সিডনির মেলব্যাগ- বড়দিনের প্রবাসী ভাবনা ও জয়তু স্বদেশ by অজয় দাশ গুপ্ত
ক্রিসমাস বা যিশুর জন্মদিনকে আমরা বাঙালীরা বলি ‘বড়দিন’। এই ডাকের ভেতরই এক ধরনের ভালবাসা আছে, আছে ব্যাপ্তি। বড় বলতে আমরা বোঝাই দীর্ঘ, উজ্জ্বল যার শীর্ষ জাতীয় কিছু।
সংখ্যায় অল্প হবার পরও বাংলাদেশে সামাজিক প্রেক্ষাপটে খ্রিস্টানদের অবস্থানকে বরাবরই ‘বড়’ করে রেখেছি আমরা। এর কারণ আছে। সংস্কৃতি ও ধর্মের সমন্বয় বা যোগসূত্র থাকলে তার বাহ্যিক চেহারা ও অন্তর্গত আচরণ আকৃষ্ট করে। আমাদেরও করেছে, ধারণা করি গরিব শীতবস্ত্র বঞ্চিত, বরফ বা কুয়াশার আবরণে ঢেকে যাওয়া প্রকৃতিহীন বঙ্গদেশের মানুষের মনে ঐসব বিষয়ের প্রতি আগ্রহ অপার। মানব চরিত্র তো তাই যা তার নেই তার প্রতি অপার কৌতূহল। বরফ মোড়ানো প্রকৃতি, সেøজ গাড়ি, আপাদমস্তক পোশাক আচ্ছাদিত সান্ডা, মমতাময়ী মেরী ও দেবশিশু যিশু। এই অপরূপ সৌন্দর্যে আমরা শৈশব থেকেই মুগ্ধ। পার্থক্য যে ছিল না তা কিন্তু নয়। তফাৎটা ছিল নামের কারণে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু, পরিচিত জন বা অন্য যে কেউ খ্রিস্টান হলেই ‘বিদেশী’ ‘বিদেশী’ মনে হতো, কারণ তাদের নামগুলো বাঙালী নাম ছিল না। ফলে এক ধরনের ভিনদেশী অনুভূতি কাজ করত। ছেলেবেলা থেকে পাঠ্যপুস্তক বা অন্যান্য সূত্রে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা বা ভয় জাগানিয়া ইংরেজ নামগুলোর সমান্তরালে খ্রিস্টান বন্ধুদের কিঞ্চিৎ দূরের মনে হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। তবে শ্রদ্ধা জাগত আরও কিছু কারণে। এদের পরিপাটি বাসগৃহ, কাঁটা চামচ, নৈপুণ্যের সাথে তার ব্যবহার আর চমৎকার পোশাকে বিস্মিত হবার কারণ ছিল। সাধারণত বাঙালীরা হাত দিয়ে খায়, রান্না ঘর বা পোশাকের ব্যাপারে অগোছালো, শুধুমাত্র উৎসব এলেই পরিপাটি। এরা তার ব্যতিক্রম। সবচেয়ে অধিক টানত গির্জার উপাসনা। হেমিংওয়ের উপন্যাস, কীটসের কবিতা বা শক্তির অসাধারণ পদ্যের মতো দুলে উঠত গির্জার ঘণ্টা। আমরা চট্টগ্রামে মানুষ, বেশ ক’টি বড় গির্জা আছে এই শহরে। প্রার্থনা সভা–অবলোকনের আনন্দে কতবার গিয়েছি, কতবার দাঁড়িয়ে থেকেছি, দূর থেকে দেখেই হৃদয় জুড়িয়ে যেত। এ জাতীয় প্রার্থনার অপূর্ব ব্যবহার করেছেন নাট্যকার ও নির্দেশক নাসিরউদ্দীন ইউসুফ। সম্ভবত তিনিই প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ছায়াছবিতে বাঙালী খ্রিস্টানদের অন্তর্ভুক্ত করেন। অবশ্য এ কৃতিত্ব উপন্যাসটির লেখক শাহরিয়ার কবিরেরও প্রাপ্য। প্রার্থনা ভাল লাগার আরও একটি কারণÑ সঙ্গীত। গান বা সুরের ভেতর দিয়ে ঈশ্বর অনুভূতির মতো দ্বিতীয় সুখানুভূতি নেই। রবীন্দ্রনাথ চেষ্টা করেছিলেন বটে, বাঙালী হিন্দু তা নিতে পারেনি। তার উন্মাদনা ঢাকঢোল আর মন্ত্র পাঠেই সীমাবদ্ধ। মন্ত্রপাঠের সুরালোকও এখন ঘুচে যাবার পথে। গান বাজনায় হিন্দুরা উৎসাহী হলেও তা মাইক বা যন্ত্রযোগে। ফলে প্রার্থনার পরিবর্তে উৎসবের গান পূজার বেলায় যন্ত্রণাসঙ্গীত হয়ে ওঠে। বাঙালী খ্রিস্টানরা এ দায় মুক্ত। তাঁদের প্রার্থনা শুনে, কোরাস বা সমবেত সঙ্গীতের আবহে মন ভিজে যায়। প্রাণ গেয়ে ওঠে ‘নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মোছায়ে’। সম্প্রতি আমার মা পরলোক গমন করেছেন। নানাবিধ আচার আচরণ আর ক্রিয়ার দাপটে অসহায় বোধ করছিলাম। কিছু কিছু শোক বা দুঃখ থাকে যা একান্ত নিজস্ব। মন তখন শান্ত, অচঞ্চল আর স্থৈর্য প্রত্যাশায় পাতার মতো হৃদয় বাড়িয়ে রাখে। যদি করুণার দুয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পাওয়া যায়! প্রভু যিশুকে আমরা দেখিনি। তিনি অতিন্দ্রীয় না মানবলোকের তাও জানি না। তবে একটা দারুণ মূর্তি আছে তাঁর। সম্ভবত ব্রাজিল বা ঐ জাতীয় কোথাও। পর্বতের শীর্ষদেশে দু’হাত বাড়িয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে, মনে হচ্ছিল ঐ জাতীয় দুটো হাত আমাকে আশীর্বাদ করুক; মাথায় হাত বুলিয়ে দিক।ভাবগম্ভীর কথা থাক। বাঙালী খ্রিস্টান বা যিশু অনুগতদের কাছে আবেদন জানাই, বাংলাদেশের মূলধারায় অবদান রাখুন। শান্তি ও কল্যাণের চেতনায় বাঙালীকে জাগিয়ে তুলুন। এদেশ বা বিদেশে এ দেশের মানুষের মূলশক্তি মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। সে যুদ্ধের সেøাগান ছিল “বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি”। সে শক্তিই যেন উৎসবের প্রেরণা হয়। ফুলের পাপড়ির মতো এক হয়েই যেন থাকি আমরা।
অতিক্রান্ত বিজয় দিবস ও দূতাবাস
এবারের ষোল ডিসেম্বর ছিল রোববার। অস্ট্রেলিয়ায় ছুটির দিন। সচরাচর যা দুর্লভ। এ তো আর বাংলাদেশ নয় যে, আমাদের জাতীয় দিবসে ছুটি থাকবে। এই দেশ বা জাতিতে আমরা এখনও নতুন অভিবাসী। ধীরে ধীরে শেকড় গেড়ে বসলেও আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য এখনও তেমন করে তুলে ধরার কাজ হয়নি। এখনও তরুণ তরুণীরা মূলধারায় আসন পেতে বসার সময় হয়নি। তারপরও বাংলাদেশ এখানে জাগ্রত সত্তা। পোশাক শিল্পে, ক্রিকেটে, অভিবাসীদের মেধা ও শ্রমে উচ্চারিত উজ্জ্বল এক নাম। এবারের বিজয় দিবসে রাজধানী ক্যানবেরায় থাকার সুবাদে সকালেই পৌঁছে গিয়েছিলাম দূতাবাসে। দূর থেকে পতপত করে উড়তে থাকা বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকাই বলে দিচ্ছিল প্রাণের আবেগ কতটা উড্ডীন। মাননীয় রাষ্ট্রদূত ও তার পতœীর অভ্যর্থনা আর আন্তরিকতায় সমবেত বাংলাদেশীরা ছিলেন প্রাণবন্ত। বিশেষত শিশুদের ছবি আঁকা আমার বিশেষ নজর কেড়েছে। বিষয় বেছে নেয়ার ব্যাপারে তাদের বাংলাদেশ প্রীতি ও আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি ভালবাসা জানিয়ে দিচ্ছিল। জয় বাংলার ক্ষয় নাই। আর একটি চমৎকার দৃশ্য ছিল ছোট জলাধারের নীল জলে ভাসমান সাত বীর শ্রেষ্ঠের প্রতিকৃতি। অসাধারণ এই ধারণাটি বাংলাদেশ দূতাবাসের ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতার প্রবাসী দৃষ্টান্তও বটে। ফিরে আসার পথে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার আরেকটি দিক তার মানুষজনের প্রীতি ও ভালবাসা, যা দেশের চেয়ে বিদেশে আরও ঘনীভূত। বিজয় দিবসে ক্যাঙ্গারুর দেশে উড্ডীন পতাকার মতো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ছড়িয়ে পড়বেÑএই আমাদের প্রত্যাশা।
dasguptaajoy@hotmail.com
No comments