আনন্দ-বেদনার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট by মোঃ এনামুল হাসান
শচীনের আলোচিত ওয়ানডে অবসর ॥ ২৩ ডিসেম্বর পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে টানা ২৩ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রানের মালিক শচীন টেন্ডুলকর। ডানহাতি এই ব্যাটসমস্যানকে বলা হয়, আধুনিক ক্রিকেটের সবচেয়ে পরিপূর্ণ ক্রিকেটার।
‘আমি ক্রিকেটের একদিনের ফরম্যাট থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিশ্বকাপজয়ী ভারতীয় দলে থাকার স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। ২০১৫ বিশ্বকাপে শিরোপা ধরে রাখার লড়াইয়ে প্রস্তুতি দ্রুত শুরু করা উচিত এবং এটা এখন থেকেই করা অত্যন্ত জরুরী। আগামী দিনে দলের সফলতা কামনা করছি আমি। বছরের পর বছর আমাকে শর্তহীনভাবে সমর্থন ও ভালবাসায় আমি আমার শুভাকাক্সক্ষীদের প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।’ অবসরের ঘোষণা দেয়ার সময় বলেন মাস্টার ব্যাটসম্যান।দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ৪৬৩টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন শচীন। গড়েছেন একের পর এক গৌরবময় রেকর্ড। ওয়ানডেতে তাঁর ১৮৪২৬ রান, ৪৯টি সেঞ্চুরি। দুটোই বিশ্বরেকর্ড। ওয়ানডে গড় ৪৪.৮৩। টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান ও সেঞ্চুরির মালিক শচীন বল হাতেও কম যাননি। ওয়ানডেতে শচীনের শিকার ১৫৪ উইকেট। সেরা বোলিং ৩২ রানে ৫ উইকেট। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯৮৯ সালে পাকিস্তান সফরে গুজরানওয়ালায় তৃতীয় সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে চিরশত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল শচীন টেন্ডুলকরের। নিজের অভিষেক ম্যাচে ওয়াকার ইউনুসের বলে শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন ক্ষুদে শচীন। নবম ওয়ানডেতে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম অর্ধশতক করলেও ৭৮ ওয়ানডে পর্যন্ত সেঞ্চুরি বঞ্চিত থাকতে হয়েছিল! ১৯৯৪ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে নিজের ৭৯তম ম্যাচে প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরির স্বাদ পেয়েছিলেন শচীন। সেই থেকে ক্রিকেটের বিস্ময় বালক গড়েছেন একের পর এক রেকর্ড। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া শচীন শেষ ওয়ানডে ম্যাচটিও খেলেছেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের বিরুদ্ধে। গত ১৮ মার্চ ঢাকার মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপ ক্রিকেটের ম্যাচ ছিল সেটি। ওই ম্যাচ হাফসেঞ্চুরি (৫২ রান) করে দলের জয়ে রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে ‘সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি’ করা একমাত্র ক্রিকেটার শচীন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নাম জড়িয়ে আছে শচীনের সঙ্গে। গত মার্চে এশিয়া কাপে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করে শতকের শতক করেছিলেন এ কালের ডন ব্র্যাডম্যান, যা শচীনের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৪৯তম ও শেষ ওয়ানডে শতক।
একদিনের ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো ডাবল সেঞ্চুরি করার কীর্তিগাথাও শচীনের। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গোয়ালিয়রে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অপরাজিত ২০০ রান করেছিলেন সাবেক ভারতীয় অধিনায়ক। তবে গত বছর শচীনের রেকর্ড ভেঙে ওয়ানডেতে ব্যক্তিগত রানের মালিক হন স্বদেশী বীরেন্দর শেবাগ। ২০০২ সালের উইজডেন এর একটি নিবন্ধে শচীনকে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা টেস্ট ক্রিকেটার বলে অভিহিত করা হয়। শচীন ১৯৯৭-১৯৯৮ সালের জন্য ভারতের খেলাধুলার সর্বোচ্চ পুরস্কার রাজীব গান্ধী খেলরতœ পুরস্কার এবং ১৯৯৯ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার অর্জন করেন। টেন্ডুলকর ১৯৯৭ সালে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটারও নির্বাচিত হন। চলতি বছর ভারতীয় রাজ্যসভার সদস্যও (মিনিস্ট্রি অব পার্লামেন্ট) হয়েছেন শচীন।
