খেলাধুলা-একাত্তরে ফুটবলের গৌরবের পতাকা এখন অনেক হাতে by আখতার হোসেন খান
খেলাধুলা হচ্ছে বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। একইসঙ্গে সুস্থ দেহমনের জন্যও চাই খেলাধুলা। ফিটনেস যে কোনো খেলার জন্য অপরিহার্য। সব বয়সের সব মানুষের জন্যও চাই ফিটনেস। এর অভাবে কাজে আনন্দ মিলবে না, দক্ষতায় থেকে যাবে ঘাটতি।
আমাদের ক্রীড়া নীতিনির্ধারণে এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রদানের সময় এসেছে। এ জন্য একটি শর্ত হচ্ছে খেলাধুলার বাজেট বাড়ানো
বাংলাদেশের গৌরবের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গড়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। মুক্তিযোদ্ধারা যখন রণাঙ্গনে লড়ছিল, ফুটবল খেলোয়াড়দের কেউ কেউ তাতে শামিল হয়ে যায়। কয়েকজন ক্রিকেটারও লড়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অসম সাহসে। প্রথম বিভাগে খেলা ক্রিকেটার জুয়েল স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল আমাদের ফুটবল দল। যাদের নিয়ে এ দল গড়ে উঠেছিল তাদের বেশিরভাগ সে সময়ে ঢাকার ফুটবল লীগে খেলতেন। কেউ কেউ তো ছিলেন রীতিমতো স্টার। তারা যখন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য উদ্যোগী হলেন, তার প্রভাব হয় অসামান্য। তারা ভারতের বিভিন্ন এলাকায় প্রদর্শনী ম্যাচে অংশ নেন। তখন পর্যন্ত ভারত সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, কিন্তু সে দেশের জনগণ বাংলাদেশের লাল-সবুজ-সোনালি পতাকাকে অভিবাদন জানায়, মাঠে বিপুল সংখ্যায় হাজির হয়ে অনন্য এসব যোদ্ধাকে অনুপ্রেরণা জোগায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সহায়ক হিসেবে খেলোয়াড়দের নিয়ে এমন দল বিশ্বের কোথাও গড়ে উঠেছে বলে জানা নেই। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে সরকার স্বাধীনতা পদক দিয়ে সম্মানিত করেছে। এ দলের সদস্যদের আরও নানাভাবে সম্মানিত করার সুযোগ রয়েছে। সে সময়ের মাঠের মুক্তিযোদ্ধা কাজী সালাউদ্দিন এখন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি। তার সুদক্ষ পরিচালনায় আমাদের ফুটবলের মান বাড়বে এবং সর্বত্র প্রসারিত হবে, এটাই প্রত্যাশা।
স্বাধীনতার পর ঢাকাকেন্দ্রিক ফুটবল আরও জনপ্রিয় হয়। আবাহনী ক্রীড়াচক্র বিদেশি কোচ নিয়ে আসে। সে সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হল্যান্ড দল টোটাল ফুটবলের ধারণা প্রবর্তন করে। আবাহনীর খেলায় তার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং বিজেএমসিও আকর্ষণীয় ফুটবল উপহার দিয়েছে। এসব দলের খেলা দেখতে দর্শকদের ঢল নামত মাঠে। দেশের সর্বত্রই ফুটবল জনপ্রিয় খেলা ছিল। স্বাধীনতার পর অন্যান্য খেলার পাশাপাশি এ খেলার বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফুটবল ফেডারেশনের সদস্য হয়। ফলে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে আমাদের অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ে। প্রশিক্ষণের জন্যও মেলে সহায়তা। এ সময়ই বাংলাদেশে ক্রীড়া পরিষদ আইন প্রণীত হয়, যার গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ফেডারেশনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ে। দেশের মধ্যেও জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ চালু হয়। ফুটবল, অ্যাথলেটিক্স ও সাঁতারে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতে থাকে। ব্যাডমিন্টন, লন টেনিস ও টেবিল টেনিস জনপ্রিয় হয়। ঢাকার বাইরে থেকেও অনেক প্রতিশ্রুতিবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসতে থাকেন। টেবিল টেনিসে টানা