপলব্ধি করা উচিত, বাংলাদেশকে নিয়ে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বিরোধপূর্ণ রাজনীতির সুযোগ নিতে কুচক্রী মহল মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই উভয় রাজনৈতিক দলকেই সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে। অন্যথায় রাজনীতি হাতছাড়া হয়ে যাবে। আর এবার যদি তেমনটি ঘটে তাহলে দেশ আবার পিছিয়ে যাবে।
অবরোধ-হরতালের রাজনীতি পরিহার করে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঢাকায় পাঁচটি স্থানে পথসভা করেছেন। একইভাবে সারা দেশে পথসভা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ এসব সভা-সমাবেশের কভারেজ অন্য যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির চেয়ে বেশি ছিল। প্রতিটি টিভি ও সংবাদপত্র আগে থেকেই এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রচার ও প্রকাশ করেছে। কোথাও কোনো ভাঙচুর, জ্বালাওপোড়াওয়ের ঘটনা ঘটেনি। ফলে সাধারণ মানুষও বিএনপির এই কর্মসূচিকে সাদরে গ্রহণ করেছে। এখন বিএনপি নেতৃত্ব ভাবছেন, ভবিষ্যতেও তাঁরা অবরোধ-হরতালের কর্মসূচির পরিবর্তে মানববন্ধন, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মতো কর্মসূচি দেবেন। এ ধরনের পদক্ষেপ শান্তিপূর্ণ রাজনীতির জন্য ইতিবাচক বলে মনে করি।
এদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে। তারাও উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, রাজনীতিকে অশান্ত করে তৃতীয় পক্ষকে উৎসাহিত করা যাবে না। সংগত কারণেই তারা এখন বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায়।
জাতীয় নির্বাচন সামনে। নির্বাচনে প্রধান দুই দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আলোচনা খুবই জরুরি। আলোচনার মাধ্যমেই নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কী হবে তা চূড়ান্ত করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক হোক কিংবা অন্তর্বর্তী হোক- যেকোনো ধরনের ব্যবস্থায় যেতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন করবে না এবং সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতাও পাবে না। এর ফলে নতুন সরকার আস্থার সংকটে পড়বে।
এ প্রসঙ্গে আমরা বিএনপির সেই ১৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কথা স্মরণ করতে পারি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট অংশ না নেওয়ার কারণে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তখন বিএনপি সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থেকেও বঞ্চিত হয়েছিল। ফলে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল এনে তা সংসদে পাস করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করবে না!
আওয়ামী লীগের ইতিহাস ঘাঁটলেও দেখা যায়, এটি নির্বাচনের দল। কোনো রকম কূটকৌশল করে ক্ষমতায় যাওয়ার দল নয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনকেই সব সময় অগ্রাধিকার দিয়েছে। সেই ১৯৫৪ সাল থেকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও দলটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেও দলটি জনগণের সঙ্গে মাঠে-ময়দানে থেকেছে। সেই দলটি নিশ্চয়ই ক্ষমতার মোহে নিজেদের সোনালি ঐতিহ্য জলাঞ্জলি দেবে না।
আমরা দেখতে চাই, দেশের অভিভাবক হিসেবে সরকার বিএনপির সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নেবে এবং নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার ব্যাপারে সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছবে। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে দেশ যদি আবার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে, তাহলে তার সুযোগ নেবে তৃতীয় পক্ষ। ফলে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে এবং তার দায় নিতে হবে দুটি বড় দলকেই।
আমরা স্বীকার করি, আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলই এ দেশের অপার সম্ভাবনা সম্পর্কে অবগত। উন্নত দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা যেমন বাংলাদেশকে নিয়ে উচ্চ ধারণা পোষণ করছেন, যেমনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের জরিপেও বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ অচিরেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। কাজেই এ দেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র হবে- এটাই স্বাভাবিক। রাজনীতিকদের ভুলের কারণে দেশ যাতে আবার কোনো ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়তে না পারে সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।
