সাদাকালো-মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা by আহমদ রফিক
আজ থেকে দশক দুই আগে কোচিং-বাণিজ্য বন্ধের জন্য বার দুই কলাম লিখেছিলাম। এর মধ্যে একটির শিরোনাম ছিল 'কোচিং শিক্ষার বাণিজ্যিক বিকাশ মেধা বিকাশের অন্তরায়'। তখন কোচিং-ব্যবসা সবে রমরমা হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এখন অবশ্য তা মহামারীর আকার ধারণ করেছে।
আর সে জন্য কোচিং ক্লাসবিরোধী বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হতে দেখছি।
আমার তখনকার লেখাটা ছিল একেবারেই অভিজ্ঞতাভিত্তিক, জেনে-শুনে ও দেখে-শুনে লেখা। এখনকার মতো তত্ত্ববিচারের নয়। অবশ্য এর পরও দেখেছি, এই তো বছর দুই আগেও দেখেছি গৃহিণীদের সে কী হ্যাপা? ছেলে বা মেয়েকে নিয়ে কোচিং সেন্টারে যাওয়া- সেখানে বসে থাকা অথবা ফিরে এসে আবার যাওয়া, একটিকে রেখে আরেকটিকে নিয়ে ছুটতে ছুটতে ঘাম ঝরানো (ঘাম ঝরানো অবশ্য স্থূলতা কমানোর পক্ষে সহায়ক)।
কোচিং ব্যবস্থাটা বাস্তবিক একটি দুষ্ট বাণিজ্যিক ব্যবস্থা- অতি দ্রুত এর বাড়বাড়ন্ত। শুরুতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর এ বিষয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। অথচ এর মধ্যে ছিল একাধিক সমস্যা- যেমন অর্থনৈতিক, তেমনি শিক্ষাগত দিক। যে কারণে একদা 'নোট বই' ব্যবস্থা বন্ধ করা হয়েছিল। তারই জীবন্ত প্রকাশ কোচিং শিক্ষা তথা মেধা বিকাশবিরোধী শিক্ষার বাণিজ্য ব্যবস্থা বন্ধে কারো আগ্রহ দেখা যায়নি।
এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে এবং কোচিং-বাণিজ্যের যে বিশাল শক্তিমান সাম্রাজ্য তৈরি হয়েছে, তাতে তারা কোচিং বন্ধের কোনো নীতিমালাও মানতে রাজি হবে না। শিক্ষা কর্তৃপক্ষের দরকার ছিল এ বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া। এমন অনেক নীতিবান শিক্ষক আছেন, যাঁরা নীতিগতভাবে কোচিং শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধী। সংখ্যায় তাঁরা হয়তো কম; কিন্তু নৈতিকতার জোর সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না।
সম্প্রতি সংবাদপত্রে কোচিং ব্যবস্থা বন্ধ করা বিষয়ক বেশ কিছু লেখা পড়েছি। তাঁরা এর ভালো-মন্দ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাই কোচিং ব্যবস্থার ভালো-মন্দ ইতিকথা নিয়ে বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন বোধ করছি না। কোচিং-বাণিজ্য যে এক শ্রেণীর শিক্ষকের আর্থিকভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠা এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অভিভাবকদের পকেটের ওপর চাপ সৃষ্টির দারুণ ব্যবস্থা, এতে সন্দেহের কারণ নেই। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশের অন্তরায় এই কোচিং শিক্ষা, যা আসলে একমুখী শিক্ষা, নিতান্তই পরীক্ষা বৈতরণী পার হওয়ার সেতু, এতেও ভিন্নমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই। তাই আপাতবিচারে প্রতিক্রিয়ার কথা না ভেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বিভাগের দরকার বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে কোচিং বিষয়ক সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করা, যা নিয়ে বড় একটা প্রশ্ন উঠবে না। নোট বই বন্ধের সময়ও আশঙ্কা ছিল প্রতিবাদের; কিন্তু সে ব্যবস্থা তো সফলভাবেই বাস্তবায়িত হয়েছিল।
আসলে কোচিং-বাণিজ্য নিয়ে নয়, মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যে বিতর্ক শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের অগতির গতি শহীদ মিনারে জড়ো হতে উদ্বুদ্ধ করেছে, সে বিষয়ে সাবেক মেডিক্যাল ছাত্র হিসেবে দুই কথা লেখার উদ্দেশ্য নিয়ে কলম ধরা। কিন্তু কান টানলে মাথা আসার মতো এ বিষয়ে কোচিং-বাণিজ্য নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক লেখা প্রকাশ পেয়েছে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক-অধ্যাপকের, তাই কোচিং শিক্ষাবিষয়ক দু-চার কথায় মতামত প্রকাশ জরুরি মনে হয়েছে।
