বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৬০৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহ, বীর উত্তম মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অনন্য কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহ (কে এম সফিউল্লাহ) ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন।
এর অবস্থান ছিল জয়দেবপুর রাজবাড়িতে। ২৮ মার্চ তিনি বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টর এবং পরে ‘এস’ ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অনন্য। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার চান্দুরায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক যুদ্ধে তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান। ষোলোই ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উপস্থিত ছিলেন। এখন জানা যাক তাঁর নিজ বয়ান (১৯৭৫) থেকে মুক্তিযুদ্ধের কিছু ঘটনা:
‘২৫ মার্চ রাত একটায় কর্নেল মাসুদুল হাসান খান (দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাবেক অধিনায়ক। ২৩ মার্চ তাঁকে ঢাকা সেনানিবাসে অ্যাটাচড করা হয়) ঢাকা থেকে টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করেন যে তোমাদের খবর কী? ঢাকাতে তো বেশ গোলাগুলি শুনছি। এই টেলিফোন পাবার পর ঢাকার সাথে সামরিক-বেসামরিক সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঢাকায় যে তখন কী হচ্ছিল, তার কোনো খবরই আমরা পাচ্ছিলাম না।
‘২৬ মার্চ সকালবেলায় ব্যাটালিয়নের কমান্ডার কর্নেল রকিবকে (কাজী আবদুর রকিব, তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল) বললাম যে গত রাতে যা কিছু ঘটেছে এবং চারদিকে যে সমস্ত গুজব রটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে একটা উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে। এ মুহূর্তে এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা উচিত।
‘২৭ মার্চ বিকেলের দিকে আমাদের একজন ড্রাইভার ঢাকা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়।...সন্ধ্যার দিকে আরও কিছু লোক ঢাকা থেকে আসে। তাঁদের মুখে শুনতে পাই ঢাকাতে বেশ হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এর আগে ড্রাইভার ছাড়া আর কারও কাছে কিছু শুনতে পাইনি।
‘২৮ মার্চ ১০টার সময় উদ্বৃত্ত অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহন নিয়ে আমি ময়মনসিংহ অভিমুখে যাত্রা করি। জয়দেবপুর থেকে বের হওয়ার পর সকল গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডয়ন করি। সাথে সাথে সমস্ত জোয়ানের মাঝে এক অভূতপূর্ব আনন্দের সৃষ্টি হয়। আমার কনভয় জয়দেবপুর থেকে বের হবার সাথে সাথে জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং “জয় বাংলা” স্লোগান দিয়ে আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে।
‘টাঙ্গাইলে জনতার উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখে আমি খুবই অনুপ্রাণিত হই। ভাবনাও কম ছিল না। মনে মনে চিন্তা করতে থাকি, আমি যা করতে চলেছি সে কাজে আমি শুধু একা, না আরও কেউ আছে? কারণ আমি জানি, আমি যা করতে চলেছি তা যদি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তাহলে মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র সাজা। অন্যদিকে জনতার উৎফুল্লতা দেখে মনে উৎসাহের সৃষ্টি হতো।
‘২৯ মার্চ বিকেলে জেলা (ময়মনসিংহ) অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সমস্ত অফিসারবৃন্দ, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএদেরকে নিয়ে এক বৈঠক করা হয়। সেই বৈঠকে কীভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে তার পরিকল্পনা নিই।
‘৩০ মার্চ ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনযোগে নরসিংদী রওনা দেই। আসার পূর্বে আমি জনগণকে আশ্বাস দিলাম যে, আমি আমার ব্যাটালিয়ন নিয়ে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে যাচ্ছি। আমার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি কিশোরগঞ্জ। আর আমার লোকজন বিভিন্ন গন্তব্যে অগ্রসর হয়।’
কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহ এর পর আর পেছন ফিরে তাকাননি। ৩ নম্বর সেক্টর এলাকায় তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচালনায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে অসংখ্য যুদ্ধে অংশ নেন। তাঁর সার্বিক নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি সরাসরি যুদ্ধও সংঘটিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ০২।
কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পর্যায়ক্রমে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৭৫ সালের পর যুক্তরাজ্য, কানাডা ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার এবং সুইডেনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার রূপগঞ্জ (কাজী বাড়ি) গ্রামে। স্থায়ীভাবে ঢাকায় বাস করেন। তাঁর বাবার নাম কাজী মোহাম্মদ আবদুল হামিদ, মা রজ্জব বানু। স্ত্রী সাইদা আক্তার। তাঁদের তিন মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, নবম ও দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অনন্য। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার চান্দুরায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক যুদ্ধে তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান। ষোলোই ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উপস্থিত ছিলেন। এখন জানা যাক তাঁর নিজ বয়ান (১৯৭৫) থেকে মুক্তিযুদ্ধের কিছু ঘটনা:
‘২৫ মার্চ রাত একটায় কর্নেল মাসুদুল হাসান খান (দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাবেক অধিনায়ক। ২৩ মার্চ তাঁকে ঢাকা সেনানিবাসে অ্যাটাচড করা হয়) ঢাকা থেকে টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করেন যে তোমাদের খবর কী? ঢাকাতে তো বেশ গোলাগুলি শুনছি। এই টেলিফোন পাবার পর ঢাকার সাথে সামরিক-বেসামরিক সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঢাকায় যে তখন কী হচ্ছিল, তার কোনো খবরই আমরা পাচ্ছিলাম না।
‘২৬ মার্চ সকালবেলায় ব্যাটালিয়নের কমান্ডার কর্নেল রকিবকে (কাজী আবদুর রকিব, তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল) বললাম যে গত রাতে যা কিছু ঘটেছে এবং চারদিকে যে সমস্ত গুজব রটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে একটা উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে। এ মুহূর্তে এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা উচিত।
‘২৭ মার্চ বিকেলের দিকে আমাদের একজন ড্রাইভার ঢাকা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়।...সন্ধ্যার দিকে আরও কিছু লোক ঢাকা থেকে আসে। তাঁদের মুখে শুনতে পাই ঢাকাতে বেশ হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এর আগে ড্রাইভার ছাড়া আর কারও কাছে কিছু শুনতে পাইনি।
‘২৮ মার্চ ১০টার সময় উদ্বৃত্ত অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহন নিয়ে আমি ময়মনসিংহ অভিমুখে যাত্রা করি। জয়দেবপুর থেকে বের হওয়ার পর সকল গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডয়ন করি। সাথে সাথে সমস্ত জোয়ানের মাঝে এক অভূতপূর্ব আনন্দের সৃষ্টি হয়। আমার কনভয় জয়দেবপুর থেকে বের হবার সাথে সাথে জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং “জয় বাংলা” স্লোগান দিয়ে আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে।
‘টাঙ্গাইলে জনতার উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখে আমি খুবই অনুপ্রাণিত হই। ভাবনাও কম ছিল না। মনে মনে চিন্তা করতে থাকি, আমি যা করতে চলেছি সে কাজে আমি শুধু একা, না আরও কেউ আছে? কারণ আমি জানি, আমি যা করতে চলেছি তা যদি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তাহলে মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র সাজা। অন্যদিকে জনতার উৎফুল্লতা দেখে মনে উৎসাহের সৃষ্টি হতো।
‘২৯ মার্চ বিকেলে জেলা (ময়মনসিংহ) অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সমস্ত অফিসারবৃন্দ, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএদেরকে নিয়ে এক বৈঠক করা হয়। সেই বৈঠকে কীভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে তার পরিকল্পনা নিই।
‘৩০ মার্চ ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনযোগে নরসিংদী রওনা দেই। আসার পূর্বে আমি জনগণকে আশ্বাস দিলাম যে, আমি আমার ব্যাটালিয়ন নিয়ে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে যাচ্ছি। আমার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি কিশোরগঞ্জ। আর আমার লোকজন বিভিন্ন গন্তব্যে অগ্রসর হয়।’
কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহ এর পর আর পেছন ফিরে তাকাননি। ৩ নম্বর সেক্টর এলাকায় তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচালনায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে অসংখ্য যুদ্ধে অংশ নেন। তাঁর সার্বিক নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি সরাসরি যুদ্ধও সংঘটিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ০২।
কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পর্যায়ক্রমে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৭৫ সালের পর যুক্তরাজ্য, কানাডা ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার এবং সুইডেনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার রূপগঞ্জ (কাজী বাড়ি) গ্রামে। স্থায়ীভাবে ঢাকায় বাস করেন। তাঁর বাবার নাম কাজী মোহাম্মদ আবদুল হামিদ, মা রজ্জব বানু। স্ত্রী সাইদা আক্তার। তাঁদের তিন মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, নবম ও দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
No comments