আমরা এও বিশ্বাস করি, যে গণতন্ত্রের জন্য দুই নেত্রী দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, সে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য নিশ্চয়ই তাঁরা সমঝোতায় পৌঁছবেন। নতুন বছরের শুরুতেই আমরা দুই নেত্রীর সেই সমঝোতা বৈঠক দেখতে চাই। দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা দুই নেত্রীর বৈঠকের উদ্যোগ নেবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
এর আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলানিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আলোচনায় বসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর একটি ফোন কলই যথেষ্ট। বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত আছে। কিন্তু তখন সরকারের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই হরতাল-অবরোধের মতো কিছু কর্মসূচি জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আর তাতে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতি এক অরাজক অবস্থার দিকে ধাবিত হয়।
অবরোধ প্রতিরোধের নামে ছাত্রলীগ নামধারী একদল সশস্ত্র ক্যাডার নিরীহ বিশ্বজিৎকে প্রকাশ্যে রাজপথে কুপিয়ে ও খুঁচিয়ে হত্যা করে। বিশ্বজিৎ বারবার নিজেকে হিন্দু এবং কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয় বলে প্রাণভিক্ষা চাইলেও ওই পাষণ্ডদের মন গলাতে পারেনি। নির্মম পৈশাচিকতার শিকার হয় বিশ্বজিৎ। ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের মিডিয়ার কর্মীরাও এই নির্মম দৃশ্যের ছবি তুলতেই ব্যস্ত ছিলেন। অনেকে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলেন। কিন্তু তাঁরা কেউই বিশ্বজিৎকে বাঁচাতে এগিয়ে যাননি। একজন মানুষও যদি সাহস করে বিশ্বজিৎকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে যেত, তাহলে হয়তো তাঁকে বাঁচানো যেত। দুর্ভাগ্য আমাদের। আমরা তাঁকে বাঁচাতে পারিনি। আজ মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন উঁকি দেয়, কোথায় গেল আমাদের মানবতা! আমরা কি এভাবেই অন্যায়ের কাছে মাথানত করব? আমাদের নীরবতার সুযোগ নিয়ে এভাবেই কি অপশক্তি দাপিয়ে বেড়াবে?
বিশ্বজিতের এ ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেই ওয়ান/ইলেভেন-পূর্ববর্তী সময়ের লগি-বৈঠার মিছিলের কথা। পল্টন এলাকায় রাজপথে লগি-বৈঠার মিছিল থেকে প্রতিপক্ষের কর্মীদের প্রকাশ্যে হত্যা করে সেই লাশের ওপর দাঁড়িয়ে উল্লাস করা হয়েছিল। মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কী করে! আমরা দেখলাম, ওই ঘটনার পর পরই ওয়ান/ইলেভেনের ঘটনা ঘটল! মনে হলো, পরিকল্পিতভাবে দেশকে গভীর সংকটের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আবারও সেই একই প্রক্রিয়ায় দেশকে আরেকটি ঝুঁকির মুখে ঢেলে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে।
এটা ঠিক, বিশ্বজিৎ হত্যার পুরো দায় চেপেছে সরকারের ওপর। সরকারের ভাবমূর্তির ওপর যেন টর্নেডো আঘাত হেনেছিল। সেই আঘাত সামলাতে সরকার বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের জামায়াত-শিবির বানানোর চেষ্টা করেছিল। সরকারের পক্ষ থেকে প্রেস ব্রিফিং করে বলা হয়েছিল, ওরা ছাত্রলীগের ভেতরে ঢুকে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়েছে। আসলে তাদের পুরো পরিবার জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। গণমাধ্যম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ওরা কারা? এ বিষয়ের ওপর গণমাধ্যমে একের পর এক রিপোর্ট প্রকাশের পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে সরকার। ফলে এ ইস্যুতে সরকার ও গণমাধ্যম মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়। দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। শেষ পর্যন্ত হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করায় সরকারের শেষ রক্ষা হয়। তবে এটা ঠিক, এখনকার যুগে কোনো কিছু চেপে রাখা যায় না। গণমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কোনো ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা একসময় বুমেরাং হয়।
আমাদের বিশ্বাস, বিশ্বজিতের ঘটনাটি রাজনীতিকদের চোখ খুলে দিয়েছে। তাঁদের ভুল শোধরানোর একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। কি আওয়ামী লীগ কি বিএনপি- উভয় পক্ষের নেতাদেরই উপলব্ধি করা উচিত, বাংলাদেশকে নিয়ে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বিরোধপূর্ণ রাজনীতির সুযোগ নিতে কুচক্রী মহল মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই উভয় রাজনৈতিক দলকেই সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে। অন্যথায় রাজনীতি হাতছাড়া হয়ে যাবে। আর এবার যদি তেমনটি ঘটে তাহলে দেশ আবার পিছিয়ে যাবে।
