শেখ হাসিনার রাশিয়া সফর অনেক উন্নয়নের দ্বার খুলেছে by আবদুল মান্নান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়ায় তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে দেশে ফিরেছেন। এই সফরকালে রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের দশটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
এই চুক্তিগুলোর অন্যতম হচ্ছে: রাশিয়া হতে এক বিলিয়ন ডলারের (এক হাজার কোটি ডলার) সমরাস্ত্র ক্রয়, পাবনার রূপপুরে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র (এক হাজার মেগাওয়াট করে দুটি কেন্দ্র) অন্যতম। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন দেশের সাথে এটি বৃহত্তম সমরাস্ত্র ক্রয়সংক্রান্ত চুক্তি। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, শেখ হাসিনার সফর ছিল বাংলাদেশের কোন সরকার বা রাষ্ট্র প্রধানের রাশিয়ায় চল্লিশ বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় সফর। ১৯৭২ সালে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট লিউনিড ব্রেজনেভের আমন্ত্রণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১ মার্চ হতে ৬ মার্চ পর্যন্ত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোয় ছয় দিনের রাষ্ট্রীয় সফর করেন। সেই সফরে বাংলাদেশের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বঙ্গবন্ধু মস্কো ত্যাগের আগে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র-শিক্ষকদের এক সমাবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার আগ পর্যন্ত তাকে তৃতীয় বিশ্বের একজন অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গণ্য করা হতো। একারণে তার এই বক্তৃতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শেখ হাসিনাও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিয়েছেন; তবে পার্থক্য এই যে, বর্তমান বিশ্ব-পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিকভাবে অনেক পরিবর্তন এসেছে। নব্বইয়ের দশকে পরাক্রমাশালী সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে এবং লেনিন প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের প্রথম কমিউনিস্ট রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে বারটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, যার মধ্যে একাধিক রাষ্ট্র আছে যেগুলো আবার মুসলিম প্রধান দেশ এবং তেলসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। এই সব দেশের দুই-একটি আবার বিশ্ব-দরবারে ধর্মীয় জঙ্গীবাদ লালনের দেশ হিসেবেও পরিচিত হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে বিশ্বের সামরিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে এবং বর্তমানে বিশ্বে সামরিক পরাশক্তি বলতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রকেই বুঝানো হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়ার গুরুত্ব তেমন একটা কমেনি এবং এই শতকে যে চারটি দেশ প্রথম দিকে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভাব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে রাশিয়া তার অন্যতম। বাকি তিনটি হচ্ছে চীন, ব্রাজিল আর ভারত।সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে কয়েকটি দেশ অনেকটা খোলাখুলিভাবে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল তার মধ্যে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন অন্যতম। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে শুধু নৈতিকভাবে সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, একই সঙ্গে আর্থিক আর কূটনৈতিকভাবেও সমর্থন যুগিয়েছে। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান যখন ভারতের পশ্চিম সীমান্তে পড়ন্ত বেলায় বিমান আক্রমণ করে ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করল তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কোলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি তার বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে দিল্লীতে ফিরে যান এবং লোকসভা ও রাজ্যসভার যৌথ অধিবেশন আহ্বান করে দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাল্টা যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের এই অতর্কিত হামলার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে চলমান মুক্তিযুদ্ধ হতে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নেওয়া; যদিও পাকিস্তানের এই চাল ছিল একটি চরম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ফলে পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী এক সপ্তাহের মধ্যেই পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে; আর পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। অবস্থা এমন দাঁড়ল যে, বাংলাদেশ তো হাত ছাড়া হলোই; সেইসাথে পশ্চিম পাকিস্তানও যায় যায় অবস্থা। এই সময় পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়াল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন নিক্সন প্রশাসন। তারা ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিল, সময়মতো হস্তক্ষেপ না করলে পাকিস্তান বলে রাষ্ট্রটির আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্র কালবিলম্ব না করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৪, ৫ ও ১৩ ডিসেম্বর উপমহাদেশে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনে এবং প্রত্যেকবারই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দিয়ে তা নাকচ করে দেয়। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার অর্থই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অকাল মৃত্যু। নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানায় চীন ও আরব দেশসমূহ; আর সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রত্যক্ষ সমর্থন জানায় ব্রিটেন ও ফ্রান্স। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে যুদ্ধ হতে নিভৃত করতে তার সপ্তম নৌবহরের পারমাণবিক শক্তিচালিত যুদ্ধজাহাজ ইউএস এন্টারপ্রাইজ বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার একটি আস্ত নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ করে। একচল্লিশ বছর পর চিন্তা করলে মনে পড়ে, কতই না গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাঙালীর ইতিহাসের সে কঠিন সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা ভারতের ভূমিকা!
