নতুন সরকার? চমকে উঠতে হয় ... by রাহাত খান
বিএনপি-জামায়াত ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ফজলে হাসান আবেদ এবং আরও কিছু দল ও মিডিয়ার বদৌলতে ফুলে-ফেঁপে যাওয়া কিছু ব্যক্তির নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটি হালে খুব একটা পানি পাচ্ছে বলে মনে হয় না। ভবিষ্যতে পাবে বলেও বিশ্বাস হয় না। বছর দেড়েক আগেও এই দাবি নাকি ‘জাতীয়’ দাবি হয়ে উঠেছিল।
কি কারণে এই দাবি এ মুহূর্তে বাংলাদেশের গরিষ্ঠ অংশের জনগণের কাছে তেমন সমর্থন পেল না, এই প্রশ্ন অতঃপর আপনা-আপনি উঠে আসে।
তবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বিএনপি-জামায়াত এবং আরও কিছু কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর তরফে এখনও জারি আছে। নির্বাচনের বাকি আছে আরও এক বছর পাঁচ মাসের কাছাকাছি। এই সময়ের মধ্যে কি হয় তা আগাম না বলাই শ্রেয়। তবে দেখে শুনে মনে হচ্ছে কিছুদিন আগে ব্রিটেন সফরকালীন বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন (জামায়াত বাদে) নির্বাচিত সাংসদদের সমন্বয়ে একটি ক্ষুদ্র সর্বদলীয় সরকারের যে ধারণা ব্যক্ত করেছিলেন তা দেশে-বিদেশে যথেষ্ট ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে।
তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন ‘সেলফ-মেড’ হামিদ কারজাইর উদ্ভব ঘটেছে এবং রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ স্বাভাবিক গতিতে অগ্রসর হবে নাকি নির্বাচনের আগেই ষড়যন্ত্রমূলক কিছু ঘটবে, এ ব্যাপারে কিছুটা হলেও একটা সন্দেহ সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর ব্যাপারে নানাবিধ তদন্ত হচ্ছে দেখে আমাদের দেশের একদল লোক হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে। সেই ব্যক্তিটি হয়ত নিজেকে রাষ্ট্রের চেয়েও বড় এবং সব রকম প্রচলিত আইনের উর্ধে বলে নিজেকে মনে করেন। সম্প্রতি তিনি তাঁর স্বঘোষিত কালো দিবসের এক রচনায় আশা প্রকাশ করেছেন যে ভবিষ্যতে আসবে যে নতুন সরকার, তারা হয়ত হালে করা গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাদেশটি বাতিল করে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘সরকারী’ ব্যাংকটি আবার আগের রূপে ফিরিয়ে আনবে।
নতুন সরকার! কথাটা ভাবার মতো বটে! দেশে তো গণতান্ত্রিক ধারায় নির্বাচন এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের বিধান রয়েছেই। নির্বাচনের ধারায় হয় বিএনপি না হয় আওয়ামী লীগ কিংবা একটি কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় আসবে। কেউ কেউ মনে করেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানা না হলে বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এই মতের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে একটু ভিন্নমত পোষণ করি। যদি নির্বাচন কমিশনকে যথার্থ অর্থে নির্বাচনের আগে নব্বই দিনের জন্য যথেষ্ট ক্ষমতাবান করা যায় এবং আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, পার্লামেন্টে বামপন্থী সাংসদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য নিহায়তই ‘ডে টু ডে’ কাজ করার জন্য নির্বাচিত সাংসদ সমবায়ে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা যায় তাহলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন প্রয়োজন পড়ে না। বিএনপি ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বসে যদি শক্তিশালী কার্যকর এবং নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের আলোচনায় বসে, এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কে হবেন, সেটা নিয়েও আলোচনায় প্রবৃত্ত হয় তাহলেও নির্দলীয় এবং অনির্বাচিত লোকদের দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজনীয়তা সর্বাংশে দুর্বল ও অসার বলে প্রতিপন্ন হবে। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য বর্তমান সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে হিল্লি-দিল্লী, বেজিং, সৌদি আরব, পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে যেতে পারবেন। সেটা আর কিছু না হোক, একটা দীর্ঘ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও আনন্দ-লাভ বেগম জিয়ার হবে। তবে কোন মিত্র দেশ কোন দেশের রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের মতো কোন অ-কূটনীতিকসুলভ কাজ করবে, তেমনটা না ভাবাই সঙ্গত হবে। রাজনীতির অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, শেষ পর্যন্ত বিএনপির বোধোদয় ঘটবে এবং নির্বাচনে যোগ না দেওয়ার মতো অবাস্তব ও অপরিণত বুদ্ধির পরিচয় দেয়া থেকে নিজেদের তারা নিবৃত্ত করবে। সেজন্যে তাদের দরকার একটা সম্মানজনক উসিলা।
তেমনটা ঘটাই হবে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য স্বাভাবিক ও স্বস্তিদায়ক। তা যদি হয় তাহলে আগামী নির্বাচনের ধারায় হয় আওয়ামী লীগ নয় বিএনপি কিংবা একটি কোয়ালিশন সরকারেরই ক্ষমতায় আসার কথা। কিন্তু যথোচিত সম্মান জানিয়ে বলি যে, বাংলাদেশে এক ব্যক্তি বোধহয় নিজেকে রাষ্ট্রের চেয়েও বড় মনে করেন। তিনি সম্প্রতি স্বঘোষিত এক কালো দিবসে নির্বাচনের বিষয়টি সম্পূর্ণ উহ্য রেখে একটি সম্ভাব্য নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন। বলেছেন, সেই সরকার ক্ষমতায় এসে নিশ্চয়ই তার প্রতিষ্ঠিত ‘সরকারী’ ব্যাংকটির ‘নতুন’ অধ্যাদেশটি বাতিল করে দেবে!
নতুন সরকার বলতে বিশ্বজুড়ে সম্মান কুড়োনো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিটি আসলে কি বলতে চেয়েছেন, তা ব্যাখ্যা করতে পারেন শুধু তিনিই। তাঁকে কোন রকম হেয় না করে বাস্তবের একাধিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলা যায়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছে তার খুবই ছিল এবং সম্ভবত আছে।
২০০৬ সালে সেনা-সমর্থিত সরকারের প্রধান হিসেবে তাঁর নামই ছিল প্রধান বিবেচনায়। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, তিনি তখন বলেছিলেন তাঁকে দেশ-শাসনের জন্য দশ বছরের একটি মেয়াদ দিলে সেনা-সমর্থিত সরকারের প্রধান হতে তিনি রাজি আছেন। প্রধান সেনা-কর্মকর্তারা তাঁর এই শর্তের জবাবে সবিনয়ে বলেছিলেন, তারা নিজেরাই দেড় বছর, দু’বছরের মধ্যে অবসরে চলে যাবেন, ‘মহান’ ব্যক্তিটিকে দশ বছর দেশ শাসনের গ্যারান্টি তারা কিভাবে দেবেন? শেষ পর্যন্ত ‘মহান ব্যক্তিটি’ বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা, তাঁর খুবই অনুগত ও প্রিয় ফখরুদ্দীন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সুপারিশ করেন যা যথাবিহিত গৃহীত হয়। অর্থাৎ রাজনীতি করুন না করুন গ্রামীণ ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক একটি শিল্প-গোষ্ঠীর স্বার্থে দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব নিয়ে দশ বছরের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে মোটেও অনাগ্রহী ছিলেন না তিনি।
ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়কের একটি কীর্তি হচ্ছেÑ সংবিধান মোতাবেক তিন মাস ক্ষমতায় থাকার কথা থাকলেও, তার সরকার ক্ষমতায় ছিল দুই বছর! আর ক্ষমতার পেছনে থাকা সশস্ত্র বাহিনীর কীর্তি হচ্ছে কতিপয় সেনা কর্মকর্তার অপরিমেয় দুর্নীতি সত্ত্বেও দেশকে তারা একটি অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। ওইসব সেনা কর্মকর্তারা দুর্নীতি ও অবাধ লুণ্ঠনে এমন মেতে উঠেছিলেন যে দেশের রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় ‘কলাপসড’ (ধসে পড়ার) হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