অবরোধ-হরতালের রাজনীতি পরিহার করে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঢাকায় পাঁচটি স্থানে পথসভা করেছেন। একইভাবে সারা দেশে পথসভা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ এসব সভা-সমাবেশের কভারেজ অন্য যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির চেয়ে বেশি ছিল। প্রতিটি টিভি ও সংবাদপত্র আগে থেকেই এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রচার ও প্রকাশ করেছে। কোথাও কোনো ভাঙচুর, জ্বালাওপোড়াওয়ের ঘটনা ঘটেনি। ফলে সাধারণ মানুষও বিএনপির এই কর্মসূচিকে সাদরে গ্রহণ করেছে। এখন বিএনপি নেতৃত্ব ভাবছেন, ভবিষ্যতেও তাঁরা অবরোধ-হরতালের কর্মসূচির পরিবর্তে মানববন্ধন, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মতো কর্মসূচি দেবেন। এ ধরনের পদক্ষেপ শান্তিপূর্ণ রাজনীতির জন্য ইতিবাচক বলে মনে করি।
এদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে। তারাও উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, রাজনীতিকে অশান্ত করে তৃতীয় পক্ষকে উৎসাহিত করা যাবে না। সংগত কারণেই তারা এখন বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায়।
জাতীয় নির্বাচন সামনে। নির্বাচনে প্রধান দুই দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আলোচনা খুবই জরুরি। আলোচনার মাধ্যমেই নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কী হবে তা চূড়ান্ত করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক হোক কিংবা অন্তর্বর্তী হোক- যেকোনো ধরনের ব্যবস্থায় যেতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন করবে না এবং সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতাও পাবে না। এর ফলে নতুন সরকার আস্থার সংকটে পড়বে।
এ প্রসঙ্গে আমরা বিএনপির সেই ১৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কথা স্মরণ করতে পারি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট অংশ না নেওয়ার কারণে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তখন বিএনপি সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থেকেও বঞ্চিত হয়েছিল। ফলে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল এনে তা সংসদে পাস করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করবে না!
আওয়ামী লীগের ইতিহাস ঘাঁটলেও দেখা যায়, এটি নির্বাচনের দল। কোনো রকম কূটকৌশল করে ক্ষমতায় যাওয়ার দল নয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনকেই সব সময় অগ্রাধিকার দিয়েছে। সেই ১৯৫৪ সাল থেকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও দলটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেও দলটি জনগণের সঙ্গে মাঠে-ময়দানে থেকেছে। সেই দলটি নিশ্চয়ই ক্ষমতার মোহে নিজেদের সোনালি ঐতিহ্য জলাঞ্জলি দেবে না।
আমরা দেখতে চাই, দেশের অভিভাবক হিসেবে সরকার বিএনপির সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নেবে এবং নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার ব্যাপারে সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছবে। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে দেশ যদি আবার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে, তাহলে তার সুযোগ নেবে তৃতীয় পক্ষ। ফলে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে এবং তার দায় নিতে হবে দুটি বড় দলকেই।
আমরা স্বীকার করি, আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলই এ দেশের অপার সম্ভাবনা সম্পর্কে অবগত। উন্নত দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা যেমন বাংলাদেশকে নিয়ে উচ্চ ধারণা পোষণ করছেন, যেমনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের জরিপেও বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ অচিরেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। কাজেই এ দেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র হবে- এটাই স্বাভাবিক। রাজনীতিকদের ভুলের কারণে দেশ যাতে আবার কোনো ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়তে না পারে সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।
আমরা এও বিশ্বাস করি, যে গণতন্ত্রের জন্য দুই নেত্রী দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, সে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য নিশ্চয়ই তাঁরা সমঝোতায় পৌঁছবেন। নতুন বছরের শুরুতেই আমরা দুই নেত্রীর সেই সমঝোতা বৈঠক দেখতে চাই। দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা দুই নেত্রীর বৈঠকের উদ্যোগ নেবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
No comments