মুম্বাইয়ের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল জন্মগ্রহণকারী শচীনের নাম রাখা হয় বিখ্যাত সুরকার শচীন দেব বর্মণের নামানুসারে। ছোটবেলায় বড় ভাই অজিত ছিলেন তার কোচ। এরপর রামাকান্ত আর্চরেকারের হাত ধরে শচীনের এগিয়ে যাওয়া শুরু। ১৯৮৩ সালে ভারত বিশ্বকাপ জয়ের পর টেন্ডুলকর ১৯৮৬ সালে চেন্নাইয়ের এমআরএফ পেস বোলিং একাডেমীতে গতি দানব হওয়ার স্বপ্নে প্রশিক্ষণ নিতে যান। কিন্তু এমআরএফের তৎকালীন অসি কোচ ডেনিস লিলি তার উচ্চতা দেখে ফিরিয়ে দেন এবং বলেন ব্যাটিংয়ের প্রতি মনযোগী হও। এরপরই মূলত ব্যাটিংয়ে মনোনিবেশ করেন পুঁচকে ছেলে শচীন। যার ফল কি হয়েছে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্রিকেট ব্যাটিংয়ের সব গৌরবময় রেকর্ডই শচীনের পদতলে আছড়ে পড়েছে। যেদিকে দু’চোখ মেলে তাকানোর দুঃসাহস হয়ত কারও নেই! নিজের রেকর্ডকে সীমাহীন উচ্চতায় রেখে অবশেষে শচীন পথচলা শেষ করলেন ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে।
ওয়ানডেতে বিদায়বেলায় ফর্মহনীতার মাঝেও ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কলকাতা টেস্টে আরেক বিরল রেকর্ড গড়েন গ্রেট শচীন। তুলে নিলেন ক্যারিয়ারের ৬৬তম হাফ সেঞ্চুরি। আউট হওয়ার আগে ব্যক্তিগত ৭৬ রানের পথেও আরও এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেন ‘এ যুগের ডন।’ ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে ‘চৌত্রিশ হাজার’ রান সংগ্রহের অনন্য মাইলফলক সৃষ্টি করেন ব্যাট হাতে অসংখ্য রেকর্ডের স্রষ্টা। (কলকাতা টেস্টের প্রথম ইনিংস পর্যন্ত) টেস্টে তার মোট রান ১৫,৬৩৮। ওয়ানডেতে ১৮,৪২৬। টেস্ট ও ওয়ানডে দুই ভার্সন মিলিয়ে মোট ৩৪,০৬৪!! অবিশ্বাস্য বৈকি। খেলা চালিয়ে যাওয়াদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে থাকা জ্যাক ক্যালিস রান সংখ্যায় তার চেয়ে ১০ হাজারে পিছিয়ে। দুই ভার্সন মিলিয়ে প্রোটিয়া তারকার সংগ্রহ (১২,৯৮০+১১,৪৯৮) = ২৪,৪৭৮ রান। অবসরে যাওয়া ও বর্তমান খেলোয়াড়দের মধ্যে ক্যালিস আছেন চার নম্বরে। ২৭,০৮২ রান নিয়ে এ তালিকায় শচীনের পরের অবস্থানটি সদ্য অবসরে যাওয়া অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটিং তারকা রিকি পন্টিংয়ের। খেলা চালিয়ে যাওয়াদের মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থজন যথাক্রমে শ্রীলঙ্কার মাহেলা জয়াবর্ধনে (২১,৪৮৪) ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের শিবনারায়ণ চন্দরপল ( ১৯,৪৭৪)।
টেস্টে বছরজুড়ে ক্লার্কের দুরন্ত ব্যাটিং ॥ এডিলেডে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি (২৩০) হাকানোর পথে বেশ কিছু কীর্তির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক। এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে ৪টি ডাবল সেঞ্চুরির অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেন তিনি। ২০১২ সালের প্রথম মাস অর্থাৎ জানুয়ারির তৃতীয় দিনেই সিডনিতে সফরকারী ভারতের বিরুদ্ধে ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি হাকিয়েছিলেন। পরে ওই ইনিংসটাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরিতে। অপরাজিত ছিলেন ৩২৯ রানে। দুর্দান্ত এই ইনিংসের পর জানুয়ারিতেই ফের দ্বিশতক হাঁকান অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক। একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এডিলেড ওভালে খেলেন ২১০ রানের অনবদ্য ইনিংস। দশ মাসের ব্যবধানে এবারও ডাবল