এসব কারণে পরবর্তী নির্বাচনোত্তর সরকারের বদলে ‘নতুন’ সরকার বলায় খানিকটা বিভ্রান্তি এবং অনেকটা উদ্বেগ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে বৈকি। বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম হওয়ার পর হত্যা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাহুবলে দুই সামরিক ব্যক্তি শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। প্রথম স্বৈরাচারী শাসক জিয়াউর রহমানের কলঙ্কময় কীর্তিকলাপ জনগণ কোন দিন ভুলবে না। টুকটাক ভাল কাজ দেশের জন্য তিনি যে করেননি, তা নয়। তবে অপকর্ম যা যা করেছেন তা ভয়াবহ বললেও বোধকরি কম বলা হয়। এই জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষার জন্য দুনিয়ার ঘৃণ্যতম ও জঘন্যতম ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করেছিলেন। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালী যুদ্ধ করেছিল যে চারটি আদর্শের ভিত্তিতে (বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্ম-নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র) একটি নামে মাত্র রেখে বাকি তিনটি মূল ভিত্তি তিনি কলমের এক আঁচড়ে রদ করে দিয়েছিলেন। জেনারেল জিয়া স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশকে কার্যত পুনরায় দ্বিতীয় পাকিস্তান করতে চেয়েছিলেন। জাতির পিতা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী, মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (নির্বাচিত পার্লামেন্টের অনুমোদন ক্রমে) করে যাওয়া দালাল আইন ও ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধকরণ আইন দু’টিও বাতিল করেন জিয়াউর রহমানই। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রমুখ পাকিস্তানপন্থী দলের পুরুজ্জীবন ও সযতœ পুনর্বাসন তাঁরই হাত দিয়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামায়াতের আমির গোলাম আযম দেশে দেশে পাকিস্তানের পক্ষে ও বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই ঘৃণ্য, খুনী ও ধর্ষকদের নেতা বাংলাদেশবিরোধী গোলাম আযমকে সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে এনে তাকে বাংলাদেশের নির্বিঘেœ বসবাসের সুয়োগ দিয়েছিলেন এই জেনারেল জিয়াউর রহমানই। গণতন্ত্র ছিল বইতে। জিয়াউর রহমানের হিপ পকেটে। আসল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের শুধু নামটা রেখে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানানো।
ক্ষুদে জ্ঞান পাপী আর ইউনূসের ও বিএনপির দালালরা না হয় এসব কীর্তি-কাহিনী বিস্মৃত হয়েছে কিংবা সত্য ধামাচাপা দিতে সচেষ্ট রয়েছে। কিন্তু ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিকুল হক প্রমুখ প্রখ্যাত ব্যক্তি কি করে এসব কথা ভুলে যান? কি করে তারা একই দাঁড়িপাল্লায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে সমান গুরুত্ব দিয়ে মাপার চেষ্টা করেন? খালেদা জিয়া, তার পুত্র তারেক রহমান এবং তাদের নেতৃত্বাধীন বিএনপি তো স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর ঘৃণ্য এজেন্ডা, বাংলাদেশকে আবার সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে তথা দ্বিতীয় পাকিস্তান তৈরির এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন। জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরি হিসাবে তারেক রহমান তো প্রকাশ্যেই বলেছেন জামায়াত ও বিএনপি এক পরিবারভুক্ত, সেটা তো কথার কথা নয়, নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় ও অবস্থান জনগণের কাছে স্পষ্ট করে তুলে ধরারই চেষ্টা।
