সময়ের কথা-নরমে গরমে, বাস্তবে বাগাড়ম্বরে... by অজয় দাশগুপ্ত

বিএনপি নেতৃত্ব নিশ্চয়ই এ ইতিহাস জানেন। তারপরও কেন এ ধরনের হুঙ্কার চলছে টানা তিন বছর? তিন বছর ধরে তারা যে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচির কথা বলছেন, সেটা দিচ্ছেন না বা দিতে পারছেন না। কিন্তু একদল লোক বুঝে হোক বা না বুঝে হোক 'ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে বাংলাদেশে' বলে এসব কথাকে গ্রহণ করছে।
এর প্রভাবে বা এতে শঙ্কিত হয়ে বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকছে কিংবা অন্তত থাকার কথা বলছে কিছু লোক। অক্টোবরের শেষ দিকে ঈদুল আজহা। তখন থেকেই পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষা এবং স্কুলে অন্যান্য ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষা


* বিএনপি ঈদের পর কঠোর আন্দোলনে যাবে_ সাংবাদিকদের খালেদা জিয়া।
* বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঈদের পর সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য হরতাল, অবরোধ ও বিক্ষোভ মিছিলসহ কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন_ বিএনপির নীতিনির্ধারণী স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান।
* ঈদুল ফিতরের পর বিএনপি কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচিতে যাবে।
বাংলাদেশের রাজনীতির যারা খোঁজখবর রাখেন, বিশেষ করে সংবাদপত্রের যারা নিয়মিত পাঠক তাদের কাছে এ ধরনের খবর নতুন নয়। 'ঈদের পর কঠোর আন্দোলন'_ এ হুঙ্কার কতবার যে শুনেছে মানুষ তার হিসাব রাখা কঠিন। ওপরের যে তিনটি 'কঠোর আন্দোলনের' হুশিয়ারি উদ্ধৃত হয়েছে, তা নেওয়া হয়েছে ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালের সংবাদপত্রের পাতা থেকে। পরপর তিন বছর হুবহু একই কথা বলা হয়েছে। তিন বছরেই দেখা গেছে_ রমজানের রোজার শেষে খুশির ঈদ আসে, কিন্তু 'কঠোর' আন্দোলন কর্মসূচি আসে না। এ ধরনের বক্তব্য কি কেবলই বাগাড়ম্বর, যার লক্ষ্য কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা রাখা? এমন বক্তব্য রাখা হয় দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে।
২০১০ সালে যখন এ বক্ত্ব্য দেওয়া হয়, তখন মহাজোট সরকারের কেবল এক বছর পূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু 'কঠোর কর্মসূচি' বলতে যেটা বোঝানো হয় অর্থাৎ সরকারকে ফেলে দেওয়া বা প্রায় ফেলে দেওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি করা_ সেটা আমরা দেখতে পাইনি। পরের বছরেও একই হুঙ্কার। তৃতীয় বছর ২০১২ সালেও একই কথা_ আর সহ্য করা হবে না। এবারে ঈদের পর বিএনপি স্থায়ী কমিটি বৈঠকে বসেছিল ২৬ আগস্ট। সেখান থেকে আসে দেড় মাসের আন্দোলন কর্মসূচি_ গণমিছিল, সমাবেশ ও খালেদা জিয়ার জেলায় জেলায় সফর। একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র এ খবর প্রকাশ করেছে 'ঈদুল আজহা পর্যন্ত ১৮ দলীয় জোটের 'নরম' কর্মসূচি' শিরোনামে। পত্রিকাটি এটাও জানিয়েছে_ খালেদা জিয়া গত ১১ জুন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রোজার ঈদের পর কঠোর কর্মসূচি প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু নতুন কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে আপাতত 'কঠোর' অবস্থান থেকে সরে এসেছে বিরোধীদলীয় জোট। আগামী ঈদুল আজহা পর্যন্ত ১৮ দলীয় জোট 'নরম' বা 'ঢিলেঢালা' কর্মসূচির মাধ্যমে জনমত গঠনের কাজ চালিয়ে যাবে। তবে এসব কর্মসূচিকে ঢিলেঢালা ভাবতে রাজি নন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি মনে করেন, আন্দোলনের প্রতি জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে ধাপে ধাপে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
অন্যদিকে সরকার বলছে যে, তারা আন্দোলনের হুমকিতে ভয় পায় না। 'কঠোর হস্তে মোকাবেলার' কথাও তারা বলছে। সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি ব্যাহত করার জন্য বিরোধী দলের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে জনগণকে সতর্ক করছেন একাধিক মন্ত্রী।
বায়বীয় আন্দোলন মোকাবেলায় বায়বীয় হুমকি!
