ধ্বংসের দশক চলছে? by রাহাত খান
বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর এ্যালেন গোল্ডস্টেইনের মেয়াদ শেষ। দু’এক দিনের মধ্যে উত্তরসূরির কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তাঁর বাংলাদেশ ত্যাগ করার কথা।
যাওয়ার ঠিক আগে আগে, গত ১৯ জানুয়ারি একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি এমন একটি বক্তব্য দিয়ে গেলেন তা কূটনীতিসুলভ নয় বলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি নির্বিশেষে বহু লোক মন্তব্য করেছেন। অনেকের মতে এটা বিরক্তিকর। দুর্নীতি সব দেশে হয়, হচ্ছে। গোল্ডস্টেইনের নিজের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই ব্যাধি থেকে মুক্ত নয়। এবং সব মুক্ত ও গণতান্ত্রিক দেশেই জনগণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এটা খুব একটা নতুন কথা বলে গেলেন না গোল্ডস্টেইন।তিনি বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের রুখে দাঁড়ানো প্রশংসার দাবি রাখে। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নেয়ায়’ পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে গোল্ডস্টেইনের নাম আর ভূমিকা নাকি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে অপশাসন বা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ চিরকালই সোচ্চার। বাংলাদেশীদের এই ব্যাপারে সার্টিফিকেট দেয়ার প্রয়োজন ছিল না। এই মন্তব্য অযাচিত। অকূটনৈতিক। পদ্মা সেতু প্রকল্পে তিনি যে ভূমিকা রেখে গেছেন, সেটাও এখন পরিষ্কার। বিশ্বব্যাংকের চাকরিতে এসে কেউ একটা স্বাধীন দেশের সরকারের বিরুদ্ধে এ ধরনের আপত্তিকর বক্তব্য দেয় বলে আমার জানা নেই। গরিবের সুন্দরী বৌ গেরামের সব মানুষের ‘ভাওজ’, মানে ভাবী। বোধকরি সেই রকম একটা মনোভঙ্গি থেকেই কেউ কেউ একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের ভালো-মন্দের ব্যাপারে সার্টিফিকেট দিতে সাহস পান।
পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এটা দুদকও তাদের প্রতিবেদনে স্বীকার করেছে। সরকার এই রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করেনি, বরং স্বীকার করে নিয়েছে। তদন্তে হয়ত আরও কিছু অপূর্ণতা রয়ে গেছে। দুদক এ ব্যাপারে কাজ করছে। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী এবং সাবেক এক উপদেষ্টা বহু নাটকীয় ঘটনা ঘটিয়েছেন। এই দুই ব্যক্তি যে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অগ্রগতিতে বিঘœ সৃষ্টি করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সরকারকেও কিছুটা বিতর্কিত করেছেনÑএই ব্যাপারেও বোধকরি সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে আমি বলব, পদ্মা সেতু প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি নাটকীয় ভূমিকা বিশ্বব্যাংকের। বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের অর্থায়নে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ বলতে প্রায় দু’বছর সময়ক্ষেপণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হালফিল যা প্রধান প্রায়োরিটি সেই জঙ্গী-সন্ত্রাস দমনে যে দেশ শতকরা ৯৯ ভাগ সাফল্য দেখাতে পেরেছে, বিশ্বব্যাপী বিরাজমান মহামন্দার চরম দুঃসময়েও অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বিশাল সাফল্য অর্জন করেছে, বাংলাদেশের সেই সরকারকে বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে কেন হেনস্থা করা হচ্ছে তা বোঝা কঠিন।
