পাঠ্যপুস্তক উৎসব ॥ চার কোটি শিক্ষার্থীর জন্য ২৭ কোটি বিনামূল্যের বই বছরের প্রথম দিনেই কার্যক্রম শুরু-
শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনই ঝকঝকে নতুন বই হাতে নিয়ে দেশব্যাপী পাঠ্যপুস্তক উৎসবের শুরু করল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী। রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামের স্কুলে স্কুলে প্রায় ২৭ কোটি পাঠ্যবই নিয়ে মঙ্গলবার বছরের প্রথম দিনই শুরু হলো উৎসব।
শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয় বিনামূল্যের পাঠ্যবই। শিশুরা খালি হাতে হাজির হয়েছিল নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে। নতুন বছরের প্রথম দিন স্কুলে এসেই নতুন রঙিন বই হাতে পেয়ে আনন্দ আর উল্লাসে মেতেছে শিশুরা। শিশুদের হৈচৈ আর আনন্দের উচ্ছ্বাসে যেন এক ছন্দময় পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। রাজধানীর রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজে সপ্তাহব্যাপী এ উৎসবের মূল আয়োজন হলেও দেশের সকল স্কুলে ছিল একই উৎসবের আমেজ। যারা প্রথম দিনই প্রিয় স্কুলে আসতে পারেনি তাদেরও নেই চিন্তার কোন কারণ। তারা যেদিনই স্কুলে আসবে সেদিনই হাতে পাবে নতুন বই।দেশব্যাপী স্কুলে স্কুলে উৎসবে শামিল হয়ে শিশুদের হাতে বই তুলে দিয়েছেন রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নেতৃবৃন্দ। উৎসবে শামিল হয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষা সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিসহ অন্যান্য সদস্য, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, সংসদ সদস্য, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ অনেকেই। তাঁরা শিশুদের উদ্দেশে বলেছেন, নতুন এ বই হলো তোমাদের নতুন বছরের শুভেচ্ছা। সপ্তাহব্যাপী অন্যরকম এক উৎসরের মধ্য দিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের তিন কোটি ৬৮ লাখ ৮৬ হাজার ১৭২ জন শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হবে ২৭ কোটি বিনামূল্যের পাঠ্যবই। এবার ১৭ কোটি চার রঙের ঝকঝকে বই পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। প্রাথমবারের মতো শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে বিনামূল্যের ব্যাকরণ ও গ্রামার বই। মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের বিশাল মাঠে চারটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিয়ে উৎসবের শুরু করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। আর গুলশানের কালাচাঁদপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উৎসবে শামিল হন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ডা. মোঃ আফছারুল আমীন ও প্রতিমন্ত্রী মোঃ মোতাহার হোসেন। সকাল ১১টায় রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজে উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ অন্য অতিথিরা কলেজ প্রাঙ্গণে আসার সঙ্গে সঙ্গে স্কাউটের একটি সুসজ্জিত বাদক দল তাঁদের নিয়ে যায় জাতীয় পতাকার রঙে সাজানো মূল মঞ্চে। অতিথিদের পরিয়ে দেয়া হয় লাল-সবুজ কাপড়ের উত্তরীয়। এ সময় মঞ্চের সামনে বসা শিক্ষার্থীদের হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে যায় উৎসবের ‘আনুষ্ঠানিক যাত্রা।’ দৃষ্টিনন্দন লাল-সবুজ মঞ্চের সামনে বসে থাকা কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর হাতে এ সময় দেখা যায় নতুন রঙিন বই। তাদের বাম হাতের কব্জিতে বাঁধা ছিল সুবজ ফিতা, ডান হাতে ছোট্ট লাল পতাকা। এই পতাকা তুলে ধরে থেকে থেকে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছিল তারা। শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ছিলেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নোমান উর রশীদ, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোস্তফা কামাল উদ্দিন, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন, রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের অধ্যক্ষ কর্নেল মোসলেহ উদ্দিন ভূঞা প্রমুখ। শিক্ষামন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, আমি খুব ভাল করেই বুঝতে পারি আজ সকালে ছিল শীত শীত। আর এখন গরম গরম। উৎসব করলে এমন গরমই থাকা যায়। শিক্ষর্থীদের নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, আগে বই কিনতেই কয়েক মাস চলে গেলেও এখন বছরের প্রথম দিনই সব শিক্ষার্থী নতুন বই পাচ্ছে।
