স্মরণ- গ্রন্থ নির্মাণের কারিগর by আবুল আহসান চৌধুরী
আজ ২৬ ডিসেম্বর প্রকাশনা সংস্থা ‘মুক্তধারা’র প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহার মৃত্যুদিন। পাঁচ বছর আগে এই দিনে তাঁকে আমরা হারিয়েছি। হারিয়েছি বাংলাদেশের গ্রন্থ প্রকাশনা ও গ্রন্থ আন্দোলনের এক অগ্রনায়ককে।
চিত্তরঞ্জন সাহাকে যত দূর মনে পড়ে, প্রথম দেখি বাংলা একাডেমীতে—ঘাসের গালিচায় চট বিছিয়ে বই বিক্রির সময়। দেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। তাঁর নামের সঙ্গে পরিচয় ছিল ‘পুঁথিঘর’-এর সৌজন্যে। আর বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতার অ্যান্টনিবাগান লেন থেকে ‘মুক্তধারা’ নাম দিয়ে বই প্রকাশের সূত্রে। মুক্তধারা নামটির নিচে বন্ধনীর মধ্যে লেখা থাকত: ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’। ১৯৭৪-এ বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন। এই অনুষ্ঠানে প্রথম বইয়ের স্টল দেয় মুক্তধারা, এককভাবে। এর মূলে ছিল চিত্তরঞ্জন সাহার পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় জহরলাল সাহার ওপর।
এর বেশ পরে আশির দশকের প্রথম দিকে তাঁর সঙ্গে সরাসরি আলাপ হয়। তিনি তখন জেলায় জেলায় মুক্তধারার বইমেলার আয়োজন শুরু করেছেন। আমাদের দেখা-সাক্ষাতের একটা স্থায়ী জায়গা ছিল কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরি। আমি তখন এই লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক। একদিন সন্ধ্যায় আমার হাতে একটি প্ল্যাকার্ড তুলে দেন। তাতে সাদা কাগজের ওপর গোটা গোটা হরফে লাল কালিতে লেখা: ‘হাতের অস্ত্র ফেলে দাও/ আবার বই তুলে নাও’। লেখাগুলো কালের নিয়মে বিবর্ণ হয়ে গেলেও এখনো সেটি লাইব্রেরিতে আছে। এভাবে ধীরে ধীরে চিত্তরঞ্জন সাহার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয় এবং তাঁর আন্তরিক প্রীতি-ভালোবাসায় সিক্ত হই।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই কুষ্টিয়া শহরে আমাদের নিয়মিত আড্ডার জায়গা ছিল কল্যাণ মিত্রের সাইনবোর্ড লেখার ‘চিত্রণ’ নামের দোকানটি। কল্যাণ মিত্র ছিলেন ষাটের দশকের নামকরা নাট্যকার। পরে তাঁর নাম আরও ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবাহিক প্রচারিত তাঁর জল্লাদের দরবার নামের নাট্যনকশার কারণে। ১৯৭২-এ নাট্যসাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কারও পান তিনি। তাঁকে দিয়ে লালন ফকির নামে একটি নাটক লেখাই। আমার অনুরোধে নাটকটি চিত্তরঞ্জন সাহা ছাপেন। ঢাকায় গিয়ে কল্যাণ মিত্রের পক্ষে আমাকেই চুক্তি সই-স্বাক্ষর করতে হয়। সদরঘাটের কাছে ৭৪ ফরাশগঞ্জে একটি বনেদি পুরোনো বাড়িতে চিত্তদা তখন থাকতেন। মুক্তধারার অফিসও ছিল সেখানে।
চিত্তদা ছিলেন ব্যতিক্রম। শুধু ব্যতিক্রম বললে কম বলা হয়, বিরল ব্যতিক্রম। স্বতন্ত্র ছিলেন আরেক কারণেও। আমার জানা নেই কজন প্রকাশক লেখকের সঙ্গে বই প্রকাশের চুক্তি করেন। প্রকাশকের কাছ থেকে অনেক নামীদামি লেখকও প্রাপ্য সম্মানী পান না, এমনকি কোনো কোনো সময় কানাকড়িও জোটে না, বই বেরোলে কখানা বই হাতে গুঁজে দিয়ে নগদ-বিদায় করেন।
চিত্তদা বইয়ের খবর নামে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা বের করেছিলেন। সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হতো বিজলীপ্রভা সাহার আর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এরপর বের হয় সাহিত্যপত্র নামে আরেকটি পত্রিকা। যা হোক, বইয়ের খবর খুব উঁচুমানের পত্রিকা হিসেবে অল্প দিনেই স্বীকৃতি পেয়েছিল। জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ এনামুল হক ও আবুল ফজলের প্রয়াণে বইয়ের খবর-এর আলাদাভাবে যে তিনটি স্মরণসংখ্যা বেরিয়েছিল, তা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। কী বই কী পত্রিকা প্রকাশ—সব ক্ষেত্রেই চিত্তদার একটা আলাদা রকমের দৃষ্টিভঙ্গি ও রুচি ছিল। যেকোনো বইয়ের ছাপা-বাঁধাই-প্রচ্ছদ-দাম—এসব বিষয়ে খুব নজর রাখতেন। কলকাতার লেখকদের বই বাংলাদেশে চুরি করে ছাপা হতো, এখনো হয়। চিত্তদা এই অসাধু প্রবণতা বন্ধের জন্য চুক্তি করে ভারতীয় লেখকদের বই ছেপেছেন—অন্নদাশঙ্কর রায়, গোপাল হালদার, মৈত্রেয়ী দেবী, গজেন্দ্রকুমার মিত্রের। আর সালতামামিতে হিসাব করে লেখকের প্রাপ্য কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে দেওয়ার মানুষ চিত্তদা ছাড়া আর কে ছিলেন, আর কেই বা আছেন!