মাথা প্রসঙ্গে একজন শিক্ষক লিখেছেন, 'মাথাব্যথার জন্য কি মাথা কেটে ফেলতে হবে?' অবশ্যই নয়। তবে মাথাব্যথা নিরাময়ে ব্যবস্থাপত্র দিতে দোষ কী? কোচিং-বাণিজ্য ভর্তি পরীক্ষা বন্ধের অন্যতম কারণ হলেই বা ক্ষতি কী? কোচিং শিক্ষার নানামুখী আপত্তিকর দিক তো অস্বীকারের উপায় নেই। অন্য একজন লিখেছেন কোচিং বন্ধ করা নিয়ে এবং এ বিষয়ে 'সরকারকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে'- এমন পরামর্শ দিয়ে। আরো একজন লিখেছেন ভর্তি পরীক্ষার ভালো-মন্দ দুই দিক নিয়েই। বিভিন্নজনের লেখার মধ্য দিয়ে যে বিষয়টা স্পষ্ট হচ্ছে, তা হলো- লেখকদের গরিষ্ঠসংখ্যক ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের বিরোধী। এর মধ্যে কি সরকার-বিরোধিতার আভাস রয়েছে? জানি না। নিশ্চিত করে এমন ঢালাও মন্তব্য করা ঠিক হবে না। যদিও সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা একটি রাজনৈতিক অভ্যাসে পরিণত। একজন স্বনামখ্যাত লেখক অধ্যাপক অবশ্য 'দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে সম্মিলিত একটি ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার' পক্ষে মতামত প্রকাশ করেছেন। আলাদাভাবে মেডিক্যাল বা প্রকৌশল বা কৃষি মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নয়। বলতে হয় অনেকটা প্রতিবেশী দেশের জয়েন্টের মতো। কেন্দ্রীয় পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিভিন্ন শিক্ষায়তনে ভর্তি হওয়া।
সত্যি বলতে কী, ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে শিক্ষক বা কলামিস্টদের উঠেপড়ে লাগার কোনো যুক্তি আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তবে শিক্ষার্থীদের একাংশের ক্ষোভের যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। অনেক টাকা খরচ করে অনেক শ্রম ও সময়ের বিনিময়ে কোচিং নেওয়ার পর যদি হঠাৎ শোনা যায় যে ভর্তি পরীক্ষা হবে না, মেধা তালিকার ভিত্তিতেই ছাত্র ভর্তি করা হবে, তাহলে তাদের ক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষ করে যারা মেধা তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকার করতে পারেনি। কিন্তু শিক্ষকদের এত মাথাব্যথা কেন?
অনেক যুক্তিটুক্তির মধ্যে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে নানা কারণে ভালো ফল করতে পারেনি- এমন মেধাবীর জন্য ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ তৈরি করে দেবে। তা ছাড়া এমন কথাও উঠে এসেছে যে ওই দুই পরীক্ষার ফলাফল মেধার নিশ্চিত পরিচায়ক নয়। কিন্তু কথা থাকে যে মাধ্যমিকে চার বছর এবং উচ্চ মাধ্যমিকে দুই বছরের পাঠ প্রস্তুতি শেষে পরীক্ষার ফলাফল যদি মেধার যথার্থ পরিচায়ক না হয়, তাহলে এক দিনের সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা কি মেধা বা যোগ্যতার প্রমাণ রাখবে? যুক্তি কি এ ধরনের চিন্তা বা মতামত সমর্থন করবে?
ভর্তি পরীক্ষা ব্যবস্থা শুরু হওয়ার আগে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র ভর্তির ব্যবস্থা ছিল, তাতে তো মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধাবীদেরই সমাবেশ দেখা গেছে। এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপত্তির যুক্তিসংগত কারণ দেখতে পাচ্ছি না। দু-দুটো পরীক্ষার সাফল্য যদি মেধার পরিচায়ক না হয়, তাহলে কিসে তার প্রমাণ হবে? একবেলার পরীক্ষায়? দুটো পরীক্ষায় ভালো ফল করে ইচ্ছামতো শিক্ষাধারায় ভর্তি হওয়ার অধিকারে বাধা সৃষ্টি করা কি গণতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যে পড়ে? দুটি দীর্ঘমেয়াদি পাঠ শেষে ভালো ফল করতে পারেনি যে ছাত্র বা ছাত্রী- একবেলার পরীক্ষায় তার আপতিক ভালো করাটা কি মেধার যৌক্তিক পরিচয়? বরং এটা আর্য ফলাফলের মতো দাঁড়ায়। নিয়মবহির্ভূত হঠাৎ ভালোত্ব। তা মেধার পরিচায়ক নয়।
তবু সব শেষে বলি, একটি যুক্তিসংগত ব্যবস্থাও হঠাৎ আরোপ করা হলে তাতে অনেক সমস্যা তৈরি হয়। যেমন হয়েছে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিসংক্রান্ত হঠাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে, যা শেষ পর্যন্ত আদালতে গিয়ে পৌঁছেছে সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য। তাই এ বছর পূর্বব্যবস্থা সচল রেখে আগামী ভর্তি বছর থেকে নয়া ব্যবস্থা চালু করাই বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়। তা ছাড়া অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের নিয়ে বিচার-বিবেচনা করে ভর্তিবিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আগামী বছর থেকে তা প্রয়োগ করা হবে- এমন সিদ্ধান্ত অগ্রিম শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জানিয়ে দেওয়া সঠিক পদক্ষেপ হবে। সে ক্ষেত্রে আপাতত সমস্যা থেকে সরকারের পরিত্রাণ।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক
No comments