সেঞ্চুরির খেলায় মত্ত হন ক্লার্ক। ব্রিসবেনে প্রথম টেস্টে প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে করেন বছরের তৃতীয় ডাবল সেঞ্চুরি। হার না মানা ২৫৯ রানের ইনিংসটির পথে ‘বছরে তিন ডাবল সেঞ্চুরির ইনিংস’ খেলে ক্লার্ক স্পর্শ করেছিলেন দুই স্বদেশী স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ও রিকি পন্টিংকে। এডিলেডের ডাবল সেঞ্চুরিতে সাবেক দুই গ্রেটকেও ছাপিয়ে যান তিনি! অস্ট্রেলিয়া তো বটেই টেস্ট ক্রিকেটের দীর্ঘ ইতিহাসেও এক ক্যাল্ডোর বর্ষে চার ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানোর বিরল নজির স্থাপন করলেন নিউ সাউথ ওয়েলস হিরো।
পন্টিং, স্ট্রস, দ্রাবিড়, স্ট্রস, লক্ষণ বাউচারের অবসর ॥ ২২ নবেম্বর ঘরের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে এডিলেড টেস্টের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান সাবেক অসি অধিনায়ক রিকি পন্টিং। ১৯৭৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন পন্টিং। ১৯৯৫ সালের ৮ ডিসেম্বর শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে পার্থে তার টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। আর একই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তার একদিনের ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে ভেন্যুতে টেস্ট ক্রিকেটে পথচলা শুরু করেছিলেন, সেই ভেন্যুতেই ইতি টানছেন ক্যারিয়ারের। ১৬৮ টেস্ট ম্যাচে অংশগ্রহণ করে ১৩৩৭৮ রান করেছেন পন্টিং। গড় ৫২.২১। এর মধ্যে ৪১টি শতক ও ৬২টি অর্ধশতক। টেস্টে পন্টিংয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ২৫৭ রান। পাশাপাশি পন্টিং ৩৭৫টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলেছেন। একদিনের ক্রিকেটে তার মোট রান ১৩,৭০৪। বছরের আলোচিত অবসরের মধ্যে রয়েছে সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক এ্যান্ড্রু স্ট্রস, প্রোটিয়া উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান মার্ক বাউচার, ভারতের দুই টেস্ট স্পেশালিস্ট রাহুল দ্রাবিড় ও ভিভিএস লক্ষণের অবসর। আর ২৩ ডিসেম্বর ব্যাটিং গ্রেট শচীন টেন্ডুলকরের ওয়ানডে থেকে অবসর নেয়ার ঘটনাও ছিল তুমুল আলোচিত।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের টি২০ বিশ্বকাপ জয় ॥ ৭ অক্টোবর ফাইনালে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কাকে ৩৬ রানে হারিয়ে চতুর্থ টি২০ বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে ‘ক্রিকেটে সত্তরের দশকের’ পুনঃ উত্থান ঘোষণা করে ড্যারেন সামির ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সারা টুর্নামেন্টে ব্যাটিং ঝলক দেখিয়ে প্রায় একাই দলকে টেনে তোলায় ফাইনাল ঘিরে গেইল উন্মাদনার জ্বরে কেঁপে উঠে দুনিয়া। কিন্তু মূল মঞ্চের চূড়ান্ত লড়াইয়ে ক্লিক করেনি জ্যামাইকান হিরোর ব্যাট! যদিও আসরে আগগোড়া আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিলেন গেইল। ১৯৭৫ ও ’৭৯-এর ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর ২০০৪ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয় ছিল কোন বড় আসরে ক্যারিবীয়দের সর্বশেষ সাফল্য। ফাইনালে ব্যাট হাতে আসরে প্রথমবারের মতো ব্যাটিং দৈত্য গেইলের ব্যর্থতা সত্ত্বেও এগারো উইন্ডিজ সেনার চৌকস নৈপুণ্যে ‘ফাইনাল ট্র্যাজেডি’ বরণ করে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা! মারলন স্যামুয়েলসের ৫৬ বলে ৭৮ রানের ওপর ভর করে ১৩৭ রান সংগ্রহ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাবে সুনিল নারিনের স্পিন ঘূর্ণি ও ড্যারেন সামির পেস তোপের মুখে মাত্র ১০১ রানে অলআউট হয়ে যায় স্বাগতিক লঙ্কানরা। দুরন্ত এক জয় নিয়ে প্রথমবারের মতো টি২০ বিশ্বকাপ জয় করে ক্রিকেটে নিজেদের পুনরুত্থান ঘোষণা করে ক্যারিবীয়রা।
No comments