চিত্তরঞ্জন সাহা ছিলেন শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির উদার পৃষ্ঠপোষক, নীরবে কত লেখক-শিল্পীকে তাঁদের দুঃসময়ে বা প্রয়োজনের মুহূর্তে সহায়তা করেছেন, তার সাক্ষ্য নিশ্চয়ই সৎ-বিবেকী উপকৃতরা দেবেন। উদার মন ও মতের মানুষ ছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার অনুসারী। তাই দেশের দুর্দিনে মুক্তিযুদ্ধের কালে মুক্তধারা নামে প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে তিনি এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। পারিবারিক পরিমণ্ডলে তাঁর ‘হয়ে ওঠার’ পেছনে, সব কর্মকাণ্ডে স্ত্রী বিজলীপ্রভা সাহা এবং পরমাত্মীয় জহরলাল সাহার সমর্থন ও সহায়তা তাঁকে শুধু ভারমুক্তই করেনি, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণাও জুগিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পে তাঁর যে অবদান, মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁর যে ভূমিকা, তার জন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ এবং ‘জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র স্বর্ণপদক’ পান। বাংলা একাডেমী ‘চিত্তরঞ্জন সাহা পুরস্কার’ প্রবর্তন করে যোগ্য কাজ করেছে। আজ এই অবক্ষয়ের কালে মানুষকে গ্রন্থমনস্ক ও গ্রন্থপ্রেমী করে তোলার জন্য চিত্তরঞ্জন সাহার মতো মানুষের খুব প্রয়োজন।
চিত্তরঞ্জন সাহা দুই সন্তান রেখে গেছে। একজনের নাম ‘মুক্তধারা’, অপরজন ‘পুঁথিঘর’। এদের মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন। এদের বিকশিত হওয়ার মধ্য দিয়েই তাঁর নাম সবার মনে পড়বে, তাঁর স্মৃতি জেগে থাকবে।
আবুল আহসান চৌধুরী
এর বেশ পরে আশির দশকের প্রথম দিকে তাঁর সঙ্গে সরাসরি আলাপ হয়। তিনি তখন জেলায় জেলায় মুক্তধারার বইমেলার আয়োজন শুরু করেছেন। আমাদের দেখা-সাক্ষাতের একটা স্থায়ী জায়গা ছিল কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরি। আমি তখন এই লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক। একদিন সন্ধ্যায় আমার হাতে একটি প্ল্যাকার্ড তুলে দেন। তাতে সাদা কাগজের ওপর গোটা গোটা হরফে লাল কালিতে লেখা: ‘হাতের অস্ত্র ফেলে দাও/ আবার বই তুলে নাও’। লেখাগুলো কালের নিয়মে বিবর্ণ হয়ে গেলেও এখনো সেটি লাইব্রেরিতে আছে। এভাবে ধীরে ধীরে চিত্তরঞ্জন সাহার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয় এবং তাঁর আন্তরিক প্রীতি-ভালোবাসায় সিক্ত হই।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই কুষ্টিয়া শহরে আমাদের নিয়মিত আড্ডার জায়গা ছিল কল্যাণ মিত্রের সাইনবোর্ড লেখার ‘চিত্রণ’ নামের দোকানটি। কল্যাণ মিত্র ছিলেন ষাটের দশকের নামকরা নাট্যকার। পরে তাঁর নাম আরও ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবাহিক প্রচারিত তাঁর জল্লাদের দরবার নামের নাট্যনকশার কারণে। ১৯৭২-এ নাট্যসাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কারও পান তিনি। তাঁকে দিয়ে লালন ফকির নামে একটি নাটক লেখাই। আমার অনুরোধে নাটকটি চিত্তরঞ্জন সাহা ছাপেন। ঢাকায় গিয়ে কল্যাণ মিত্রের পক্ষে আমাকেই চুক্তি সই-স্বাক্ষর করতে হয়। সদরঘাটের কাছে ৭৪ ফরাশগঞ্জে একটি বনেদি পুরোনো বাড়িতে চিত্তদা তখন থাকতেন। মুক্তধারার অফিসও ছিল সেখানে।