প্রায় দুই যুগ জাতীয় চ্যাম্পিয়ন জোবেরা রহমান লিনুর নাম এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি ক্রিকেট গুরুত্ব পেতে থাকে। সংবাদপত্রে ক্রিকেটের জন্য তুলনামূলক বেশি স্থান বরাদ্দ হয়। সে সময় একদিনের ক্রিকেট চালু হয় এবং বিশ্বকাপের আয়োজন করা হয় ইংল্যান্ডে। বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেট অঙ্গনে নিজের স্থান করে নিতে তৎপর হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় খেলতে আসে এমসিসির একটি দল। এরপর ভারতের ডেকান ব্লুজ দল আসে। শ্রীলংকার একাধিক দলের সফল সফর অনুষ্ঠিত হয়। আশির দশকের শেষ দিকে আয়োজন করা হয় ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের জাতীয় দল নিয়ে এশীয় কাপ টুর্নামেন্ট। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করে। মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত বাছাইপর্বে বাংলাদেশ যখন ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য প্রতিযোগিতার জন্য কোয়ালিফাই করে, ঢাকাসহ গোটা দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এখনও সে রঙের খেলা চোখের সামনে ভাসে। এবারে ক্রিকেটের বিশ্বকাপেরও আমরা অন্যতম আয়োজক। তবে বিশ্বের সেরা দলের কাতারে পেঁৗছাতে বাংলাদেশকে এখনও অনেক দূর পাড়ি দিতে হবে।
খেলাধুলার উন্নয়নে প্রশিক্ষণ এবং নিয়মিত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। সাভারের বিকেএসপি প্রশিক্ষণের জন্য একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান। সেখানে হকির জন্য রয়েছে সিনথেটিক টার্ফ। অ্যাথলিকদের জন্যও রয়েছে বিশেষ ট্রাক। দিনাজপুর, সিলেট, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামেও এর শাখা গড়ে উঠেছে। তবে এগুলো এখনও আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারেনি। এর প্রতি মনোযোগ প্রদান করতে হবে।
চার দশকে খেলাধুলায় আমরা কতটা এগিয়েছি, এর মূল্যায়ন করতে বলা হলে প্রথমেই বলব যে, আমরা সঠিক ধারাতেই রয়েছি। দক্ষিণ এশীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সফল আয়োজন করেছি আমরা। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল বিশ্বমানের। সব খেলাতেই খেলোয়াড় সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সর্বত্র অগ্রগতি সমান নয়। কোথাও কোথাও সুযোগের পুরো ব্যবহার করা যায়নি। হতাশার চিত্রও রয়েছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, পাকিস্তান আমলে আমাদের বিকাশ নানাভাবে রুদ্ধ করে রাখার চেষ্টা হয়েছিল। অনেক খেলায় আমাদের প্রকৃত অর্থেই শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। খেলাধুলা হচ্ছে বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। একইসঙ্গে সুস্থ দেহমনের জন্যও চাই খেলাধুলা। ফিটনেস যে কোনো খেলার জন্য অপরিহার্য। সব বয়সের সব মানুষের জন্যও চাই ফিটনেস। এর অভাবে কাজে আনন্দ মিলবে না, দক্ষতায় থেকে যাবে ঘাটতি। আমাদের ক্রীড়া নীতিনির্ধারণে এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রদানের সময় এসেছে। এ জন্য একটি শর্ত হচ্ছে খেলাধুলার বাজেট বাড়ানো। