স্কুলে স্কুলে উৎসব, হাতে হাতে বই- অপার আনন্দ
শুধু আনন্দই নয়, এ যেন তার চেয়েও বেশি। একদিকে বছরের প্রথম দিন অন্যদিকে প্রিয় স্কুলে উৎসবে শামিল হয়ে হাতে আকর্ষণীয় ছবি আর বিষয় সংবলিত শিক্ষাক্রমের রঙিন ঝকঝকে নতুন এক সেট পাঠ্যবই। দেশজুড়ে অন্যরকমের এক উৎসব।
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া রূপসা থেকে পাথুরিয়া স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থীর এক অন্যরকম আনন্দ। বছরের প্রথম দিন খালি হাতে স্কুলে যাওয়া, আর সহপাঠীদের সঙ্গে পাঠ্যপুস্তক উৎসবে শামিল হয়ে হাতে পাওয়া নতুন বই। শিক্ষার্থীরা নেচে-গেয়ে, আনন্দ-উল্লাসে, প্লাকার্ড-ফেস্টুন নেড়ে, বেলুন উড়িয়ে শামিল হয় উৎসবে। রঙের বর্ণিল পাঠ্যবইয়ের মোড়ক কোমলমতি শিশুদের হাতে হাতে অনেক স্কুলে। মাঠে জেগে উঠেছিল সাত রঙের রংধনু। বছরের প্রথম দিন বই পেয়ে শিশুরা আনন্দে এতটাই উদ্বেলিত যে প্রত্যেকের অভিব্যক্তি ছিল, আজ আমরা অনেক খুশি। নতুন বইগুলো নতুন রাখতে চাই। আজই বইয়ে মলাটে লাগাব। মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করব। বইয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতেও ভুল করেনি শিশুরা।শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আজকের শিশুদের এই আনন্দে শামিল হতে পেরে খুশি। শিশুদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, নতুন বছরের প্রথম দিন এই বই হলো তোমাদের জন্য আমাদের সবচেয়ে বড় শুভেচ্ছা। এ বই হলো তোমাদের প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শুভেচ্ছা। তবে আমাদের আজকের এই বিশাল উৎসবে পৌঁছানোর পথ সহজ ছিল না। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই ছাত্রছাত্রী যেমন পায়নি বিনামূল্যের বই তেমনি বছরের প্রথম দিনও পাঠ্যবই হাতে পায়নি। বরং তা পেতে পেতে মার্চ/ এপ্রিল পার হয়ে যেত প্রতিবছর। আর এই সুযোগে পাঠ্যবই নিয়ে অসাধু সিন্ডিকেট চক্র অস্থির করে তুলত বইয়ের বাজার। এমনই এক অবস্থায় আমাদের মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই প্রথমবারের মতো ২০১০ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের দুই কোটি ৭৬ লাখ ৬২ হাজার ৫২৯ শিক্ষার্থীকে ১৯ কোটির অধিক বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছিল। পরে একটি বিশেষ মহল এনসিটিবির গুদামে আগুন লাগিয়ে দেয়। শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ২০১১ ও ২০১২ সালে বইয়ের সংখ্যা ২৩ কোটিতে উন্নীত করতে হয়। এবার তিন কোটি ৬৮ লাখ ৮৬ হাজার ১৭২ শিক্ষার্থীর বই দিতে হবে প্রায় ২৭ কোটি। অর্থাৎ গত তিন বছরে ঝরেপড়া রোধ হয়েও নতুন ভর্তি বেড়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে কঠিন এ কাজ করার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, আমি যখন বলেছিলাম সারাদেশে বিনামূল্যের বই দেব আমরা তখন আমার দেশী এমনকি বিদেশী অনেক বন্ধুও বলেছিল, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? এ কঠিন কাজ অসম্ভব। আজ আমি বলতে চাই জাতির জন্য আমি সেই কঠিন কাজটিই করতে পেরেছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য কঠিন ও অসম্ভবকেই সম্ভব করতে চান। আজকের এই উৎসব আমাদের নতুন প্রজন্মকে জাগিয়ে তুলেছে। মন্ত্রীর এ কথার সত্যতা পাওয়া গেল উৎসবের প্রথম দিন স্কুলে স্কুলে নতুন বই নিতে আসা শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকের কথাতেই। বর্ণিল আয়োজনের কারণে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া রেসিডেন্সিয়াল মডেল, মোহম্মদপুর মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজ, গণভবন সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় এবং শেরেবাংলানগর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আনন্দ একটা বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। তাই বলে আনন্দের কমতি ছিল না রাজধানীর নামী স্কুল থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন প্রতিষ্ঠানের শিশুদেরই। সকালেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীনের হাত থেকে রঙিন বই পেয়ে খুশিতে মাকে জড়িয়ে ধরেছিল গুলশানের কালাচাঁদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশু টুম্পা। শিশুটি বলছিল, মায়ের হাত ধরে খালি হাতে স্কুলে এসেছি। নতুন বই হাতে বাড়ি যাব।