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন তখন বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ। বাংলাদেশের দুটি সমুদ্র বন্দরÑ চট্টগ্রাম আর মংলা বন্দর বন্ধ; কারণ, পশ্চাৎপসারণরত পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এই দুটি বন্দরে হাজার হাজার ভাসমান মাইন (শক্তিশালী ভাসমান বোমা) ছড়িয়ে বন্দর দুটিকে অচল করে দেয়। তৎকালীন সময়ে এই ধরনের ভাসমান মাইন উদ্ধারের সক্ষমতা যে কয়েকটি দেশের ছিল তার মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্যতম। এই মাইন পরিষ্কার করতে এগিয়ে আসে সোভিয়েত নেভি এবং প্রায় ছ’মাস সময় নিয়ে তারা বন্দর দুটিকে মাইনমুক্ত করে জাহাজ চলাচল করার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। এই কাজটি ছিল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ এবং তা করতে গিয়ে রেডকিন নামের একজন সোভিয়েত নেভির সদস্য চট্টগ্রামে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। তার মরদেহ বর্তমানে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা নৌ একাডেমী প্রাঙ্গণে সমাহিত আছে। তখন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য অনেক কিছু প্রয়োজন। চাল-ডাল হতে শুরু করে ঔষধপত্র। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সুচিকিৎসা প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে একটি ডলারও জমা নেই। জাতির এই ক্রান্তিকালে বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে এসেছিল বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো, যার মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্যতম। সাহায্য করেছিল নিজ দেশে ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহে নিয়ে গিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতে। অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য সংগ্রহ করতে সহায়তা করেছিল যার বেশিভাগই ছিল সাহায্য। যেহেতু তখন বাংলাদেশের কাছে আন্তর্জাতিক বাজার হতে কোন কিছু ক্রয় করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা ছিল নাÑ বাংলাদেশ তখন পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহের সাথে প্রাচীন পণ্য বিনিময় বা বার্টার পদ্ধিতে সীমিত আকারে বাণিজ্য শুরু করেছিল। একই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহের কাছ হতে বাংলদেশের স্বীকৃতি আদায়ের ব্যবস্থা করেছিল। নতুন দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রায়ত্ত নতুন খাতকে ব্যবস্থাপনা করার জন্য প্রয়োজন ছিল দক্ষ প্রশাসকের। বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রথম ক্যাডার সার্ভিস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস। একঝাঁক শিক্ষিত তরুণকে বৃত্তি দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশে প্রেরণ করা হয়েছিল উচ্চশিক্ষা আর প্রশিক্ষণের জন্য। এছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে পড়ালেখা করার জন্য কয়েক শ’ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেয়া হয়েছিল। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ড. আবুল বারকাত, ড. শাহ আলম (আইন কমিশন), ড. মুস্তাফিজ প্রমুখরা সোভিয়েত জামানারই সৃষ্টি। বর্তমান ইতিহাসবিমুখ প্রজন্মের কাছে এই সব অধ্যায় সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত।
দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার রাশিয়া সফর বঙ্গবন্ধুর রাশিয়া সফরের চাইতেও অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। রাশিয়ার বর্তমান গড় অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ প্রায় ১.৮৬ ট্রিলিয়ন ডলার এবং গড়ে ব্যক্তিগত আয় ১৮,৯৪৫ ডলার। ১৪ কোটি মানুষের এই দেশটি তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অনেকটা সেবা খাতের ওপর নির্ভরশীল। ভোগ্যপণ্যের সিংহভাগই বিদেশ হতে আমদানি করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ গড়ে বছরে রাশিয়ার সাথে সাত শ’ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করে যা এক বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব। রাশিয়া ও বাংলাদেশে উভয়ই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হওয়াতে এই বাণিজ্য সম্প্রসারণ কিছুটা হলেও সহজ হবে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, চা, চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য ইত্যাদি পণ্য রাশিয়ায় রফতানির একটি বিরাট সুযোগ রয়ে গেছে। ইউরোপের যেসব দেশে দ্রুত জন্মহার কমছে তার মধ্যে রাশিয়া অন্যতম। সেখানে দ্রুত বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে যার ফলে আর দুই দশক পর সে দেশে কলকারখানা বা অফিস আদালতে কাজ করার জন্য দক্ষ জনশক্তির মারাত্মক অভাব ঘটবে। এখন হতে পরিকল্পনা করলে বাংলাদেশ তার বৃহৎ জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য যত বেশি জানালা খোলা যায় তত বেশি মঙ্গল এবং দেশ তত বেশি ঝুঁকিমুক্ত হতে পারে। তৈরি পোশাক রফতানির জন্য বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার কারণে অনেক সময় অকারণে এই সব দেশের সরকার বাংলাদেশের ওপর নানামুখী চাপ সৃষ্টি করে।
রাশিয়া হতে এক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ক্রয় চুক্তি নিয়ে ইতোমধ্যে নানামুখী আলোচনা সমালোচনা তর্কবিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। অনেকে এই বিশাল অঙ্কের ক্রয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কোন কোন বিশ্লেষক বলেছেন, এই চুক্তি হচ্ছে দুটি দুর্নীতিপরায়ণ দেশের মধ্যে চুক্তি সুতরাং এই চুক্তির ফলে দুর্নীতির সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। চুক্তির শর্ত সম্পর্কে স্বচ্ছতা দাবি করেছেন কেউ কেউ। বিএনপি প্রধানের একজন উপদেষ্টা, যিনি কিনা একজন সাবেক উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন তিনি দাবি করেছেন এই ক্রয় সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকারের উচিত ছিল সামরিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করা। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, এই চুক্তি করা হয়েছে কমিশন খাওয়ার জন্য। তিনি আবার হিসাব করে বলেছেন, এই কমিশনের পরিমাণ ১২ মিলিয়ন ডলার। বাস্তবটা হচ্ছে এখানে কোন আর্থিক লেনদেন নেই। রাশিয়া সমরাস্ত্র ক্রয়ের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করেছে তা ২০১৭ সালের মধ্যে ব্যবহার করতে হবে। পুরোটা করতে না পারলে যতটুকু করতে পেরেছে বাংলাদেশ তার ওপর ০.৭৫% সার্ভিস চার্জ দেবে। ২০১৮ সাল হতে ১৮টি সমান কিস্তিতে এই অর্থ ফেরর দিতে হবে। বাংলাদেশ কী ক্রয় করবে তা বাংলাদেশেই ঠিক করবে। ২০০৫ সালে বিএনপি সরকার ১১৭ মিলিয়ন ডলারে চীন হতে ১৬টি এফ-৭ যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছিল। এই মর্মে চুক্তি হয়েছিল ২৬ জুন। চুক্তি স্বাক্ষরের ত্রিশ দিন পর হতেই কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছিল।
সামরিক বাহিনীর জন্য সমরাস্ত্র ক্রয় করা হয় ডিজিডিপ বা সামরিক ক্রয় পরিদফতরের মাধ্যমে এবং তা করা হয় আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করে। এই ধরনের ক্রয় এমন নয় যে, প্রধানমন্ত্রী একটি বা দুটি দোকানে গিয়ে তার তালিকা ধরিয়ে দিয়ে ক্রয় সমাপ্ত করলেন। ক্রয়ের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পূর্বে অর্থ, আইন, পরারাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তা যাচাই-বাছাই করেন। কোন একটি মন্ত্রণালয় কোন প্রসঙ্গে আপত্তি তুললে তা নিষ্পত্তি করতে হয়। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময়ের প্রয়োজন হয়। যদিও সামরিক বাহিনীর জন্য একটি আদর্শ ক্রয়নীতি হওয়া উচিত ছিল খোলামেলা; কিন্তু বাস্তবে কোন দেশেই তা হয় না। বাংলাদেশে সব সময় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বটা সরকার-প্রধানের হাতে ছিল। ব্যতিক্রম ছিল শুধু বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে। তিনি এই মন্ত্রণালয়ের জন্য একজন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছিলেন, যিনি আবার পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে কিছুটা অভিযুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। সম্পাদিত অস্ত্র ক্রয় চুক্তিটি দুটি দেশের মধ্যে সরাসরি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ক্রয়ের চুক্তি। এই ক্রয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের কোন ভূমিকা নেই। এখানে কমিশন খাওয়ার তেমন কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। তারপরও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রাশিয়া হতে আটটি