স্বাধীন বাংলাদেশে বাহুবলে ক্ষমতা দখলকারী দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রসঙ্গক্রমে তার কথাও বলতে হয়। হ্যাঁ, বাহুবলে ক্ষমতা দখল, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার তার বেলায়ও কিছু কম ছিল না। সুযোগসন্ধানী এবং অতি সুবিধাবাদী রাজনীতিক হিসেবে একটি প্রায় স্থায়ী দুর্নাম বয়ে বেড়াচ্ছে তার অনুসৃত রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পুরস্কৃত করেছেন তিনিও। তবে এইসব গুরুতর দুর্নাম ও বিচ্যুতি সত্ত্বেও ইতিহাস তাকে বাংলাদেশের একজন উদারচিত্ত একনায়ক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। বাংলাদেশে প্রকৃত উন্নয়নের অবকাঠামো তৈরির তিনিই পথিকৃত। বাংলাদেশে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের ধারায় উপজেলা পদ্ধতির প্রণেতা জেনারেল এরশাদই। তিনি পাকিস্তান ফেরত কতিপয় উচ্চাকাক্সক্ষী, নীতিভ্রষ্ট, সেনা কর্মকর্তার সাহায্য-পৃষ্ঠপোকতায় তাঁর শাসন মেয়াদকে ৯ বছর পর্যন্ত উন্নীত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আবার এও সত্য, দেশের অধিকাংশ উপজেলায় রাস্তা ও বিদ্যুত পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব তাঁরই। তৈরি পোশাক শিল্প, জনশক্তি রফতানি, বই ও ফুলের ব্যবসার অভূতপূর্ব উন্নতি তাঁরই আমলে সাধিত হয়েছিল।
হ্যাঁ, এসবের পরেও তো বলতে হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হননি। আবার পাশাপাশি এও বলতে হয়, স্বৈরাচারী হিসেবে ক্ষমতায় এলেও সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের উন্নয়নমূলক কাজের বেনিফিট যারা পেয়েছে তারা তার সমালোচনার পাশাপাশি প্রশংসাও করে থাকেন। দেশের সব প্রান্তেই শতকরা ৯ ভাগ থেকে ১১ ভাগ লোক তাঁর এবং তাঁর দলের সমর্থক। এবার বিএনপি যদি নানান অজুহাত দেখিয়ে নির্বাচন করা থেকে বিরত থাকে তাহলে বিএনপির (জামায়াতের নয়) অন্তত একটা অংশের ভোট এরশাদের (মার্কা) বাক্সে গিয়ে পড়বে। দুই স্বৈরাচারী জিয়া ও এরশাদের মধ্যে মিল কম আছে, পার্থক্য আছে বেশি।
কথায় কথায় মূল প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে এসেছি। কথা হচ্ছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বলা ‘নতুন সরকার’ নিয়ে। ঘর পোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় হয়। ড. ইউনূস আবার দেশের তরুণ সমাজের ‘আদর্শ’ ও ‘নেতা’ হওয়ার চেষ্টাও করছেন বলে মনে হয়। তা সেই চেষ্টা তিনি করতেই পারেন। আমার প্রশ্ন, বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বিরোধ ও টানাপোড়েন চলছে, তাতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. ইউনূস তো নিজে থেকে দেশের স্বার্থে একটা ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারতেন। তাতে দল বিশেষ না হোক দেশের তরুণ সমাজ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাপ্লুত হতে পারত। তিনি তো তা করেননি। বরং বাংলাদেশের বেশির ভাগ লোকের সন্দেহ, গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব তাঁর হাত থেকে কেড়ে নেয়ায় বিশ্ব ব্যাংকের সাথে বাংলাদেশের এই টানাপোড়েনের মূলে রয়েছে তাঁর আন্তর্জাতিক প্রভাব? তেমনটা যদি হয়ে থাকে তাহলে বলতেই হয় শান্তিতে নোবেল পাওয়ার মর্যাদা তিনি রক্ষা করতে পারেননি। এমন কাউকে দেশের জাগ্রত, সচেতন তরুণ সমাজের সমর্থন করার কোন কারণ নেই।
বাংলাদেশ নয়, বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণ নয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে একমাত্র প্রাধান্য হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক। এই ব্যাংকের ওপর থেকে তাঁর কর্তৃত্ব চলে যাওয়ায় যেন সর্বনাশ হয়ে গেছে! কার সর্বনাশ, ড. ইউনূসের না বাংলাদেশের।
