খালেদা জিয়ার রাজনীতি by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের অনিবার্যতায় সংগঠিত হয়েছে। ইতিহাসের অনিবার্যতায় বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই অনিবার্যতাকে অস্বীকার করাই খালেদা জিয়ার রাজনীতি।
পাকিস্তান রাষ্ট্রে সেনাবাহিনী সিভিল সমাজকে তছনছ করেছে, জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী দিয়ে বাংলাদেশের সিভিল সমাজ তছনছ করেছেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন; খালেদা জিয়া রাষ্ট্র পরিচালনায় ও রাজনীতি পরিচালনায় জিয়াউর রহমান থেকে এই শিক্ষা লাভ করেছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রে সেনাবাহিনী সিভিল সমাজের শক্তি হ্রাস করেছে জামায়াতে ইসলামীকে ব্যবহার করে এবং সিভিল সমাজের রাজনীতিতে অস্ত্রের ব্যবহার বৈধ করে। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনায় ও রাজনীতিতে তার প্রতিপক্ষ ভেবেছে সিভিল সমাজকে। সিভিল সমাজের শক্তি হ্রাস করার জন্য তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিকে অস্ত্রে সজ্জিত করার অধিকার দিয়েছেন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিএনপিকে অস্ত্রের রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। অস্ত্র ছাড়া রাজনীতি হয় না এই শিক্ষা জিয়াউর রহমান থেকে খালেদা জিয়া লাভ করেছেন। খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে সে জন্য সমাজের ভাবনায় লিবার্টি নেই; ব্যক্তি ও ব্যক্তির সম্পর্কের ভাবনায় সমতা নেই; ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের ভাবনায় জাস্টিসের বোধ নেই। আছে একমাত্র ক্ষমতার চিন্তা, সশস্ত্র ক্ষমতার চিন্তা।যে রাজনীতি অস্ত্রে সজ্জিত, যে রাজনীতির ভিত্তি দুর্বৃত্তপনা, যে রাজনীতির অভিজ্ঞতা অর্জিত জামায়াতে ইসলামী থেকে ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফ্যাসিস্টিক কার্যকলাপ থেকে, সে রাজনীতিতে ফ্রিডম মূল্যবোধ হিসেবে কাজ করে না। খালেদা জিয়া ফ্রিডমের পক্ষে নন, লিবার্টির পক্ষে নন, সমতার পক্ষে নন, তিনি জাস্টিসের পক্ষে নন। সে জন্য তাঁর ক্ষমতার রাজনীতি বিভ্রান্তিকর ও প্রবঞ্চক। তাঁর রাজনীতিতে মানুষের জীবন বহিষ্কৃত। তাঁর অনুচররা তাঁর রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে অবলীলায় হরতালে মানুষ পুড়িয়ে মারে, গুলি চালায়, গাড়ি-বাড়িতে আগুন দেয়। এসব কারণে খালেদা জিয়ার রাজনীতি জামায়াতের রাজনীতি, জামায়াতের রাজনীতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রাজনীতি, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রাজনীতি বাংলাদেশকে কলোনি করে রাখার রাজনীতি। খালেদা জিয়া একই সঙ্গে জামায়াতের রাজনীতি করছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রাজনীতি করছেন আর বাংলাদেশকে তাঁর দলের কলোনি করার রাজনীতি করছেন। তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধিতা করছেন বলে রাষ্ট্রদ্রোহী, তিনি বাংলাদেশ সমাজের বিরোধিতা করছেন বলে দেশদ্রোহী।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বাসিন্দারা একটি জাতি হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের অভিযাত্রা বাংলাদেশে প্রকম্পিত করেছে; সে জন্য আমি এবং বাংলাদেশ, আমরা এবং বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন। বিপরীতে জামায়াতে ইসলামী সম্বন্ধে খালেদা জিয়ার মধ্যে ঘৃণার বোধ নেই, সে জন্য তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে নন এবং সভ্যতার পক্ষে নন। জামায়াতে ইসলামীর সখা তিনি হতে পেরেছেন, তার বড় কারণ নিরস্ত্র মানুষের হত্যা তাঁকে কখনও বিচলিত করেনি। সে জন্য তিনি ডেমাগগ হতে পেরেছেন, হত্যা ও অন্যায়ের পক্ষে যেতে পেরেছেন, জামায়াতকে নিয়ে রাজনীতি করতে পেরেছেন। জামায়াত তাঁর চোখে যুদ্ধাপরাধী নয়, অপরাধী হচ্ছে আওয়ামী লীগ এবং বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দল এবং নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ, যারা যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছে। তাঁর চোখে