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট নিয়ে মোট বরাদ্দ এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ হচ্ছে মাত্র ৬২৬ কোটি টাকা। ক্রিকেট ও ফুটবল ফেডারেশন তাদের আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে অর্থ বরাদ্দ পায়। বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজনের অর্থ মূলত এসেছে আইসিসি থেকে। কিন্তু সরকার খেলাধুলা খাতে বরাদ্দ না বাড়ালে সবার জন্য খেলাধুলার সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে দুটি অগ্রাধিকার বিশেষভাবে বলব। এক. স্কুল পর্যায়ে সুযোগ বাড়ানো; দুই. ক্লাবগুলোকে সহায়তা প্রদান। স্কুলে খেলাধুলার জন্য মাঠের সমস্যা রয়েছে। কিন্তু যেখানে যে সুযোগ রয়েছে তা কাজে লাগাতে হবে। সরকার প্রতিটি জেলায় দুই বা তিনটি স্কুল বেছে নিতে পারে, যেখানে যে খেলায় যার তুলনামূলক সুবিধা রয়েছে তাকে বিকাশের জন্য আরও সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের জন্য বাজেট দিতে হবে, প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। ক্লাবগুলোর প্রতিও মনোযোগ বাড়াতে হবে। তারা নিজের নিজের পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে ঠিকই, কিন্তু সমন্বয়ও থাকা চাই। ঢাকা কিংবা জেলার ক্লাবগুলো সব খেলার জন্যই নিজস্ব দল গঠন করুক, এটা প্রত্যাশিত নয়। কেউ জোর দেবে ফুটবলে, কেউ ক্রিকেট বা হকি কিংবা ব্যাডমিন্টনে। সব ক্লাবকে সমান বরাদ্দ প্রদানের দরকার নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় তৈরিতে যারা যত বেশি সফল হবে, তারা তত বেশি অর্থ পাবে। প্রয়োজনে তাদের মাঠ বা প্রশিক্ষণ স্তর তৈরি করে দিতে হবে, প্রশিক্ষক নিয়োগে সহায়তা দিতে হবে। বর্তমানে অনেক বড় বড় ক্লাব পৃষ্ঠপোষকের সংকটে পড়েছে। তারা ভালো দল গড়তে পারছে না। কিন্তু অতীতের দিকে তাকালে আমরা করণীয় নির্ধারণ করতে পারি। ষাটের দশকে ঢাকার ক্লাবগুলো পাকিস্তানি ফুটবলারদের আকৃষ্ট করত। পুরান ঢাকার মাহুতটুলী স্কুল থেকে অনেক হকি খেলোয়াড় বের হয়েছে। আজাদ বয়েজ ও ইগলেটসসহ কয়েকটি ক্লাব ছিল ক্রিকেটের জন্য বিখ্যাত। দেশের কোনো কোনো এলাকায় বিশেষ খেলার প্রতি ঝোঁক দেখা যায়। যেমন আমি বলতে পারি নেত্রকোনার কথা। এক সময়ে এ অঞ্চল থেকে অনেক ফুটবলার বের হয়েছে। পার্শ্ববর্তী সুনামগঞ্জ থেকেও আমরা পেয়েছি কয়েকজন খ্যাতিমান খেলোয়াড়। মুন্সীগঞ্জ সাঁতারের জোগানদাতা। ফরিদপুর থেকে বের হয়ে এসেছিলেন অনেক হকি খেলোয়াড়। কেন এমনটি হচ্ছে, তার সমাজতাত্তি্বক বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকতেই পারে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, স্বাভাবিক সুযোগ কাজে লাগানো। যদি কোনো স্কুলে দেখা যায় যে, নিয়মিত তারা ভালো ফুটবলার বা ক্রিকেটার জোগান দিচ্ছে, তাহলে তাদের প্রতি মনোযোগ বাড়াতেই হবে। তারা হয়ে উঠবে কাঁচামালের উৎস। তাদের মান আরও বাড়িয়ে নেওয়ার দায়িত্ব পড়বে ফেডারেশন কিংবা এ ধরনের কর্তৃপক্ষের।
মানসম্পন্ন খেলোয়াড় বের করার জন্য গ্রামের প্রতি দিতে হবে বিশেষ দৃষ্টি। বাংলাদেশ শহরগুলোতে মাঠের অভাব। গ্রামে এ সুযোগ তুলনামূলক বেশি। তাছাড়া শহরের সচ্ছল জনগোষ্ঠীর অনেকেই চায় না যে, তাদের সন্তানরা পড়াশোনার প্রতি গুরুত্ব কম দিয়ে খেলাধুলা নিয়ে বেশি মেতে থাকুক। এ ক্ষেত্রে গ্রামের সম্ভাবনা বেশি। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাও সেটাই বলছে। খেলাকে যেন পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারে, অর্থাৎ তা হয়ে উঠতে পারে রুটি-রুজির উৎস, সেটাও ক্রমে নিশ্চিত হতে হবে। খেলাধুলার জীবন শেষেও পেতে হবে এ নিশ্চয়তা। এ ক্ষেত্রেও দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। একইসঙ্গে বেসরকারি সূত্র থেকেও আসতে হবে অর্থ ও অন্যান্য সুবিধা। যারা খেলাধুলার প্রসারে অর্থের জোগান দেবে, তাদের জন্য বিশেষ কর-ছাড় সুবিধা সরকার দিতে পারে।