‘আগামীর বাংলাদেশ’ গড়তে শিক্ষার্থীদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা যা করে দেখাতে পারিনি তোমাদের তা করে দেখাতে হবে। তোমরা কি প্রস্তুত? মন্ত্রীর প্রশ্ন শেষ হতেই গগণবিদারী চিৎকারের মধ্য দিয়ে হাজার কণ্ঠের জবাব এলো ‘হ্যা’। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বিশ্বে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যারা একসঙ্গে ২৭ কোটির বেশি বিনামূল্যে বই ছাপিয়ে বিতরণ করেছে। দেশব্যাপী বই বিতরণকে দেশের জন্য অসামান্য কাজ অভিহিত করে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বিশাল এই কাজ বদলে দিয়েছে দেশের শিক্ষার করুণ চিত্র। শিক্ষায় আমরা এগিয়ে চলেছি। তিনি জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার শিশুর কণ্ঠের জবাব এলো ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ বিনামূল্যের বই বিতরণকে বিশ্বের যে কোন দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে বলে মন্তব্য করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। বলেন, এই অসামান্য কাজ আমাদের শিক্ষার উন্নয়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে। প্রতিবছরের মতো এবারও ‘পাঠ্যপুস্তক উৎসব দিবসের কবিতা’ পড়ে শোনান শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নোমান উর রশিদ বলেন, এ এক অন্যরকম দিন। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের এ এক অন্যরকম উৎসব। অনুষ্ঠানে রেসিডেন্সিয়াল ছাড়াও মোহম্মদপুর মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজ, গণভবন সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় এবং শেরে বাংলানগর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীতের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেয়া হয়।
এদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী আফছারুল আমীন উৎসবমুখর পরিবেশে সকালে প্রথমে গুলশানের কালাচাঁদপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেন। এ সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন, সচিব এমএম নিয়াজউদ্দিন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক শ্যামল কান্তি ঘোষ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া গাজীপুরের টঙ্গীর আউচপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সদরের চন্দনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মৌচাকের মৌচাক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, কালিয়াকৈর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতেও নতুন বই তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। ডা. আফছারুল আমীন বলেছেন, সরকারের এ কাজ পাল্টে দিয়েছে দেশের শিক্ষার চিত্র। বইয়ের মানও অনেক ভাল হয়েছে। এমনকি পাঠ্যবই নিয়ে এখন আগের মতো কেউ অনৈতিক বাণিজ্যও করতে পারছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর রাজধানীর মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বিতরণের বই তুলে দেন। এ সময় স্কুলের গবর্নিং বডির সভাপতি স্থানীয় সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার, স্কুলের অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেনসহ গবর্নিং বডির সদস্য ও স্কুলের শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রী বলেন, ‘এ বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণীতে ২৭ কোটিরও বেশি বই বিতরণ করা হচ্ছে, যা অতীতে কোন সময়ে হয়নি। তিনি সমাজের বিত্তশালী ও সৃজনশীলদের আরও বেশি করে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। এর মাধ্যমে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে বলে মনে করেন তিনি।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে পাঠ্য বই বিতরণ করেন গবর্নিং বডি এবং ও শিক্ষা সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এ সময় সঙ্গে ছিলেন অধ্যক্ষ ড. শাহার আরা, গবর্নিং বডির সদস্য মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম আশরাফ তালুকদার, গবর্নিং বডির সদস্য খন্দকার মোস্তাক প্রমুখ। অধ্যক্ষ জানান, প্রথম শ্রেণীর নতুন শিক্ষার্থীদের বই আগামী ৮ তারিখ দেয়া হবে। এছাড়া ভর্তি হওয়া যে কোন শিক্ষার্থী যেদিনই স্কুলে আসবে সেদিনই তারা বই পাবে। অধ্যক্ষসহ অন্যান্য শিক্ষক মিলে বই বিতরণ করেছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের ছাত্রীদের মাঝে। অধ্যক্ষ মঞ্জুআরা বেগম জানান, প্রথম শ্রেণী ছাড়া অন্যান্য শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা যারাই স্কুলে এসেছে তারা বই পেয়েছে। ভর্তি কার্যক্রম শেষ হলেই প্রথম শ্রেণীর নতুন শিশুরা বই পাবে।
অন্যদিকে এবার বছরের প্রথম দিনই ই-বুকে এবং এনসিটিবির ওয়েবসাইট থেকে সব বই বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যাচ্ছে। প্রাথমিকে এবার ১০ কোটি ৭৮ লাখ ৬২ হাজার ৭১৪টি, ইবতেদায়ীতে এক কোটি ৭২ লাখ ১ হাজার ৪০টি, মাধ্যমিকে ১১ কোটি ৪৮ লাখ ২১ হাজার ৩৩১টি, মাদ্রাসায় দুই কোটি ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৫৪০টি এবং কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর কাছে ১৩ লাখ ২৮ হাজার ৪৮১টি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে এক সপ্তাহে। বিনামূল্যে বিতরণের বই কোথাও পাওয়া গেলে তা না কিনতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, আগে টাকা দিয়েও বই পাওয়া যেত না। এখন বিনামূল্যে বই দেয়ার ফলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া কমেছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে। সরকার নির্ধারিত পাঠ্যসূচীর বাইরে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অন্য বই কিনতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
No comments