বিএনপি এবং তাদের মিত্ররা বলতে পারে যে, এ ধরনের কথা বলা বাংলাদেশের রাজনীতিতে রেওয়াজ। এতে কর্মীরা চাঙ্গা থাকে। সরকার শঙ্কিত থাকে। 'দেশে-বিদেশে' অনেকে এ বার্তা পেয়ে যায় যে বিরোধীরা যথেষ্ট শক্তি রাখে। আবার কারও কাছে মনে হতে পারে যে ধরনের বাগাড়ম্বর রাজনীতিতে অচল হয়ে পড়ছে। অনেকে আমাদের এটাও স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন যে, ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগও একই ধরনের বাগাড়ম্বর করেছে। আবদুল জলিলের ২০০৫ সালের '৩০ এপ্রিলের ট্রাম্পকার্ড' এত সহজে ভুলে যাওয়ার নয়। একই কথা তাদের কাছে শুনেছি ১৯৯৪-৯৫ সালে। আবার বিএনপি এটা বলেছে ১৯৯৮, ১৯৯৯ ও ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ে। এই ধারাই কি চলতে থাকবে?
সত্তরের দশকে ছাত্র আন্দোলনের একটি কৌতুক ছিল এভাবে : মিছিলে স্লোগান চলছে_ 'আর নয় প্রতিবাদ, এখন থেকে প্রতিরোধ।' পরক্ষণেই স্লোগান_ 'আগামীকালের প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিন।' এ সময়ে আর প্রতিরোধের কথা নেই। আহ্বান জানানো হচ্ছে প্রতিবাদের। প্রকৃতই আমরা যা বিশ্বাস করি তা বলি না, যা বলি তা বিশ্বাস করি না।
কিন্তু কেউ যদি সত্যিই 'ঈদের পর কঠোর' আন্দোলনের ঘোষণা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন?
এক বিশ্বখ্যাত নাট্যকার ও সাহিত্যিকের কাছে এসেছিলেন এক সুন্দরী তরুণী। সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব রেখে কনে বলেন, 'আপনার গুণ ও আমার রূপ নিয়ে আমাদের যে সন্তান আসবে সে হবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষ।' এমন আকর্ষণীয় প্রস্তাব পেয়ে খুশি হলেন খ্যাতির শীর্ষে থাকা নাট্যকার-সাহিত্যিক। কেবল একটি 'কিন্তু' যোগ করে বলেন, 'আচ্ছা, আমাদের সন্তান যদি আমার রূপ এবং আপনার মতো বুদ্ধি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে?'
এমন প্রশ্নের উত্তর হয় না। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে দেখা দেওয়া অনেক প্রশ্নেরও কোনো উত্তর হয় না। তবে দেশের বাইরের অনেক এবং ভেতরেও কিছু লোক কিন্তু রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরকে গুরুত্ব দেন। তাদের কাছে এ দেশটি অব্যাহত অস্থিরতার দেশ_ যেখানে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা রাজনৈতিক ঝুঁকি ও অস্থিতিশীলতা, যেখানে হরতাল-ধর্মঘট-অবরোধ নিত্যদিনের ঘটনা। বিশ্বব্যাংক কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অনেক দলিলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে মন্তব্য পাবেন। দেশের ব্যবসায়ীদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে দেখবেন এই 'অস্থিরতা' নিয়ে শঙ্কার প্রকাশ।
কিন্তু বাস্তবতা কি তা থেকে ভিন্ন নয়?