আমাদের সম্ভাবনাগুলোও চিহ্নিত করতে হবে। সাঁতার অবশ্যই প্রাধান্য পাবে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, পানিতে ভেসে থাকা আর সাঁতার এক কথা নয়। সাঁতারের জন্য প্রতিযোগী গড়ে তোলায় বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। এ খেলার আইটেম অনেক। তার মধ্যে কোন কোনটি থেকে আমাদের প্রতিযোগীরা পদক আনতে পারেন, সেটা বিবেচনায় নিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হতে পারে। শুটিং আমাদের জন্য সম্ভাবনাময়। এ খেলা থেকে কমনওয়েলথ গেমসে প্রথম স্বর্ণপদক জয়ের সময়ের কথা ভাবুন_ গোটা দেশ অনুপ্রাণিত হয়েছিল। গলফ খেলা সীমিত কিছু লোকের। কিন্তু সিদ্দিকুর রহমান এ খেলাতেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের জন্য বড় সুনাম নিয়ে এসেছেন। খেলা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমি চীনের নীতি অনুসরণের পক্ষে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতার জন্য প্রথমদিকে তারা মেয়েদের ইভেন্টগুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। তারা দেখেছে, ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে খেলাধুলায় মেয়েদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। জিমন্যাস্টিকসে পদকসংখ্যা অনেক। ডাইভিংয়েও সম্ভাবনা। ফুটবল ও হকির মতো যেসব খেলায় ফিজিক্যাল কন্ট্যাক্ট বেশি দরকার হয়, সেখানে এতদিন তারা কম গুরুত্ব দিয়েছে। আমাদেরও এটা বিবেচনায় নিতে হবে। ফুটবলে বাংলাদেশ কত দূর যেতে পারবে? শারীরিক সক্ষমতায় আমরা পিছিয়ে। আমরা এখনও এমনকি দক্ষিণ এশীয় মানেও পেঁৗছাতে পারিনি। অদূর ভবিষ্যতে পারব বলেও মনে হয় না। জনপ্রিয় এ খেলাকে উপেক্ষা করার প্রশ্ন নেই। কিন্তু বিশ্ব অঙ্গনে নিজেদের জন্য বিশেষ স্থান করে নিতে হলে এমন খেলা বাছাই করতে হবে, যেখানে সম্ভাবনা রয়েছে। ক্রিকেট সে তুলনায় সম্ভাবনাময়। কারণ, এখানে দলের পাশাপাশি ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দেখানোর সুযোগ রয়েছে। ছোট মাঠে এবং ঘরের ভেতরে ছোট অঙ্গনে খেলা যায় সেসব খেলার প্রতিও আমাদের জোর দিতে হবে।
খেলাধুলা বিকাশের জন্য আমাদের অবকাঠামো সুবিধা বাড়ছে। আরও বাড়াতে হবে। তবে জোর দিতে হবে মানবসম্পদ বাড়ানোর প্রতি। কেবল কংক্রিটের কিছু ভবন তুললেই এ লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। কোনো ফেডারেশনই যেন তার মূল দায়িত্ব ভুলে না যায়। ভবন তুলে ভাড়া দেওয়া নয়, বরং তাদের নজর বাড়াতে হবে সেরা খেলোয়াড় গড়ে তোলা এবং তাদের পরিচর্যার প্রতি। সরকার তার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় খেলাধুলাকে বিশেষ গুরুত্ব দেবে, এটাই কাম্য। এভাবে সূচিত হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
খেলাধুলা কিন্তু এখন অর্থনীতির সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। ক্রিকেটে এখন আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রচুর। আমরা যত ভালো খেলব, তত বাইরের অর্থ আসবে। দেশেও বাড়বে পৃষ্ঠপোষক। বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যথেষ্ট বেড়েছে। আরও কয়েকটি খেলায় যদি বাংলাদেশ পারদর্শিতা দেখাতে পারে, তাহলে অর্থের সমাগম বেশি হবে। বিশ্বে আমাদের দেশের প্রচার বাড়বে, ভাবমূর্তি উন্নত হবে। অর্থনীতির নানা খাতে বিদেশি বিনিয়োগের যে সুযোগ রয়েছে সেটাও সম্প্রসারিত হবে।
খেলাধুলা আমাদের জাতীয় ঐক্যের ভিত তৈরি করে দেয়। ক্রিকেটে জাতীয় দল ভালো করলে বাঁধভাঙা উল্লাস দেখা দেয়। আবার খারাপ খেললে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে শহর ও বন্দর ছাড়িয়ে এমনকি নিভৃত পল্লীতেও। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভেদ যথেষ্ট বলেই অভিযোগ ওঠে। কিন্তু দেশের সম্মান যেখানে, সেখানে সবাই এক। খেলাধুলার মান বাড়তে থাকলে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্যের মুকুটে নতুন নতুন পালক যুক্ত হলে দেশ অনুপ্রাণিত হবে, অন্যান্য লক্ষ্য অর্জনের পানেও এগিয়ে চলতে পারব দৃঢ়পণে।
