প্রকৃতির মিলনমেলা, দৃষ্টি নন্দন টাওয়ার মৌসুমী ফুলে শোভিত ক্যাম্পাস- নতুনরূপে শেকৃবি by বশিরুল ইসলাম
রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সেজেছে নতুন রূপে। ক্যাম্পাসজুড়ে যেন প্রকৃতির মিলনমেলা। শীতে প্রকৃতির বুকে রুক্ষতা ও শুষ্কতাও যেন এমন পরিবেশে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। নানা প্রজাতির দেশী এবং বিদেশী ফুলের মনোলোভা দৃশ্য মন কেড়ে নেয় প্রকৃতিপ্রেমীদের।
এই সব ফুলের মনোলোভ্য দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে ক্যাম্পাসে। গবেষণা মাঠগুলোতে রয়েছে মৌসুমী ফুলের সমারোহ। এ যেন ফুলে ফুলে শোভিত ক্যাম্পাস। এই রূপরহস্যের কাছে ধরা দিতে প্রায়ই চলছে নাটক, সিনেমা ও মিউজিক ভিডিওর শূটিং। শিক্ষার্থীদের আড্ডাও জমে উঠছে ক্যাম্পাস চত্বরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের খামার বিভাগের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ল্যান্ডস্কেপিংয়ের অংশ হিসেবে চারটি আবাসিক হল, প্রশাসনিক ভবন, একাডেমিক ভবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে রাস্তা দুই পাশে ও কৃষি টাওয়ার চত্বর ঘিরেই মূলত শোভা পাচ্ছে শীতকালীন ফুলের বাগান। এমনকি উপাচার্যের বাসভবনও সেজেছে বাগানবিলাস, গোলাপ, ডালিয়া, কসমস, এস্টার, গাঁদাসহ নানা ফুলে।প্রশাসনিক ভবনসংলগ্ন ৪৫ ফুট উঁচু টাওয়ার শীতের আগেও ছিল জীর্ণ। শীতের শুরুতেই টাওয়ার প্রাঙ্গণ ঘিরে লাগানো হয় বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ। খুব অল্প দিনের মধ্যেই এসব গাছ ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। টাওয়ার প্রাঙ্গণ ফুলের শোভায় হয়ে ওঠে অপরূপ। ক্যাম্পাসের প্রধান আকর্ষণই হলো এই টাওয়ার। ১৯৭৬ সালে বৃক্ষমেলা উপলক্ষে নির্মাণ করা হয় টাওয়ারটি। ওই সময় তৎকালীন কৃষি ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসে আয়োজন করা হয়েছিল বৃক্ষমেলা। পরবর্তী সময় মেলার স্থান পরিবর্তন হলেও রয়ে যায় টাওয়ারটি। আর এখন এই টাওয়ার শীতের রুক্ষতা ও শুষ্কতাকে পাশ কাটিয়ে ফিরে পেয়েছে নতুনরূপ।
ক্যাম্পাসের প্রধান রাস্তা থেকে দুটি ছোট মেঠোপথ চলে গেছে টাওয়ার পর্যন্ত। মেঠোপথের দু’পাশ ঘিরে লাগানো হয়েছে ঘন সবুজ গাছ। সৌন্দর্যবর্ধক এসব গাছ খুব একটা বড় হয় না। এসব গাছের পাশেই বাগানজুড়ে রয়েছে হাইব্রিড এফ ইনকা, সিলভিয়া, ডালিয়া, কসমস, এস্টার, জিনিয়া, দোপাটি , কার্নেশান, গোলাপ, ডুয়ার্ফ রঙ্গন, ক্যালেন্ডুলা, পিটুনিয়া, পান্সি, ডায়্যান্থাস, ফ্লক্স, গাজনিয়া বা চন্দ্রমল্লিকার প্রভৃতি জাতের ফুলগাছ। হাইব্রিড এফ ইনকা মূলত গাঁদা ফুলেরই একটি বিদেশী প্রজাতি। এ প্রজাতির একটি গাছে পুরো শীত মৌসুমে ২৫-৩০টি ফুল ধরে। হলুদ, সোনালি ও কমলা রঙের ফুল থাকে অক্টোবর থেকে ফেরুয়ারি পর্যন্ত। শীত কমার সঙ্গে সঙ্গে ফুল কমে যায়। হলুদ, সোনালি, কমলা, মেজে-া ও মিশ্র বর্ণের হাইব্রিড ডালিয়া, রক্ত লাল বর্ণের সিলভিয়া, হলুদ ও কমলা বর্ণের হাইব্রিড জিনিয়া ও দোপাটি ফুলের সমাহার বাগানগুলোতে সৃষ্টি করেছে অপরূপ দৃশ্য। এছাড়া একাডেমিক ভবন ঘিরেও রয়েছে অসংখ্য ফুলের সমারোহ। টাওয়ারের উভয়পাশে রয়েছে গবেষণা মাঠ।