মহাজোট সরকারের বিকল্প বিএনপি-জামায়াত জোট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোন বিকল্পটি বেছে নেবে, সেটাই দেখার বিষয়। রাজনৈতিক দুই জোটের পাল্টা আর একটি বিকল্প আছে তৃতীয় শক্তি। তবে এ ধরনের তৃতীয় শক্তি বেশিদিন টেকে না। সর্বমুখীন রাজনৈতিক আন্দোলনের মুখে এ ধরনের শেকড়হীন তৃতীয় শক্তিকে খুব দ্রুতই অত্যন্ত অপমানজনকভাবে বিদায় নিতে হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ওপর একটি রাজনৈতিক ও আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে একটি ধাঁধা সৃষ্টি করা হয়েছে। আশা করি দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশে কোন জঙ্গী-সন্ত্রাসী জোটকে ক্ষমতায় দেখতে চাইবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের লাগোয়া একটি দেশে দ্বিতীয় পাকিস্তান দেখার ইচ্ছাও তাদের না থাকারই কথা।
আমার আলোচনা থেকে মনে হতে পারে সাধারণ নির্বাচন ধরে বাইরের শক্তি বুঝি বা কোন দেশে নিজেদের পছন্দসই সরকার ক্ষমতায় বসাতে পারে। না, সাধারণভাবে সেটা সম্ভবপর নয়। কোন্ দল বা জোট দেশের শাসন ক্ষমতায় যাবে তা সাধারণ নির্বাচনে নির্ধারণ করবে দেশের জনগণই। তবে বাইরের শক্তি কিংবা দেশের প্রচার মিডিয়া এই ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী কান্ট্রি ডিরেক্টর এ্যালেন গোল্ডস্টেইন তাঁর বক্তব্যে কি যে বুঝাতে চেয়েছেন সেটা ভাবার বিষয়।
থাক এ্যালেন গোল্ডস্টেইনের প্রসঙ্গ। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার গত চার বছরে সফল না ব্যর্থ সেটা পরিষ্কার হওয়াটাই জরুরী। বিএনপির নেতা বেগম খালেদা জিয়ার মতে, বর্তমান মহাজোট সরকার পদে পদে ব্যর্থ। ড. কামাল হোসেন প্রমুখ নেতা মনে করেন, দেশে এখন ধ্বংসের যুগ চলছে। কয়েকটি মিডিয়ার প্রায় প্রতিদিনকার প্রচারণা থেকেও মনে হতে পারে দেশের বারোটা বুঝি বেজে গেছে। এ দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে শুধু উনি এবং তৃতীয় শক্তির সমর্থক সুশীল সমাজের লোকেরা বাঁচিয়ে দিতে পারে।
উনি কে? এ প্রশ্নের উত্তর আমি যেমন জানি তেমনি আপনারাও ভালভাবে জানেন। সুতরাং উনার নাম-পরিচয় উহ্য থাকাই শ্রেয়। উনি নাকি খুব বেশিদিন না, মাত্র দশ বছর ক্ষমতায় থাকতে ইচ্ছুক। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করে ছাড়বেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে সুশাসন ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবেন। দেশের মানুষ শুধু ‘মৎস্য ধরিবে এবং মহাসুখে খাইবে।’
উচ্চাশা উচ্চাকাক্সক্ষা থাকা ভাল। তবে সীমা লঙ্ঘন করলেই বিপদ। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে থাকে নানা সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা। ইচ্ছে করলেই সময়ের পুষ্টি খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হওয়া দুর্নীতি এক বছরে, দু’বছরে, চার বছরে দূর করা যায় না। দুর্নীতি রোধে প্রয়োজন প্রযুক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণের অনাচার থেকে মুক্ত করা। প্রয়োজন মূল্যবোধের শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করা।
এসবের কোনটাই স্বল্প-মেয়াদে সম্ভব নয়। এছাড়া দেশের রাজনৈতিক শক্তিসমূহের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে অত্যন্ত কলুষিত। বিরোধিতার জন্য তারা বিরোধিতা করে। দেশ শাসনে জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে তারা বোঝে সব পেয়ে যাওয়া। রাজনীতির এই দূষিত সংস্কৃতি দূর করা কোন তৃতীয় শক্তির কাজ নয়। পেছনকার খুঁটির জোরে ক্ষমতায় আসা তৃতীয় শক্তির এ যাবতকালের সব গল্পই ব্যর্থতার। এই দূষিত সংস্কৃতি বদলে দেয়ার ভার বর্তায় রাজনীতিকদের ওপরই। সংসদে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের নিয়মিত অংশগ্রহণ, জাতীয় ইস্যুতে একে অন্যের সাহায্যে আসা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণের হাত থেকে রক্ষা করা ইত্যাকার কর্মধারাই ধীরক্রমে হলেও সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে।