আখতার হোসেন খান : সাবেক সচিব ও ক্রীড়া সংগঠক
akhtarhk@gmail.com
বাংলাদেশের গৌরবের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গড়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। মুক্তিযোদ্ধারা যখন রণাঙ্গনে লড়ছিল, ফুটবল খেলোয়াড়দের কেউ কেউ তাতে শামিল হয়ে যায়। কয়েকজন ক্রিকেটারও লড়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অসম সাহসে। প্রথম বিভাগে খেলা ক্রিকেটার জুয়েল স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল আমাদের ফুটবল দল। যাদের নিয়ে এ দল গড়ে উঠেছিল তাদের বেশিরভাগ সে সময়ে ঢাকার ফুটবল লীগে খেলতেন। কেউ কেউ তো ছিলেন রীতিমতো স্টার। তারা যখন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য উদ্যোগী হলেন, তার প্রভাব হয় অসামান্য। তারা ভারতের বিভিন্ন এলাকায় প্রদর্শনী ম্যাচে অংশ নেন। তখন পর্যন্ত ভারত সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, কিন্তু সে দেশের জনগণ বাংলাদেশের লাল-সবুজ-সোনালি পতাকাকে অভিবাদন জানায়, মাঠে বিপুল সংখ্যায় হাজির হয়ে অনন্য এসব যোদ্ধাকে অনুপ্রেরণা জোগায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সহায়ক হিসেবে খেলোয়াড়দের নিয়ে এমন দল বিশ্বের কোথাও গড়ে উঠেছে বলে জানা নেই। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে সরকার স্বাধীনতা পদক দিয়ে সম্মানিত করেছে। এ দলের সদস্যদের আরও নানাভাবে সম্মানিত করার সুযোগ রয়েছে। সে সময়ের মাঠের মুক্তিযোদ্ধা কাজী সালাউদ্দিন এখন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি। তার সুদক্ষ পরিচালনায় আমাদের ফুটবলের মান বাড়বে এবং সর্বত্র প্রসারিত হবে, এটাই প্রত্যাশা।
স্বাধীনতার পর ঢাকাকেন্দ্রিক ফুটবল আরও জনপ্রিয় হয়। আবাহনী ক্রীড়াচক্র বিদেশি কোচ নিয়ে আসে। সে সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হল্যান্ড দল টোটাল ফুটবলের ধারণা প্রবর্তন করে। আবাহনীর খেলায় তার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং বিজেএমসিও আকর্ষণীয় ফুটবল উপহার দিয়েছে। এসব দলের খেলা দেখতে দর্শকদের ঢল নামত মাঠে। দেশের সর্বত্রই ফুটবল জনপ্রিয় খেলা ছিল। স্বাধীনতার পর অন্যান্য খেলার পাশাপাশি এ খেলার বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফুটবল ফেডারেশনের সদস্য হয়। ফলে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে আমাদের অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ে। প্রশিক্ষণের জন্যও মেলে সহায়তা। এ সময়ই বাংলাদেশে ক্রীড়া পরিষদ আইন প্রণীত হয়, যার গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ফেডারেশনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ে। দেশের মধ্যেও জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ চালু হয়। ফুটবল, অ্যাথলেটিক্স ও সাঁতারে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতে থাকে। ব্যাডমিন্টন, লন টেনিস ও টেবিল টেনিস জনপ্রিয় হয়। ঢাকার বাইরে থেকেও অনেক প্রতিশ্রুতিবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসতে থাকেন। টেবিল টেনিসে টানা প্রায় দুই যুগ জাতীয় চ্যাম্পিয়ন জোবেরা রহমান লিনুর নাম এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি ক্রিকেট গুরুত্ব পেতে থাকে। সংবাদপত্রে ক্রিকেটের জন্য তুলনামূলক বেশি স্থান বরাদ্দ হয়। সে সময় একদিনের ক্রিকেট চালু হয় এবং বিশ্বকাপের আয়োজন করা হয় ইংল্যান্ডে। বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেট অঙ্গনে নিজের স্থান করে নিতে তৎপর হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় খেলতে আসে এমসিসির একটি দল। এরপর ভারতের ডেকান ব্লুজ দল আসে। শ্রীলংকার একাধিক দলের সফল সফর অনুষ্ঠিত হয়। আশির দশকের শেষ দিকে আয়োজন করা হয় ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের জাতীয় দল নিয়ে এশীয় কাপ টুর্নামেন্ট। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করে। মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত বাছাইপর্বে বাংলাদেশ যখন ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য প্রতিযোগিতার জন্য কোয়ালিফাই করে, ঢাকাসহ গোটা দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এখনও সে রঙের খেলা চোখের সামনে ভাসে। এবারে ক্রিকেটের বিশ্বকাপেরও আমরা অন্যতম আয়োজক। তবে বিশ্বের সেরা দলের কাতারে পেঁৗছাতে বাংলাদেশকে এখনও অনেক দূর পাড়ি দিতে হবে।
খেলাধুলার উন্নয়নে প্রশিক্ষণ এবং নিয়মিত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। সাভারের বিকেএসপি প্রশিক্ষণের জন্য একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান। সেখানে হকির জন্য রয়েছে সিনথেটিক টার্ফ। অ্যাথলিকদের জন্যও রয়েছে বিশেষ ট্রাক। দিনাজপুর, সিলেট, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামেও এর শাখা গড়ে উঠেছে। তবে এগুলো এখনও আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারেনি। এর প্রতি মনোযোগ প্রদান করতে হবে।
চার দশকে খেলাধুলায় আমরা কতটা এগিয়েছি, এর মূল্যায়ন করতে বলা হলে প্রথমেই বলব যে, আমরা সঠিক ধারাতেই রয়েছি। দক্ষিণ এশীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সফল আয়োজন করেছি আমরা। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল বিশ্বমানের। সব খেলাতেই খেলোয়াড় সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সর্বত্র অগ্রগতি সমান নয়। কোথাও কোথাও সুযোগের পুরো ব্যবহার করা যায়নি। হতাশার চিত্রও রয়েছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, পাকিস্তান আমলে আমাদের বিকাশ নানাভাবে রুদ্ধ করে রাখার চেষ্টা হয়েছিল। অনেক খেলায় আমাদের প্রকৃত অর্থেই শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। খেলাধুলা হচ্ছে বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। একইসঙ্গে সুস্থ দেহমনের জন্যও চাই খেলাধুলা। ফিটনেস যে কোনো খেলার জন্য অপরিহার্য। সব বয়সের সব মানুষের জন্যও চাই ফিটনেস। এর অভাবে কাজে আনন্দ মিলবে না, দক্ষতায় থেকে যাবে ঘাটতি। আমাদের ক্রীড়া নীতিনির্ধারণে এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রদানের সময় এসেছে। এ জন্য একটি শর্ত হচ্ছে খেলাধুলার বাজেট বাড়ানো। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট নিয়ে মোট বরাদ্দ এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ হচ্ছে মাত্র ৬২৬ কোটি টাকা। ক্রিকেট ও ফুটবল ফেডারেশন তাদের আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে অর্থ বরাদ্দ পায়। বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজনের অর্থ মূলত এসেছে আইসিসি থেকে। কিন্তু সরকার খেলাধুলা খাতে বরাদ্দ না বাড়ালে সবার জন্য খেলাধুলার সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে দুটি অগ্রাধিকার বিশেষভাবে বলব। এক. স্কুল পর্যায়ে সুযোগ বাড়ানো; দুই. ক্লাবগুলোকে সহায়তা প্রদান। স্কুলে খেলাধুলার জন্য মাঠের সমস্যা রয়েছে। কিন্তু যেখানে যে সুযোগ রয়েছে তা