জানতে বড়ই ইচ্ছে হয় কি মধু আছে বা ছিল এই গ্রামীণ ব্যাংকে? গ্রামীণ ব্যাংক বড়, না বাংলাদেশ? এটাও জানতে বড় ইচ্ছে হয়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক
তবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বিএনপি-জামায়াত এবং আরও কিছু কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর তরফে এখনও জারি আছে। নির্বাচনের বাকি আছে আরও এক বছর পাঁচ মাসের কাছাকাছি। এই সময়ের মধ্যে কি হয় তা আগাম না বলাই শ্রেয়। তবে দেখে শুনে মনে হচ্ছে কিছুদিন আগে ব্রিটেন সফরকালীন বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন (জামায়াত বাদে) নির্বাচিত সাংসদদের সমন্বয়ে একটি ক্ষুদ্র সর্বদলীয় সরকারের যে ধারণা ব্যক্ত করেছিলেন তা দেশে-বিদেশে যথেষ্ট ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে।
তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন ‘সেলফ-মেড’ হামিদ কারজাইর উদ্ভব ঘটেছে এবং রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ স্বাভাবিক গতিতে অগ্রসর হবে নাকি নির্বাচনের আগেই ষড়যন্ত্রমূলক কিছু ঘটবে, এ ব্যাপারে কিছুটা হলেও একটা সন্দেহ সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর ব্যাপারে নানাবিধ তদন্ত হচ্ছে দেখে আমাদের দেশের একদল লোক হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে। সেই ব্যক্তিটি হয়ত নিজেকে রাষ্ট্রের চেয়েও বড় এবং সব রকম প্রচলিত আইনের উর্ধে বলে নিজেকে মনে করেন। সম্প্রতি তিনি তাঁর স্বঘোষিত কালো দিবসের এক রচনায় আশা প্রকাশ করেছেন যে ভবিষ্যতে আসবে যে নতুন সরকার, তারা হয়ত হালে করা গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাদেশটি বাতিল করে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘সরকারী’ ব্যাংকটি আবার আগের রূপে ফিরিয়ে আনবে।
নতুন সরকার! কথাটা ভাবার মতো বটে! দেশে তো গণতান্ত্রিক ধারায় নির্বাচন এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের বিধান রয়েছেই। নির্বাচনের ধারায় হয় বিএনপি না হয় আওয়ামী লীগ কিংবা একটি কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় আসবে। কেউ কেউ মনে করেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানা না হলে বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এই মতের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে একটু ভিন্নমত পোষণ করি। যদি নির্বাচন কমিশনকে যথার্থ অর্থে নির্বাচনের আগে নব্বই দিনের জন্য যথেষ্ট ক্ষমতাবান করা যায় এবং আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, পার্লামেন্টে বামপন্থী সাংসদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য নিহায়তই ‘ডে টু ডে’ কাজ করার জন্য নির্বাচিত সাংসদ সমবায়ে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা যায় তাহলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন প্রয়োজন পড়ে না। বিএনপি ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বসে যদি শক্তিশালী কার্যকর এবং নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের আলোচনায় বসে, এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কে হবেন, সেটা নিয়েও আলোচনায় প্রবৃত্ত হয় তাহলেও নির্দলীয় এবং অনির্বাচিত লোকদের দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজনীয়তা সর্বাংশে দুর্বল ও অসার বলে প্রতিপন্ন হবে। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য বর্তমান সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে হিল্লি-দিল্লী, বেজিং, সৌদি আরব, পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে যেতে পারবেন। সেটা আর কিছু না হোক, একটা দীর্ঘ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও আনন্দ-লাভ বেগম জিয়ার হবে। তবে কোন মিত্র দেশ কোন দেশের রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের মতো কোন অ-কূটনীতিকসুলভ কাজ করবে, তেমনটা না ভাবাই সঙ্গত হবে। রাজনীতির অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, শেষ পর্যন্ত বিএনপির বোধোদয় ঘটবে এবং নির্বাচনে যোগ না দেওয়ার মতো অবাস্তব ও অপরিণত বুদ্ধির পরিচয় দেয়া থেকে নিজেদের তারা নিবৃত্ত করবে। সেজন্যে তাদের দরকার একটা সম্মানজনক উসিলা।
তেমনটা ঘটাই হবে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য স্বাভাবিক ও স্বস্তিদায়ক। তা যদি হয় তাহলে আগামী নির্বাচনের ধারায় হয় আওয়ামী লীগ নয় বিএনপি কিংবা একটি কোয়ালিশন সরকারেরই ক্ষমতায় আসার কথা। কিন্তু যথোচিত সম্মান জানিয়ে বলি যে, বাংলাদেশে এক ব্যক্তি বোধহয় নিজেকে রাষ্ট্রের চেয়েও বড় মনে করেন। তিনি সম্প্রতি স্বঘোষিত এক কালো দিবসে নির্বাচনের বিষয়টি সম্পূর্ণ উহ্য রেখে একটি সম্ভাব্য নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন। বলেছেন, সেই সরকার ক্ষমতায় এসে নিশ্চয়ই তার প্রতিষ্ঠিত ‘সরকারী’ ব্যাংকটির ‘নতুন’ অধ্যাদেশটি বাতিল করে দেবে!
নতুন সরকার বলতে বিশ্বজুড়ে সম্মান কুড়োনো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিটি আসলে কি বলতে চেয়েছেন, তা ব্যাখ্যা করতে পারেন শুধু তিনিই। তাঁকে কোন রকম হেয় না করে বাস্তবের একাধিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলা যায়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছে তার খুবই ছিল এবং সম্ভবত আছে।
২০০৬ সালে সেনা-সমর্থিত সরকারের প্রধান হিসেবে তাঁর নামই ছিল প্রধান বিবেচনায়। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, তিনি তখন বলেছিলেন তাঁকে দেশ-শাসনের জন্য দশ বছরের একটি মেয়াদ দিলে সেনা-সমর্থিত সরকারের প্রধান হতে তিনি রাজি আছেন। প্রধান সেনা-কর্মকর্তারা তাঁর এই শর্তের জবাবে সবিনয়ে বলেছিলেন, তারা নিজেরাই দেড় বছর, দু’বছরের মধ্যে অবসরে চলে যাবেন, ‘মহান’ ব্যক্তিটিকে দশ বছর দেশ শাসনের গ্যারান্টি তারা কিভাবে দেবেন? শেষ পর্যন্ত ‘মহান ব্যক্তিটি’ বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা, তাঁর খুবই অনুগত ও প্রিয় ফখরুদ্দীন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সুপারিশ করেন যা যথাবিহিত গৃহীত হয়। অর্থাৎ রাজনীতি করুন না করুন গ্রামীণ ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক একটি শিল্প-গোষ্ঠীর স্বার্থে দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব নিয়ে দশ বছরের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে মোটেও অনাগ্রহী ছিলেন না তিনি।
ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়কের একটি কীর্তি হচ্ছেÑ সংবিধান মোতাবেক তিন মাস ক্ষমতায় থাকার কথা থাকলেও, তার সরকার ক্ষমতায় ছিল দুই বছর! আর ক্ষমতার পেছনে থাকা সশস্ত্র বাহিনীর কীর্তি হচ্ছে কতিপয় সেনা কর্মকর্তার অপরিমেয় দুর্নীতি সত্ত্বেও দেশকে তারা একটি অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। ওইসব সেনা কর্মকর্তারা দুর্নীতি ও অবাধ লুণ্ঠনে এমন মেতে উঠেছিলেন যে দেশের রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় ‘কলাপসড’ (ধসে পড়ার) হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