এই ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশ বাংলাদেশে আছে বলাটা যেমন আংশিক সত্য তেমনি নেই বললেও সুইপিং কমেন্ট বা ঢালাও বক্তব্য হয়ে যায়। বর্তমান সরকারের আমলে রাজনীতিতে একটা জরুরী বিধানের অন্তত আংশিক বাস্তবায়ন ঘটেছে। সেটা হলো দল বা সরকারের লোকজন আইন ভঙ্গ করলেও বহুক্ষেত্রে এই আইন ভঙ্গের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে। আগের বিএনপি কিংবা বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে সেটা কিন্তু প্রায় একেবারেই নেয়া হয়নি। জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়ার আমলে কোন রাজনৈতিক হত্যাকা-ের বিচার হয়নি বরং হত্যাকারীদের বাঁচাতে কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন প্রণীত হয়েছে, হত্যাকারীদের নানাভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে, রাজনৈতিক খুনের মামলা অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান ইত্যকার ঘটনার জন্য হওয়া মামলাগুলো ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে।
বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে রাজনৈতিক অপশাসন একেবারে হয়নি, এমন নয়। তবে সত্যের খাতিরে স্বীকার করতে হয় এক্ষেত্রে বেশ কিছুটা আইনের প্রয়োগও চালু হয়েছে। আত্মস্বীকৃত খুনীর বিচার চায় বিরোধী দল। আমরা দেশের আপামর জনগণও তা চাই। তবে আত্মস্বীকৃত খুনীদের রক্ষা করতে যারা ‘আইন’ প্রণয়ন করেছিল, আত্মস্বীকৃত খুনীদের যারা নানাভাবে পুরস্কৃত করেছিল, রাজনৈতিক হত্যাকা- এবং জঙ্গী সন্ত্রাসীদের সযতেœ লালন-পান করে দেশটাকে প্রায় দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করতে যারা সচেষ্ট ছিল আমরা সে সব অপকর্মের ও পাশবিকতা আর হিংস্রতার হোতাদের বিচার চাই। এক যাত্রায় তো পৃথক ফল হয় না।
বেগম জিয়া মনে করেন এবং বলেন দেশটা দুর্নীতির পঙ্কে ডুবে গেছে। তা সাবেক প্রধানমন্ত্রী তো নিজের অসদুপায়ে অর্জিত কালো টাকা দ- দিয়ে সাদা করেছিলেন। এটা কি তাঁর এবং তাঁর শাসনামলের সুনীতির কোন নিদর্শন ছিল? আর হাওয়া ভবন? হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা? এসব কি খুব দুর্নীতিবিরোধী সৎ কর্ম ছিল।
বেগম জিয়া এবং ড. কামাল প্রমুখ ব্যক্তি যা-ই বলুন, কিছু কিছু ব্যর্থতা সত্ত্বেও বর্তমান মহাজোট সরকারের অর্জিত সাফল্য বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। বিরোধী দল বা ব্যর্থ রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন যা-ই বলুন বর্তমান মহাজোট সরকারের নানা ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্য বিশ্বের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই তো ১৯ জানুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজেনা বর্তমান বাংলাদেশের নানা উন্নয়ন সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন : বাংলাদেশ বাস্তবেই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ন্যায় শক্তিধর হয়ে উঠছে দিন দিন।
দেশে ধ্বংসের দশক চলছে না। বরং রাজনীতির অপশক্তি নানা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে বাংলাদেশে আবার ধ্বংসের যুগ ফিরিয়ে আনতে চাইছে। এটাই নিরেট সত্যি কথা।
No comments