মাদকযুদ্ধে বিক্ষত মেক্সিকো
পাকিস্তান যেমন ধর্মান্ধ শক্তিগুলোর আধিপত্যের লড়াইয়ে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, অন্যদিকে আরেকটি দেশও একইভাবে বিক্ষত হচ্ছে। দেশটার নাম মেক্সিকো। তবে তফাতটা হচ্ছে সেখানে আধিপত্যের লড়াইটা ড্রাগ কার্টেল বা বড় বড় মাদক চক্রগুলোর মধ্যে।
পাকিস্তানে যেমন ধর্মান্ধ শক্তির আক্রমণের শিকার হয়েছে বেনজির ও মালালার মতো নারীরা তেমনি মেক্সিকোতেও মাদক চক্রের হামলার শিকার হওয়া চরিত্রের অভাব নেই। এদেরই একজন মারিয়া সান্তোস গোরেসটাইটা।পেশায় ডাক্তার মারিয়া তিন সন্তানের জননী। ২০০৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত টিকিচি শহরের মেয়র ছিলেন। সেসময় তাকে হত্যায় অন্তত দু’দফা চেষ্টা চালানো হয়। দুবারই বেঁচে যান। এক হামলায় তার স্বামী নিহত হন। অন্য হামলায় তাঁর শরীর বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হলেও মারা যাননি। হামলার কারণ তিনি মাদক ব্যবহার প্রতিবাদ করেছিলেন। মাদকচক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
মেক্সিকো মারিজুয়ানা ও আফিমের বেআইনী চাষাবাদের জন্য বিখ্যাত। একই সঙ্গে এলাকাটি মাদক কারবারীদের লাড়ইয়ের ময়দানেও পরিণত হয়েছে। সরকার এসব চক্রের বিরুদ্ধে অভিমান শুরু করার পর থেকে গত ৬ বছরে শীর্ষ মাদক কারবারীদের কয়েকজন মারা যায় বা ধরা পড়ে। কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে হানাহানি বন্ধ হয়নি এবং এই হানাহানির ক্রসফায়ারে সাধারণ লোকদেরকেও জীবন দিতে হয়েছে। সরকারী হিসাব অনুযায়ী অভিযান শুরুর পর থেকে ৫০ হাজার লোক নিহত হয়েছে। মাদক ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে লড়াইয়ে প্রধান কুশীলব হচ্ছে লা ক্যামিলিয়া মিকোয়াকানা নামে ৩০ কুখ্যাত ড্রাগ কার্টেল। যতসব লোমহর্ষক হত্যাকা- ঘটানো এদের কাজ। এরা শিরোñেদের জন্য কুখ্যাতি লাভ করেছে।
মেক্সিকো দেশটা পুরুষদের পৌরুষ প্রদর্শনের জন্য পরিচিত হলেও মাদকবিরোধী লড়াইয়ের ক্ষেত্রে কিন্তু পুরুষদের অগ্রণী ভূমিকায় দেখতে পাওয়া যায় না; সেই ভূমিকা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহিলাদের ওপর এসে পড়ে। মহিলারা নিরস্ত্র। আর্থিক সম্পদও নেই বললেই চলে। বিপদের সময় পুলিশের সাহায্য চেয়েও অনেক সময় পায় না। তারপরও তারা শুধু মাদকবিরোধী লড়াইয়েই নয়, পরিবার ও সমাজের জীবনমান উন্নয়নের সংগ্রামে সামনের কাতারে চলে এসেছে। তাদেরই একজন ছিলেন মারিয়া সান্তোস গরোসটাইটা। আরও আতঙ্কের মতো তিনিও তাঁর ছোট শহরের মানুষগুলোর জীবনমান উন্নয়নের লড়াইয়ে আত্মনিবেদিত হয়েছিলেন। সেই লড়াইয়ের একটা দিক মাদক কার্টেলগুলোর লোকদের ধরিয়ে দিতে ফেডারেল পুলিশকে সাহায্য করা। আর সেটাই তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। মারিয়া সমাজ সোবায় উৎসর্পিত প্রাণ ছিলেন। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘আমার জনগণের প্রতি, নারী-শিশু-বয়স্কদের প্রতি এবং এক টুকরো রুটি ঘরে আনার জন্য যারা প্রতিদিন নিজেদের আত্মা বিদীর্ণ করে দিচ্ছে তাদের সবার প্রতিই আমার একটা দায়িত্ব আছে।’
কিন্তু মাদক অধিপতিরা সেটা দেখেনি। মারিয়ার এই ভূমিকা তাদের কাছে কোন পার্থক্য রচনা করেনি। কিছুদিন আগে তিনি তাঁর মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন গাড়ি ড্রাইভ করে। মেয়রের দায়িত্বে আর ছিলেন না বলে সঙ্গে তাঁর কোন এসকট ছিল না। তাদের সহজেই অপহরণ করা হলো। মারিয়ার কাকুতি-মিনতিতে তাঁর মেয়েকে ছেড়ে দিলেও তাঁকে রেহাই দেয়নি অপহরণকারীরা। পাঁচদিন পর মারিয়ার লাশ পাওয়া গেল। সারা শরীরে অত্যাচারের চিহ্ন।
এমনিভাবেই মেক্সিকোর মাদকচক্রের হাতে খুন হয়ে যাচ্ছে মারিয়ার মতো প্রতিবাদী নারীরা। এমনিভাবেই ড্রাগ ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত সহিংসতায় প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে মেক্সিকো। রক্তক্ষরণ ঘটে চলেছে মধ্য আমেরিকার এই দেশটির। মেক্সিকোর ড্রাগ কার্টেলগুলোর অস্তিত্ব বেশ কয়েক দশক ধরে রইলেও এরা ১৯৯০-এর দশকে কলম্বিয়ার ক্যালি ও মেডেলিন কার্টেলের বিলুপ্তির পর থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রে যত মাদকদ্রব্য এসে প্রবেশ করে তার শতকরা ৯০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে মেক্সিকোর কার্টেলগুলো এবং এর মাধ্যমে তারা পাইকারি মাদক বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। প্রধান দুই কার্টেল টিজুয়ানা ও গালফ কার্টেলের নেতারা ধরা পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচারের রুটগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখন বিভিন্ন কার্টেলের মধ্যে লড়াই চলছে। এক হিসাবে জানা গেছে, বেআইনী মাদক ব্যবসা থেকে কার্টেলগুলোর বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ১৪০০ কোটি থেকে ৫ হাজার কোটি ডলার।
চলমান ডেস্ক
No comments