এসব কারণে পরবর্তী নির্বাচনোত্তর সরকারের বদলে ‘নতুন’ সরকার বলায় খানিকটা বিভ্রান্তি এবং অনেকটা উদ্বেগ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে বৈকি। বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম হওয়ার পর হত্যা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাহুবলে দুই সামরিক ব্যক্তি শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। প্রথম স্বৈরাচারী শাসক জিয়াউর রহমানের কলঙ্কময় কীর্তিকলাপ জনগণ কোন দিন ভুলবে না। টুকটাক ভাল কাজ দেশের জন্য তিনি যে করেননি, তা নয়। তবে অপকর্ম যা যা করেছেন তা ভয়াবহ বললেও বোধকরি কম বলা হয়। এই জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষার জন্য দুনিয়ার ঘৃণ্যতম ও জঘন্যতম ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করেছিলেন। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালী যুদ্ধ করেছিল যে চারটি আদর্শের ভিত্তিতে (বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্ম-নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র) একটি নামে মাত্র রেখে বাকি তিনটি মূল ভিত্তি তিনি কলমের এক আঁচড়ে রদ করে দিয়েছিলেন। জেনারেল জিয়া স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশকে কার্যত পুনরায় দ্বিতীয় পাকিস্তান করতে চেয়েছিলেন। জাতির পিতা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী, মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (নির্বাচিত পার্লামেন্টের অনুমোদন ক্রমে) করে যাওয়া দালাল আইন ও ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধকরণ আইন দু’টিও বাতিল করেন জিয়াউর রহমানই। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রমুখ পাকিস্তানপন্থী দলের পুরুজ্জীবন ও সযতœ পুনর্বাসন তাঁরই হাত দিয়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামায়াতের আমির গোলাম আযম দেশে দেশে পাকিস্তানের পক্ষে ও বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই ঘৃণ্য, খুনী ও ধর্ষকদের নেতা বাংলাদেশবিরোধী গোলাম আযমকে সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে এনে তাকে বাংলাদেশের নির্বিঘেœ বসবাসের সুয়োগ দিয়েছিলেন এই জেনারেল জিয়াউর রহমানই। গণতন্ত্র ছিল বইতে। জিয়াউর রহমানের হিপ পকেটে। আসল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের শুধু নামটা রেখে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানানো।
ক্ষুদে জ্ঞান পাপী আর ইউনূসের ও বিএনপির দালালরা না হয় এসব কীর্তি-কাহিনী বিস্মৃত হয়েছে কিংবা সত্য ধামাচাপা দিতে সচেষ্ট রয়েছে। কিন্তু ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিকুল হক প্রমুখ প্রখ্যাত ব্যক্তি কি করে এসব কথা ভুলে যান? কি করে তারা একই দাঁড়িপাল্লায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে সমান গুরুত্ব দিয়ে মাপার চেষ্টা করেন? খালেদা জিয়া, তার পুত্র তারেক রহমান এবং তাদের নেতৃত্বাধীন বিএনপি তো স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর ঘৃণ্য এজেন্ডা, বাংলাদেশকে আবার সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে তথা দ্বিতীয় পাকিস্তান তৈরির এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন। জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরি হিসাবে তারেক রহমান তো প্রকাশ্যেই বলেছেন জামায়াত ও বিএনপি এক পরিবারভুক্ত, সেটা তো কথার কথা নয়, নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় ও অবস্থান জনগণের কাছে স্পষ্ট করে তুলে ধরারই চেষ্টা।
