যিশুর জন্মতীর্থ- ও আমার প্রাণের শহর by ফারুক ওয়াসিফ

নিশ্চয়ই যিশু হলেন শ্রেষ্ঠ ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিন ভূমিতে এযাবৎ যত শিশু জন্মেছে, যিশু তাঁদের মধ্যে সর্বোত্তম। যে বনি ইসরায়েলি জাতির ত্রাতা হিসেবে যিশুর আবির্ভাব, তাদের বর্তমান প্রতিনিধি ফিলিস্তিনি মুসলিম ও খ্রিষ্টানরাই, জবরদখলকারী জায়নবাদীরা নয়।
ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ফরেনসিক প্রমাণ হাজির করে এ দাবিই তুলেছেন ইসরায়েলের তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক শোলমো স্যান্ড। তাঁর ইনভেনশন অব দ্য জুয়িশ পিপল নামে সাড়া জাগানো বইটি এরই দলিল।
যিশুখ্রিষ্ট সেই ফিলিস্তিনি ঘরেরই সন্তান। ২৫ ডিসেম্বর ক্রিসমাস দিবস ছিল তাঁর জন্মদিন। এই ক্রিসমাসে যদি মা মেরি যিশুকে জন্ম দিতে চাইতেন, তাহলে কি তিনি বেথলেহেমে প্রবেশ করতে পারতেন? খুব সম্ভব কোনো ইসরায়েলি তল্লাশি চৌকিতে আরও অনেক ফিলিস্তিনি নারীর মতো তাঁর মৃত্যু হতো। তাঁর স্বামী যোসেফকে গাধার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতে হতো বেথলেহেম শহর ঘিরে রাখা বর্ণবাদী দেয়ালের চারপাশে। দেয়ালগুলো ইসরায়েলের দম্ভ হিসেবে খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তক আর ইসলামের রাসুলের জন্মতীর্থকে লাঞ্ছিত করে চলেছে।
দুই হাজার ১২ বছর আগেকার কথা। মেরি ও যোসেফ তাঁদের শিশুপুত্রের ভূমিষ্ঠ হওয়ার নিরাপদ জায়গার খোঁজে এ শহরের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। ওদিকে ভবিষ্যদ্বাণী মেনে প্রাচ্যের তিন জ্ঞানী পুরুষও বহুদূর থেকে যাত্রা করেছিলেন। তাঁরা সেই মহামানবের জন্মের সাক্ষী হয়ে জীবনধন্য করবেন। দুই হাজার বছর ধরে সেই শুভ জন্ম স্মরণে সব ধর্মের তীর্থযাত্রীরা এ শহরপানে ছুটেছেন। এই মহামানবিক সর্বজনীন কাফেলার পথ আজ রুদ্ধ। যিশুখ্রিষ্টের জন্মশহর আজ ইসরায়েলি দেয়াল আর চেকপোস্টে অবরুদ্ধ। তাঁর জন্মস্থানের ওপর এক হাজার ৬০০ বছর আগের চার্চ অব ন্যাটিভিটির বিশাল ফাঁকা বুকজুড়ে দিনে দিনে বিরান হয়ে আসা শহরটির কান্না প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
যখন বিশ্বব্যাপী ক্রিসমাস উদ্যাপিত হচ্ছিল, তখন কি খ্রিষ্টান কি অখ্রিষ্টান—সবাই-ই এ ছোট্ট শহরের কথা মনে করেছিল। খ্রিষ্টানরা তাদের ক্রিসমাস ক্যারলে আর প্রার্থনায় এ শহরটিকে ধন্যবাদ জানায়। কিন্তু খোদ বেথলেহেমের মানুষের মনে আনন্দের মাঝেও দুঃখের কাঁটা খচখচ করেছে। বেথলেহেম শহরের বেইত জালা গির্জার ফাদার ইব্রাহিম শোমালি বড়দিনের আগে আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘যদি যিশুখ্রিষ্ট এ বছর আসতে চাইতেন, বেথলেহেম তাঁর জন্য বন্ধ থাকত, তাঁকে হয়তো জন্মাতে হতো কোনো ইসরায়েলি চেকপোস্টে, কিংবা ইসরায়েলি দেয়ালের বাইরে। মেরি ও যোসেফকে হয়তো ইসরায়েলিদের অনুমতি নিতে হতো।’ (দ্য গার্ডিয়ান, ২৪ ডিসেম্বর) বেথলেহেমের মাত্র ১৩ শতাংশ পড়েছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আওতায়। বাদবাকি ৮৭ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল। ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত বেথলেহেমে কোনো ভবন বানানো বা সংস্কার করা নিষেধ। তা সত্ত্বেও, মিরান্ডা নাসরি কাসাফেহ নামের এক খ্রিষ্টান নারী তাঁদের ১৫০ বছর পুরোনো পাথুরে বাড়িটায় নতুন লোহার ছাদ দেন, বাগানে লাগান বাদাম, খেজুর আর এস্কাদিনিয়া গাছ। কিন্তু বড়দিনের ১৩ দিন আগে ইসরায়েলি সেনারা আরও চার ফিলিস্তিনির বাড়ির সঙ্গে তাঁরটাও গুঁড়িয়ে দেয়। উপড়ে ফেলা হয় তাঁর সাধের বাগান। ঘটনার ধাক্কায় মিরান্দার বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। রাগে-দুঃখে মিরান্দা বড়দিন পালন স্থগিত করে দেন। ‘ইসরায়েলি কমান্ডার বলেছে, এখানে নাকি আমার কিছুই নেই। এটা নাকি আমার দেশ না। কিন্তু এখানেই আমরা বাঁচতে ও বাড়তে চাই। আমাদের তো আর কোনো উপায় নেই!’ মিরান্দার বড় ছেলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চায়। ‘আমি আমার ছেলেমেয়েদের মনে এই কথা বুনে যাচ্ছি যে, পৃথিবীর আর কোনো জায়গা এমন নয়। আমরা ছেড়ে যাব না।’