তৃতীয় শ্রেণীর রাকিব ও ফারজানা বলছিল, আজকে আমাদের বই দিয়েছে স্যাররা। কোন ক্লাস হবে না, ক্লাস হবে আগামীকাল। আমাদের খুব আনন্দ লাগছে। মেয়েকে পাঠ্যবই উৎসবে নিয়ে এসেছিলেন কাঁচামাল বিক্রেতা মমতাজ উদ্দিন। আপনার সন্তান বই পেয়েছে? এমন প্রশ্ন করতেই তার অভিব্যক্তি ছিল, মেয়েকে স্কুলে নিয়ে এসেই বই পেয়েছি। মেয়ে এবং আমরা অভিভাবকরাও খুশি। রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজের উৎসবের সময় বই পেয়ে কেমন লাগছে একথা জিজ্ঞেস করেছিলাম চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ফাহিমের কাছে। ফাহিমকে দেখে রীতিমতো সেখানে বই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার সহপাঠীরা। সকলেরই এক কথা, আমাদের খুব আনন্দ লাগছে। একই শ্রেণীর আকিব, অরুণাময়, ইশতিয়াক, শাফিউল, মিনহাজ, পল্লব, ইফতেখার বলছিল, আমাদের আজ খুব আনন্দ লাগছে। একই স্কুলের শিক্ষার্থী রুবেল, শিশির ধন্যবাদ দিল প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে। তারা দুজনই বলছিল, মা-বাবা আমাদের বলেছে প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর কারণেই আমরা এই সুন্দর বই পেয়েছি। নতুন বই হাতে বন্ধুদের নিয়ে মোবাইল ফোনে অনেক ছবি তোলে শিশু শরিফুল হাসান। লাল ফ্রেম কাগজ দিয়ে নতুন বইয়ে মলাট দেবে ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী শেখ হামিদও। তার ছোট্ট কথা, বইয়ে মলাট না দিলে কি বই ভাল থাকে? বলছিল, বছরের প্রথম দিনেই নতুন বই পেয়ে খুব আনন্দ লাগছে। প্রতিবছরই আমরা এভাবে প্রথম দিনে বই পেতে চাই। গণভবন সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী আমিনা রেহানা মহিবুলাল্লাহ তার মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল এক সেট বই নিয়ে। বই পেয়েছ? জিজ্ঞেস করতেই শিশুটি বলল, হ্যাঁ। সব বই পেয়েছি। খুব ভাল লাগছে। মা বলছিল, বছরের প্রথম দিনই এত সুন্দর একটা উৎসবে এসে বাচ্চা বই পেয়েছে ভেবে আমারও খুব ভাল লাগছে।
শুধু এই শিক্ষার্থীই নয়, মঙ্গলবার দেশের সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়েই পাঠ্যপুস্তক উৎসবের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে নতুন বই। রঙিন বই হাতে পেয়ে আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর উল্লাসে মেতেছে শিক্ষার্থীরা। হাজার হাজার শিক্ষার্থী বছরের প্রথম দিনেই বিনামূল্যে চকচকে পাঠ্যবই হাতে পেয়ে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। প্লাকার্ড-ফেস্টুন নেড়ে, বেলুন উড়িয়ে এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে শিক্ষার্থীরা। ঢাক-ঢোল বাজিয়ে শিক্ষার্থীরা উৎসবকে বরণ করে। এদিকে এবারের উৎসবের শিশুদের আনন্দের মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম ও বিষয়ের নতুন নতুন বই। জানা গেছে, দীর্ঘ ১৭ বছর পর এবার পরিবর্তন আনা হয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রমে। আধুনিক ও যুগোপযোগী হয়েছে পাঠ্যক্রম। প্রথম দিনই সারাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা হাতে পায় নাতুন শিক্ষাক্রমের ১০৪টি পাঠ্যবই। শিক্ষার্থীরা হাতে পায় নতুন শিক্ষাক্রমের বাংলা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) এবং সমাজ বিজ্ঞানের পরিবর্তে পাবে বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়। ষষ্ঠ শ্রেণীর নতুন বিষয় আইসিটি। অভিন্ন নতুন বই হিসেবে শিক্ষার্থীরা পায় বাংলা, ইংরেজী, গণিত, কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) এবং সমাজ বিজ্ঞানের পরিবর্তে হচ্ছে বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়।
No comments