স্বাধীন বাংলাদেশে বাহুবলে ক্ষমতা দখলকারী দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রসঙ্গক্রমে তার কথাও বলতে হয়। হ্যাঁ, বাহুবলে ক্ষমতা দখল, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার তার বেলায়ও কিছু কম ছিল না। সুযোগসন্ধানী এবং অতি সুবিধাবাদী রাজনীতিক হিসেবে একটি প্রায় স্থায়ী দুর্নাম বয়ে বেড়াচ্ছে তার অনুসৃত রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পুরস্কৃত করেছেন তিনিও। তবে এইসব গুরুতর দুর্নাম ও বিচ্যুতি সত্ত্বেও ইতিহাস তাকে বাংলাদেশের একজন উদারচিত্ত একনায়ক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। বাংলাদেশে প্রকৃত উন্নয়নের অবকাঠামো তৈরির তিনিই পথিকৃত। বাংলাদেশে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের ধারায় উপজেলা পদ্ধতির প্রণেতা জেনারেল এরশাদই। তিনি পাকিস্তান ফেরত কতিপয় উচ্চাকাক্সক্ষী, নীতিভ্রষ্ট, সেনা কর্মকর্তার সাহায্য-পৃষ্ঠপোকতায় তাঁর শাসন মেয়াদকে ৯ বছর পর্যন্ত উন্নীত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আবার এও সত্য, দেশের অধিকাংশ উপজেলায় রাস্তা ও বিদ্যুত পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব তাঁরই। তৈরি পোশাক শিল্প, জনশক্তি রফতানি, বই ও ফুলের ব্যবসার অভূতপূর্ব উন্নতি তাঁরই আমলে সাধিত হয়েছিল।
হ্যাঁ, এসবের পরেও তো বলতে হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হননি। আবার পাশাপাশি এও বলতে হয়, স্বৈরাচারী হিসেবে ক্ষমতায় এলেও সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের উন্নয়নমূলক কাজের বেনিফিট যারা পেয়েছে তারা তার সমালোচনার পাশাপাশি প্রশংসাও করে থাকেন। দেশের সব প্রান্তেই শতকরা ৯ ভাগ থেকে ১১ ভাগ লোক তাঁর এবং তাঁর দলের সমর্থক। এবার বিএনপি যদি নানান অজুহাত দেখিয়ে নির্বাচন করা থেকে বিরত থাকে তাহলে বিএনপির (জামায়াতের নয়) অন্তত একটা অংশের ভোট এরশাদের (মার্কা) বাক্সে গিয়ে পড়বে। দুই স্বৈরাচারী জিয়া ও এরশাদের মধ্যে মিল কম আছে, পার্থক্য আছে বেশি।
কথায় কথায় মূল প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে এসেছি। কথা হচ্ছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বলা ‘নতুন সরকার’ নিয়ে। ঘর পোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় হয়। ড. ইউনূস আবার দেশের তরুণ সমাজের ‘আদর্শ’ ও ‘নেতা’ হওয়ার চেষ্টাও করছেন বলে মনে হয়। তা সেই চেষ্টা তিনি করতেই পারেন। আমার প্রশ্ন, বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বিরোধ ও টানাপোড়েন চলছে, তাতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. ইউনূস তো নিজে থেকে দেশের স্বার্থে একটা ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারতেন। তাতে দল বিশেষ না হোক দেশের তরুণ সমাজ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাপ্লুত হতে পারত। তিনি তো তা করেননি। বরং বাংলাদেশের বেশির ভাগ লোকের সন্দেহ, গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব তাঁর হাত থেকে কেড়ে নেয়ায় বিশ্ব ব্যাংকের সাথে বাংলাদেশের এই টানাপোড়েনের মূলে রয়েছে তাঁর আন্তর্জাতিক প্রভাব? তেমনটা যদি হয়ে থাকে তাহলে বলতেই হয় শান্তিতে নোবেল পাওয়ার মর্যাদা তিনি রক্ষা করতে পারেননি। এমন কাউকে দেশের জাগ্রত, সচেতন তরুণ সমাজের সমর্থন করার কোন কারণ নেই।
বাংলাদেশ নয়, বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণ নয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে একমাত্র প্রাধান্য হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক। এই ব্যাংকের ওপর থেকে তাঁর কর্তৃত্ব চলে যাওয়ায় যেন সর্বনাশ হয়ে গেছে! কার সর্বনাশ, ড. ইউনূসের না বাংলাদেশের।
জানতে বড়ই ইচ্ছে হয় কি মধু আছে বা ছিল এই গ্রামীণ ব্যাংকে? গ্রামীণ ব্যাংক বড়, না বাংলাদেশ? এটাও জানতে বড় ইচ্ছে হয়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক
No comments