কাজে লাগাতে হবে। সরকার প্রতিটি জেলায় দুই বা তিনটি স্কুল বেছে নিতে পারে, যেখানে যে খেলায় যার তুলনামূলক সুবিধা রয়েছে তাকে বিকাশের জন্য আরও সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের জন্য বাজেট দিতে হবে, প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। ক্লাবগুলোর প্রতিও মনোযোগ বাড়াতে হবে। তারা নিজের নিজের পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে ঠিকই, কিন্তু সমন্বয়ও থাকা চাই। ঢাকা কিংবা জেলার ক্লাবগুলো সব খেলার জন্যই নিজস্ব দল গঠন করুক, এটা প্রত্যাশিত নয়। কেউ জোর দেবে ফুটবলে, কেউ ক্রিকেট বা হকি কিংবা ব্যাডমিন্টনে। সব ক্লাবকে সমান বরাদ্দ প্রদানের দরকার নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় তৈরিতে যারা যত বেশি সফল হবে, তারা তত বেশি অর্থ পাবে। প্রয়োজনে তাদের মাঠ বা প্রশিক্ষণ স্তর তৈরি করে দিতে হবে, প্রশিক্ষক নিয়োগে সহায়তা দিতে হবে। বর্তমানে অনেক বড় বড় ক্লাব পৃষ্ঠপোষকের সংকটে পড়েছে। তারা ভালো দল গড়তে পারছে না। কিন্তু অতীতের দিকে তাকালে আমরা করণীয় নির্ধারণ করতে পারি। ষাটের দশকে ঢাকার ক্লাবগুলো পাকিস্তানি ফুটবলারদের আকৃষ্ট করত। পুরান ঢাকার মাহুতটুলী স্কুল থেকে অনেক হকি খেলোয়াড় বের হয়েছে। আজাদ বয়েজ ও ইগলেটসসহ কয়েকটি ক্লাব ছিল ক্রিকেটের জন্য বিখ্যাত। দেশের কোনো কোনো এলাকায় বিশেষ খেলার প্রতি ঝোঁক দেখা যায়। যেমন আমি বলতে পারি নেত্রকোনার কথা। এক সময়ে এ অঞ্চল থেকে অনেক ফুটবলার বের হয়েছে। পার্শ্ববর্তী সুনামগঞ্জ থেকেও আমরা পেয়েছি কয়েকজন খ্যাতিমান খেলোয়াড়। মুন্সীগঞ্জ সাঁতারের জোগানদাতা। ফরিদপুর থেকে বের হয়ে এসেছিলেন অনেক হকি খেলোয়াড়। কেন এমনটি হচ্ছে, তার সমাজতাত্তি্বক বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকতেই পারে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, স্বাভাবিক সুযোগ কাজে লাগানো। যদি কোনো স্কুলে দেখা যায় যে, নিয়মিত তারা ভালো ফুটবলার বা ক্রিকেটার জোগান দিচ্ছে, তাহলে তাদের প্রতি মনোযোগ বাড়াতেই হবে। তারা হয়ে উঠবে কাঁচামালের উৎস। তাদের মান আরও বাড়িয়ে নেওয়ার দায়িত্ব পড়বে ফেডারেশন কিংবা এ ধরনের কর্তৃপক্ষের।
মানসম্পন্ন খেলোয়াড় বের করার জন্য গ্রামের প্রতি দিতে হবে বিশেষ দৃষ্টি। বাংলাদেশ শহরগুলোতে মাঠের অভাব। গ্রামে এ সুযোগ তুলনামূলক বেশি। তাছাড়া শহরের সচ্ছল জনগোষ্ঠীর অনেকেই চায় না যে, তাদের সন্তানরা পড়াশোনার প্রতি গুরুত্ব কম দিয়ে খেলাধুলা নিয়ে বেশি মেতে থাকুক। এ ক্ষেত্রে গ্রামের সম্ভাবনা বেশি। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাও সেটাই বলছে। খেলাকে যেন পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারে, অর্থাৎ তা হয়ে উঠতে পারে রুটি-রুজির উৎস, সেটাও ক্রমে নিশ্চিত হতে হবে। খেলাধুলার জীবন শেষেও পেতে হবে এ নিশ্চয়তা। এ ক্ষেত্রেও দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। একইসঙ্গে বেসরকারি সূত্র থেকেও আসতে হবে অর্থ ও অন্যান্য সুবিধা। যারা খেলাধুলার প্রসারে অর্থের জোগান দেবে, তাদের জন্য বিশেষ কর-ছাড় সুবিধা সরকার দিতে পারে।