স্বাধীনতা অপরাধ, যুদ্ধ অপরাধ নয়; তাঁর চোখে যুদ্ধাপরাধী বলে কেউ নেই, কিছু নেই। তাঁর দল বিএনপি জামায়াত থেকে উত্থিত, পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে উৎসারিত, তাঁর দল বিএনপির মতাদর্শ জামায়াত ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত। এই রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তাঁর সরে যাওয়া সম্ভব নয়। এই অবস্থান তাঁকে যুদ্ধাপরাধী করে তুলেছে। নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা যেমন অপরাধ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করার সাফাই গাওয়াও তেমনই অপরাধ। এখানেই নুরেমবার্গ বিচারের অন্তঃসার। ব্যক্তি নাৎসিকে অপরাধের দায়ভাগ নিতে হয়েছে, তেমনই দল হিসেবে নাৎসি পার্টিকে অপরাধের দায়ভাগ নিতে হয়েছে। সে জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নাৎসি ব্যক্তির মতাদর্শ নিষিদ্ধ, তেমনই সংগঠন হিসেবে নাৎসি পার্টি নিষিদ্ধ। এই অর্থে যুদ্ধাপরাধ সভ্যতাবিরোধী। সভ্যতাবিরোধী ব্যক্তি, সভ্যতাবিরোধী মতাদর্শ, সভ্যতাবিরোধী সংগঠন- কোথাও তাদের জায়গা নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন পবিত্র গ্রন্থে যে ব্যক্তি হত্যা করে সে ব্যক্তি অভিশপ্ত বলে চিহ্নিত। পৃথিবীর বিভিন্ন উপকথায় যে ব্যক্তি হত্যাকারী সে ব্যক্তি অভিশপ্ত বলে উচ্চারিত। বাংলাদেশে অভিশপ্ত হত্যাকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন খালেদা জিয়া। গোলাম আযম, সাঈদী, মুজাহিদ কত নাম বলব- এরা মানুষ হত্যাকারী এবং এদের সংগঠন জামায়াত নিরপরাধ মানুষদের হত্যার সাহায্যকারী। সে জন্য এসব ব্যক্তির বিচার সভ্যতা রক্ষার জন্য জরুরী, এসব ব্যক্তি মানবতাবিরোধী কাজ করেছে; তাদের শাস্তি অনিবার্য এবং অমোঘ এবং অপ্রতিরোধ্য- শাস্তি তাদের পেতেই হবে পবিত্র গ্রন্থের বিধান অনুযায়ী, নুরেমবার্গ এবং অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের আদালতের বিচারের বিধান অনুযায়ী। সেই সঙ্গে এদের সংগঠন জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধকরণ, যদি সভ্যতা রক্ষা করতে হয়, অনিবার্য এবং অমোঘ এবং অপ্রতিরোধ্য। সেই অনিবার্যতা উচ্চারিত হয় যখন শেখ হাসিনা বলেন : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতে হতেই হবে; সেই অমোঘতা ধ্বনিত হয় যখন মতিয়া চৌধুরী বলেন : গোলাম আযমদের বিচার ও জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধকরণ এক ও অভিন্ন; সেই অপ্রতিরোধ্যতা দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে যখন ড. আলমগীর বলেন : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যারা বানচাল করতে চায় তারাও যুদ্ধাপরাধী, তখন বোঝা যায় যুদ্ধাপরাধের ভিত্তি কেন বিশাল, কেন ব্যাপ্ত, কেন বিচার জরুরী। এই বিচার না হলে সভ্যতা, মানুষের সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে, অভিশপ্ত জাতি হিসেবে আমরা মানুষের ইতিহাসে চিহ্নিত হব।
খালেদা জিয়া এবং তাঁর দল ভবিষ্যত সম্বন্ধে ভীত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁদের জায়গা কোথাও নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে পারলেই তাঁদের রাজনৈতিক ফায়দা হবে। সে জন্য জামায়াতের সঙ্গে তাঁদের সখ্য। খালেদা জিয়ার মধ্যে ক্ষমতার লোভ অসীম আর এই লোভের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করে চলেছি সংস্কৃতির ক্ষমতা দিয়ে। আমাদের কাছে সংস্কৃতি ও সভ্যতা এক ও অভিন্ন। এই এক ও অভিন্নতা আমাদের মধ্যে তৈরি করেছে চিন্তার স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা রক্ষাই আমাদের প্রাত্যহিক কাজ, সারাবছরের কাজ, সারা জীবনের কাজ। আমাদের মধ্যের যে কোন একজনকে বিএনপি-জামায়াত হত্যা করতে পারে, কিন্তু সবাইকে, সব মানুষকে হত্যা করতে পারে না। ধ্বংস করতে পারে না। সভ্যতা ও মনুষ্যত্বকে রক্ষা করার জন্য আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবই; মানুষ হত্যা যে অপরাধ- এই বোধের কাছে বার বারই ফিরে যাবই। এই হচ্ছে মনুষ্যত্ববিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার বাস্তবতা।
No comments