মেসির সাফল্যে মোড়ানো বছর by জাহিদুল আলম জয়
কালের গর্ভে বিলীন হতে চলেছে আরও একটি ইংরেজী বছর। বছরের দিনলিপি ফুরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই আলোচনায় ওঠে আসছে বছরের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ। এক্ষেত্রে দেশীয় ও বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি, তথ্যপ্রযুক্তি, বিনোদন প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে আলোচনায় ওঠে আসছে ক্রীড়াঙ্গনও।
২০১২ সালে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন আলোচনায় থেকেছে প্রায় সব সময়। এ বছরই অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় আসর অলিম্পিক গেমস। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছে ব্রাজিলের ক্লাব করিন্থিয়ান্স। ইউরোপসেরা হয়েছে ইংলিশ ক্লাব চেলসি। অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর গোললাইন প্রযুক্তিরও পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু করেছে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা (ফিফা)। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে স্পেন ফুটবল দলের ঐতিহাসিক ট্রেবল জয় ও লিওনেল মেসির গোলের গৌরবময় রেকর্ড। বছরের শেষভাগে এসে এ দু’টি অর্জনকেই বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে এগিয়ে রাখা হচ্ছে। একটা সময় ছিল ফুটবলে সমর্থন মানেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। ইতালি, জার্মানিসহ অন্যান্য দেশের সমর্থক থাকলেও তা যেন হাতেগোনা! শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা ফুটবলবিশ্বেই এ চিত্র দেখা গেছে। কিন্তু স্পেন ২০০৮ ইউরো ও ২০১০ বিশ্বকাপ জয়ের পর এ চিত্র পাল্টাতে থাকে। আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের ধারাবাহিক ব্যর্থতা ও স্পেনের অনিন্দ্য সুন্দর ফুটবলের কারণে নতুন প্রজন্ম স্পেনকে সমর্থন করতে থাকে। গত জুলাইয়ে ইউরো জয়ের পর স্প্যানিশদের সমর্থনের পালে ঢেউ যে আরও বাড়বে তা বলাই বাহুল্য। ২০১২ ইউরো ফুটবলের ফাইনালে ইতালিকে নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলায় মেতে উঠেছিলেন স্পেনের ফুটবলাররা। গত ২ জুলাই ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে ইউরোপিয়ান ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের আসরের ফাইনালে স্পেনের কাছে হার মানে ইতালি। স্পেনের শৈল্পিক, ছন্দময় পাসিং ফুটবলের কাছে রীতিমতো অসহায় আত্মসমর্পণ করে আজ্জুরিরা। একপেশে ফাইনালে ইতালিকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে ইউরো শিরোপা ধরে রাখতে সক্ষম হয় স্পেন। যে পাসিং ফুটবল নিয়ে সমালোচনার ঢেউ উঠেছিল সেটা দিয়েই সমালোচকদের জবান বন্ধ করে দেন ভিসেন্তে দেল বস্কের শিষ্যরা। অপ্রতিরোধ্য জয়ে ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে ঐতিহাসিক ‘ট্রেবল’ জয়ের কৃতিত্ব দেখায় ইকার ক্যাসিয়াসের দল। অর্থাৎ ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো জয়ী বিশ্বের একমাত্র দল এখন স্পেন। সেই সঙ্গে ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে টানা দুটি ইউরো জয়েরও রেকর্ড গড়ে স্প্যানিশরা। পাশাপাশি ইউরোর সর্বোচ্চ শিরোপা জয়ে (তিনবার) জার্মানির রেকর্ডেও ভাগ বসায়। চার গোলের ব্যবধানে জয় ইউরো কিংবা বিশ্বকাপের ফাইনালের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যবধানে জয়ের রেকর্ড। গৌরবময় রেকর্ড অর্জনের ম্যাচে অনন্য মাইলফলক স্পর্শ করেন স্পেন অধিনায়ক ইকার ক্যাসিয়াস। ট্রফি জয়ের ম্যাচে ইতিহাসের প্রথম ফুটবলার হিসেবে শততম আন্তর্জাতিক ম্যাচ জয়ের কৃতিত্ব দেখান রিয়াল মাদ্রিদ সেনাপতি। চলতি বছরটা বার্সিলোনা তারকা লিওনেল মেসির জন্য সোনায় সোহাগা। প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া মেসি এবার নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছেন অনন্য উচ্চতায়। বছরের শুরুতেই ফিফা ব্যালন ডি’র জয় করে বিশ্বরেকর্ড গড়েন। যা টানা তিনবার বর্ষসেরা হওয়ার প্রথম রেকর্ড। আর্জেন্টাইন অধিনায়ক সম্প্রতি এক বছরে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়েছেন। ১৯৭২ সালে পশ্চিম জার্মানি ও বেয়ার্ন মিউনিখের হয়ে গার্ড মুলার করেছিলেন রেকর্ড ৮৫ গোল। ডিসেম্বরে এ রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন টানা তিনবারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার। গত ২২ ডিসেম্বর ভ্যালাডোলিডের বিরুদ্ধে লা লীগায় এক গোল করে ২০১২ সাল শেষ করেছেন মেসি। এই গোলের মধ্য দিয়ে মেসি বছর শেষ করেছেন ৯১ গোল করে। তবে মুলারকে অতিক্রম করার পর মেসির রেকর্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এতদিন মুলারের ৮৫ গোলকেই এক বছরে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড বলে ধরা হতো। কিন্তু মেসি ভক্তদের জন্য দুঃসংবাদ, ফিফা থেকে এর কোনো স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। ফিফা বলেছে, আন্তর্জাতিক ম্যাচ ছাড়া কোনো দেশের ঘরোয়া ফুটবলের রেকর্ড তাদের সংরক্ষণে নেই। তাই কে এ ধরনের রেকর্ড গড়ল তাতে তাদের মাথাব্যথা নেই। ক’দিন আগে ফিফা বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছে। ফিফার যেখানে স্বীকৃতি নেই সেখানে মেসির রেকর্ড থাকছে না বলে মানছেন অনেকে। কেননা মেসির চেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ড আছে জাম্বিয়ার গডফ্রে চিতালুর। তিনি এক বছরে গোল করেন ১০৭টি। তবে সব পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়ে গেছেন ফুটবল কিংবদন্তি পেলে। শুধু ব্রাজিলিয়ান লীগেই দু-দু’বার একশ’র বেশি গোল করেছেন তিনি। সান্তোস, ব্রাজিল ও অন্যান্য মিলিয়ে ১৯৫৯ সালে পেলে করেছেন ১২৭ গোল। আর ১৯৬১ সালে সান্তোসের হয়ে করেছিলেন ১১০ গোল। পেলের এ রেকর্ড অবশ্য ফিফাও জেনেছে। এরপরই ফিফা জানিয়ে দিয়েছে, মেসির রেকর্ডকে তারা স্বীকৃতি দিতে পারছে না। ফিফার মুখপাত্র অ্যালেক্স স্টোন বলেন, মেসির রেকর্ডের কথাটা আসলে মিডিয়ার বানানো। আর সব ক্লাবের তথ্য সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব নয়। তাই মেসির রেকর্ডেরও স্বীকৃতি দিতে পারছে না ফিফা। এক বছরে সর্বোচ্চ গোলের স্বীকৃতি থাক বা না থাক ২০১২ সালে মেসি যে রেকর্ডের বরবাল্য গড়েছেন তা এককথায় অনবদ্য। একগাদা গোলের গৌরববয় রেকর্ড গড়ে বছরটাকে একান্তই নিজের করে নিয়েছেন ক্ষুদে জাদুকর লিওনেল মেসি। রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়া মেসি ২০১১-১২ মৌসুমে বার্সিলোনার হয়ে ৭৩ গোল করে এক মৌসুমে ইউরোপিয়ান ক্লাব মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়েছিলেন। ভেঙ্গে দিয়েছিলেন ১৯৭২-৭৩ মৌসুমে গার্ড মুলারের ৬৭ গোলের রেকর্ড। গত হতে যাওয়া বছরে মুলারের আরও একটি গৌরবময় রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন মেসি। রেকর্ডের সঙ্গে যার নিত্য বসবাস তার রেকর্ড নিয়ে মাতামাতির কি আছে! সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রেকর্ড আর নিজের নামটি যেন সমার্থকে পরিণত করেছেন; খেলছেন রেকর্ড ভাঙ্গাগড়ার খেলা। এর মধ্যে গত মৌসুমে সবচেয়ে বেশি রেকর্ডের দখলদারিত্ব নিয়েছেন। মূলত গোলের গৌরবময় রেকর্ডই ঝুলিতে ভরছেন। ধারাবাহিকতা ধরে রেখে চলতি মৌসুমেও এগিয়ে চলেছেন দুর্দান্ত গতিতে। ইতোমধ্যে সঙ্গী হয়েছেন আরও কয়েকটি রেকর্ডের। নবেম্বর মাসে ফুটবলের রাজা পেলের এক বছরের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ভেঙ্গেছেন। তখন থেকেই আরও একটি গৌরবময় রেকর্ডের অপেক্ষা শুরু। মাঝখানে অপ্রত্যাশিত ইনজুরিতে সম্ভাবনার দোয়ারে কালো মেঘ ভর করেছিল। সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় ছিলেন দুনিয়াজুড়ে তাঁর ভক্ত, সমর্থক, শুভাকাক্সক্ষীরা। কিন্তু না, নিজেকে কিংবা ভক্তদের অপেক্ষায় রাখেননি।
No comments