ঈদের ছুটিতে রাজধানীর যে লাখ লাখ মানুষ 'শিকড়ের টানে' হাজার হাজার গ্রাম পানে ছুটে যায় তারা সড়কপথের 'বিপর্যস্ত-বেহাল দশার' কারণে বাড়িতে যেতে পারবে না, এমনই ধারণা করা হয়েছিল। অন্তত কোনো কোনো সংবাদপত্র ও টেলিভিশন প্রতিবেদন থেকে এমন ধারণা করা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বাস্তবে কাউকে 'ফেরিঘাটে ঈদের জামাত' আদায় করতে হয়নি। 'ঈদের পর কঠোর আন্দোলন' এবং 'ঈদে বাড়ি ফেরায় চরম অনিশ্চয়তা'_ এ ধরনের প্রচারের মধ্যে মিল রয়েছে অবশ্যই। তবে সবাই যে তা পরিকল্পিতভাবে করছে, সেটা বলা ঠিক হবে না। এ যেন 'চলে আসছে, চলুক না' ধরনের বিষয়।
যে পত্রিকাটি গণমিছিল-সমাবেশকে 'কঠোর কর্মসূচি' বা আন্দোলন মনে করে না তাদের কাছে প্রশ্ন করা যায়_ কেবল হরতাল-অবরোধই কি আন্দোলন? এর উত্তরে তারা বলতে পারে যে বিরোধী দল থেকেই তো 'কঠোর কর্মসূচি' সম্পর্কে এমন ধারণা দেওয়া হয়। এখন তারা সরে এসে 'ঢিলেঢালা' কর্মসূচি দিলে তার দায় তাদের ওপরেই বর্তাবে।
এ প্রশ্ন বিএনপি এবং তাদের রাজনৈতিক জোটের শরিকদের কাছে করাই যায় যে টানা তিন বছর ধরে তারা কেন 'ঈদের পর কঠোর আন্দালনের কর্মসূচির' কথা বলেও সেটা রক্ষা করা হচ্ছে না? তারা এ পথে না চলায় দেশের উপকার হয়েছে, সেটা স্বীকার করা উচিত সবার। রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটা বলে দেবে। বিএনপি নেতৃত্বও এটা জানে। পাকিস্তান আমলে আমাদের এ ভূখণ্ডের মানুষ ছিল সামরিক শাসক আইয়ুব খানের ঘোরতর বিরোধী। ছাত্রসমাজ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের সেই পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ভাষা আন্দোলনের সময়েই নাকচ করে দিয়েছে। ১৯৬২ ও ১৯৬৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের জোয়ার এমনই ছিল যে, মনে হতো আইয়ুব খানের দিন বুঝি শেষ। তারপরও প্রায় দশ বছর চলেছে দুঃশাসন। আশির দশকে এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিন জোটের আন্দোলন চলেছে টানা কয়েক বছর এবং তাতে জনগণের সমর্থন ছিল যথেষ্ট। ছাত্রসমাজ ছিল এ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একাট্টা। কিন্তু একটি সরকারের পতন ঘটানো সহজ কাজ নয়।
বিএনপি নেতৃত্ব নিশ্চয়ই এ ইতিহাস জানেন। তারপরও কেন এ ধরনের হুঙ্কার চলছে টানা তিন বছর? তিন বছর ধরে তারা যে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচির কথা বলছেন, সেটা দিচ্ছেন না বা দিতে পারছেন না। কিন্তু একদল লোক বুঝে হোক বা না বুঝে হোক 'ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে বাংলাদেশে' বলে এসব কথাকে গ্রহণ করছে। এর প্রভাবে বা এতে শঙ্কিত হয়ে বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকছে কিংবা অন্তত থাকার কথা বলছে কিছু লোক। অক্টোবরের শেষ দিকে ঈদুল আজহা। তখন থেকেই পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষা এবং স্কুলে অন্যান্য ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষা। 'কঠোর কর্মসূচির' নতুন সময়সীমার প্রভাব এসব পরীক্ষায় কীভাবে পড়ে, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকব।
তবে ইতিহাস এবং অভিজ্ঞতা বলে যে দেশের অনেক মানুষ এ ধরনের বাগাড়ম্বর উপেক্ষা করেই নিজ নিজ কাজ চালিয়ে যায়। কৃষককে মাঠে যেতে হয়। রোদ-বৃষ্টি-কুয়াশা উপেক্ষা করে তাদের কাজ করতে হয়। তাদের শ্রমে-ঘামেই বাংলাদেশ এখন খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। আগামীতে চাল-গমের দাম অনেক পরিমাণে বাড়তে পারে ভেবে অনেক দেশ উদ্বিগ্ন। কিন্তু বাংলাদেশে বরং উদ্বেগ ভিন্ন কারণে_ এখানের বাজারে চালের দাম কম। কৃষকরা চাইছে আরও বেশি দাম, যাতে তারা কৃষি কাজ করে লাভবান হতে পারে। 'কঠোর আন্দোলনের' ছাত্রছাত্রীদের বই নিয়ে পড়ার টেবিলে বসতে হয়। তৈরি পোশাক শিল্পের লাখ লাখ শ্রমিককে সাত সকালে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে অফিসে আসতে হয় এবং ফিরে যেতে হয় অনেক রাতে। এ পোশাক বন্দর হয়ে চলে যায় আমেরিকা-ইউরোপে। এ বন্দরেই খালাস হয় আমদানি করা পণ্য।
তাহলে কেন বাংলাদেশ চিহ্নিত হবে 'অব্যাহত' অস্থিরতার দেশ হিসেবে? এই অব্যাহত বাগাড়ম্বর থেকে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা কী সুখ পান?

অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.