উত্তর বেথলেহেমে প্রতিষ্ঠিত ইসরায়েলি বসতি শহরটিকে তার ঐতিহাসিক যমজ জেরুজালেম থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। বাইবেলে কথিত যে তৃণভূমিতে ফেরেশতারা মেষপালকদের যিশুর জন্মসংবাদ শুনিয়েছিল, তার ওপর নির্মিত হয়েছে হার হোমা ইহুদি বসতি। জেরুজালেম ও বেথলেহেমের মধ্যকার এক চিলতে পথটা ধ্বংস করে নতুন আরেকটি বসতি নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। অবশেষে, ইউরোপীয় ইউনিয়নও হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ইসরায়েলকে এবার থামতে হবে। ইসরায়েলও জানিয়েছে, তারা কারও ধার ধারে না। এভাবে চারদিক থেকে বেথলেহেম ঘিরে দেয়াল আর জবরদখলি বসতি দিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে যিশুর জন্মস্থান। উদ্দেশ্য একটাই, ফিলিস্তিন যাতে কোনোভাবেই রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে না পায়।
বেথলেহেম আজ আর জ্ঞানী, ভ্রমণকারী বা তীর্থযাত্রীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় নয়। শহরটি ২৬ ফুট উঁচু কংক্রিটের দানবীয় দেয়ালের মধ্যে বন্দী। কেউ যদি এর মধ্যে ঢুকতে যায়, তাকে অবশ্যই দুই সেট এক্স-রে মেশিনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। যেতে হবে বন্দুকধারী, ক্যামেরা ও অন্যান্য হাইটেক যন্ত্রপাতি-সজ্জিত ভয় ধরানো করিডরের মধ্য দিয়ে। হ্যাঁ, এ সবকিছুই ইসরায়েল রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য, বিদেশি ও স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের এ শহরে প্রবেশে নিরস্ত করার জন্য।
ফিলিস্তিনে আগে থেকেই ক্রিসমাসে প্রচুর আনন্দ হয়। ফিলিস্তিনি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয়ই মনে করে, যিশু তাদের আপন মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই বেথলেহেম হয়ে ওঠে ক্রিসমাস উৎসব উদ্যাপনের কেন্দ্র। কিন্তু প্রতিবছর বেথলেহেমে ক্রিসমাস আসে বিষণ্ন থেকে আরও বিষণ্ন রূপে। এখন এটা এক মৃতপ্রায় শহর। একসময় পর্যটকদের রাজস্ব আয়ের জন্য শহরবাসী উন্মুখ হয়ে থাকত, এখন তা বন্ধ। শহরটির ১৮ শতাংশ কর্মক্ষম মানুষই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী। ২৩ শতাংশ বেকার। এর চেয়েও খারাপ হলো, হাজার হাজার বছরের পুরোনো আবাস ছেড়ে খ্রিষ্টানদের একে একে চলে যাওয়া। যারা পারছে তারাই দেশ ছাড়ছে। ফাদার শোমালির কথায়ও হতাশা, ‘চার্চের হাজিরা খাতার দিকে তাকাই আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি। পরিচিত অনেক পরিবার শহর ছেড়ে চলে গেছে। হয়তো ২০ বছর পরে যিশুখ্রিষ্টের জন্মস্থানে আর কোনো খ্রিষ্টান পাওয়া যাবে না।’
যিশুর জন্ম স্মরণে কোটি কোটি খ্রিষ্টান এবারও ক্রিসমাস ক্যারল গেয়েছে। আবার অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্যও স্লোগান দিচ্ছে লাখো-কোটি মানুষ। এই কোরাস আর সেই স্লোগান কি ত্রিধর্মীয় তীর্থ জেরুজালেম আর বেথলেহেমের জন্য এক হতে পারে না? এবার তা হয়েছিল। বড়দিনের মধ্যরাতে বেথলেহেমের ম্যানজার চত্বরে রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রধান ফুয়াদ তওয়ালের কণ্ঠে সেই ঐকতান ধ্বনিত হয়েছে। জমায়েতের উদ্দেশে তিনি বলেন, এবারের ক্রিসমাস বরণ হোক ‘খ্রিষ্টের আর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্মবরণ’। তাঁর পাশে ছিলেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। সারা পৃথিবী থেকে তো বটেই, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের বিভিন্ন শহর থেকে আসা সব ধর্মের তীর্থযাত্রীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্র পাওয়ার পথ এখনো অনেক দীর্ঘ, এবং তার জন্য আমাদের দরকার ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট।’ ফুয়াদ তওয়াল আর মাহমুদ আব্বাসের এই প্রার্থনাই এবারের বড়দিনের শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা।
গার্ডিয়ান, প্যালেস্টাইন ক্রনিকল ও বিবিসি অবলম্বনে
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.