আমাদের সম্ভাবনাগুলোও চিহ্নিত করতে হবে। সাঁতার অবশ্যই প্রাধান্য পাবে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, পানিতে ভেসে থাকা আর সাঁতার এক কথা নয়। সাঁতারের জন্য প্রতিযোগী গড়ে তোলায় বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। এ খেলার আইটেম অনেক। তার মধ্যে কোন কোনটি থেকে আমাদের প্রতিযোগীরা পদক আনতে পারেন, সেটা বিবেচনায় নিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হতে পারে। শুটিং আমাদের জন্য সম্ভাবনাময়। এ খেলা থেকে কমনওয়েলথ গেমসে প্রথম স্বর্ণপদক জয়ের সময়ের কথা ভাবুন_ গোটা দেশ অনুপ্রাণিত হয়েছিল। গলফ খেলা সীমিত কিছু লোকের। কিন্তু সিদ্দিকুর রহমান এ খেলাতেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের জন্য বড় সুনাম নিয়ে এসেছেন। খেলা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমি চীনের নীতি অনুসরণের পক্ষে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতার জন্য প্রথমদিকে তারা মেয়েদের ইভেন্টগুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। তারা দেখেছে, ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে খেলাধুলায় মেয়েদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। জিমন্যাস্টিকসে পদকসংখ্যা অনেক। ডাইভিংয়েও সম্ভাবনা। ফুটবল ও হকির মতো যেসব খেলায় ফিজিক্যাল কন্ট্যাক্ট বেশি দরকার হয়, সেখানে এতদিন তারা কম গুরুত্ব দিয়েছে। আমাদেরও এটা বিবেচনায় নিতে হবে। ফুটবলে বাংলাদেশ কত দূর যেতে পারবে? শারীরিক সক্ষমতায় আমরা পিছিয়ে। আমরা এখনও এমনকি দক্ষিণ এশীয় মানেও পেঁৗছাতে পারিনি। অদূর ভবিষ্যতে পারব বলেও মনে হয় না। জনপ্রিয় এ খেলাকে উপেক্ষা করার প্রশ্ন নেই। কিন্তু বিশ্ব অঙ্গনে নিজেদের জন্য বিশেষ স্থান করে নিতে হলে এমন খেলা বাছাই করতে হবে, যেখানে সম্ভাবনা রয়েছে। ক্রিকেট সে তুলনায় সম্ভাবনাময়। কারণ, এখানে দলের পাশাপাশি ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দেখানোর সুযোগ রয়েছে। ছোট মাঠে এবং ঘরের ভেতরে ছোট অঙ্গনে খেলা যায় সেসব খেলার প্রতিও আমাদের জোর দিতে হবে।
খেলাধুলা বিকাশের জন্য আমাদের অবকাঠামো সুবিধা বাড়ছে। আরও বাড়াতে হবে। তবে জোর দিতে হবে মানবসম্পদ বাড়ানোর প্রতি। কেবল কংক্রিটের কিছু ভবন তুললেই এ লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। কোনো ফেডারেশনই যেন তার মূল দায়িত্ব ভুলে না যায়। ভবন তুলে ভাড়া দেওয়া নয়, বরং তাদের নজর বাড়াতে হবে সেরা খেলোয়াড় গড়ে তোলা এবং তাদের পরিচর্যার প্রতি। সরকার তার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় খেলাধুলাকে বিশেষ গুরুত্ব দেবে, এটাই কাম্য। এভাবে সূচিত হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
খেলাধুলা কিন্তু এখন অর্থনীতির সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। ক্রিকেটে এখন আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রচুর। আমরা যত ভালো খেলব, তত বাইরের অর্থ আসবে। দেশেও বাড়বে পৃষ্ঠপোষক। বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যথেষ্ট বেড়েছে। আরও কয়েকটি খেলায় যদি বাংলাদেশ পারদর্শিতা দেখাতে পারে, তাহলে অর্থের সমাগম বেশি হবে। বিশ্বে আমাদের দেশের প্রচার বাড়বে, ভাবমূর্তি উন্নত হবে। অর্থনীতির নানা খাতে বিদেশি বিনিয়োগের যে সুযোগ রয়েছে সেটাও সম্প্রসারিত হবে।
খেলাধুলা আমাদের জাতীয় ঐক্যের ভিত তৈরি করে দেয়। ক্রিকেটে জাতীয় দল ভালো করলে বাঁধভাঙা উল্লাস দেখা দেয়। আবার খারাপ খেললে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে শহর ও বন্দর ছাড়িয়ে এমনকি নিভৃত পল্লীতেও। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভেদ যথেষ্ট বলেই অভিযোগ ওঠে। কিন্তু দেশের সম্মান যেখানে, সেখানে সবাই এক। খেলাধুলার মান বাড়তে থাকলে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্যের মুকুটে নতুন নতুন পালক যুক্ত হলে দেশ অনুপ্রাণিত হবে, অন্যান্য লক্ষ্য অর্জনের পানেও এগিয়ে চলতে পারব দৃঢ়পণে।
আখতার হোসেন খান : সাবেক সচিব ও ক্রীড়া সংগঠক
akhtarhk@gmail.com
No comments