গবেষণা মাঠগুলো শিক্ষার্থীদের গবেষণা কার্যক্রমে সারাবছরই সরব থাকে। তবে শীতের এই বাহারি ফুলগুলো যেন গবেষণা কার্যক্রমের পালে দিয়েছে নতুন হাওয়া। টাওয়ারের পশ্চিম পাশে রয়েছে কৃষিতত্ত্ব বিভাগের গম, সরিষা, ধান প্রভৃতির গবেষণা প্লট। পূর্ব পাশে বিভিন্ন ডালজাতীয় শস্য ভুট্টা, গোল আলু, শিম গবেষণা প্লট। সাউ সরিষা-১, সাউ সরিষা-২ নিয়ে গবেষণা করছেন প্রফেসর ড. মোঃ শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া, যা কৃষিতত্ত্ব মাঠের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে। এই ফুলগুলো দর্শনার্থীদের মন কেড়ে নিচ্ছে।
উদ্যানতত্ত্ব মাঠেও রয়েছে নানা মৌসুমী সবজিসহ বিভিন্ন ফুলের গাছ। ড. এএম ফরেজ মোঃ জামাল উদ্দিন গবেষণা করছেন গোলাপ ফুলের বিভিন্ন কালার- লাল, নীল, কালো, হলুদ, গোলাপি, সোনালি, কমলা, মিশ্র কালারে ওপর। গবেষণা চলছে গ্লাডিওলাস ফুলের জাত উন্নয়নের। উদ্যানতত্ত্ব খামারে গড়ে উঠেছে জার্মপ্লাজম সেন্টার। জার্মপ্লাজম সেন্টারে রয়েছে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন জাতের ফুল, ফল, অর্কিড ও মসলার চারা সংগ্রহের কার্যক্রম। ফুলের পরিচর্যা সম্পর্কে ড. এএম ফরেজ মো. জামাল উদ্দিন বলেন, গোলাপ ফুলের ক্ষেত্রে গাছের ডালপালা ছেঁটে দিয়ে টবে খৈল পচা ও হাড়ের গুঁড়া দিলে ফুলের সংখ্যা ও ফুল আকারে বড় হয়। তাছাড়া অন্যান্য ফুলের ক্ষেত্রে বাজারে প্রচলিত জৈব তরল সার ফলিয়ার ফিডিং করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। এমএস শিক্ষার্থী মোঃ রুহুল আমীন বলেন, শুধু শীতকালে নয়, পুরো ক্যাম্পাসে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য সারাবছর ফুলগাছ লাগানো উচিত। গবেষণা মাঠে বাণিজ্যিকভাবে নানা ফুলের চাষ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তা হবে বাড়তি আয়ের উৎস। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশমুখে স্থায়ী বাগান করা উচিত।
দর্শনার্থীদের একজন মোসাঃ শাকিলা ইসলাম জানান, রাজধানীর বুকে এত সুন্দর পরিবেশ দেখতে প্রায়ই এই ক্যাম্পাসে পরিবার নিয়ে চলে আসি। এই ক্যাম্পাসটা যেন রাজধানীর বুকে একটা গ্রাম। এখানকার ফুলগুলো অন্য সব ফুল থেকে বড়। পরিবেশটা খুবই চমৎকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য প্রফেসর মোঃ শাদাত উল্লা বলেন, প্রকৃতির সঙ্গে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। প্রকৃতিপ্রেমীদের ক্যাম্পাসে আগমন দেখে মন ভরে ওঠে। গবেষণার কাজ করতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী মনের অজান্তেই প্রকৃতিকে জীবন্ত করে তোলে। আর প্রকৃতি মনোরম ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্ধারিত কার্যক্রম তো রয়েছেই। তাছাড়া ক্যাম্পাসে সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভাস্কর্য নির্মাণ, স্থায়ী ল্যান্ডস্কেপিং, টিএসসিসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর উন্নয়ন। বর্তমান সরকার এ কাজের জন্য ৯২ কোটি টাকা একনেকে পাস করেছে।
No comments