চিত্তদা ছিলেন ব্যতিক্রম। শুধু ব্যতিক্রম বললে কম বলা হয়, বিরল ব্যতিক্রম। স্বতন্ত্র ছিলেন আরেক কারণেও। আমার জানা নেই কজন প্রকাশক লেখকের সঙ্গে বই প্রকাশের চুক্তি করেন। প্রকাশকের কাছ থেকে অনেক নামীদামি লেখকও প্রাপ্য সম্মানী পান না, এমনকি কোনো কোনো সময় কানাকড়িও জোটে না, বই বেরোলে কখানা বই হাতে গুঁজে দিয়ে নগদ-বিদায় করেন।
চিত্তদা বইয়ের খবর নামে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা বের করেছিলেন। সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হতো বিজলীপ্রভা সাহার আর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এরপর বের হয় সাহিত্যপত্র নামে আরেকটি পত্রিকা। যা হোক, বইয়ের খবর খুব উঁচুমানের পত্রিকা হিসেবে অল্প দিনেই স্বীকৃতি পেয়েছিল। জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ এনামুল হক ও আবুল ফজলের প্রয়াণে বইয়ের খবর-এর আলাদাভাবে যে তিনটি স্মরণসংখ্যা বেরিয়েছিল, তা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। কী বই কী পত্রিকা প্রকাশ—সব ক্ষেত্রেই চিত্তদার একটা আলাদা রকমের দৃষ্টিভঙ্গি ও রুচি ছিল। যেকোনো বইয়ের ছাপা-বাঁধাই-প্রচ্ছদ-দাম—এসব বিষয়ে খুব নজর রাখতেন। কলকাতার লেখকদের বই বাংলাদেশে চুরি করে ছাপা হতো, এখনো হয়। চিত্তদা এই অসাধু প্রবণতা বন্ধের জন্য চুক্তি করে ভারতীয় লেখকদের বই ছেপেছেন—অন্নদাশঙ্কর রায়, গোপাল হালদার, মৈত্রেয়ী দেবী, গজেন্দ্রকুমার মিত্রের। আর সালতামামিতে হিসাব করে লেখকের প্রাপ্য কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে দেওয়ার মানুষ চিত্তদা ছাড়া আর কে ছিলেন, আর কেই বা আছেন!
চিত্তরঞ্জন সাহা ছিলেন শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির উদার পৃষ্ঠপোষক, নীরবে কত লেখক-শিল্পীকে তাঁদের দুঃসময়ে বা প্রয়োজনের মুহূর্তে সহায়তা করেছেন, তার সাক্ষ্য নিশ্চয়ই সৎ-বিবেকী উপকৃতরা দেবেন। উদার মন ও মতের মানুষ ছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার অনুসারী। তাই দেশের দুর্দিনে মুক্তিযুদ্ধের কালে মুক্তধারা নামে প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে তিনি এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। পারিবারিক পরিমণ্ডলে তাঁর ‘হয়ে ওঠার’ পেছনে, সব কর্মকাণ্ডে স্ত্রী বিজলীপ্রভা সাহা এবং পরমাত্মীয় জহরলাল সাহার সমর্থন ও সহায়তা তাঁকে শুধু ভারমুক্তই করেনি, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণাও জুগিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পে তাঁর যে অবদান, মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁর যে ভূমিকা, তার জন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ এবং ‘জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র স্বর্ণপদক’ পান। বাংলা একাডেমী ‘চিত্তরঞ্জন সাহা পুরস্কার’ প্রবর্তন করে যোগ্য কাজ করেছে। আজ এই অবক্ষয়ের কালে মানুষকে গ্রন্থমনস্ক ও গ্রন্থপ্রেমী করে তোলার জন্য চিত্তরঞ্জন সাহার মতো মানুষের খুব প্রয়োজন।
চিত্তরঞ্জন সাহা দুই সন্তান রেখে গেছে। একজনের নাম ‘মুক্তধারা’, অপরজন ‘পুঁথিঘর’। এদের মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন। এদের বিকশিত হওয়ার মধ্য দিয়েই তাঁর নাম সবার মনে পড়বে, তাঁর স্মৃতি জেগে থাকবে।
আবুল আহসান চৌধুরী
No comments