মিগ-২৯ ক্রয় নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল এবং সেই অভিযোগ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজনের নামে মামলা হয়েছিল। পরবর্তীকালে সেই দুর্নীতির কোন প্রমাণ মেলেনি। একই সময় কোরিয়া হতে নৌবাহিনীর জন্য একটি ফ্রিগেট ক্রয় করা হয়েছিল যার নামকরণ করা হয়েছিল বিএনএস বঙ্গবন্ধু। ২০০১ সালে বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে সেই ফ্রিগেটটি ডিকমিশন করে নামকরণ বাতিল করেছিলেন এবং সেই ক্রয়েও দুর্নীতির গন্ধ পেয়েছিলেন। বেগম জিয়ার শাসনকালের পুরো সময় ধরে সেই ফ্রিগেট চট্টগ্রাম নৌবাহিনী বন্দরে অলস পড়ে থাকতে থাকতে তার ওয়ারেন্টি পিরিয়ড শেষ করেছিল। এই ফ্রিগেটের বঙ্গবন্ধু নামকরণই তার কাল হয়েছিল। ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীকে আরও আধুনিকায়ন করা হবে তেমন প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করেছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের যে একটি আধুনিক সেনাবাহিনী নিজের আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজন তাই নয় বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের অবদান সবচাইতে বেশি। এই মুহূর্তে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে প্রায় ১০ হাজার সেনা ও পুলিশ বাহিনী কর্মরত আছেন। তারা বাংলাদেশের জন্য অনেক ক্ষেত্রে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণের বৈদেশিক অর্থ উপার্জন করেন। সুতরাং এই বাহিনীর আধুনিকায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। সম্প্রতি জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল আমিরা হক বাংলাদেশে এসে আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিকায়ন করার ব্যাপারে বেশ গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। আফ্রিকার সন্ত্রাসীরা বেশ আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। যখন বাংলাদেশের কোন সমরাস্ত্র জাতিসংঘ বাহিনীতে যায় তখন তার জন্য বাংলাদেশ ভাড়া পায়। যেমন একটি যুদ্ধ বিমান উড়লে তার প্রতি ঘণ্টা ভাড়া ২৫০০ ডলার। আনুমানকি তিন বছরে এই বিমানের মূল্য উঠে আসে আর বিমানটিও বাংলাদেশের থেকে যায়। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, কোন পর্যায়ে যেন এই সব ক্রয়ে কোন প্রকারের দুর্নীতি প্রবেশ করতে না পারে।
পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তবে সেই প্রশ্ন তোলাটা অমূলক নয়; যেহেতু এই ধরনের বিদ্যুত কেন্দ্রের সাথে জননিরাপত্তার প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের মতো একটি ঘন বসতিপূর্ণ দেশে বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে এই ধরনের বিদ্যুত কেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া আর সম্প্রতি জাপানে। এমন একটি দুর্ঘটনার ফলে রাশিয়ার চেরনোবিল শহরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হয়েছে। তবে এই সবগুলোই ছিল প্রথম প্রজন্মের পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র। বাংলাদেশের সাথে সম্প্রতি যে চুক্তিটি হয়েছে তা তৃতীয় প্রজন্মের বিদ্যুত কেন্দ্র। ষাট বছর মেয়াদি এই চুক্তির অধীনে নির্মাণ হতে শুরু করে পাঁচ স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টির সম্পূর্ণ গ্যারান্টি দিচ্ছে রাশিয়া। আশা করা যায় নিরাপত্তাজনিত সব বাধ্যবাধকতা মেনে এই বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপিত হলে বাংলাদেশে বিদ্যুত চাহিদার অনেকটা পূরণ হবে। এটিও মনে রাখতে হবে সারা বিশ্ব এখন বিকল্প জ্বালানি ও বিদ্যুত উৎপাদনের উপায় খুঁজতে ব্যস্ত। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কোন মুসলিম-প্রধান দেশে কেউ এখন পারমাণবিক প্রযুক্তি বিক্রয় করতে চায় না। রাশিয়া বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে তা বিক্রয় করতে রাজি হয়েছে।
শেখ হাসিনার রাশিয়া সফর বাংলাদেশের জন্য অনেকগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্বার খুলে দিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, উভয় সরকার কীভাবে এই সুযোগগুলোকে কাজে লাগায়। ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হলে তাকে এ রকম আরও অনেক দ্বারের অনুসন্ধান করতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক
১৯ জানুয়ারি, ২০১৩
No comments